স্থিতেৎ দ্বিতীয়ভাবে স্মিনকথং পূজা বিধীয়তে।।
যিনি অখন্ড,সচ্চিদানন্দ,একমাত্র নির্বিকল্পরূপ এবং অদ্বৈতরূপে বিদ্যমান তার পূজা কি করে হতে পারে? অর্থাৎ হতে পারে না। পূজার দৈতভাব (পূজ্য-পূজক ভাব হওয়া) আবশ্যক।
ঈশ্বর হলেন এক অসম্পূর্ণ অখন্ড তত্ত্ব। যখন এরকম বলা হয় যে, জীব হলো ব্রহ্মের অংশ তখন এর অর্থ হচ্ছে যে, কোন এক সময় ছিল যখন আমরা সবাই ব্রহ্ম ছিলাম। কালান্তরে তার থেকে আমরা পৃথক হয়ে অংশ হয়ে থেকে গেছি। প্রকান্তরে এর অর্থ হলো যে, ব্রহ্ম এক সবয়ব পদার্থ ছিল। কালান্তরে তার বিঘটন হয়েছে এবং সে টুরো টুকরো হয়ে সংসারে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু এখানে পড়েছে কিছু ওখানে পড়েছে। যখন ব্রহ্ম ছাড়া অতিরিক্ত অন্য কোন সত্তা ছিল না তাহলে এ বিঘটনটি করলো কে? এবং সে যদি আত্মহত্যা করে এবং স্বয়ং নিজের টুকরো করে নিয়েছে তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে যে সে এরকমটি কেন করেছে?
বস্তুত পরমেশ্বর হলেন অখন্ড। তিনি সর্বদা এক থাকেন তার মধ্য কোন প্রকারের বিকার, পরিণাম বা বিঘটনের কোন কল্পনা করা যেতে পারে না।অংশ সর্বদা অবয়বী পদার্থেরই হয়। জীবাত্মা নিরপেক্ষ ব্রহ্মের অংশ সম্পূর্ণ এককের মধ্যে কেটে নেওয়া ভাগ হতে পারে না।
শঙ্করাচার্যের মত হলো যে, ব্রহ্ম পূর্ণ তথা অবিভক্তরূপে জীবাত্মার রূপে বিদ্যমান রহিয়াছে। কেননা ব্রহ্ম অনেক পদার্থের মিলনে তৈরী নয়। অতঃ যৌগিক অর্থেও তার টুকরা হতে পারে না। এই জন্য শঙ্করাচার্য এই বাক্যের জীব সর্বোপরি সত্তার অংশ এই অর্থ লাগিয়েছেন যে, " জীব অংশের সমান অর্থাৎ অংশের মতো" কেননা নিরয়বে ব্রহ্মের বাস্তবিক অংশ হওয়া সম্ভব নয়।
অংশ ইবাংশো, ন হি নিরবয়স্য মখ্যোংশঃ সম্ভবতি।
(ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ০২।০৩। ৪৩)
যদি জীবাত্মা খন্ডিত ঈশ্বরের অংশ হতো তাহলে তাতে ঈশ্বরের সমস্ত গুন পাওয়া যেতো। তাত্তিক দৃষ্টিতে সমষ্টির সবই গুন ব্যষ্টিতে বিদ্যমান থাকে। যদি সমুদ্র লবণযুক্ত হয় তাহলে সমুদ্রের জলের এক এক বিন্দুতে লবণ থাকবে। ঠিক এই প্রকার অংশী পরমাত্মার সমস্ত গুণ তার অংশ জীবাত্মাতে হওয়া উচিত।
পরস্ত পরমেশ্বরের সর্বজ্ঞত্ব, সর্বশক্তিমত্ত, নির্ভ্রান্তিত্ব সর্বব্যপকত্ব আদি গুন জীবাত্মা থেকে ভিন্ন এবং জীবাত্মার অল্পজ্ঞতা, অল্পশক্তি, ভ্রান্তি তথা অপরিছিন্নতা আদিগুন পরমেশ্বর থেকে সর্বদা পৃথক, ভিন্ন। পরমেশ্বর হলেন নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব যুক্ত। কিন্তু জীবাত্মা জন্ম ও মরণের বন্ধনে পড়া তা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াসে লেগে থাকে।
স্বয়ং শঙ্করাচার্য লিখেছেন-
যথা জীবঃ সংসারদুঃখমনুভবতি নৈবমীশ্বরোনুভবতি
(বেদান্তদর্শন ০২।০৩।৪৬)
অর্থাৎ যেমনভাবে জীব সংসারের দুঃখকে অনুভব করে তেমনটি ঈশ্বর করে না। তাহলে ঈশ্বর এবং জীবের মধ্যে অংশাঅংশি ভাব কি করে থাকতে পারে? বস্তুত এক আত্মা অন্য আত্মার অংশ হতে পারে না। ঈশ্বর সদা অখন্ড এবং আগেও সদা অখন্ড থাকবেন।
অর্থাৎ পূজা দ্বৈত ভাব হলে পরেই সম্ভব। উপাসনা করছে আরাধক এবং উপাস্যবিষয় ( আরাধ্য) র মাঝখানে যে সমন্ধ তা এই কথাটি সংকেত করছে যে দুই জনের মধ্যে ভেদ রয়েছে। ভক্তি হলো পরমাত্মাতে আস্থা এবং প্রেমের নাম। নারদ তাকে পরমপ্রেমরূপা বলেছেন।
শান্ডিল্যের অনুসারে, পরমেশ্বরের প্রতি প্রেমের পরকাষ্ঠা হলো (Highest Degree) - সা পরাণুরত্তিরীশ্বরে।
যোগশাস্ত্রে একে ঈশ্বর প্রণিধান নামে অভিহিত করা হয়েছে।
এইভাব উপাসক এবং উপাস্যের মধ্যে দ্বৈত হওয়াটা অনিবার্য্য।বস্ততঃ ঈশ্বরের প্রতি আস্থা এবং মুক্তির জন্য তিন হওয়াটা অতন্ত্য দরকার-
(i) জীবাত্মা, যে মুক্ত হতে চায়।
(ii) প্রকৃতি, যার থেকে মুক্ত হতে হবে।
(iii) পরমাত্মা, যে তাকে মুক্ত করবে।
এই জন্য অদ্বৈতমতের প্রতিপাদন করা লোকদের স্বীকার করতে হয়েছে যে,
"পরমার্থিকম দ্বৈতং দ্বৈতং জ্ঞানহেতবে"
অর্থাৎ যথার্থতায় অদ্বৈত হওয়া সত্ত্বেও ভক্তির জন্য দ্বৈত অনিবার্য্য।
জীবাত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যে অদ্বৈত বা অভেদ অর্থাৎ অনন্যত্ব হলে পর "ভক্তি" শব্দটাই নিরর্থক হয়ে যায়। একই ব্যক্তি উপাসক ও উপাসক কি করে হতে পারে? কে আর উপাসনা করবে?
নিজের স্তুতি বা উপাসনা করা অথবা ব্রহ্ম ব্রহ্মের উপাসনা করে। এটি হবে সবচেয়ে হাস্যাস্পদ।
যদি আমি স্বয়ং ব্রহ্ম হই যা অবিদ্যা উপাধির কারনে জীব হয়ে বন্ধনে এসেছি তাহলে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যার শরনে যাই ? কেননা আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই।
জ্ঞানমার্গী হওয়া সত্তেও শঙ্করাচার্য ভক্তির আবশ্যকতা এবং উপাদেয়তা এবং তদর্থ দ্বৈত সত্তার নিষেধ করতে পারে না। ঈশোপনিষদের স্বরচিত ভাষ্যে ১৫ নং মন্ত্রের ব্যাখ্যাতে "সত্য ধর্মায়" র ভাষ্য করতে গিয়ে বলেছেন-
"সত্যধর্মায় তব সতস্যোপসনাং সত্যং ধর্মো যস্য মম স্যোহং সত্যধর্মা তৈস্মে মহম"
অর্থাৎ তোর মতো সত্যস্বরূপের উপাসনাতে আমি সত্যনিষ্ঠ হয়ে গেছি।
বস্তত দুই ছাড়া ভক্তির কল্পনা করা যেতে পারে না। যতক্ষন পর্যন্ত উপাসকের নিজের তুচ্ছতায় এবং নিজের উপাস্যের মহানতার অনুভূতি না হবে ততক্ষন পর্যন্ত ভক্তিভাব জাগ্রত হতে পারে না।
0 মন্তব্য(গুলি)