https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতা বিশ্লেষনঃ ০৪ - গীতায় ঈশ্বর নিজেকে মনুষ্যদেহধারী বলেছে এর অর্থ কি?

Wednesday, May 3, 2017


প্রশ্ন - আপনি বলেছেন গীতার ৪।৭,৮নং শ্লোক কৃষ্ণের বাণী নয়, এগুলো ঈশ্বরের বাণী। তাহলে গীতার ৪।৫ ও ৬নং কার বাণী? তাছাড়া গীতা ৯।১১ নং শ্লোকে তো ঈশ্বর নিজেকে মানুষ্য শরীরধারী বলেছে, নাকি এখানেও কৃষ্ণ ও ঈশ্বরের বাণীর মধ্যে পার্থক্য আছে?

উত্তর- গীতার ৪।৭,৮নং পূর্বের একটা পর্বে ব্যাখ্যা করেছি। এখন গীতা ৪।৫ ও ৬নং শ্লোকের ব্যাখ্যা দেখুন। এই শ্লোকদ্বয় কৃষ্ণের, পরমেশ্বর বা ঈশ্বরের নয়। দেখুন-
"আমি জম্মরহিত, অক্ষয় আত্মা, জীবসমূহের_ঈশ্বর হয়েও নিজের অন্তরঙ্গ শক্তিকে বা স্বভাবকে আশ্রয় করে মায়ার দ্বারা দেহ ধারণ করি।"
(গীতা৪ ।৬)
ব্যাখ্যা- পূর্বের শ্লোকে মানে গীতা ৪।৫ নং শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে- "আমার ও তোমার বহু জম্ম অতীত হয়েছে।...।" অথচ গীতার ৪।৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে তিনি জম্মরহিত। তাহলে কি এই দুই শ্লোকের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান?
প্রকৃত পক্ষে তা নয়, কারণ ৫নং শ্লোকে মোক্ষ বা মুক্তি প্রাপ্ত জীবাত্মা শ্রীকৃষ্ণ যে পূর্বে পাপ পূর্ণ রূপ কর্মফলে আবদ্ধ হয়ে দেহধারণ হয়েছিল অর্থাৎ জম্মগ্রহণ করেছিলেন তা স্বীকার করেছেন। আর ৬নং শ্লোকে তিনি নিজের ইচ্ছায় অবতরণের কথা
বলেছেন। কেননা সকল মুক্ত আত্মারা নিজের ইচ্ছা শক্তি দ্বারা দেহ ধারণ করতে পারেন। আর এই ভাবে দেহধারণকেই অবতরণ বলে (কিন্তু জম্ম নয়) ও জ্ঞানীরা ঐ মুক্ত জীবাত্মাকে বলে
অবতার। আর তিনি এটাও বলেছেন যে
তিনি অক্ষয় আত্মা(জীবাত্মা), আমরা সকলেই জানি কোন জীবাত্মারই ক্ষয় নেই।
গীতার ৪।৬নং শ্লোকে তিনি বলেছেন আত্মমায়ায়
দেহধারণ করেন, আর মোক্ষ প্রপ্ত আত্মারা তা পারেন। তার প্রমাণ বেদান্ত সূত্র থেকে দেখুন-
"সংকল্পাদেব তু, তচ্ছ্রতেঃ
(বেদান্ত_সূত্র ৪।৪।৮)
অর্থাৎ ইচ্ছামাত্র মুক্তআত্মারা তাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে পারেন।"
গীতা ৪।৬নং শ্লোকে তিনি নিজেকে জীবসমূহের_ঈশ্বর বলেছেন। ইহারও একটা কারণ আছে, বেদান্ত সূত্র থেকে দেখুন-
"অত এব চানন্যাধিপতিঃ
(বেদান্ত_সূত্র ৪।৪।৯)
অর্থাৎ সেই স্থানে মুক্ত আত্মার কোন অধিপতি নাই। কারণ তখন তিনি স্বাধীন ও সতন্ত্র থাকেন।"
সংসার জগতে যেমন প্রধান অপ্রধান থাকে মুক্তিতে সেইরূপ থাকে না বলেই তিনি নিজেকে সংসারে আবদ্ধ সকল জীবের ঈশ্বর বলেছেন। কারণ ঐ সময় তিনি সংসারে আবদ্ধ সকল জীবের চেয়ে উন্নত ছিলেন, কারণ তিনি মুক্ত ছিলেন। তবে এটাও জেনে রাখা উচিত মুক্ত
জীবাত্মা সর্বশক্তির অধীশ্বর নয়, বেদান্ত সূত্রে ইহা স্পষ্ট বলা আছে। প্রমাণ দেখুন-
"ভোগমাত্রসাম্যলিঙ্গাচ্চ।।
(বেদান্ত_সূত্র ৪।৪।২১)
অর্থাৎ শুধুমাত্র ভোগ্য ব্যাপারে পরমেশ্বর
ও মুক্ত জীবাত্মার মধ্য সাম্যভাব আছে। সর্বশক্তিমত্তা বিষয়ে নয়।"
আরো জেনে রাখা উচিত যে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত মুক্ত আত্মা সৃষ্ট্যাদি ব্যাপার ব্যতীত অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। প্রমাণ দেখুন-
"জগদৃব্যাপারবর্জম্ প্রকরণাৎ,
অসন্নিহিতত্বাচ্চ।।
(বেদান্ত_সূত্র ৪।৪।১৭)
অর্থাৎ মুক্ত আত্মা সৃষ্ট্যাদিশক্তি ব্যাপার ব্যতীত অন্য ক্ষমতার অধিকারী হন।"
এখন গীতার ৯।১১ ও ১২নং শ্লোকের ব্যাখ্যা করা হল-
"(মুঢ) মূর্খ লোক (মাম) আমাকে
(মানুষীং, তনু আশ্রিতম) মানুষের শরীরে আশ্রিত বলে (অবজানন্তি) অবজ্ঞা করে, (ভূতমহেশ্বরম) সর্ব প্রাণীর মহান ঈশ্বর (মম, পরম ভাবম
অজানন্ত) আমার পরমভাবকে না জানার কারণে।"
(গীতা ৯।১১)
এই শ্লোক মধ্যে মূলত শ্রীকৃষ্ণজীর মধ্যে প্রকটিত ঈশ্বরের পরমভাবের কথা বলা হয়েছে। আর এটা ঈশ্বরেরই বাণী, কৃষ্ণের নয়। কিন্তু ঈশ্বরের জন্ম মান্যকারী লোক ইহার অর্থ করেছে যে, কৃষ্ণকে
পরমেশ্বর না জানার কারণে সেই সময়ে লোক তাকে অবজ্ঞা করেছিলো এবং তাদেরকে কৃষ্ণজী মুঢ বলেছেন। এই টীকাকারের এই অর্থ যদি সত্য মানাও যায় তবেও কৃষ্ণের ঈশ্বরাবতার হওয়া সিদ্ধ হয় না। কারন সেই সময়ের লোক কৃষ্ণকে
তখনই মনুষ্য = শরীরধারী জেনেছিলো যতক্ষন তাদের মধ্যে ভৌতিক শরীরের ভাব ছিলো।
আর আমাদের মতে ইহার অর্থ এই যে, মুক্ত পুরুষ কৃষ্ণের আত্মায় ঈশ্বর প্রকটিত হয়েছেন এবং অনেকে ঈশ্বরের এই পরম ভাবকে বুঝতে না পেরে, ঈশ্বর মনুষ্য শরীর ধারণ করেছে বলে অবজ্ঞা  করেছে এবং এখনো করছে। ঈশ্বর বা
পরমাত্মাতো সর্বত্রই বিরাজমান, আর এটাকে আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে সর্ব প্রাণীর হৃদয়েই বিদ্যমান বলা চলে। কিন্তু সকলের হৃদয়ে বা শরীরে পরমাত্মা প্রকটিত বা আশ্রিত হয় না। কিছু কিছু লোক এটা বুঝে উঠতে পারেনা তথা স্বীকার করেনা, তাদের মধ্যে অনেকে বলে ঈশ্বর কি করে মানুষ হল? আবার অনেকে বলে ঈশ্বর নাকি অবতার রূপে মানুষ্য শরীর ধারণ করে। কিন্তু উপরের শ্লোকটা এই দুই প্রকৃতির মানুষদের ধ্যান ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিল। কারণ এখানে মূলত যোগী, ধর্মাত্মা ও মুক্ত আত্মাদের
শরীরে কি করে পরমাত্মা প্রকটিত বা আশ্রিত হয় তাই বর্ণনা করা হয়েছে। এই কারণেই গীতা ৭।২৪ এ ঈশ্বর বলেছেন যে-
"অল্প বুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার (ঈশ্বরের) নিত্য সর্বোৎকৃষ্ট পরম স্বরূপ না জানায় অব্যক্তম আমাকে (ঈশ্বরকে) প্রাকৃত মনুষ্যবৎ ব্যক্তিভাবাপন্ন মনে করে।"
(গীতা ৭।২৪)
যোগী, ধর্মাত্মা, পূর্ণ আত্মা তথা মুক্ত আত্মাদের শরীরে পরমাত্মা কিভাবে প্রকটিত হয় সেই সম্পর্কিত বেদেরও একটি মন্ত্র দেখুন-
"য়েনেদং ভূতং ভুবনং ভবিষ্যৎ পরিগৃহীতমমৃতেন সর্বম্।
য়েন য়জ্ঞস্তায়তে সপ্তহোতা তম্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু।।"
(যজুর্বেদ ৩৪।৪)
অনুবাদ- "হে জগদীশ্বর! যদদ্বারা যোগীগণ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কার্য জানিতে পারেন, যাহা অবিনাশী জীবাত্মাকে পরমাত্মার সহিত
মিলিত করিয়া সর্বপ্রকারে ত্রিকালজ্ঞ করে, যাহাতে জ্ঞান ও ক্রিয়া আছে, যাহা
পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও আত্মার সহিত সংযুক্ত এবং যা দ্বারা যোগীগণ যোগরূপে যজ্ঞের
বৃদ্ধি সাধন করেন, আমার মন সেই যোগবিজ্ঞান সম্পন্ন হইয়া অবিদ্যাদি ক্লেশ হতে দূরে থাকুক।"
আশা করি বুঝতে পেরেছেন,নমস্তে।।