https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বেদ ও সরস্বতী

Saturday, October 1, 2016

বর্তমান কিছু পন্ডিতের বিচারধারা এই যে, বেদের মধ্যে সরস্বতী নদীর বর্ণনা রয়েছে। এই ষড়যন্ত্র পাশ্চাত্য ভাষ্যকাররা করেছিলো। ব্রিটিশ শাসনের এবং স্বতন্ত্রতার পরে সংস্কৃত এবং বিদ্যার এমন হ্রাস হয়েছে যে,এই ভ্রমের বিরুদ্ধকারী লোক খুজে পাওয়া কঠিন।
একটা আক্ষেপ এই যে,বেদের মধ্যে সরস্বতী নদীর উল্লেখ সেই সব লোক পর্যন্ত স্বীকার করে যারা বেদকে অপৌরষেয় মানে। তারা লিখে যে,  ঋগবেদের এক রাজা সুদাসের রাজ্য সরস্বতী নদীর তটে ছিলো।  তাহলে কি বেদের রচনা রাজা সুদাসের পরে হয়েছে? ইহা শুধু একটি উদাহরন মাত্র।   বেদ কি? বেদ হচ্ছে ঈশ্বরীয় জ্ঞান।  ঈশ্বর নিত্য  এবং তার জ্ঞানও নিত্য। সৃষ্টির প্রারম্ভে ঈশ্বর মানুষের কল্যাণের জন্য এই জ্ঞান দিয়েছেন। এটা ঈশ্বরের সম্পূর্ণ জ্ঞান নয়, মানুষের জন্য সম্পূর্ণ। ঋষিরা মন্ত্র দ্রষ্টা মাত্র, মন্ত্র স্রষ্টা নয়। বেদ সার্বকালিক এবং সার্বভৌমিক। এর মধ্যে সাংসারিক বস্তু পাহাড়,নদী আদি মানুষের নাম নেই।  বেদ সাংসারিক ইতিহাস ভূগোলের পুস্তক নয়। ইতিহাস ভূগোল বদলাতে পারে, বেদ বদলাতে পারে না। তাই বেদের মধ্যে অনিত্য ইতিহাস থাকতে পারে না। বেদের মধ্যে সরস্বতী, গঙ্গা,যমুনা কৃষ্ণ আদি  শব্দ এসেছে। কিন্তু এসব ঐতিহাসিক কোন চরিত্র হিসেবে আসে নি।
তেমনি বেদের মধ্যে সরস্বতী নাম অনেক স্থানে লক্ষ করা যায়। মূখ্যরূপে ঋগবেদের সপ্তম মন্ডলের ৯৫ এবং ৯৬ সুক্তের মধ্যে সরস্বতীর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু  এ সরস্বতী কোন দেশের মধ্যে বহমান নদী নয়।  বেদের অর্থ বোঝার জন্য আমাদের প্রাচীন ঋষিদের প্রমাণ রয়েছে। নিঘন্টু মধ্যে বাণীর ৫৭ টি নাম রয়েছে তার মধ্যে সরস্বতী একটি।  অর্থাৎ সরস্বতী অর্থ বেদবাণী।  ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বেদ ব্যাখ্যার প্রাচীনতম গ্রন্থ। সেখানে সরস্বতীর অনেক অর্থ রয়েছে।

(i) বাক সরস্বতী।  বাণী সরস্বতী (শতঃ ৭।৫।১।৩১)
(ii) জিহ্বা সরস্বতী (শতঃ ১২।৯।১।১৪)
(iii) সরস্বতী হি গৌ (শতঃ ২।৫।১।১০)
গৌ সরস্বতী অর্থাৎ বাণী, রশ্মি,পৃথিবী,ইন্দ্রীয় আদি।
(iv) অথ যত অক্ষা কৃষ্ণং তত সারস্বতম (শতঃ ১২।৯।১।১২)
চোখের কালো অংশ সরস্বতীর রূপ
(v)  অথ যত স্ফুর্জয়ত্ন বাচমিব বদন দহতি (ঐতরীয় ৩।৪)
অগ্নি যখন জ্বলে শব্দ করে সেই অগ্নি সরস্বতী রূপ।
(vii) সরস্বতী পুষ্টি (তৈঃ ২।৫।৭।৪)
(viii) এষাং বৈ অপাং পৃষ্ঠং যত সরস্বতী (তৈঃ ১।৭।৫।৫)
জলের পৃষ্ঠ সরস্বতী।
(ix)  সরস্বতী তদ দ্বিতীয়ং বজ্র রূপং (কৌঃ ১২।২)
সরস্বতী বজ্রের দ্বিতীয় রূপ।

ঋগবেদ  ৬।৬১ সুক্তের দেবতা সরস্বতী।  বেদার্থ প্রকৃয়ায় অনভিজ্ঞ ব্যক্তি প্রথমে তো এটি একটি নদী মানেই, আবার এই সুক্তে না কি তার সাত বোনের বর্ণনা ও রয়েছে। ই সুক্তের ৯ম মন্ত্রে "বিশ্বা স্বসৃ" ১০ম মন্ত্রে "সপ্ত স্বসৃ" এবং ১২ মন্ত্রো "সপ্ত ধাতু" পাঠ রয়েছে।  সায়ন আচার্যও অনেক স্থানে সাত বোনের মধ্যে গঙ্গা আদি কল্পনা করেছেন। কিন্তু ১২ মন্ত্রে স্বীকার করেছে " সপ্ত ধাতবো অবয়বাঃ গায়ত্রদ্যাঃ যস্যা" যার গায়ত্রী আদি সাত অবৃয়ত্ব রয়েছে। ১০ মন্ত্রেও "সপ্ত স্বসা গায়ত্রাদীনি সপ্ত ছন্দাংসি স্বসায়ৌ যস্যাস্তাদৃশী" এখানেও সাত ছন্দবিশিষ্ট বেদ বাণীর কথা বলা হয়েছে। ১১ নং মন্ত্রে তাকে পৃথিবী এবং অন্তরীক্ষের সর্বত্র নিজ তেজ দ্বারা পূর্ণকারী বলা হয়েছে।
এই সরস্বতী শব্দে এক বিশেষ নদী মেনে ভাষ্যকার কি প্রকার ভ্রমে পড়েছে তার কিছু নমুনা আমরা দেখে নেই -

একা চেতত্ সরস্বতী নদীনাং শুচির্যতী গিরিজঃ আ সমুদ্রাত।
রায়শেতন্তো ভূবনস্য  ভুরেঘৃতং পয়ো দুদুহে  নাহুষায়।।
(ঋগবেদ ৭।৯৫।২)

এখানে সায়ন সরস্বতীকে নদী ভেবে কল্পনার ঘোড়ে সওয়ার হযেছেন। এখানে তিনি রাজা নাহুষের কথা উল্লেখ করেছেন। নাহুষ রাজা না কি এক হাজার বর্ষ ঘী দুগ্ধ দিয়েছেন।  তিনি মন্ত্রার্থের অর্থ এরূপ করেছেন -
"নদীর মধ্যে শুদ্ধ পর্বত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত যায় এক সরস্বতী নদী। নাহুষের প্রার্থনা জেনে এবং প্রাণীদের বহু প্রকারে ধর্ম শিখায়, নাহুষ রাজা এক হাজার বর্ষের যজ্ঞের জন্য পর্যাপ্ত ঘী দুধ দিয়েছে"

এখানে  "নাহুষ" কোন রাজা নয়। নিঘন্টু অনুসারে মানুষের ২৫ পর্যায় রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে নাহুষ (নিঃ ২।৩)। সরস্বতী হচ্ছে বেদ বাণী।  আর ঘৃতঃ পয়ঃ এখানে বেদ (শতঃ ১১।৫।৭।৫)। তাহলে মন্ত্রটির বাস্তবিক অর্থ হচ্ছে -

(একা নদী শুচীঃ গিরিজঃ আসমুদ্রাত যতী) যেমন এক নদী পর্বত থেকে পবিত্র সমুদ্র পর্যন্ত যায়।  সেই প্রকার (সরস্বতী এক) এক অদ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ বেদ বাণী (গিরিজ) জ্ঞানোপদেষ্টা গুরু দ্বারা (আ সমুদ্রাত্) জনসমূহ রূপ সমুদ্র পর্যন্ত যায় (ভূবনস্য ভূয়ে চেতন্তি) সংসার এবং  জগতের প্রভূত ঐশ্বর্য  জ্ঞান করিয়ে (নাহুষায়) মানুষ মাত্রকে (ঘৃতং পয়ঃ দুদহে) প্রকাশময়, পান করার যোগ্য রসের তুল্য জ্ঞান রস বাড়ায়।

প্রকরন বশত আরেকটি মন্ত্রের উপর বিচার করা অতন্ত্য আবশ্যক। ঋগবেদ ১০।৭৫।৫ এই মন্ত্রে পৌরাণিক ভাষ্যকারদের দাবী হচ্ছে, এখানে গঙ্গা আদি দশ নদীর  নাম রয়েছে -

ইমং মে গঙ্গা যমুনা সরস্বতা শুতুদ্রি স্তোমেং সচতা পরুষ্নিয়া।
অসিকণ্যা মরুদ্রধে বিতস্তযার্জীকীয়ে শৃণুহ্যা সুষো ময়া।।
(ঋগবেদ ১০।৭৫।৫)

সায়ন এই মন্ত্রে দশ নদীর বর্ণনা মেনেছেন। এবং বলেছেন তোমরা আমাদের স্তুতিকে শোন।
কিন্তু বেদের তাৎপর্য কখনোই ভৌগলিক স্থিতির বর্ণনা করে না
যাস্ক এবংস্বামী দয়ানন্দজীর মতে বেদ বিশ্বজনীন জ্ঞান, এতে কোন ইতিহাস ও ভুবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞান নেই ৷ যদি কোন নির্দিষ্ট নদীকে এই সকল নামে ডাকা হয়, বুঝতে হবে এই নাম সমূহ বেদ হতে এসেছে বেদে এই নাম সমূহ শব্দ হিসেবে পূর্বেই ছিল এবং নদীর বৈশিষ্ট্য এই নাম-শব্দের অনুরূপ ৷ এ কারনেই অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ শরীরের নির্দিষ্ট স্নায়ু, ধমনী ও শিরাকেও এই বৈদিক শব্দ-নামে ডাকা হয় ৷
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারে বেদের নদী হচ্ছে সেটি যা পাপনাশক বা দুঃখ তাড়ার সামর্থ রাখে। কিন্তু প্রাকৃতির নদীর সে সামর্থ নেই।   মূলত ইড়া,পিঙ্গলা,সুষুম্না হচ্ছে গঙ্গা নদী আদির সঙ্গা। যোগ মধ্যে ধারনা আদি কে সিদ্ধির জন্য চিত্তকে স্থির করার জন্য এগুলোর উপযোগীতা রয়েছে।

পন্ডিত জয়দেব শর্মা উক্ত মন্ত্রের ভাষ্যে কেরালার প্রাচীন পাণ্ডুলিপি হতে উদ্বৃতি দিয়েছেন, এবং ব্যাখ্যা করেছেন - অনবরত প্রবাহিত গঙ্গা হল ইড়া, যাহা আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিচালিত করে ৷ যমুনা হল পিঙ্গলা যাহা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সহিত সুশৃঙ্খলভাবে যুক্ত ৷ সরস্বতি হল সুষুষ্মা যাহা আমাদিগকে জ্ঞানের আনন্দের দিকে পরিচালিত করে ৷ পরুশ্নি (প্রভাবতী, ভাস্বতী, কুটিলগামিনী) যাহা মেরুদন্ডের ভার্টিব্রার মধ্য দিয়ে যায় জ্বলজ্বল করছে ৷ অসিক্ন্যা হল অন্ধকার, মারুদবৃধে হল সকল প্রবাহ দ্বারা বর্ধিত, শুতুদ্রী হল দ্রুতগতিসম্পন্ন ও পূর্ণ, বিতস্তা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে, অর্জীকীয়া ব্রেনের রুজুকা নামক কেন্দ্র হতে উদ্ভুত, একে বিপদ নামেও ডাকা হয়, যদি ইহা কখনও ছিড়ে যায় তবে মৃত্যু ঘটে এবং প্রাণসমূহ ও আত্মা শরীরকে কম্পিত করে ৷ এ কারনেই ইহাকে উরুনজারাও বলা হয় ৷ সিন্ধু হল প্রধান যাহাতে সকল প্রাণ ও (নদী) প্রবাহ সমাপ্ত হয় ৷ এভাবেই স্রোতসমূহ ও স্রোতসমূহের নাম জীবের প্রাণশক্তির সাধারন পরিভাষা বিবিধ শারিরীক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বর্ণনা ৷

অতএব এই সংক্ষিপ্ত বিবরণে এই কথা স্পষ্ট যে,বেদ মধ্যে সরস্বতীর নাম অনেকবার এসেছে। কিন্তু এটা ধরণীর  কোন স্থান বিশেষের উপর বহমান নদীর নামে আসে নি।  না  এসেছে বেদের মধ্যে সরস্বতী সমন্ধী কোন ব্যক্তির ইতিহাস। অতএব, সরস্বতী নদীর ঐতিহাসিকতা বেদ দ্বারা প্রমাণ করার প্রচেষ্টা বেদকে অবমূল্যায়ন করা ছাড়া কিছুই নয়।

  1. খুব ভালো একটা লেখা ৷ কঠিন বিষয় কিন্তু খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৷

    ReplyDelete
  2. দারুন বিশ্লেষণ !

    ReplyDelete