https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বৈদিক দেবতা বিষয়

Thursday, October 27, 2016

বর্তমানে দেবতা বিষয় নিয়ে যেন এক ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। সকলে দেবতা বলতে তেত্রিশ কোটি কাল্পনিক কোন ব্যক্তি বিশেষ কে বোঝে। যারা কি না বিভিন্ন অস্ত্র শস্ত্র তথা বিভিন্ন স্বর্নালংকারে সজ্জিত। কিন্তু এই কাল্পনিক দেবতার বাস্তবিক ভিত্তি কতটুকু তা আমাদের অবশ্যই বিচার করা প্রয়োজন।

দেবতা কে? নিরক্তে দেব শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। "দেবো দানদ বা, দীপনাদ্ বা, দৌতনাদ বা, দ্যুস্থানো ভবতীতি বা; নিঃ ৭।১৫অর্থাৎ দেবের লক্ষন হচ্ছে দান। সবার হিতার্থে যে দান করে সে দেব। দেবের গুণ হচ্ছে দীপন অর্থাৎ প্রকাশ করা। সূর্য,চন্দ্র, অগ্নি প্রকাশ করে বলে তাদের দেব বলা হয়। দেবের কর্ম হচ্ছে দৌতন অর্থাৎ সত্যপদেশ করা। অর্থাৎ যে মানুষ সত্য মানে, সত্য বলে এবং সত্য উপদেশ দান করে সে দেব। দেবের বিশেষতা হচ্ছে দ্যুস্খান অর্থাৎ উপরে স্থিতি লাভ। ব্রহ্মাণ্ডের উপরে স্থিতি লাভ করার জন্য সূর্যকে, সমাজের উপর স্থিতি লাভ করার জন্য বিদ্যান কে এবং রাষ্টের উপর স্থিতি লাভ করার জন্য রাজা কে দেব বলে।

এখন প্রশ্ন যে, এই দেব কত জন? পবিত্র বেদে স্পষ্ট রূপে উল্লেখ আছে যে, দেব তেত্রিশ জন।

যস্য ত্রয়স্ত্রিংশদ্ দেবা নিধিং রক্ষন্তি সর্বদা।
নিধিং তমদ্য কো বেদ যং দেবা অভিরক্ষথ।।
(অথর্ববেদ ১০।৭।২৩)

যেই [পরমেশ্বরের]  সংসার কে তেত্রিশ দেব সর্বদা রক্ষা করছে।  সেই সংসার কে আজ কে জানতে পারে,  যাকে হে দেব! তুমি সর্বদা রক্ষাকারী হও।

বৈদিক সংস্কৃতিতে "কোটি" শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রকারঅর্থাৎ বিশ্বের মধ্যে দেব হচ্ছে তেত্রিশ প্রকার তেত্রিশ কোটি নয়। তেত্রিশ কোটি দেবতার কল্পনা মিথ্যা এবং ভ্রামক।

এই তেত্রিশ প্রকার দেবতা কে কে?

" অষ্টৌ বসব একাদশ রুদ্রা দ্বাদশদিত্যাস্ত একত্রিংশদিন্দ্রশ্চৈব প্রজাপতিশ্চ ত্রয়ত্রিংশা চিতি"
(বৃহঃ উপঃ ৩।৯।২)

অর্থাৎ অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য এই কয় জন মিলিয়া একত্রিশ এবং ইন্দ্র ও প্রজাপতি মিলিয়া তেত্রিশ দেব।

★ অষ্ট বসুঃ (অগ্নিশ্চ পৃথিবীশ্চ বায়শ্চান্তিরিক্ষং চাদিত্যশ্চ দ্যৌশ্চ চন্দ্রমাশ্চ নক্ষত্রাণি চৈত্রে বসব ;
বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৩। )

অর্থাৎ অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরিক্ষ, আদিত্য, দ্যুলোক, চন্দ্র, নক্ষত্রপুন্জ ইহারা অষ্ট বসু। কারন নিখিল পদার্থ ইহাদের মধ্যে নিহিত আছে সেই জন্য এদের নাম বসু।

★ একাদশ রুদ্রঃ (দশমে পুরুষো প্রাণা আত্মৈকাদশন্তে ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৪)

অর্থাৎ পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ এবং জীবাত্মা মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায় বলিয়া রুদ্র বলা হয়। এগুলো হচ্ছে -
পঞ্চ প্রাণঃ প্রাণ, উদান,সমান, ব্যান, অপান।
উপ প্রাণঃ নাগ, কুর্ম, কৃকল, দেব, ধনন্জয়।
এবং জীবাত্মা।

★ দ্বাদশ আদিত্যঃ (দ্বাদশ বৈ মাসা ; বৃহঃ উপঃ ৩।৯।৬)
সম্বৎসরে বার মাস আছে ইহারাই আদিত্য। কারন ইহারা এই সমস্তকে আদান করিয়া যান। যেহেতু এই সমস্ত কে আদান করিয়া যান অতএব তাহারা আদিত্য। দ্বাদশ আদিত্য হচ্ছে -
চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঁঢ়, শ্রাবন, ভাদ্রপদ, আশ্বিন, কার্ত্তিক, মার্গশীর্ষ, পৌষ, মাঘ এবং ফাল্গুন।

★ ইন্দ্রঃ (স্তনযিত্নুরেবেন্দ্রো ; বৃহঃ উপঃ ৬।১।৬) অর্থাৎ বিদ্যুৎ হচ্ছে ইন্দ্র । কারন ইহা ঐশ্বর্যের সাধন গতি শক্তি, প্রকাশ, সমৃদ্ধি এবং সুখের সাধন প্রাপ্ত হয়।

★ প্রজাপতিঃ (যজ্ঞঃ প্রজাপতিরিতি ; বৃহঃ উপঃ ৬।১।৬) যজ্ঞ হচ্ছে প্রজাপতি। কারন ইহার দ্বারা বর্ষা হয়, প্রাণীদের সুখ মিলে। গীতা ৩।১৪ মধ্যে বলা হয়েছে - প্রাণী অন্ন থেকে, অন্ন বৃষ্টি থেকে এবং বৃষ্টি যজ্ঞ দ্বারা উৎপন্ন হয়। এই প্রকার ইহা প্রাণীদের জীবন ও সুখের আধার।

বেদের উল্লেখিত দেবতাগুলো কি?

বেদের প্রত্যেকটি মন্ত্রেরই এক বা একাধিক দেবতা রয়েছে।পবিত্র বেদ সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব থাকায় আমরা অধিকাংশ মানুষ মনে করে এগুলো হল মানুষ আকৃতির বিভিন্ন দেবতা যাদেরকে ওই মন্ত্রটিতে স্তুতি করা হয়েছে। অথচ এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের ঘোষনা দেয়া পবিত্র বেদে এরকম কোন দেবতা ই নেই।তাহলে প্রত্যেকটি মন্ত্রের সাথে উল্লেখিত এই দেবতাগুলো কি?

 আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে পবিত্র বেদের অধ্যয়সূচী(Index) যাতে প্রত্যেকটি মন্ত্রের অধ্যয়,সেই মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষি এবাং সেই মন্ত্রের দেবতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে তাকে বলা হয় অনুক্রমনি।এরকম বেশ কয়েকটি অনুক্রমনির মধ্যে ঋষি কাত্যায়ন এর সর্বানুক্রমনি সবচেয়ে খ্যতনামা বলে বিবেচিত।এই সর্বানুক্রমনিতে ঋষি কাত্যায়ন মন্ত্রের দেবতা কি তার ব্যখ্যায় বলেছেন- "যা তেন উচ্চতে সা দেবতা" অর্থাত্ মন্ত্রের যে বিষয়বস্তু অর্থাত্ যা নিয়ে মন্ত্রে কথা বলা হয়েছে তাই ওই মন্ত্রের দেবতা। মহর্ষি যস্কাযার্চ লিখিত বৈদিক শব্দকোষ ও ব্যকরন গ্রন্থ নিরুক্ত সাংহিতায় বলা হয়েছে- "যত্কাম ঋষির্যেস্যাং দেবতাযামার্থপত্যম্ ইচ্ছত্ স্তুতিং প্রযুক্তেতম্ দেবতঃ স মন্ত্রো ভবতি।।" অর্থাত্ যখন ঈশ্বর কোন একটি বিষয়ের সম্বন্ধে আমাদের মন্ত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দেন তখন মন্ত্রের সেই বিষয়টিকে দেবতা বলা হয়। উদাহরনস্বরুপ ঋগ্বেদ ১০.১৫১ এর দেবতা হল 'শ্রদ্ধা' এবং এই সুক্তের আলোচ্য বিষয় হল ঈশ্বর ও গুরুজনে শ্রদ্ধা বা সম্মান। ঋগ্বেদ ১০.১১৭ এর দেবতা হল 'ধনদানপ্রশাংসা' এবাং এই সুক্তের মন্ত্রসমূহের আলোচ্য বিষয় হল গরীবদুঃখীদের দানে উত্সাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। ঋগ্বেদ ১০.১৪৬ এর দেবতা হল 'দ্যুতনিন্দা' এবং তাই এর আলোচ্য বিষয়বস্তু হল জুয়াখেলার অপকারিতা ও নিষিদ্ধতা। ঋগ্বেদ এর প্রথম মন্ডলের প্রথম সুক্তের দেবতা হল 'অগ্নি'। আজ ম্যাক্সমুলার সহ বিদেশী মিশনারীদের অপপ্রচারের কারনে একে সবাই নির্দিষ্ট আকৃতিযুক্ত আলাদা একটি দেবতা মনে করে যদিও তা সম্পূর্ন ভূল।

উপযোগের দেব -

এই তেত্রিশ প্রকার দেব এর মধ্যে কেবল জীবাত্মা চেতন। ইহা অন্যের উপযোগ করে অথবা স্বয়ং অন্য জীবাত্মার উপযোগে আসে। যেমন গাভী দুধ দিয়ে, ভেড়া ঊণ দিয়ে, ষাড় হাল চাষের উপযোগে আসে। তেমনি সৈনিক, বৈদ্য আদি উপযোগে আসে এবং স্বামী, রাজা আদি উপযোগ নেয়। জীবাত্মার অতিরিক্ত শেষ বত্রিশ দেব জড় এবং উপযোগের দেব বলা হয়।

ব্যবহারের দেব -

মাতা, পিতা,আচার্য, অতিথি এবং পতি-পত্নি দ্বারা সংসারের ব্যবহার সিদ্ধ হয়। এ জন্য এই পাঁচ কে ব্যবহারের দেব বলা হয়।

★ প্রথম দেবতা মাতাঃ 

মাতার স্থান ঈশ্বরের পরেই তিনি জাগ্রত মূতিমতি দেবী ।সন্তান কর্তব্য হলো মাকে শ্রদ্ধা, ভক্তি, সন্মান,সেবা ও পূজা করা। মা দুঃখ-কষ্টপান এমন কাজ করা কোন সন্তানের কতর্ব্য নয়।
এ জন্য অথর্ববেদে বলা হয়েছে " মা হিংসষ্ট পিতরং মাতরং চ (অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)" অর্থাৎ পিতা মাতাকে কখনো হিংসা করো না।

★ দ্বিতীয় দেবতা পিতাঃ

পিতা আমাদের সর্বদা রক্ষা করেন। তাই সন্তানের কর্তব্য মাতার সমান পিতাকেও সেবা করা। পিতাকে কখনো কষ্ট দেওয়া উচিৎ নয়। 
যজুর্বেদ এ জন্য বলছে " মা নো বধীঃ পিতরং মাতরং যজু১৬।১৫" অর্থাৎ পিতা মাতাকে কখনো বধ করো না,  তাদের তাড়না দিও না।

★ তৃতীয় দেবতা আচার্য্যঃ 

আচার্য্য  অর্থাৎ যিনি বিদ্যাদাতা তাকে কায় মন বাক্য দ্বারা সেবা করা উচিৎ। কারন তিনি আমাদের  বিকশিত শরীর মন ও উন্নত মস্তিস্কবানরূপে প্রস্তুত করেন।
 অথর্ববেদে বলা হয়েছে - "আচার্য্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিনং কৃণুতে গর্ভমন্ত (অথর্ববেদ ১১।৫।৩) অর্থাৎ আচার্য ব্রহ্মচারীকে উপনয়ন সংস্কার করে নিজের সমীপে রেখে তাহার মধ্যে বিদ্যা গর্ভরূপে স্থাপন করেন। 

★চতুর্থ দেবতা অতিথিঃ

একজন গৃহস্থ  ব্রাত্য অর্থাৎ সত্যব্রতধারী, ধার্মিক, অকপকট অতিথিকে সৎকার করবে।
অথর্ববেদে বলা হয়েছে " ব্রাত্যোহপরিমিতা রাত্রীরতিথির্গৃহে বসতি.....তেনাব রুন্ধে (অথর্ববেদ ১৫।১৩।৯) অর্থাৎ অতিথি  বহু রাত্রী গৃহ মধ্যে অবস্থান করলে তাকে সৎকার দ্বারা গৃহস্থ  সুরক্ষিত করবে। 

★পঞ্চম দেবতা পতিপত্নিঃ

অর্থাৎ স্ত্রীর পক্ষে পতি এবং পতির পক্ষে স্বপত্নী।  অর্থাৎ স্বামী তার স্ত্রীকে শ্রদ্ধা করবেন।  এবং স্ত্রীও তার  স্বামীকে শ্রদ্ধা করবেন

"পূজ্যা ভুষয়িত ব্যাশ্চ বহু কল্যাণমীপসুভীঃমনুঃ ৩।৫৫"  অর্থাৎ শুধু  পতিই স্ত্রীকে পূজা করবেন এমন নয়।  কি  ভ্রাতা,  পিতা,  দেবর সবাই ইহাকে ভোজনাদি দ্বারা পূজা করবেন এবং বস্ত্রালংকার দ্বারা ভূষিত করবেন। 
এবং স্ত্রীও পতিকে দেবতাজ্ঞানে সেবা করবেন - " উপচর্যঃ স্ত্রীয়া সাধ্ব্যা সততং দেবব পতিম্। মনুঃ ৫।১৫৪"

এই পাঁচজন বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ দেব-দেবী। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও আমরা এইরূপ দেবতাদেরকেই দেখতে পাই এবং তাদের পূজনের কথা পাই। "মাতৃ দেবো ভব, পিতৃ দেবো ভব, আচার্য দেবো ভব, অতিথি দেবো ভব।" তৈত্তিরীয়_উপনিষদ্ ১।১১।২" 

 তাহলে কি সমস্ত মানুষ ই দেব হয়ে যায়? না, দেব হচ্ছে বহু বিশেষন যুক্ত। একজন মাতা যদি নিজ পুত্রের পক্ষপাত করে অন্যের সাথে বিবাদ করে। তখন সে মাতা দেব এর সঙ্গার মধ্যে পড়ে না। দেব হবে সেই যার মধ্যে উত্তম গুনাবলী তথা বিভিন্ন দৈবী সম্পদ রয়েছে।

উপরের বর্ণিত যে তেত্রিশ প্রকার দেবের বর্ণনা করা হলো। ইহাদের হইতে সুখ যেমন মিলে তেমনি দুঃখ ও মিলে। অগ্নি দেব কিন্তু অনেক সময় সবকিছু জ্বালিয়ে দেয়, অতিথী দেব কিন্তু পরবর্তিতে শত্রু ও হতে পারে। রাজা দেব কিন্তু কুপিত হয়ে দুঃখদায়ী হতে পারে। এই কারনে ইহা সদুপযোগ এবং সৎকারের মর্যাদা দ্বারা বাধে। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী এর সদুপযোগ করা মর্যাদা। মাতা, পিতা আচার্য এবং অতিথির সেবা করা ধর্ম। পূর্বজ মহাপুরুষের পথ অনুসরন, সংবিধান পালন এবং দেশের রক্ষা করা মানুষের কর্তব্য। কিন্তু এরা কোন উপাস্য দেব নয়। উপাস্য দেব কেবল পরমাত্মা, কারন পরমাত্মাই সবার ইষ্ট দেব। এই সৃষ্টির সব কাল এবং পরিস্খিতির মধ্যে পূর্ণতম দেব এক এবং সেই পরমাত্মা। সেই জন্য পবিত্র বেদ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন -

" হে মিত্র! পরমাত্মা ভিন্ন অন্য কাহারো স্তবন করো না এবং দুঃখী হয়ো না। এই উৎপন্ন জগতের সাথে মিলে সেই শক্তিশালী শত্রুর নাশকারী প্রভূর স্তুতি করো এবং বারংবার উক্ত স্তোত্রের স্তবন করো (অথর্ববেদ ২০।৮৫।১)"
অর্থাৎ আমাদের শুধু সেই এক পরমাত্মার উপাসনা করা উচিৎ।