বেদ বিষয়ে এক ভ্রান্তি প্রচলিত যে, বেদে জাদু টোনা আদি অন্ধবিশ্বাসের বর্ণনা রয়েছে। ইহার মূখ্য কারন সায়ন আদি দ্বারা বেদের কিছু প্রকরনে জাদু টোনার বর্ণনা। বিদেশী লেখক দ্বারাও এই মান্যতার সমর্থন দেখতে পাওয়া যায়। অনেক ভারতীয় লেখকদেরও এই মান্যতান সমর্থন রয়েছে।
বৈদিক বিদ্বান শ্রী প্রিয়রত্ন আর্য অনুসারে জাদু শব্দ বেদের "যাতু" শব্দের রূপান্তর যা অপভ্রংশ। "যাতু" শব্দের অর্থ নিঘন্টু ২।১৯ অনুসারে "হিংসা"।
অথর্বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে শারীরিক, মানসিক রোগের উপাচার, শরীরের মধ্যে বিভিন্ন রোগ দূর করে স্বাস্থ এবং উত্তম গুনকে গ্রহন করার জন্য সন্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই মন্ত্র গুলোর মূল সন্দেশ না বোঝার কারনে এই ভ্রান্তির উদ্ভব হয়েছে -
আমরা অথর্বেদের কিছু সুক্ত এবং মন্ত্রের উপর বিচার করে দেখবো যে, বেদে জাদু টোনা বা অশ্লিতার বর্ণনা নেই।
অর্থর্বেদের অনেক সুক্তে "মণি" শব্দের প্রয়োগ রযেছে। সায়ন আদি ভাষ্যকার "মণি" শব্দের অর্থ এরূপ করেছে যে - যা শরীরে বেধে উক্ত মন্ত্র পাঠ করলে অভিষ্ট ফল প্রাপ্ত হওয়া যায়। কিছু মনি সুক্ত এই প্রকার -
(i) পর্ণমণি - অথর্ববেদ ৩।৫ সুক্তের অর্থ করে সায়ন আদি লিখেছে - যে ব্যক্তি তেজ, বল, আয়ু এবং ধন আদিকে প্রাপ্ত করতে চায় সে পর্ণ অর্থাৎ পলাশ বৃক্ষের তৈরী মণিকে ত্রয়োদশীর দিনে দই এবং মধুর মধ্যে ভিজিয়ে তিন দিন রেখে চতুর্থ দিনে সেই মণিকে এই সুক্তের মন্ত্র পাঠ করে বেধে রাখবে সেই দই এবং মধুগুলো গ্রহন করবে। সায়ন আরো লিখেছে - যদি কোন রাজার রাজ্য হারায় তো কাম্পীল নামক বৃক্ষের শাখা দ্বারা অন্ন পাক করে সাথে মন্ত্রের পাঠ করে গ্রহন করে তো সেই রাজ্য প্রাপ্ত হবে।
যদি এমনই হতো তবে লোকজন কদাপি পরাধীন থাকতো না। জাদু টোনা করে নিজেকে স্বতন্ত্র করে নিতো। শতপথ ব্রাহ্মণ ৬।৫।৫।১ এ সোমকে পর্ণ বলা হয়েছে "সোম বৈ পর্ণ"। তথা তৈত্তেরীয় ব্রাহ্মণ ১।২।১।৬ এ "সোমপর্ণা " বলা হয়েছে। এই আধারে পর্ণমণিকে সোমমণিও বলা হয়। বেদে "সোম" দিব্যপোষক রসের রূপে প্রসিদ্ধ। তাছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪।১।৩।১২ অনুসারে "রাজা বৈ সোম" রাজাকে সোম বলা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষাত্রবৃত্তির সাথে সাথে যে তেজ প্রাপ্ত হয় যে রাজার তেজ বা বল দ্বারা প্রাপ্ত হয় তাহাই পর্ণমণি। এই সুক্তের প্রত্যেক মন্ত্রে পর্ণমনি বা পালক মাত্র বলের ভিন্ন ভিন্ন রূপে দর্শানো হয়েছে। ফলত - এই পর্ণমনি অধিকার বা অধিকারসূচক পদ যা তার চিহ্নভূত পদার্থ যাহার ধারন করে রাজা অধিকার প্রাপ্ত হয়। ইহা এক পদক বা পদসূচক চিহ্নমাত্র। এই পদক দ্বারা রাজা যেসব অধিকার প্রাপ্ত হয় সেগুলো হচ্ছে - রাজ্যে শত্রুর উপর দন্ড বা নাশ করার অধিকার প্রাপ্ত করেন। প্রজার পালন পোষন করা এবং প্রজার স্বাস্থের বন্ধোবস্ত করেন। শিল্পি কারীগরি এবং বিদ্বান অধ্যাপক কে স্খির করেন। পুরোহিত , রথবাহক, গ্রামাধিপধিকে স্থির করেন।নিজ শরীর রক্ষার জন্য অঙ্গরক্ষক নিযুক্ত করেন। এই অধিকার কে প্রাপ্ত করা এবং সেগুলোর সামর্থ পুরুষকে স্থির করা দুইই মন্ত্রের মধ্যে সূচিত হয়েছে। এই প্রকার এই সুক্তে পর্ণমণিকে এরূপ কাব্যময় শৈলীর মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। জাদু টোনার উপর কোন নিশান নেই।
(ii) জাংগিডমণি - অথর্বেদ ২।৪ সুক্ত তথা ১৯।৩৪-৩৫ সুক্তে জাংগিডমণির মহিমা বর্ননা করে সায়ন লিখেছে - যে ব্যক্তি কৃত্যা (হিংসা) থেকে বাঁচতে চায় নিজের রক্ষা চায় তথা বিঘ্ন থেকে শান্তি চায় সে জাংগিড পেড় দ্বারা বিশেষ প্রকার মণি প্রস্তুত করে উক্ত সুক্ত পাঠ করে বেধে নিলে তাহার মনের কামনা পূর্ণ হয়।
অথর্ববেদের উক্ত সুক্ত গুলো বিশ্লেষন করলে দেখা যায় জাংগিড কোন প্রকার মনি নয় যাকে বাঁধলে হিংসা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। বরং ইহা এক ঔষধি যা ভূমি থেকে উৎপন্ন বনস্পতি এবং রোগের নিবারন করে। অঃ ১৯।৩৪।৯ এ জাংগিড রোগ নিবারন কারী। অঃ ১৯।৩৫।১, অঃ ১৯।৩৫।৫, অঃ ২।৪।৩ এই মন্ত্রগুলতো কৃমিরূপ (microbes) কীটের নাশক। অর্থাৎ এসব মন্ত্রে জাদু টোনা নেই বরং আয়ুর্বেদের বর্ণনা রয়েছে।
(iii) শঙ্খমণি - অথর্ববেদ ৪।১০ সুক্তে শঙ্খমণির বর্ণনা এসেছে। সায়নের অনুসারে উপনয়ন সংস্কারের পর বালকের দীর্ঘ আযুর জন্য শঙ্খ কে এই সুক্তের মন্ত্রের সাথে বেধে দিলে তার ডুবে মরার ভয় থাকে না
সায়নের অনুসারে যদি এমনটাই হয় তাহলে কোন শিশু আর জলে ডুবে মরবে না। মূলত এ সুক্তে শঙ্খ শব্দে পরমেশ্বরকে বুঝানো হয়েছে। যিনি আমাদের মৃত্যু ভয় থেকে রক্ষা করেন। শঙ্খ = শমেঃ খঃ। শম আলোচনে = বিবেচনে। শমো দর্শনে। শমু উঁপশম, শান্তিকরনে খ প্রত্যয়। অর্থাৎ সবার বিচারকর্তা, দর্শনকারী, শান্তিদায়ক পরমেশ্বর। কারন সেই সুখস্বরূপ পরমেশ্বরই আমাদের রোগ তথা দুষ্কর্ম থেকে রক্ষা করতে পারেন।
(iv) শতবার মণি - অথর্ববেদ ১৯।৩৬ সুক্তের ভাষ্যের সায়ন লিখেছে - যেই ব্যক্তির সন্তান মারা গিয়েছে এবং এই প্রকার কুলের ক্ষয় হয়েছে, সে এই সুক্তের মন্ত্র পড়ে শতবার মণি বেধে নিলে তার এই সংকট দূর হবে।
শতবার মণি কোন জাদু টোনার বস্তু নয় বরং এক ঔষধি যার দ্বারা শরীরের বল বৃদ্ধি এবং রোগের নাশ হয়। উপরের পঙ্কিগুলোতে চার প্রকার মণি সমন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোতে কোন জাদু টোনার উল্লেখ নেই। চার গুনকারী ভেষজ ঔষধের বর্ণনা রযেছে । যার দ্বারা রোহের নিবারন এবং বহু উপযোগী হবার কারনে মনি বলা হয়েছে।
(v) কৃত্যা ও অভিচার - অর্থবেদের বহু স্থলে (১৯।৩৪।৪, ২।৪।৬, ৪।৫।২) কৃত্যা ও অভিচারের প্রয়োগের বর্ণনা পাওয়া যায়। সায়নের অনুসারে অভিচার শব্দের অর্থ কোন শত্রকে পীড়া দেবার জন্য তাকে রোগী বানানোর জন্য অথবা তার মৃত্যুর জন্য কোন বিশেষ হবন অথবা কর্মকান্ড করা। কৃত্যার অর্থ ঐ উক্ত অনুষ্ঠান দ্বারা কাউকে হিংসা করে মেরে ফেলা।
মূলত অভিচারের অর্থ হচ্ছে বিরোধী দ্বারা শস্ত্রের প্রহার অথবা আক্রমন তথা কৃত্যার অর্থ সেই প্রহার দ্বারা ক্ষত। মণি সুক্তের ঔষধি সেই ক্ষতের পীড়া দূর করে। ইহাই মূলত মন্ত্রের মূল সন্দেশ।
এই প্রকার যেখানে বেদের মধ্যে মণি আদির উল্লেখ। সেখানে কোন প্রকার জাদু টোনার সাথে সমন্ধ নেই। আয়ুর্বেদের সাথে অথর্ববেদের সমন্ধ রেখে বিভিন্ন ঔষধিকে যদি দেখা যায় তো মণি শব্দের দ্বারা ঔষধির অর্থ স্পষ্ট হয়ে যায়।
যদি কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে স্বয়ং রূপে দেখা যায় তো বেদ মন্ত্রে অনেক সুন্দর এবং জীবন উপযোগী শিক্ষা দেখতে পাওয়া যাবে। এবং বেদের মধ্যে জাদু টোনার মিথ্যা ভ্রম দূর হবে।
0 মন্তব্য(গুলি)