
"কৃষ্ণস্ত ভগবান স্বয়ং" ভাগবতের এই শ্লোক বৈষ্ণব তথা পৌরাণিকদের মুখে মুখে ফেরে। সুযোগ পেলেই তারা এই শ্লোকের সদ্ব্যবহার করে। এবং সেই সাথে শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণ পরমেশ্বর দাবী করার বৃথা চেষ্টা চালায়।যদিও ভাগবতে এই শ্লোকটি একটিবার মাত্র বলা হয়েছে।
যদি আমরা উপনিষদের দিকে লক্ষ্য করি তো দেখতে পাওয়া যায়, গুরুদের তার শিষ্যরা ভগবান বলে ডাকতেন। আরএত অসংখ্য বারই
গুরুদের ভগবান বলে ডেকেছে যে, তা লিখে
শেষ করা যাবে না।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, ভগবান পরমেশ্বরের একটি গুনবাচক নাম। তা কি করে মনুষ্যকে ডাকা যেতে পারে?
তার উত্তরে এটা বলবো যে, ডাকা যদি নাই যায় তবে ঋষিরা কেন ডাকলেন? তারা কি মূর্খ ছিলেন? নাকি ধর্ম সমন্ধ্যে তাদের কোন জ্ঞানই ছিলো না??
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে ভগবান শব্দের অর্থ টা কি-
"ভজ সেবায়াম্" এই ধাতু থেকে "ভগ" সিদ্ধ হয়। ইহার সাথে "মতুপ্" প্রত্যয় যোগে ভগবান শব্দ সিদ্ধ হয়।
" ভগঃ সকলৈশ্বযং সেবনং বা বিদ্যতে যস্য স ভগবান"
অর্থাৎ যিনি ঐশ্বর্যযুক্ত এবং ভজনের যোগ্য এই জন্য সেই পরমেশ্বরের নাম ভগবান।
বিষ্ণুপুরাণ মতে যার ৬টি গুণ আছে তাকেই ভগবান বলা যায়। যথা -
ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য যার আছে তাকেই ভগবান ভগবান বলে।
আর ঐ গুরুদেরও ঐ ৬টা গুণ ছিল বলেই
ওনাদেরকে ওনাদের শিষ্যরা ভগবান
ডেকেছে, কৃষ্ণজীর ও ছিলো বলে অর্জুন তাকে ভগবান বলে ডেকেছেন।
আর পরমেশ্বরের তো গুণের অন্ত নেই অর্থাৎ তার অনন্ত গুণ। তাকে কি ৬ টা গুন দ্বারা বেধে রাখা সম্ভব??
অতএব শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলার অর্থ এই নয় যে তিনি পরমেশ্বর। এখন দেখার বিষয় এই যে, তিনি কি আদৌ পূর্ণ ঈশ্বর ছিলেন না কি শুধু অংশকলা মাত্র। আসুন তবে পৌরাণিকদের সর্বমান্য ভাগবতের আলোকেই বিষয় টা বিশ্লেষন করা যাক। এবং সেই সাথে শ্রী জীব গোস্বামীর চালাকীও দেখে নেওয়া যাক যেভাবে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণ পরমেশ্বরত্ব প্রমাণ করার জন্য প্রাণপন অপচেষ্টা করেছেন।
=>সমীক্ষা - ০১
হরির অংশে পৃথিবীতে কৃষ্ণ ও বলরামের শোভা বর্ধন-
পুরা গ্রামেস্বাগ্রয়েণৈরৈন্দ্রিয়ৈশ্চ মহোৎসবৈ।
বভৌ ভূঃ পক্কশস্যাঢ্যা কলাভ্যাং নিতরাং হরে।।
(ভাগবতঃ ১০।২০।৪৮)
পদার্থঃ (পুরা) নগর (গ্রামেসু) গ্রাম (অগ্রয়ণৈ) বৎসরের নতুন শস্যের অগ্রভাগে (ইন্দ্রিয়ৈ) ইন্দ্র দেবের উদ্যেশে নিবেদন (চ) এবং (মহৎসবৈ) মহৎসব হচ্ছিলো (বভৌ) শোভা পাচ্ছিলো (ভূঃ)পৃথিবী (পক্ক) পরিপক্ক (শস্য) শস্য (অঢ্যা) সমৃদ্ধ (কলা) অংশ ( অভ্যাম) উভয়ে [ কৃষ্ণ ও বলরাম ] (নিতরাং) বিশেষ (হরে) হরির।
সরলার্থঃ নগর গ্রাম বৎসরের নতুন শস্যের অগ্রভাগে ইন্দ্র দেবের উদ্যেশে নিবেদন এবং মহোৎসব হচ্ছিলো। পরিপক্ক শস্য সমৃদ্ধা পৃথিবী হরির বিশেষ অংশ উভয়ে (কৃষ্ণ ও বলরাম) দ্বারা শোভা পাচ্ছিলো।
শ্রীজীব দেখলেন এখানে নরকারে পূর্ণব্রহ্মত্ব টিকে নাই। কাজেই তিনি অর্থ দাড় করালেন -
হরির অংশ অর্থাৎ বিভূতিরূপা পৃথিবী পূর্নব্রহ্ম শ্রী রাম, কৃষ্ণ দ্বারা নিরতিশয় শোভাশালিনী হইয়াছিলেন। ( শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ)
=> সমীক্ষা- ০২
বিষ্ণুর অংশে কৃষ্ণ ও বলরামের অবতার -
যদোশ্চ ধর্মশীলস্য নিতরাং মুনিসত্তম।
তত্রাংশেনাবতীর্স্য বিষ্ণোবীর্যাণি শংস নঃ।।
(ভাগবত ১০।১।২)
পদার্থঃ (যদো) যদুকুলে (চ) এবং (ধর্মশীলস্য) ধর্মানুরাগী (নিতরাং) যোগ্যতাসম্পন্ন (মুনিসত্তম) মহান মুনি ( তত্র) সেই বংশে (অংশ) অংশে (অবতীর্ণস্য) অবতীর্ণ হয়েছে [কৃষ্ণ ও বলরাম] (বিষ্ণঃ) বিষ্ণুর (বির্যাণি) অতন্ত বীর্যের সহিত (শংস) প্রশংসার সহিত বর্ণনা করুন (নঃ) আমাদের।
সরলার্থঃ হে মহান মুনিবর! আপনি আমাদের প্রসংশার সহিত বর্ণনা করুন ধর্মানুরাগী উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন যদুবংশের। সেই বংশে বিষ্ণুর অংশে অত্যন্ত বীর্যের সহিত (কৃষ্ণ ও বলরাম) অবতীর্ণ হয়েছে।
এখানে শ্রী জীব কষ্ট কল্পনা করিয়া অর্থ দাড় করিয়েছেন-
অংশের অর্থাৎ শ্রী বলরামের সংগে অবতীর্ণ কৃষ্ণ। সর্ব্বব্যপকতা দ্বারা পরিপূর্নতার পর্যবসান শ্রীকৃষ্ণে আছে। এই জন্য বিষ্ণু এ স্থলে শ্রীকৃষ্ণকে নির্দেশ করা হয়েছে।
কিন্তু পরিচ্ছিন্ন দেহধারী শ্রীকৃষ্ণ যে সর্বত্র বেপে থাকতেন সে কথা ব্যাসদেব মহাভারতের কোথাও বলেন নি। মহাভারত থেকে জানা যায়, কপট দ্যুতক্রিড়ায় সর্বস্ব হারিয়ে পান্ডব যখন বনে ছিলেন। তখন একদিন কৃষ্ণ সেখানে এসে বললেন-
নৈতৎ কৃচ্ছমনুপ্রাপ্তো ভবান স্যাদ বসুধাধিপ।
যদ্যহং দ্বারকায়ং স্যাং রাজন সন্নিহিত পুরা।।
(মহাঃ বনঃ ১৩।১)
অর্থাৎ আমি যদি তখন দ্বারকাতে থাকতাম তাহলে হে রাজন যুধিষ্ঠির তোমাদের এত কষ্ট ভোগ হতো না।
এখান থেকে স্পষ্ট তিনি সর্বত্র ছিলেন না।
=> সমীক্ষা- ০৩
হরির অংশে দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম-
দিষ্ট্যাম্ব তে কুক্ষিগতঃ পরঃ পুমান
অংশেন সাক্ষাৎ ভগবান ভাবয় নঃ।
(ভাগবত ১০।০২।৪১)
পদার্থঃ (দিষ্টা) সৌভাগ্যক্রমে (অম্ব) হে মাতঃ (তে) তোমার (কুক্ষিগতঃ) গর্ভে (পরঃ) পরম (পুমা) পুরুষ (অংশেন) অংশে [হরির অংশে] (সাক্ষাৎ) সাক্ষাৎ (ভগবান) ভগবান (ভবায়) কল্যানের জন্য (নঃ) আমাদের।
সরলার্থঃ হে মাতঃ! সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কল্যাণের জন্য সাক্ষাৎ পরম পুরুষ ভগবান অংশে (হরির অংশে) আপনার গর্ভে আগমন করেছেন।
এখানে কৃষ্ণ যে অংশ পূর্ণ নন তা স্পষ্ট বলা হলো। কিন্তু শ্রী জীব গোস্বামী কল্পনার মাত্রা প্রবল করলেন এবং অর্থ বের করলেন -
যিনি মৎসাদি অংশবতাররূপে পূর্বে আমাদের মঙ্গলের জন্য আবির্ভূত হইয়াছিলেন, হে মাতঃ এইবার তিনি সাক্ষাত স্বয়ং আবির্ভূত হলেন।( শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ)
"যিনি মৎসাদি অংশবতাররূপে পূর্বে আমাদের মঙ্গলের জন্য আবির্ভূত" এই রকম অর্থ কি করে করা যায় আপনারাই বলুন?
কৃষ্ণের পূর্ণত্ব স্থাপনের জন্য বৈষ্ণবদের আর কত ছলনার আশ্রয় নিতে হবে কে জানে। নিচের শ্লোক আরো স্পস্ট সাক্ষ্য দিচ্ছে -
এতৌ ভগবতঃ সাক্ষাদ্ধরের্ণারায়ন্য হি।
অবতীর্ণ বিহাংশেন বসুদেবস্য বেশ্মনি।।
(ভাগবতঃ ১০।৪৩।২৩)
পদার্থঃ (এতৌ) এরা দুজন (ভগবতঃ) ভগবান (সাক্ষাৎ) সাক্ষাৎ (হরে) হরি (নারায়নস্য) নারায়নের (হি) অবশ্যই (অবতীর্ণ) অবতীর্ণ হয়েছে (ইহ) এই লোকে (অংশেন) অংশে (বসুদেবস্য) বসুদেবের (বেশ্মনি) গৃহে।
সরলার্থঃ অবশ্যই এরা দুজন সাক্ষাৎ ভগবান নারায়ন হরির অংশে এই লোকে বসুদেবের গৃহে অবতীর্ণ হয়েছে।
=> সমীক্ষা -০৪
পৃথিবীর ভার হরনের জন্য হরির অংশে কৃষ্ণ ও অর্জুনের পৃথিবীতে আবির্ভাব-
তাবিমৌ বৈ ভগবতো হরেরংশাবিহাগতৌ।
ভারব্যয়য়া চবভূব কৃষ্ণৌ যদুকুরুদ্বহৌ।।
(ভাগবতঃ ৪।১।৫৯)
পদার্থঃ (তৌ) উভয়ে (ইমাহু) এই (বৈ) অবশ্যই (ভগবতো) ভগবান (হরি) হরির (অংশ) অংশে (ইহ) এখানে (অগাতু) আবির্ভূত হয়েছে (ভারব্যয়য়া) ভার হরনের জন্য (চ)ও (ভূবঃ) পৃথিবীতে (কৃষ্ণৌ) কৃষ্ণ ও অর্জুন (যদুকুরুদ্বহৌ) যদু ও কুরু বংশে যথাক্রমে।
সরলার্থঃ এই উভয়ে অবশ্যই হরির অংশ কৃষ্ণ ও অর্জুন এখানে পৃথিবীর ভার হরনের জন্য যথাক্রমে যদু ও কুরু বংশে আবির্ভূত হয়েছেন।
এখানে শ্রী জীব গোস্বামী একটু আরেক লাইন বেশী বুঝে লিখলেন- ভগবান নানাবতার বীজ হরির নর নারাযণাখ্য অংশ্বদ্বয় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনে প্রবেশ করিয়াছেন। অর্থাৎ ঘনীভূত পূর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণে সেই নারায়নখ্য ঋষিরূপী হরির অংশটুকু এসে মিশে গেলো।
কৃষ্ণ যে পরমাত্বার একটি কেশের অংশ মাত্র। মহাভারতের আদিপর্বেও তার বর্ণনা আছে।
"দেবগন কর্তৃক প্রার্থিত হয়ে শ্রী হরি কেশদ্বয় উৎপাটন করলেন। তার একটি শুক্ল অপরটি কৃষ্ণবর্ণ। সেই কেশদ্বয় যদুকুল মহিলা রোহিনী এবং দেবকীতে আবিষ্ট হইয়াছিলো। শ্বেতবর্ণ কেশ বলভদ্র এবং কৃষ্ণবর্ণ কেশ কৃষ্ণরূপে উক্ত হন"
(মহাভারত, আদিপর্ব ১৯৬।৩২-৩৩)
=>সমীক্ষা-০৫
কৃষ্ণ ও অর্জুন নর ও নারায়ন ঋষি ছিলেন।এবং ভূমাপুরুষের নিজের অংশ বলে দাবী-
কলাবতীর্ণব্বনের্ভারাসুরান্
হত্বেহ ভূয়স্তরয়োতমস্তি মে।।
(ভাগবত ১০।৮৯।৫৮)
পদার্থঃ (কলা) অংশে (অবতীর্ণৌ) অবতীর্ণ হয়েছো (অবনি) পূথিবীতে (ভারা) ভারস্বরূপ (অসুরান) অসূরদের (হত্বা) বধ করে (ইহ) এখানে (ভূয়) পুনরায় (ত্বরয়ে) তাড়াতাড়ি (ইতম) ফিরে এসো (অন্তি) নিকটে (মে) আমার।
সরলার্থঃ ভূমাপুরুষ বলছে, তোমরা আমার অংশে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছো। ভারস্বরূপ অসূরদের বধ করে পূনরায় আমার নিকট ফিরে।
পূর্ণকামাবপি যুবাং নরনারায়রনাবৃষৌ।
ধর্মমাচরতাং স্থিত্যৈ ঋষভৌ লোকসংগ্রহম্।।
(ভাগবত ১০।৮৯।৫৯)
পদার্থঃ (পূর্ণ) পূর্ণ (কামা) কাম (অপি) তথাপি (যুবাম) তোমরা দুজন (নর নারায়ন) নর এবং নারায়ন (ঋষী) ঋষি (ধর্মাম) ধর্মের (আচরতাম) আচরন আবশ্যক (স্থিত্যৈ) স্থিতি ও (ঋষভৌ) সর্বশ্রেষ্ঠ (লোকসংগ্রহম) লোকরক্ষার জন্য।
সরলার্থঃ তোমারা দুজনে পূর্ণকাম সর্বশ্রেষ্ঠ নর এবং নারায়ন ঋষি। তথাপি (জগতের) স্থিতি এবং লোকরক্ষার জন্য ধর্মাচরন আবশ্যক।
এই ভূমাপুরুষের উপাখ্যানে জানা যায় যে, এক বাহ্মণের মৃত পুত্রকে ফিরিয়ে আনবার জন্য অর্জুনকে নিয়ে অনন্তদেব ভূমাপুরুষের ধাম মহাকালপুরে প্রবেশ করলেন। তখন ভূমাপুরুষের অঙ্গজ্যোতি দর্শনে অক্ষম হয়ে অর্জুন চক্ষু মুদিত করলেন। তারপর কৃষ্ণার্জুন উভয়েই সেই ভূমাপুরুষকে প্রণাম করলে তিনি বলেন-
তোমরা আমার অংশ। পৃথিবীর ভারস্বরূপ অসুর বধের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছো। তা সম্পন্ন করে আমার কাছে আগমন করো
উপরের বিভিন্ন শ্লোক দ্বারা এটা সুস্পষ্ট হয় যে কৃষ্ণ জী হরির অংশ মাত্র পরমেশ্বর নয়। আর শেষ সমীক্ষাতেবৈষ্ণবমান্য ভাগবত শ্রীকৃষ্ণকে মহাপুরুষের অংশ বললেন। এবং স্পষ্ট বলে দিলেন তারা সর্বশ্রেষ্ঠ ঋষি ছিলো। আর যেসব পন্ডিত কৃষ্ণকে ঈশ্বর বানানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এই ভূমাপুরুষের উপাখ্যান তাদের দাবীকে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
এটাতো মায়াবাদ। 😂
ReplyDeleteশ্রীমদ্ভগবদগীতা যথার্থ পাঠ করুন।
ReplyDelete