কমল- বিমলদা! এবার আজ , কালকের প্রশ্নের উত্তর দাও তো দেখি।
বিমল- তোমার কালকের প্রশ্ন ছিল—‘যদি পরমেশ্বরের শরীর না থাকে, তাহলে তিনি কেমন করে জগৎ রচনা করেন? কেননা, শরীর ব্যতীত ক্রিয়া সম্ভব নয়, কার্যও সম্ভব নয়। ভাইটি শোনো। পরমেশ্বরের শরীর না থাকলে তিনি সৃষ্টি করতে পারবেন না, এ ধারণাও তোমার ভুল। কেননা, যেখানে চেতন পদার্থের আবির্ভাব ঘটবে, সেখানে সে ক্রিয়াও করতে পারবে এবং ক্রিয়াতে গতিও সৃষ্টি করতে পারবে। যেখানে সে উপস্থিত হতে পারবে না সেখানে শরীর প্রভৃতি সাধনের প্রয়োজন হবে। দেখো ! আমি এই বইখানা তুলে ধরেছি। বলতো, কী দিয়ে তুললাম?
কমল- হাত দিয়ে তুললে।
বিমল- যদি হাত না থাকত, তাহলে আমি বইটা ধরে তুলতে পারতাম—নাকি পারতাম না?
কমল- না,পারতে না।
বিমল- বেশ, হাত তো বইটাকে ধরে তুলল, এবার আমি হাত তুলছি, বলতো, হাতকে কে তুলল?
কমল- হাতকে? হাতকে তো নিজের শক্তি তুলল।
বিমল- আরও বলছি শোনো—আমি আমার সমস্ত শরীরটাকে নাড়াচ্ছি। বলতো, কী দিয়ে নাড়াচ্ছি?
কমল- আপন শক্তি দিয়ে নাড়াচ্ছ।
বিমল- তুমি তো এখনই বলছিলে যে, শরীর ছাড়া কোনও ক্রিয়া হতে পারে না। যদি তাই হয়, তাহলে শরীর ব্যতীত এই শরীরটায় গতি এলো কেমন করে? তাহলে বুঝা গেল যে, চেতন এবং তার শক্তি যেখানে যেখানে আছে, সেখানে সেখানে তার শরীরের প্রয়োজন হয় না। জীবাত্মা শরীরের ভেতরে থেকে সমস্ত শরীরকে গতি দিচ্ছে, আর শরীরের বাইরের পদার্থ সমূহে গতি দিচ্ছে কেননা, জীবাত্মা শরীরের বাইরে উপস্থিত নেই। পরমাত্মা ভেতরে এবং বাইরে সর্বত্র বিদ্যমান, তাই তাঁর শরীরের প্রয়োজন হয় না। পরমাত্মা সমস্ত জগতে ব্যাপক বলে, সমস্ত জগৎকে তিনি গতি দিচ্ছেন।
কমল- আমি তো দেখেছি, মূর্তিমান ব্যক্তিই মূর্তিমান বস্তু নির্মাণ করতে পারে। যথা—ময়রা, স্বর্ণকার ইত্যাদি। নিরাকার পরমেশ্বর কেমন করে জগৎ রচনা করতে সক্ষম হবেন?
বিমল- যত মূর্তিমান কর্তা দেখবে, তাদের সকলে নিজের বাইরের বস্তু নির্মাণে সক্ষম, কিন্তু তারা নিজের ভেতরের বস্তু নির্মাণে অক্ষম। বাইরের বস্তু নির্মাণের জন্য হাত, পা প্রভৃতির প্রয়োজন হয়, কিন্তু শরীরের ভেতরের জন্য প্রয়োজন হয় না। এই জগতে কোনও বস্তু পরমেশ্বরের বাইরে নেই, তাই তাঁর শরীরের প্রয়োজন হয় না। ময়রা নিজের শরীরের বাইরের বস্তু সমূহ নির্মাণ করে, কিন্তু সে যদি মনে করে যে, সে তার নিজের শরীরের ভেতরের বাইরের বস্তু সমূহ নির্মাণ করবে, তখন সেই বস্তুগুলো খাবে কে? এমতাবস্থায় তার হাত পায়ের প্রয়োজনই বা কী? শরীরের ভেতর রস, মাংস, হাড় প্রভৃতি পদার্থ তো হাত পা ছাড়াই তৈরী হয়ে থাকে। আর একটা কথা—একটু চিন্তা করে দেখো, ইন্দ্রিয় সমূহ বাইরের বস্তু নির্মাণ করছে, আর চোখ বাইরের বস্তুসমূহ দেখছে। সে যদি ভিতরের বস্তু সমূহ দেখা আরম্ভ করে, তাহলে তাঁর পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। যদি সে ভিতরের জিনিষগুলো দেখা আরম্ভ করে, তাহলে তার অবস্থাটা কেমন হবে ভাবতে পারো? যদি জীব চোখ দিয়ে ভিতরে মল, মূত্র, রক্ত, মাংস দেখতে থাকে তাহলে সে যে ঘৃণায় ছটপট করবে। এ সবই ঈশ্বরের কৃপা যে, ইন্দ্রিয় সমূহ দ্বারা শুধু বাইরের বস্তুই দেখা যায়, ভেতরে দেখা যায় না।
কমল- নির্মাণ কর্তা কি নির্মিত বস্তুতেও ব্যাপক হয়ে থাকে? ঘড়ির নির্মাণ কর্তা, সে তো ঘড়ি হতে পৃথক। ময়রা মিষ্টি তৈরি করল। মিষ্টি পৃথক,—আর ময়রা পৃথক। জগতের নিয়মই এই যে, নির্মাণ কর্তা, নির্মিত বস্তু হতে পৃথক থাকে। পরমেশ্বর সর্বত্র ব্যাপকও থাকবেন এবং জগত রচনাও করবেন—এ কেমন উদ্ভট কথা ! তাছড়া তিনি হাত পায়ের সাহায্য ব্যতীতই বস্তু নির্মাণ করবেন, এই বা কেমন কথা—ভেবে পাইনা।
বিমল- ঘড়ি নির্মাণ কর্তা, ময়রা স্বর্ণকার প্রভৃতি এরা সকলে একদেশী এবং অল্পজ্ঞ কর্তা। এদের কর্মের যে পর্যন্ত দায়িত্ব আছে, সেই পর্যন্তই তাদের ক্রিয়া এবং তারা সেই সমস্ত পদার্থের সঙ্গে আছে। যেখানে তারা নেই, সেখানে তাদের সঙ্গে সম্বন্ধ-রক্ষাকারী ক্রিয়াও থাকতে পারেনা। যথা—ঘড়ি সজ্জাকার ঘড়ীর রূপদান করল, সজ্জার উদ্দেশ্য কী? না, ঘড়ির কলকব্জাগুলোকে পরস্পর যুক্ত করে, তাতে ক্রিয়া দান করা। ঘড়ি-সজ্জাকার ঘড়ির কলকব্জাগুলোকে যুক্ত করল, সে কিন্তু কলকব্জার নির্মাণ কর্তা নয়; কলকব্জার নির্মাণ কর্তা অপর কেহ। ঘড়ি সজ্জাকার ঘড়িতে রূপদান করার সময় ঘড়ির সঙ্গে ছিল। যদি সে ঘড়ির কলকব্জার সঙ্গে না থাকত, তাহলে কলকব্জা নিজে জোড়া লেগে ঘড়ির রূপ ধারণ করতে পারতো না। এইভাবে কলকব্জার কর্তা তার সেই কলকব্জার সঙ্গে আছে। যদি ঘড়ির কলকব্জা-নির্মাতা কলকব্জার সঙ্গে না থাকত, তাহলে কলকব্জা তৈরীই হ’ত না। এইভাবে যে লোহার দ্বারা কলকাব্জা নির্মাণ করা হয়েছে; লোহার খনি হতে লৌহ আকরিক নিষ্কাশনকারী এবং গলিয়ে পরিষ্করণকারী, খনি, চুল্লী প্রভৃতি লোহার সঙ্গে যদি না থাকত, তাহলে খনি হতে লৌহ আকরিক নিষ্কাশন এবং পরিষ্কারণ কার্য হত না। এ হতে বুঝা যায় যে, ক্রিয়াটি হয়েছিল, সে কর্তাটি সেই ক্রিয়ার সঙ্গে ছিল। এইভাবে ময়রা, স্বর্ণকার প্রভৃতি কর্তার ব্যবস্থা জানবে যে, তারা সকলে আপন আপন ক্রিয়ার কর্তা। যিনি যাবতীয় সামগ্রী রচনা করেছেন, সেই শেষ কর্তা তো আর কেউ নয় ঈশ্বর ছাড়া। সেই সমস্ত সামগ্রী দ্বারাই ময়রা, স্বর্ণকার প্রভৃতি সকলে আপন আপন ক্রিয়াকে সফল করার সুযোগ পায় এবং দ্রব্যাদি নির্মাণ করে। এবার তুমি নিশ্চই বুঝতে পেরেছ যে, মানুষ যে জিনিসটি তৈরী করে তাতে কেবল তারই কর্তৃত্ব থাকে না, কিন্তু তাতে থাকে অনেকের কর্তৃত্ব; তবে একটা জিনিস তৈরী হয়। কেন এমনটি শুনবে? কেননা, মানুষ অল্প শক্তিমান, সে অনেক কর্তার সহযোগিতা পেয়েই কোনও বস্তু তৈরী করতে পারে। আর সেই সব কর্তা নিজ নিজ ক্রিয়ার সঙ্গেও থাকে। এবার একটু ভেবে দেখো, যখন বড় বড় কাজে তাদের কর্তা সঙ্গে থাকে, তখন স্থুল অপেক্ষা স্থুল এবং সূক্ষ্ম অপেক্ষা সূক্ষ্ম সৃষ্টি করতে হলে, সেই সমস্ত ক্রিয়ার কর্তা, তাদের সঙ্গে থাকবে না কেন? সৃষ্টি তো কেবল সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষ, নদ-নদী, মানুষ, পশু, পক্ষী প্রভৃতি নয়। এছাড়া আরো তো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এমন বস্তু আছে আমরা যার কল্পনাও করতে পারি না; সে সবই সৃষ্টি। দেখো, পাঁচটি স্থুল ভূত, পাঁচটি সূক্ষ ভূত, আর পঞ্চ তন্ত্রমাত্রা অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ, বহু প্রকার অনু-পরমাণু—এদের দ্বারাই সৃষ্টি রচিত হয়। যদি এই সমস্ত বস্তুর সংযোগ-কর্তা ওদের সঙ্গে না থাকতো, তাহলে কি এ সমস্ত রূপ পরিগ্রহ করতে পারতো? জগতের যাবতীয় বস্তু প্রকৃতির পরমাণু দ্বারা সংগঠিত। পরমাত্মা সেই সমস্ত বস্তুর ভেতরে বাইরে বিদ্যমান, তাই তিনি তাদের যুক্ত করে সূক্ষ্ম অপেক্ষা সূক্ষ্ম এবং স্থুল অপেক্ষা স্থুল জগৎ রচনা করতে সক্ষম। জগতের যাবতীয় জড় পদার্থের মধ্যে পরমাণু সর্বাপেক্ষা সূক্ষ্ম। পরমাত্মা তদপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ম এবং এই কারণেই তিনি সকলের মধ্যে ব্যাপক। তিনি যদি ব্যাপক না হতেন, তাহলে সৃষ্টির প্রয়োজনে তাঁকেও অন্য কর্তার ক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করতে হত ; যেভাবে জগতের মানুষ এবং প্রাণী সমূহকে অন্যান্য কর্তার সাহায্য নিতে হয়। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে পর্যন্ত ক্রিয়ার উত্তর দায়িত্ব থাকে সেই পর্যন্ত প্রত্যেক কর্তা আপন ক্রিয়ায় ব্যাপক থাকে। কেবল প্রশ্ন থেকে যায় যে, হস্ত পদাদি ব্যতীত তিনি কিভাবে বস্তু সমূহকে সংগঠিত করেন? যদি স্বীকার করা যায় যে, প্রত্যেক পদার্থ হস্ত পদাদি দ্বারাই নির্মিত হয়ে থাকে, তাহলে যে সমস্ত হাত এবং পা, বস্তু নির্মাণে সক্ষম সেই সমস্ত হাত এবং পা কী দিয়ে তৈরি হয়েছে? হাত এবং পা সেও তো সৃষ্টি বস্তু। যদি হাত এবং পা ; হাত-পা ব্যতীত তৈরী হতে পারে, তাহলে সৃষ্টির অন্যান্য পদার্থও হাত-পা ব্যতীত তৈরী হবে না কেন? আমি জিজ্ঞাসা করি, মাতৃগর্ভে যে শিশুটি বড় হচ্ছে, তাকে কি হাত দিয়ে গড়া হচ্ছে? ধরিত্রীর বুকে এই যে নানা প্রকার অঙ্কুর সৃষ্টি হয়ে বৃক্ষের রূপ ধারণ করছে, বলতো—সে গুলোকে কি হাত পা দিয়ে গড়া হয়েছে? শুধু তাই নয় ভেবে দেখো, হাত তো কেবল হাতের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বস্তু গঠনে সমর্থ, অন্য বস্তু তো তাদের দ্বারা গড়া যাবে না। হাত দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট কীটাণু, মশা, মাছি তথা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সূক্ষ্ম অংশ কেমন করে গড়া যেতে পারে? যে পৃথিবীতে মানব প্রভৃতি প্রাণী বাস করে তার পরিধি পঁচিশ হাজার মাইল। এর চেয়েও লক্ষ কোটিগুণ বড় সূর্য, বৃহস্পতি প্রভৃতি গ্রহকে হাত দিয়ে কেমন করে গড়বে? এইসব বস্তুকে নিয়মানুসারে গড়তে পারেন একমাত্র সর্বশক্তিমান সর্ব ব্যাপক পরমাত্মা। তিনিই সমস্ত বিশ্বজগতকে নিয়মানুসারে পরিচালনা করছেন।
কমল- বিমলদা ! তুমি দেখি একটা না একটা নতুন কথা আবিষ্কার করে ফেলো। নিয়মানুসারে কোন কাজটি চলছে বলতো? আর কোন বস্তুটি বা নিয়মানুসারে নির্মিত? আমার চোখের সামনে ঐ যে উঁচু পাহাড়, কোথাও বা গভীর খাদ, কোথাও দেখো—ভয়ানক অরণ্য, কোথাও বা বালুকাময় পৃথিবী, কোথাও আবার ঝোপ-ঝাপ। বলতো এদের কোনটা ক্রমানুসারে আর কোনটাই বা নিয়মানুসারে সৃষ্টি? সমস্ত পদার্থ এমনই উঁচু-বন্ধুর-শৃঙ্খলাহীন, এ যেন এক খামখেয়ালী সংসার। যে কাজ নিয়মানুকূল হয়, সেগুলো একই রকমের হয়। এই যে, মানুষ ঘর বাড়ী তৈরী করে তাতে একটা নিয়ম দেখা যায়। নিয়ম মত বাড়ীর চারদিকে প্রাচীর, উঠান, কুঠুরী, রান্নাঘর, স্নানের ঘর, এসবই থাকে। মালী বাগান করে, তাতে নালা, আল তৈরী করে, ফুলের টব-তাতে গাছ-পালা নিয়ম মত বসায়। দোকানদার দোকান খোলে তাতে সে সব মালপত্র নিয়ম মত সাজিয়ে রাখে। মানুষের কর্মের মধ্যে নিয়ম দেখা যায়, কিন্তু তুমি এমনই এক উদ্ভট ক্রম বিরুদ্ধ সৃষ্টির কথা বলছ, যে সৃষ্টিতে নিয়ম নেই। সৃষ্টির কোন স্থানে নিয়ম আছে কী? এ তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি সৃষ্টির সবটাই নিয়মের উল্টো। আমার বিবেচনায় সৃষ্টির কোথাও নিয়ম নেই।
বিমল- সৃষ্টিতে কোন নিয়ম নেই, একথা বলা অজ্ঞতার পরিচয়। আচ্ছা বলতো—সূর্য পূর্ব দিকে উদয় হয় কেন? আর পশ্চিমেই বা অস্ত যায় কেন? সূর্য কেন পশ্চিমে উদয় হয় না, এটা বুঝি নিয়মের মধ্যে পড়ে না? মানুষের তৈরী উত্তমোত্তম ঘড়ির সবগুলো কি একইভাবে চলে? কেউ আগে আর কেউ পিছনে চলে না বুঝি? কিন্তু দেখো, পরমাত্মার সৃষ্টি—সূর্যরূপী ঘড়ি, তার কখনও একদন্ড, এক পলক মাত্রের জন্যও আগে-পিছে হয় না। চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির এবং অন্তর্ধানের নিয়ম অটল, এতে কি কোনও সন্দেহ আছে? ঠিক এই নিয়মের উপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যত সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের দিনক্ষণ, দন্ড, পল, সে যত বছর পূর্বেই হোক না কেন ; বলে দেওয়া যেতে পারে। ঠিক এমনি অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহাদির অবস্থান সম্পর্কে বলা যায়। একটু ভেবেই দেখো, ছোলার দানায় ছোলা হয় কেন? তাতে গম হলেই তো পারতো? আমের আঁটি পুঁতে আমগাছ হয়, কিন্তু তাতে কমলা লেবু, আপেলের গাছ হয়না কেন? শিশু জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে কিশোর, বালক, যুবা, বৃদ্ধ হয় কেন, এর কারণ বলতে পারো? এরূপ ক্রম না হয়ে বৃদ্ধ যদি বালক ও কিশোর হতো? চোখ দিয়ে দেখা যায় কেন? চোখ দিয়ে শুনলেই তো বেশ হতো। নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেওয়া হয় কেন? আস্বাদের কাজটা নাক দিয়ে নিলেই তো হতো। এদের পিছনে নিয়ম কাজ করছে। বলে তো দিলে—সৃষ্টিতে পাহাড়, কোথাও নদী, কোথাও সমুদ্র, কোথাও উঁচু, তো কোথাও নিচু ঢিপি, কোথাও ঝোপ-ঝাড়, কোথাও ঘন অরণ্য, আবার কোথাও মরুভূমি। সৃষ্টিতে নিয়ম নেই একথা বলা তোমার অজ্ঞানতা ছাড়া আর কি বলবো বলো? তুমি তোমার বুদ্ধির মাপকাঠি দিয়ে সৃষ্টিকে মেপে দেখেছ। জগতের নিয়মই এই যে, যে ব্যক্তি যে বস্তুটিকে বুঝতে পারে না, সে সেই বস্তুটির দোষ বর্ণনা করতে থাকে। একটা পিঁপড়ে যখন মানুষের দেহে উঠে ধীরে ধীরে মাথায় চড়ে বসে, তখন সে মাথার চুলে আটকে পড়ে, আর ভাবে এ কেমন দেহ যাতে নিয়মের কোন চিহ্নই নেই, দেহটা তৈরীই হয়েছে অনিয়মের উপর। মাথায় এ কেমন ঝোপ-ঝাড় রে বাবা! সে যখন মাথা হতে নিচে নামতে থাকে তখন কপালের কাছে এসে ভাবে বাঃ ! কেমন সুন্দর পরিষ্কার মাঠ। আর একটু ভ্রূর কাছে নামতেই আবার বিরক্ত—এ দেখি আবার সেই ঝোপ-ঝাড়। এখানে যে কাঁটার মতো জাল বিছানো। ভ্রূর সীমা পার হয়ে একটু নিচে এসেই ভাবছে এ আবার কি রে বাবা! ভ্রূর নিচে এ কেমন গর্ত! চোখের কোণ বেয়ে নাকের ধারে এসে ভাবছে, এ দেখি আর এক লম্বা পাহাড় খাড়া করে রেখেছে। নাকের নিচে নেমে দেখে অবাক, পাহাড়ের মধ্যে আবার সুড়ঙ্গ রচনা করা যে! নাকের নিচে নেমে দেখে গোঁফ ; সেই দেখে আবার চিন্তা! এখানেও ঘন জঙ্গল করে রেখেছে গোঁফ। পিঁপড়ে তার বুদ্ধি দিয়ে মানব দেহের পরিমাপে ব্যস্ত। সে ভাবে মাপকাঠি অনুসারে মানবদেহটাকে যদি একটা ল্যাপা-পোতা পরিষ্কার মাঠ করে দেওয়া হতো, গোঁফ-দাড়ি ও মাথার চুলগুলোকে পরিষ্কার করে, চোখের গোলক—গর্ত বন্ধ করে দেওয়া হতো, নাকটাকে কেটে ন্যাড়া মাথার মত সমতল করে দেওয়া হতো তাহলে মানব দেহ রচনা বোধ হয় নিয়ম পূর্বক হয়েছে বলে মনে হতো। আবার জিজ্ঞাস্য, যদি পিঁপড়ের বুদ্ধির মাপকাঠির মত মানব দেহটা তৈরী করা হতো তাহলে মানুষ কি মানুষ থাকতো? সে মানব দেহে কি কোনও সৌন্দর্য থাকতো? না—জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয়র নিয়ম পূর্বক ব্যবহার করা তার পক্ষে সম্ভব হতো? মোটেই না। আর একটা উদাহরণ দিই শোনো। এক শিল্পী একটি যন্ত্র নির্মাণ করল। সে যন্ত্রে শত সহস্র যন্ত্রাংশ সন্নিবিষ্ট করা হলো। তার কোনটা লম্বা, কোনটা চওড়া, কোনটা বাঁকা, কোনটা কোনাকুনি, কোনটা গোল, কোনটা খুব লম্বা, কোনটা ছোট। একজন অজ্ঞানী ব্যক্তি সেই যন্ত্রটা দেখে বলছে,-“যন্ত্র নির্মাতা তো দেখি আচ্ছা মূর্খ ! যন্ত্রাংশের কোনটা খুব লম্বা, কোনটা ছোট্ট, কোনটা কত বড়, আবার কোনটা গোল, কোনটা চ্যাপ্টা এ কেমন যন্ত্র রচনা, যার মধ্যে কোনও সমতা নেই !“ বলতো—যে মানুষটি সেই যন্ত্র দেখে সমালোচনা করছে এটা কি তার বুদ্ধিপূর্বক সমালোচনা করা হচ্ছে? যন্ত্র নির্মাতা যে যন্ত্রাংশটিকে যেভাবে তৈরী করা উচিত মনে করেছে, সেটিকে সে সেই ভাবেই তৈরী করেছে। সে জানে ঐ ভাবে যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করলে তবে যন্ত্রটি চলবে। আর যে প্রয়োজনে যন্ত্রটি নির্মিত, সে উদ্দেশ্যও সিদ্ধি হবে। যদি যন্ত্র নির্মাতা যন্ত্রের সব অংশগুলি একই প্রকারের বা একই ধরনের তৈরী করতো, তাহলে কি যন্ত্র চলতো? –কখনোই না। ঠিক এই অবস্থা পরমাত্মার। তিনি তাঁর সৃষ্টিরূপী যন্ত্রের কোথাও সমুদ্র, তো কোথাও নদ-নদী, কোথাও বন-উপবন তো কোথাও ঝোপ-ঝাড় তৈরী করেছেন, কিন্তু এই সৃষ্টিরূপী যন্ত্রের একটি প্রয়োজনও আছে। সে প্রয়োজনটা কি শুনবে? জীবের কল্যাণ। অজ্ঞানী মানুষ সৃষ্টিরূপী যন্ত্রটিকে, যন্ত্রাংশগুলোকে, বিশ্রী, শৃঙ্খলা ও নিয়মহীন মনে করে। কেননা, জগতের প্রয়োজন বা জগতে সৃষ্টির উদ্দেশ্য যে কী, তা সে জানেনা। সৃষ্টিরূপী যন্ত্রের যন্ত্রাংশ রূপ সমুদ্র নদী, পাহাড় প্রভৃতি এদের উপযোগিতা সম্বন্ধে তারা অবহিত নয়। তুমি যে মালী ও দোকানদারের উদাহরণ দিয়েছ তাদের নিয়ম অতি ক্ষুদ্র, তাই তুমি তাড়াতাড়ি বুঝতে পারছ। সৃষ্টির নিয়ম বিশাল এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ম, সেই নিয়মের বিশালতা এবং সূক্ষ্মতা তুমি অনুধাবন করতে পারছ না। একটু ভেবে দেখো, যে মস্তিষ্ক দ্বারা জগতের মানুষ নিয়ম সৃষ্টি করছে, সেই মস্তিষ্কটাকেও তো সেই নিয়ামক প্রভুই সৃষ্টি করেছেন। তিনিই তো বিশাল সৃষ্টির অসংখ্য নিয়ম রচনা করেছেন। মনে কর, জগতে যদি নিয়ম না থাকত, তাহলে পরমাত্মাকে কে মানতো বলো? সৃষ্টির অটল নিয়মই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
কমল- আচ্ছা, মানলাম ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন?
বিমল- মনে রেখো, রচিত পদার্থ কার্য, সেই কাজেই উপাদান কারণ এবং কর্তার প্রয়োজন হয়। ঈশ্বর রচিত পদার্থ নহেন, তিনি অনাদি এবং সনাতন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে, ঈশ্বরের রচয়িতা কে? যিনি স্বয়ং কর্তা তাঁর আবার কর্তা কে? যদি কর্তার কর্তা থাকে, তাহলে কর্তার কর্তৃত্ব থাকে না, তখন সে কর্তা কারণে পরিণত হয়ে যায়। কর্তা যে স্বতন্ত্র। যে রচিত পদার্থ, সে কখনও কর্তা হয় না। মানুষ প্রভৃতিকে যে কর্তা বলা হয়, তাদের শরীর কর্তা নয়, শরীর সাধন মাত্র। কর্তা তো আত্মা।
কমল- আচ্ছা কর্তার কর্তা না হয়—না হলো, কিন্তু বলতো, ঈশ্বরকে কেন স্বীকার করা উচিত? আমরা তাঁর স্তুতি, প্রার্থনা, উপাসনা, এবং তাঁকে ভক্তি করব কেন? আমাদের জীবনের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ কিসের ?
বিমল- এ বিষয়ে আগামীকাল বিবেচনা করা যাবে। কেমন?
Courtesy- বৈদিক ধর্ম ধারা - পন্ডিত সিদ্ধগোপাল কবিরত্ন
0 মন্তব্য(গুলি)