https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

অসম্ভূতি ও সম্ভূতি এর উপর সমীক্ষা

Thursday, April 20, 2017
যজুর্বেদ ৪০ অধ্যায়ের ৯ - ১১ (ঈশোপনিষদ ১২-১৪ ) মন্ত্রে  সম্ভূতি অসম্ভূতি বিষয় নিয়ে এক ভ্রান্তির উদয় হয়েছে।  বিষয় টি এরূপ যে,  ৯ম মন্ত্রে সম্ভূতি অসম্ভূতির ফল অন্ধকার বর্ণনা করে আবার ১১ মন্ত্রে তদ্দ্বারা মৃত্যু জয় এবং মোক্ষপ্রাপ্তির বর্ণনা করা হয়েছে। যা দেখে পাঠকগণের মনে ভ্রান্তির উদয়  হয় যে বেদে এরূপ পরস্পর বিরোধী উক্তি কিভাবে সম্ভব? এ ভ্রান্তির  মূল কারণ বেদ নয় বরং ভাষ্যকারদের  বিক্ষিপ্ত ভাষ্য যা পাঠকগণকে ভ্রমিত করেছে। এ ভ্রান্তি সমাধানের জন্য  আমরা   মন্ত্র ত্রয়ের যথার্থ অনুবাদ,  ভাবার্থ এবং এর উপর সমীক্ষা করে দেখবো -

অন্ধতমঃ প্র বিশন্তি যেসম্ভূতিমুপাসতে।
ততো ভূয়ইব তে তমো যউ সম্ভুতাংরতাঃ।।৯

সরলার্থঃ ঘোর অন্ধকারে প্রবেশ করে যে অনাদি প্রকৃতিকে উপাসনা করে। তাহার থেকেও অধিকতর ঐ অন্ধকারে প্রবেশ করে যে বিতর্কের সহিত  প্রকৃতির কার্য মধ্যে রত থাকে।।                                                                                                              
ভাবার্থঃ  কোন মনুষ্য ঘোর অন্ধকার কে প্রাপ্ত হয় - যে মনুষ্য পরমেশ্বর কে ছেড়ে অসম্ভূতি অর্থাৎ অনাদি, অনুৎপন্ন,  প্রকৃতি নামক সত্ব, রজ, তমগুনাত্মক জড়বস্তু কে উপাস্য মানে,  সে ঘোর অন্ধকার প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাকে প্রাপ্ত হয়ে সদা দুঃখী থাকে। এবং যে সম্ভূতি অর্থাৎ সেই কারন প্রকৃতি দ্বারা উৎপন্ন,  মহদাদি স্বরূপ মধ্যে পরিণত হয়ে সৃষ্টি অর্থাৎ পৃথিবী আদি স্থুল জগত কার্য কারন রূপ সূক্ষ্ম অনিত্য সংযোগজন্ম কার্য জগৎ কে উপাস্য মানে।  এবং তাহার মধ্যে রমন
করে সে তাহা থেকেও অধিক গাঢ় অবিদ্যা অন্ধকার কে প্রাপ্ত হয়ে দুঃখী হন। অতঃ সব মনুষ্যের উচিৎ সচ্চিদানন্দ স্বরূপ পরমাত্মাকে সদা উপাসনা করা।।৯।।

 অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্য দাহুরসম্ভবাত্।
 ইতি শুশ্রম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।।১০।।

সরলার্থঃ কার্য জগতের দ্বারা অন্যই ফল ইহা বলেন এবং প্রকৃতি দ্বারা অন্য ফল ইহা বলেন। ইহা ধীর পুরুষের থেকে আমরা শুনেছি, যে বিদ্বান পুরুষ আমাদের জন্য সেই তত্বের বিশেষরূপে ব্যাখ্যা করেছেন।।১০।।

ভাবার্থঃ মনুষ্যের উচিত যে -বিদ্বান মনুষ্য ধীর অর্থাৎ মেধাবী বিদ্বান যোগী জন দ্বারা যে সম্ভূতি বিষয়ক বচন শ্রবণ করে তার বিবেচনা করে সব মনুষ্যকে বোঝাবে। সম্ভব (সম্ভূতি)  অর্থাৎ সংযোগ দ্বারা উৎপন্ন কার্য জগৎ দ্বারা উক্ত বিদ্বান অন্য ফল বলবে। এবং অসম্ভব (অসম্ভূতি) অর্থাৎ অনুৎপন্ন কারন জগৎ  দ্বারা  অন্য ফল বলবে। উক্ত বিদ্বান মনুষ্য সম্ভব (কার্যবস্তু)  অসম্ভব (কারন বস্তু) দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন বক্ষমান উপকার গ্রহন করে এবং করায়।  কার্য বস্তু এবং কারন বস্তুর গুন কে স্বয়ং  মেনে তাহার উপদেশ করবে। অতঃএব সব মনুষ্য কার্য এবং কারন বস্তুকে জানো।।১০।।

সম্ভুতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদেভয়ং সহ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যামৃতমশ্নুতে।।১১।।

সরলার্থঃ কার্য জগৎ কে এবং সুক্ষ্ম কারন জগৎ কে এই উভয় কে যে একসাথে জানে।  সে সুক্ষ্ম কারন জগৎ দ্বারা মৃত্যু ভয়কে উত্তীর্ণ করে এবং কার্য জগৎ দ্বারা মোক্ষ কে প্রাপ্ত হয়।।১১।।

ভাবার্থঃ মানুষ কার্য এবং কারন দ্বারা কি সিদ্ধ করে - কার্য (সৃষ্টি) কারন (প্রকৃতি) নামক বস্তু নিরর্থক নয়। বিদ্বান মনুষ্য সম্ভূতি অর্থাৎ কার্য নামক সৃষ্টি এবং তার গুন, কর্ম, স্বভাব এবং বিনাশ (অসম্ভূতি) অর্থাৎ  যাহার মধ্যে সব পদার্থ বিনষ্ট অর্থাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়,  সেই কারন রূপ প্রকৃতি এবং তার গুন কর্ম স্বভাব কে জানে। বিনাশ (অসম্ভূতি) নিত্য প্রকৃতি কে জেনে মৃত্যু অর্থাৎ শরীরের বিয়োগ দ্বারা উৎপন্ন দুঃখকে পার করে।  সম্ভূতি অর্থাৎ শরীর ইন্দ্রীয় এবং অন্তকরনরূপ উৎপন্ন কার্যজগত তথা ধর্ম মধ্যে প্রযত্নকারী সৃষ্টিকে জেনে ইহার সদুপযোগ করে মোক্ষের ফল প্রাপ্ত করে। এই দুই প্রকার কারন বস্তু দ্বারা মৃত্যু ভয় কে ত্যাগ এবং কার্য বস্তু দ্বারা মোক্ষের ফল সিদ্ধিরূপ ভিন্ন ভিন্ন ফল কে প্রাপ্ত করে। কারন এবং কার্য বস্তু পরমেশ্বরের স্থানে উপাসনা করা নিষেধ পরন্ত ইহার উপযোগ নেওয়াতে  নিষেধ নয়।।১১।।

উপরোক্ত মন্ত্র ত্রয়ে সম্ভূতি এবং অসম্ভূতির উপযোগ কে বোঝানো হয়েছে। ইহার মধ্যে প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, অসম্ভূতির উপাসনা করে সে ঘোর অন্ধকারে প্রবিষ্ট হয় এবং যে মনুষ্য অসম্ভূতি মধ্যে রত সে তাহা থেকেও অধিক ঘোর অন্ধকারে প্রবিষ্ট হয়। এবং দ্বিতীয় মন্ত্রে বলা হয়েছ যে, মেধাবী বিদ্বান যোগী জন আমাদের জন্য সম্ভূতি এবং অসম্ভূতির উপদেশ করেছেন, এইরূপ আমরা শুনেছি যে,সম্ভূতির ফল ভিন্ন এবং অসম্ভূতির ফল ভিন্ন। এবং তৃতীয় মন্ত্রে সম্ভূতি এবং অসম্ভূতিকে সাথে সাথে জেনে নেয়, তিনি অসম্ভূতি দ্বারা মৃত্যুর ভয় কে পার করে। এই প্রকার এই মন্ত্রে সম্ভূতি এবং অসম্ভূতির ফলের বর্ণনা করা হয়েছে।

এখন এখানে প্রশ্ন উৎপন্ন হয় যে, অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি কি বস্তু? ভাষ্যকারগণ ইহার যে ব্যাখ্যা করেছে, তার মধ্যে পর্যাপ্ত ভিন্নতা রয়েছে। মহর্ষি দয়ানন্দের ভাষ্য অনুসারে সম্ভূতির অর্থ প্রকৃতি, যা কখনো না উৎপন্ন হবার কারনে অনাদি। ইহা জড় বস্তু। এই প্রকৃতি দ্বারা যে মহত্তত্বাদি উৎপন্ন হয় তাকে সম্ভূতি বলেএই মহত্তত্বাদি প্রকৃতি থেকে সম্ভূত= উৎপন্ন হবার কারণেই সম্ভূতি বলা হয়।

 উক্ত অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি আত্মার জন্য কিরূপ উপযোগ , তাহা প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে যে অসম্ভূতি = প্রকৃতির উপাসনা করে, সে ঘোর অন্ধকারে প্রবিষ্ট হয়, অর্থাৎ সে অবিদ্যাগ্রস্ত হওয়ার দ্বারা সদা দুঃখী হয়ে থাকে।আর যে সম্ভূতি= প্রকৃতির কার্য পৃথিবী আদি জড় বস্তুতে লেগে থাকে সে তাহা থেকেও ঘোর অন্ধকারে প্রবেশ করে। অতঃএব আত্মার জন্য অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি দুইই উপাসনীয় বস্তু নয়। কিন্তু এক চেতন পরমাত্মাই উপাসনার যোগ্য।

 দ্বিতীয় মন্ত্রে অসম্ভূতি এবং সম্ভূতির ভিন্ন ভিন্ন ফল বলে তার উপযোগ বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় মন্ত্রে তাহার ফল বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি আত্মার জন্য উপাসনীয় নয়, কিন্তু অত্যন্ত উপযোগী।আত্মা কে এই দুই এর সাথে সাথে জ্ঞান প্রাপ্তি করে ইহার উপযোগ নেওয়া উচিৎ। তৃতীয় মন্ত্রে অসম্ভূতির স্থলে " বিনাশ " শব্দের পাঠ রয়েছে। কারণ সব উৎপন্ন পদার্থ প্রলয়ে প্রকৃতির মধ্যে বিনাশ = লয় প্রাপ্ত হয়। যে এই বিনাশের বিজ্ঞান অর্থাৎ সৃষ্টির কারন কার্য ভাব কে জেনে নেয়। তিনি অবিদ্যাদি কলুষ থেকে বাঁচার কারণে মৃত্যু কে পার করে যায়। এবং সম্ভূতি= প্রকৃতির কার্যপদার্থের আত্মা বিদ্বান কে সংগতি মধ্যে অবস্থান করে বেদোক্তবিধি দ্বারা ঠিক ঠিক উপযোগ করে তো তিনি অমৃত= মোক্ষ কে প্রাপ্ত করে।

এই তিন মন্ত্র দ্বারা স্পষ্ট যে অসম্ভূতি আত্মার জন্য উপাসনীয় বস্তু নয়, কিন্তু উপযোগী অবশ্যই।

শ্রী শঙ্করাচার্য জী এই মন্ত্রের বিপরীত করেছেন। এই মন্ত্রগুলোর মধ্যে প্রথম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় শ্রী শঙ্করাচার্য লিখেছে -  অসম্ভূতিম = সম্ভবনং সম্ভূতিঃ সা যস্য কার্যস্য সা সম্ভূতিঃ তস্যা অন্যা অসম্ভূতিঃ প্রকৃতিঃ কারণম্... সম্ভূত্যাং কার্যব্রহ্মাণি হিরন্যগর্ভাখ্যে।

অর্থাৎ সম্ভবন = উৎপন্ন হওয়ার নাম সম্ভূতি। তিনি যেই কার্যের ধর্ম তাকে সম্ভূতি বলেছেন। তাহা থেকে ভিন্ন কে অসম্ভূতি= প্রকৃতি বা কারণ বলেছেন। সম্ভূতির নাম কার্যব্রহ্ম

এখানে শঙ্করভাষ্যে "অসম্ভূতি"র অর্থ ঠিক করেছেন কিন্তু সম্ভূতির অর্থ পূর্বাগ্রহ বশত কল্পিত করেছেন। যখন "অসম্ভূতি" র অর্থ "সম্ভূতির" অর্থ স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তো তাহার ভিন্নথা কেন? যদি "অসম্ভূতি" র অর্থ প্রকৃতি বা কারণ হয় তবে "সম্ভূতি" র অর্থ প্রকৃতি দ্বারা উৎপন্ন কার্য জগৎ হওয়া উচিত। 

অথবা শঙ্করাচার্যের অনুসারে যদি "সম্ভূতি"র অর্থ "কার্য-ব্রহ্ম" তো অসম্ভূতির অর্থ কারন ব্রহ্ম হওয়া উচিৎ। আর হিরণ্যগর্ভাখ্য কার্য ব্রহ্ম কি বস্তু? এবং অসম্ভূতি= প্রকৃতি কি বস্তু? কারণ অদ্বৈততবাদে তো ব্রহ্ম ভিন্ন তো দ্বিতীয় বস্ত নেই।

এখানে শঙ্কারাচার্য জগতের কারনভূত প্রকৃতির সত্তাকে স্বীকার করেছেন। যখন "স পর্যগাত্" মন্ত্রে ব্রহ্ম কে ব্যাপক সর্ববিধশরীর থেক রহিত, অবিনশ্বরাদি বলা হয়েছে। তখন কারণ ব্রহ্ম থেকে কার্যব্রহ্ম কি করে উৎপন্ন হতে পারে? যখন এই মন্ত্রে স্পষ্টরূপে জড় পদার্থের উপাসনাকে নিষেধ করেছে। তখন এই কার্যব্রহ্ম = হিরণ্যগর্ভের বর্ননা এখানে কিভাবে সম্ভব?

 এবং তৃতীয় মন্ত্রে "অসম্ভূতি" ও "অসম্ভূতি"র ফল বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় মন্ত্রে কথিত ফল কে উপেক্ষা করে শঙ্কর ভাষ্যে লিখেছেন -
" সম্ভূতেঃ কার্যব্রহ্মোপাসনাদ্ অণিমাদৌশ্বর্যলক্ষণং ব্যাখ্যাতবন্ত ইত্যর্থঃ।.. অসম্ভবাদ্ = অসম্ভূতেরব্যাকৃতাদ্ অব্যাকৃতপানাত্। যদুক্তমন্ধন্তমঃ প্রবিশন্তীতি প্রকৃতিলয় ইতি চ পৌরাণিকৈরুচ্যতে।"

অর্থাৎ সম্ভূতি = কার্যব্রহ্ম কে উপাসনা দ্বারা অণিমাদি ঐশ্বর্যরূপ ফল প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং অসম্ভূতি = অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনার দ্বারা, যাকে "অন্ধনন্তমঃ প্রবিশন্তি" এই বাক্য দ্বারা বলা হয়েছে তথা পৌরাণিক তাহাকে প্রকৃতিলয় বলে।

এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাই শ্রী শঙ্করাচার্য জী সম্ভূতি এবং অসম্ভূতি কে উপাসনার ফল অনিমাদি ঐশ্বর্য প্রাপ্তি আদি বর্ণনা করেছেন। যখন ইহার প্রথম মন্ত্রেই সম্ভূতিকে উপাসনাকারী কে ঘোরতম অন্ধকারে প্রবেশ করে বলা হয়েছে। নয়। তখন তার দ্বারা ঐশ্বর্য প্রাপ্তি কিভাবে সম্ভব? আর এই মন্ত্রে "উপাসনা" শব্দই নেই। মন্ত্র মধ্যে যেই উপযোগরূপ ফলের সঙ্কেত করা হয়েছে তার ফল তো আগের মন্ত্রেই বর্ণনা করা হয়েছে। তাহার কি ফল মধ্যে এবংপূর্বক্ত মন্ত্র প্রোক্ত ফলের মধ্যে সমতা রয়েছে? যদি না হয় তবে তাহার ব্যাখ্যা মূল মন্ত্রের বিরুদ্ধ।

 বাস্তবে তৃতীয় মন্ত্রে তাহার উপযোগীতার বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ অসম্ভূতি বিজ্ঞান দ্বারা মৃত্যুকে পার করে। এবং সম্ভূতি বিজ্ঞান দ্বারা মোক্ষ কে প্রাপ্ত করা যায়। এজন্য মন্ত্রে "বেদ= জানা " ক্রিয়া রয়েছে, উপাসনা নয়।

তৃতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যায় শ্রী শঙ্করাচার্য জী লিখলেন - "সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্ বেদোভয়ং সহ বিনাশো ধর্মো যস্য কার্যস্য স তেন ধর্মিনা অভেদন উচ্যতে বিনাশ ইতি, তেন তদুপাসনেনানৈশ্বর্যম-­ধর্মকামাদিদোষজাতং চ মৃত্যুং তীর্ত্বা হিরণ্যগর্ভোপাসনেন হ্যাণিমাদি প্রাপ্তিঃ ফলম্ তেনানৈশ্বর্যাদি মৃত্যুমতীত্য অসম্ভুত্যা অব্যাকৃতোপসনায়া অমৃতং প্রকৃতিলয়লক্ষণমশ্নুতে।।"

অর্থাৎ যে পুরুষ সম্ভূতি এবং বিনাশ এই দুই কে একসাথে জানে, তিনি - যাহার কার্যের ধর্ম বিনাশ এবং সেই ধর্ম দ্বারা অভেদ হওয়ার কারণে যাকে স্বয়ং বিনাশ বলা যায়, সেই বিনাশ কে উপাসনা দ্বারা অনৈশ্বর্য, অধর্ম তথা কামনাদি দোষ দ্বারা উৎপন্ন মৃত্যু কে পার করে।  হিরণ্যগর্ভ (সম্ভূতি) কে উপাসনা দ্বারা অণিমাদি ঐশ্বর্য প্রাপ্তি রূপ ফল মিলে। এবং অসম্ভূতি= অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনা দ্বারা অমৃত = প্রকৃতিলয়ত্ব কে প্রাপ্ত হয়।
এখানে শ্রী শঙ্করাচার্য জী "বিনাশ" পদের অর্থ যথার্থ ব্যাখ্যা করেন নি। নিজে "বিনাশ" এর অর্থ বিনাশ হওয়া কার্য পদার্থ করেছেন। মন্ত্রে কার্য পদার্থের জন্য যখন "সম্ভূতি" পদ যখন পড়া হয়েছে, যাহার বর্ণনা তিনি স্বয়ং " কার্য ব্রহ্ম " অর্থ করেছেন। যদি মন্ত্রে " সম্ভূতি" এবং "বিনাশ" পদের অর্থ একই হয় তবে মন্ত্রে পূণরুক্তি দোষ ঘটবে।

মহর্ষি দয়ানন্দ এই রহস্যকে উত্তমরূপে উন্মোচন করেছেন।  তিনি লিখেছেন - মন্ত্রে " সম্ভূতি"র অর্থ তো "কার্য পদার্থ" কিন্তু "বিনাশ" এর অর্থ কারণরূপ প্রকৃতি। মহর্ষি লিখেছেন - " বিনশ্যন্ত্যদৃশ্যাঃ পদার্থ ভবন্তি যস্মিন " অর্থাৎ যাহার মধ্যে সব কার্য পদার্থ বিনষ্ট = অদৃশ্য হয়ে যায় তাকে বিনাশ= প্রকৃতি বলে। দেখুন কত সুন্দর তথা ব্যকরনসম্মত ব্যাখ্যা।

প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, সম্ভূতি এবং অসম্ভূতির উপাসনা নিষেধ। কিন্তু শঙ্করাচার্য পূনরায় তৃতীয় মন্ত্রে " উপাসনা" শব্দের প্রয়োগ করেছেন। মূলতমন্ত্রে সম্ভূতি তথা অসম্ভূতির বিজ্ঞান কে আত্মার জন্য উপযোগীতা বর্ণনা করা হয়েছে।কারন তৃতীয় মন্ত্রে "উপাসতে" ক্রিয়া নেই বরং "বেদ" জানা ক্রিয়া রয়েছে।অতঃ মন্ত্রে ইহার বিজ্ঞানের নির্দেশ। শঙ্করভাষ্যে বিনাশের বিজ্ঞান এর স্থলে বিনাশোপসনার বর্ননা শুধু কল্পনাই নয়, বরং মূল মন্ত্রের বিরুদ্ধ ।

এই মন্ত্রের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যায় শঙ্করভাষ্যে অসম্ভূতি কে উপাসনার ফল প্রকৃতিলয় রূপ অমৃত প্রাপ্তি বলেছেন। দ্বিতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যায় অন্ধন্তমঃ= ঘোর অন্ধকার মধ্যে প্রবেশ তথা প্রকৃতিলয় কে স্বয়ং মেনেছেন আর তৃতীয় মন্ত্রে প্রকৃতিলয় কে অমৃত করে দিয়েছেন। কি প্রকৃতিলয় এবং অমৃত এক হতে পারে?
কোথাই প্রকৃতিলয়= মহাদুখার্ণব মধ্যে ডুবে যাওয়া আর কোথাই অমৃত= মোক্ষ প্রাপ্তি, যাহাতে লেশমাত্র দুঃখ নেই। এই দুইএর মধ্যে আকাশ - পাতালবত্ ভেদ।

শ্রী শঙ্করাচার্য জী অন্যত্র "অমৃতম" শব্দের অর্থ "অমরণধর্মকং ব্রহ্ম" অর্থাৎ মোক্ষ অথবা "অমৃতম= সুখরূপম" করেছেন। দেখুন -
" পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্ব (মুন্ডক ৩।২।৬)
পরামৃতাঃ = পরমমৃতম = অমরণধর্মকং ব্রহ্ম আত্মভূতং যেষাং তে

শ্রী উব্বট প্রথম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় "অসম্ভূতি" পদের অর্থ অপূণর্জন্ম এবং সম্ভূতির অর্থ আত্মজ্ঞান করেছেন। তিনি লিখেছেন -

যেহসম্ভূতিমুপাসতে, মৃতস্য সতঃ পুনঃ সম্ভবো নাস্তি, অতঃ শরীরগ্রহণাদস্মাকং মুক্তিরেব। ন হি বিজ্ঞানাত্মা কশ্চিদনুচ্ছিত্তিধর্মাহস্তি যো যমনিয়মৈঃ সম্বধ্যতে। যে সম্ভুত্যামেব রতা...আত্মজ্ঞান এব রতাঃ।

এই তিন মন্ত্রে "অসম্ভূতি" এবং "সম্ভূতি" র যা অর্থ তা সর্বত্র ঘটা উচিৎ। যদি স্বীকারকৃত অর্থ সর্বত্র এক না ঘটে তবে বোঝা উচিৎ অর্থে দোষ রয়েছে।

এখানে প্রথম মন্ত্রে "অসম্ভূতি" এবং "সম্ভূতি" পদ। দ্বিতীয় মন্ত্রে একই পর্যায়বাচী "অসম্ভব" এবং "সম্ভব" পদ। এবং তৃতীয় মন্ত্রে অসম্ভূতির পর্যায়বাচী "বিনাশ" পদ। সম্ভূতি শব্দ প্রথম মন্তের তূল্যই রয়েছে।

শ্রী উব্বট দ্বিতীয় মন্ত্রে অসম্ভব এবং সম্ভব এর কোন অর্থ করেন নি। তৃতীয় মন্ত্রে সম্ভূতির অর্থ পরব্রহ্ম এবং বিনাশের অর্থ বিনাশী শরীর করেছেন। এখানে তৃতীয় মন্ত্রে সম্ভূতির এক নতুন অর্থ তিনি করলেন পরব্রহ্মআর বিনাশ পদেরও বিনাশী শরীর প্রথম মন্ত্রের অর্থ থেকে ভিন্ন করলেনঅসম্ভূতি পদের প্রথম অর্থ প্রথম মন্ত্রে অপূণর্জন্ম তথা তৃতীয় মন্ত্রে বিনাশী শরীর। শ্রী উব্বট স্থানে স্থানে অসম্ভূতি এবং সম্ভূতির অর্থ বদল করেছে। অর্থাৎ তার কৃত পদার্থের উপর স্বয়ং সন্তোষ নেই।

শ্রী উব্বট সম্ভূতি পদের অর্থ প্রথম মন্ত্রে আত্মজ্ঞান তথা তৃতীয় মন্ত্রে পরব্রহ্ম করেছেন। প্রথম মন্ত্রে সম্ভূতি= আত্মজ্ঞান দ্বারা ঘোর অন্ধকার কে প্রাপ্তি এবং তৃতীয় মন্ত্রে সম্ভূতি= পরব্রহ্মের জ্ঞান দ্বারা অমৃত কে প্রাপ্তির বর্ণনা পরস্পর বিরোধী তথা অশুদ্ধ। আর বিনাশ পদের যে শরীরগ্রহন অর্থ করেছেন তাও তর্কসংগত নয়। শরীরগ্রহন দ্বারা মৃত্যুর ভয় দূর হয় না বরং ভয় উৎপন্ন হয়। অতঃ উব্বট এর সম্ভূতি এবং অসম্ভূতির অর্থও ভ্রমপূর্ণ।