https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

আর্য আক্রমণ তত্ত্ব: নির্লজ্জ এক মিথ্যাচারের গল্প

Sunday, May 21, 2017

      
         
ছোটবেলা থেকেই আমরা কল্পকাহিনী শুনতে অভ্যস্ত। এগুলো আমাদের পাঠ্য পুস্তকেও পড়ানো হয়। যেমন আর্যরা ছিল বহিরাগত। তারা ইউরোপ থেকে এসে ভারত দখল করে। বিজয়ী আর্যরা পরাভূত প্রাগার্য গোষ্ঠী ও কৌমের মানুষদের দাস, দস্যু, রাক্ষস বা অসুর বলে উল্লেখ করেছে আর নিজেদের মনে করেছে উন্নততর মানবপ্রজাতির অংশ। এই আর্যদের ধর্মই বৈদিক ধর্ম যা কালক্রমে হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু সমাজের প্রচলিত বর্ণপ্রথায় শুদ্ররাই হচ্ছে এই অনার্যদের বংশধর।



গত দেড়শ বছর ধরে এই ‘আর্য আক্রমণ তত্ত্ব’ বা Aryan Invasion Theory হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে হিন্দুবিরোধীরা ব্যবহার করছে।
চরম হিন্দুবিদ্বেষী দৈনিক আমার দেশে কয়েক বছর আগে লেখা হয় হিন্দু ধর্ম বর্বর আর্যদের আমদানি করা ধর্ম।
দক্ষিণ ভারত আর উত্তর শ্রীলংকার তামিলরা নিজেদের দ্রাবিড় বলে আখ্যা দিয়ে তারা উত্তর ভারতের তথাকথিত আর্য হিন্দুদের ঘৃণা করতে শিখে।
হিন্দু পণ্ডিতরা যেমন স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী , স্বামী বিবেকানন্দ শুরু থেকেই এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন।
আমরা কয়েকটি পর্বে এই আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মিথ্যাচার উন্মোচন করব।


খ্রিস্টান মিশনারিদের চক্রান্তঃ
এই তত্ত্ব সম্প্রসারণের পিছনে লর্ড মেকলে আর জার্মান দার্শনিক মাক্সমুলারের অবদান সবথেকে বেশি। এরা প্রত্যেকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য এই কাজটি করেন।
max muller এর চিত্র ফলাফল
এই মাক্সমুলার প্রথম জীবনে ছিলেন একজন উদ্বাস্তু। তার আত্মজীবনীতেই রয়েছে
…Had not a penny left, and that in spite of every effort to make a little money, I should have had to return to Germany.(ref –the life and letters of Maxmuller, vol.1, p.61, London edn)
তাই ব্রিটিশদের ধর্মপ্রচারের কাজে তাকে যোগদান করতে হয়। তিনি তার মেধাকে ব্রিটিশদের হাতে বেঁচে দিলেন।
I am to hand over to the company, ready for the press, fifty sheets each year-the same I had promised to samter in Germany; for this I have asked 200 pounds a year, 4 pounds a sheet.(ref. the life and letters of Maxmuller, vol.1, p.60-61, London edn.)
কর্নেল জোসেফ বোডেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে বোম্বেতে চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান উগ্রবাদী। হিন্দুদের খ্রিস্টান বানাতে তিনি মিশনারিদের সহায়তা করতেন। ১৮০৭ সালে অবসর গ্রহণের পর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে ২৫০০০ পাউন্ড অনুদান করেন সেখানে সংস্কৃত ভাষার উপর চেয়ার প্রতিষ্ঠা করতে। বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এর নাম করে বোডেন চেয়ার। বোডেনের লক্ষ্য ছিল বাইবেলকে সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করে এর মাধ্যমে হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার।
এছাড়া মিশনারিরা হিন্দুধর্মকে একটি বহুশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু হিন্দুদের একেশ্বরবাদী চেতনার উৎসই হল বেদ। তাই তাদের লক্ষ্য ছিল বেদকে আক্রমণ করা। এর জন্য মাক্সমুলারের মত ধূর্ত লোকদের দরকার ছিল আরও অনেক বেশী যার ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষার উপর দখল ছিল অতি জঘন্য। তার কাজ ছিল হিন্দু শাস্ত্রগুলোর অপব্যাখা করা।
লর্ড মেকলে যাকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবীরা পূজা করেন তিনি জন্ম নেন এক ডানপন্থী খ্রিস্টান পরিবারে। ইংরেজি শিক্ষা এবং ইউরোপীয় ভাষা প্রচারের প্রধান লক্ষ্যই ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচার।
১৮৩৫ এর ফেব্রুয়ারিতে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।
১৮৩৬ সালের ১২ অক্টোবর তিনি তার পিতাকে
চিঠিতে লিখেন, “ our English schools are
flourishing wonderfully. We find it difficult –
indeed, in some places impossible – to provide
instructions for all who want it. At the single
town of hoogle fourteen hundred boys are
learning English. The effect of this education on
the hindoos is prodigious. No hindoo, who has
received an English education, ever remains
sincerely attached to his religion. Some continue
to profess it as a matter of policy; but many
profess themselves pure deists, and some
embrace Christianity. It is my firm belief that if,
our plans of education are followed up, there
will not be a single idolater among the
respectable classes in Bengal thirty years hence.
And this will be affected without any efforts to
proselytize; without the smallest interference
with religious liberty; merely by the natural
operation of knowledge and reflection. I heartily
rejoice in the prospects. Ref. the life and letters
of Lord Macaulay, pp. 329-330 ”
লর্ড মেকলে আর মাক্সমুলারের প্রথম সাক্ষাৎ
হয় ১৮৫১ সালে লন্ডনে। পরবর্তী সাক্ষাৎ হয়
১৮৫৫ সালের ডিসেম্বরে। তাদের সেই
সাক্ষাৎকারে মাক্সমুলার ভাষাকে ব্যবহারের কথা
জানান। তিনি লিখেন।
“…I made acquaintance this time in London with
Macaulay, and had along conversation with him
on the teaching necessary for the young men
who are sent out to India. He is very clear
headed, and extraordinarily eloquent…I went
back to oxford a sadder, and, I hope, a wiser
man. Ref. –the life and letters of Maxmuller,
vol.1, p.162, London edn”
মাক্সমুলার ক্রমাগত সংস্কৃত শাস্ত্রের অপব্যাখা
করতে থাকেন। এই বিষয়ে স্বামী দয়ানন্দ
সরস্বতী তার সত্য প্রকাশ বইয়ের ২৭৮ পৃষ্ঠাতে
লেখেন
“the impression that the Germans are the best
Sanskrit scholars, and that no one has read so
much of Sanskrit as Prof Maxmuller, is
altogether unfounded exposed Maxmuller. Yes,
in a land where lofty trees never grow, even
recinus communis or the castor oil plant may be
called as oak…. I came to learn from a letter of
a principal of some German university, that even
men learned enough to interpret a Sanskrit letter
are rare in Germany. I have also learnt from the
study of Maxmuller’s history of Sanskrit
literature and his comments on some mantras of
the Veda, that prof. Maxmuller has been able to
scribble out something by the help of the so-
called tikas or paraphrases of the Vedas current
in India”
এই মাক্সমুলারই বেদের বিভিন্ন মন্ত্রের
অপব্যাখা দিয়ে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের
প্রবর্তন করেন।
২। আর্য দ্রাবিড় বিভক্তিঃ
ঋগবেদে কোথাও এই কথা নেই যে আর্যরা
আক্রমণ করেছে বা বেদের দ্রষ্টা ঋষিরা
ভারতের বাইরে থেকে এসেছেন। তারপরও
হিন্দুবিরোধীরা অপপ্রচার চালায় ঋগবেদের
বিরুদ্ধে।
তারা বলে অঙ্গিরা বংশের ঋষিরা ইন্দ্রের আহ্বান
করেছেন দস্যু এবং পানিদের দমন করতে এবং
এটাই বুঝায় যে আর্য সেনাবাহিনী স্থানীয়
ভূমিপুত্র দ্রাবিড়দের হত্যা করেছে।
দ্রাবিড় শব্দের মানে কি?
এর সংস্কৃত মূল দ্রব। এর অর্থ তরল জাতীয় বা
জলীয়। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল
তামিলদের সঙ্গম সাহিত্যে দ্রাবিড় বলতে কোন
শব্দ নাই।
তামিলদের সঙ্গম সাহিত্য ঐ অঞ্চলের জীবন,
সময়, ঘটনাপ্রবাহ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের
সুনির্দিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত করে। এটা তামিলদের
ব্যাকরণেরও বিবর্তন নির্দেশ করে। এর
সময়সীমা খ্রিস্টের জন্মের ২০০ বছর আগে
থেকে খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর পরে
পর্যন্ত।
তাহলে আর্য বলে যদি কোন জাতি বাইরে
থেকে এসে দ্রাবিড়দের হত্যা করে তাদের
দক্ষিণ ভারতের দিকে অভিবাসী হতে বাধ্য
করে তাহলে তামিলদের এই প্রাচীন সাহিত্যে
কেন এই ঘটনার উল্লেখ নেই?
নবম শতাব্দীর দিকের তামিল সাহিত্যে দ্রাবিড়
শব্দটি প্রথম পাওয়া যায়। সেন্থান দিবাকরম নামে
একটি শব্দভাণ্ডারে দ্রাবিড় নামটি পাওয়া যায়। এটি
ব্যবহৃত হয়েছিল তামিল বুঝাতে।
এটি পরিষ্কার যে দ্রাবিড়দের নিয়ে গল্পটি একটি
নির্লজ্জ মিথ্যাচার। উনবিংশ শতাব্দীতে রবার্ট
ক্যাডঅয়েল নামক এক খ্রিস্টান ইভানজেলিস্ট
প্রথম এই দ্রাবিড় শব্দটি ব্যবহার করেন আর্য
আক্রমণ তত্ত্বে। এরপরই এটা রাজনৈতিক রূপ পায়।
৩। ঋগবেদের_বিরুদ্ধে _অপপ্রচারঃ
দেখা যাক মহাজ্ঞানীরা ঋগবেদের কোন
মন্ত্রগুলো ব্যবহার করছে আর্য আক্রমণ
তত্ত্ব প্রমাণ করতে। তারা ঋগবেদের ১০/৪৮
সুক্তকে দেখায় যেখানে আছে ইন্দ্র দস্যু,
বৃত্র এবং পানিদের দমন করেছেন, তাদের
সম্পদ নিয়ে নিয়েছেন এবং বলেছেন যারা তাঁর
অনুসারী তাঁরা ব্যর্থ হবে না। বৃত্র এবং পানি দস্যুর
প্রকারভেদ।
কিন্তু ঋগবেদের ১/৩৩/১-১০ মন্ত্রগুলো
পড়লে বুঝতে পারা যায় দস্যুদের কাছ থেকে
কেড়ে নেওয়া ইন্দ্রের সম্পদ আসলে
জ্ঞান। ঋগবেদের ১/৩৩/১ মন্ত্রটি শেষ হয়
“gavam ketam param avarjate nah” এই
কথাগুলো দিয়ে।
এর অর্থ দীপ্তিময় গাভীর সর্বোচ্চ জ্ঞান।
এই মন্ত্রটির অর্থ হচ্ছে come let us go seeking
the cows to Indra, it is he that increases the
thought in us, for us, he releases supreme
knowledge of the luminous cows.
বেদে যারা আধ্যাত্মিক কর্ম করেন তাদের যাজ্যু
বলা হয়েছে। এই উৎসর্গ যেই সত্ত্বাদের
উদ্দেশে করা হত তাদের যাজত বলা হত।
যাজ্যুকে তার শুভবুদ্ধির জন্য সুক্রাতু বলা হত।
সুক্রাতু যখন ঐশ্বরিক বানী লাভ করতেন তাদের
বলা হত বিশ্বের গায়ক।
দস্যু শব্দটি সুক্রাতু এবং যাজ্যুর ঠিক বিপরীত।
একে বলা হত অযাজ্যু। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে
দস্যু বিশ্বের গায়কদের ঘৃণা করে। এই জন্য
একজন দস্যুকে বলা হত ব্রহ্মদ্ভিসা এবং অনাসা ( যার
কথা বলার কোন মুখ নেই ) ও অমানযামানা ( যার
কোন মানসিক বিবেকবোধ নাই )। বেদে বলা
আছে দস্যুদের যে জ্ঞান তা ইন্দ্র কেড়ে
নেন মানুষের সাহায্যে। ঋগবেদের আরেক
জায়গাতে আছে পানি এমন এক ধরণের দস্যু যারা
পবিত্র গাভি চুরি করে তাদের গুহাতে আটকে
রাখে। ইন্দ্র মানুষের সহায়তায় তা উদ্ধার করেন।
ঋগবেদের ৬/৫১/১৪ তে ইন্দ্রের প্রতি
প্রার্থনা করা হয়েছে পানিদের ধ্বংস করতে এবং
পানিদের নেকড়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
ঋগবেদের ৩/৩৪/৭-১০:
৭। ইন্দ্র,সাহসীদের প্রভু,যিনি সকলের
শাসনকর্তা,যিনি সকল শক্তির মুল,যার শৌর্যে
শক্তিশালী শৌর্যময়, এই পৃথিবীতে তার এই দান
এর জন্য জ্ঞানীগন তার প্রশংসা করেন।
৮। অনন্যসাধারন,সর্বজয়ী,সকল জয়ের
দাতা,আলোক এবং পানির উত্স ,স্বর্গ ও মর্তের
মালিক,সেই ইন্দ্রকেই সকলে ভক্তিসহকারে
বন্দনা করে।
৯। তিনি শক্তিশালী সূর্য ও অশ্ব এর মালিক(সংস্কৃত
তে শক্তি এর প্রতীক হিসেবে সূর্য,অশ্ব এবং
বৃষ এই তিনটি শব্দ প্রায়শই ব্যবহৃত হয়ে থাকে)।তিনি
আমাদের গোসমূহ যোগান দিয়ছেন যা
আমাদের দুগ্ধের যোগান দেয়।তিনিই স্বর্নময়
সকল গুপ্তধনের উত্স(,তিনি দস্যুদের ধ্বংস
করেন এবং আর্যদের রক্ষা করেন।
১০। তার শক্তিতেই গাছপালা বেড়ে উঠে,দিনের
পর দিন আবর্তিত হয়;তিনি এই ভুখন্ড এবং বায়ুমন্ডল
এর অধিকারী,তিনি অসতদের বিনাশ
করেন,দাম্ভিকদের নিবৃত্ত করেন।তিনিই গাছপালা,
বনজঙ্গল, আকাশ, দিনরাত্রির শৃঙ্খল রক্ষা করেন।
এখন দস্যুরা যদি মনুষ্য সন্তান হয় এবং তারা অনার্য
আদিবাসী হয় তবে তাদের থেকে ইন্দ্র কি
করে আকাশ এবং দিনকে মুক্ত করেন? বেদে
আরও আছে ইন্দ্র দস্যুদের তাড়া করেন এবং
তাদের বিতাড়িত করেন স্বর্গ এবং মর্ত্য থেকে
তার বজ্রের সাহায্যে। ইন্দ্রের মহত্ত্ব বাড়তে
থাকে এবং ইন্দ্রের দীপ্তি দস্যুদের
পলায়নের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এরপর ইন্দ্র
হারিয়ে যাওয়া সূর্যকে উদ্ধার করেন এবং সেই
সূর্য যখন উদিত হয় তখন তার আলোয় গুহাগুলো
আলোকিত হয় যেখানে ভালা (এক ধরণের
দস্যু) পবিত্র গাভীগুলি লুকিয়ে রেখেছে।
তাহলে আমরা এমন এক চিত্র পাই যেটা
সম্পূর্ণভাবে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে
যায়।বেদের ইন্দ্র হলেন স্বয়ং পরেমেশ্ব।প্রাচীন ভাষ্যকার যাস্কের মতে ইন্দ্র নামের ব্যুৎপত্তি ঐশ্বর্য্যবাচক ইন্দ্ ধাতু থেকে ইন্দ্র।কিন্তু ইন্দ্রের সামান্য পরিচয় মাত্র বেদে ইন্দ্র সর্বত্র ইন্দ্র স্তুতি গুলি পাঠ করলে ইন্দ্র নামটি পরমেশ্বর সূচক সেটা অনুধাবন করা যায়, ইন্দ্র যে জগতের ঈশান বা ঈশ্বরে একটি প্রশংসা সূচক নাম তার পরিচয় সংহিতায় খুবই উজ্জ্বল।
সর্বাধিক ঐশ্বর্য্য একমাত্র পরমেশ্বরেরই, তাই "ইন্দ্র" শব্দের প্রধানর্থ হল পরমেশ্বর।তিনি দেবলোকের স্বর্লোকের বা জ্যোতির্লোকের অধিপতি, মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধা, শত্রুবিমর্দক,বৃ
ত্রসংহারক এবং সোমরসের মত আপ্লুত আনন্দময় পুরুষ।
দেবতা,যজ্ঞ,বৃত,গো, গোধচুরি,অসুরবধ,সোমরস ইত্যাদি শব্দগুলি মূলত প্রতীক ভাবনা রূপেই ঋগ্বেদে স্থান পেয়েছে।এদের প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে সবসময় সজাগ সচেতন না থাকলে বেদমন্ত্র গুলি মর্মার্থ অনুধাবন করা প্রায়ই সম্ভব হয় না।
দেবতা হলেন বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতীক।
যজ্ঞ হল বৃহৎ কর্মের প্রতীক।
বৃত্র হল সেই আবরণী শক্তি যা আমাদের সত্তার সহজ ও শুভঙ্কর বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়।জড়তা তামসকে আঘাত না করলে তা থেকে বিদ্যুতের ঝলক বা বর্ষার বারিধারা নেমে আসে না।পরমেশ্বররূপী ইন্দ্র আমাদের ভিতরে অন্তর্য্যামীরূপে বিরাজ করে এই কাজটি করেন।তাঁর ই প্রসাদে গোধন চুরি নিবারিত হয়।বেদে "গো" শব্দের মুখ্য অর্থ রশ্মি বা আলো।বৃত্র বালা বা পণির নামের অসুরদের কাজই হল জীবনকে সঙ্কুচিত আড়ষ্ট ও পঙ্গু করা।তাদের কবল থেকে যখন ইন্দ্ররূপী পরমেশ্বরের প্রসাদে মুক্ত হই তখন আমাদের যে আনন্দ ও উল্লাস সেটিই সোমরসপানের মধ্য দিয়ে প্রকটিত।সোমলতার পাতা ছেঁচে রসপান নিতান্তই প্রতীকী ব্যাপার মাত্র।আমাদের সত্তার দিব্য রসঘন অবস্থানটি আমাদের সর্বকর্মের অনন্য লক্ষ্য।
ইন্দ্র সকল অশুভ শক্তি বাধাবিপত্তি ব্জ্রাঘাতে বিদীর্ণ করে আমাদের জীবনে আনন্দবর্ষণ করেন।মেঘের মধ্যে যে বারি পূঞ্জীভূত হয়ে আবদ্ধ,আকাশের বজ্র বিদারণে সেই বদ্ধাবস্থা ঘুচিয়ে মর্ত্যে বৃষ্টি নামিয়ে জীবজগৎকে তিনি সঞ্জীবিত করে তোলেন। বৃত্র হল সেই দস্যু বা অসুর যা আমাদের চিত্তের গভীর অন্ধকারের ফাঁকেফাঁকে নানাভাবে লুকিয়ে থাকে, যারা আমাদের ভিতর থেকে আমাদের সকল শুভ কর্ম এবং উদ্যোগে বাধা দেয়,অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন করে আমাদের আড়ষ্ট পঙ্গু নির্জীব এবং ক্লীব করে ফেলে। বজ্রের আলোকের তেজ এবং নাদের নির্ঘোষ সেই বৃত্রাসুরকে বধ করে।
ঋগ্বেদে ইন্দ্রদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত সূক্তসংখ্যা সর্বাধিক সমগ্র ঋগ্বেদের প্রায় তিরিশ শতাংশ সূক্তেরই দেবতা ইন্দ্র।সকল গোত্রীয় ঋষিরাই ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে সূক্ত রচনা করেছেন।সব স্থানেই তাঁর এই অভিন্ন মূর্তি।দেবতারূপে যিনি স্বর্গাধিপতি ইন্দ্র, অধিভূতরূপে যিনি হলেন আকাশে বজ্রবিদ্যুৎ, অধ্যাত্মরূপে তিনিই হলেন আমাদের সর্বেন্দ্রিয়ে অধিষ্ঠিত অন্তর্য্যামী পরমেশ্বর।
কিন্তু অবাক হয়ে যাই বিশেষত পুরাণাদিতে এবং মহাকাব্য দেখলে, সেখানে ইন্দ্র নামক দেবরাজের যে উল্লেখ পাই তা একেবারেই কলঙ্কিত।বেদের ইন্দ্র হলেন সেই ইন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র।আমাদের কাছে এখন তো ইন্দ্র কেবল ভোগবাদের প্রতীক।এই দৃষ্টির সংশোধন একান্ত আবশ্যক নাহলে যুগে যুগে আমাদের অধঃপতন আরো দ্রুতগামী হবে।
উত নঃ সুভগাঁ অরিঃ
বোচেয়ুর্দস্ম কৃষ্টয়ঃ
স্যামেদিন্দ্রস্য শর্মণি।।
হে শক্রবিমর্দক ইন্দ্রদেব, এমন কি বিরোধীরাও আমাদের সৌভাগ্যশালী বলুক এবং আরো বলুক, ইন্দ্রদেবের শরণে তোমাদের সুখশান্তি হোক।
(ঋগ্বেদ সংহিতা, প্রথম মণ্ডল, চতুর্থ সূক্ত, ৬ মন্ত্র)
ভাষ্য :- বিরোধী নাস্তিকের ভাবটি, এই, তোমার ঈশ্বর কি করতে পারেন?-- যা নেই তার পিছনে জীবনভর তুমি মূর্খের মতন ছুটেছ।নাস্তিক ও আস্তিকের এই বিরোধ এবং সংঘাত চিরন্তন। কিন্তু আস্তিক যদি নিজের বিশ্বাস নিষ্ঠা এবং লক্ষ্যপথে অটল অবিচল থাকেন তবে নাস্তিকেরা কালক্রমে প্রতিরোধ বিরোধিরা তুলে নিয়স বলতে বাধ্য হয় আমরা যা করেছি এবং বলেছি রা ভুল।
একটু আবেগজাত এবং দুঃখিত হয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি এখানে নাস্তিক কেবল ঈশ্বর অবিশ্বাসীরা নয়, নাস্তিক বলতে আমি সেই সব স্বার্থবাদী মানুষদের কথা বলছি যারা বেদ কে বিকৃত করে পরমেশ্বরের অন্যতম পবিত্র এবং প্রধান নাম "ইন্দ্র" কে কলঙ্কিত করে চলেছে আর আমাদের সমাজকে ঈশ্বর থেকে বিচ্যুত করে দিচ্ছে নাস্তিকদের মত।
তাই ইন্দ্ররূপি পরমেশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের মনের বৃত্রসংহার করেন।
দস্যু কারা ? ম্যাকলের কুটিল শিক্ষা নীতির কারনেই অনেক ভারতীয় বিদ্বান ইহা মানে যে, বেদের মধ্যে কথিত আর্য এবং দস্যুদের সংঘর্ষের বর্ননা রয়েছে। আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে এসেছে। ভারতের মূল নিবাসী দাস বা দস্যু ছিলো, যাদের আর্যরা এসে পরাজিত করে দাস বানিয়েছে। কঠোর ব্যবহার করে তাদের নিচু কাজ করিয়ে এবং সর্বদার জন্য ভারতবর্ষের উপর আধিপত্য স্থাপন করেছেন। এবং এই দেশের সত্যনাশ করার ষড়যন্ত্রের শামিল অনেক সাম্যবাদি ইহাই বলে যে, আর্যরা নিজ মহত্বকে জন্মগত ভেদভাবের আধারের উপর প্রতিস্থাপিত করেছেন। ভারতবর্ষকে বিভাজিত কারী এই বিচারের কারনে আজ স্বয়ং কে দ্রবিড় তথা দলিত ভাই- বোন যে নিজেকে নিজে অনার্য মানে।তাদের মনে বেদের প্রতি ঘৃণা এবং দ্বেষের বিষ ভরে গেছে। ডাঃ আম্বেডকার ও তাদের এই বিচারে সহমত ছিলো না। কারন এই মিথ্যা বিবাদ বেদের উপর আরোপ করা হয়েছে|
অতএব এখন দেখার বিষয় বেদের মধ্যে আর্য এবং দস্যুর বাস্তবিক অর্থ কি?
মূলত ইহাই এই লেখার মূল উদেশ্য।
.
=>> আরোপঃ বেদের মধ্যে অনেক স্থানে আর্য এবং দস্যুদের বর্ণনা রয়েছে। অনেক মন্ত্রে দস্যুদের বিনাশ তথা আর্যের রক্ষার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। কিছু মন্ত্রে তো ইহা বলা হয়েছে যে, স্ত্রী যদি দস্যু হয় তবে তাকেও নিষ্কৃতি দেওয়া উচিত নয়। এ থেকে জানা যায় যে, বেদের মধ্যে দস্যুদের উপর আর্যের অত্যন্ত ঘাতক আক্রমনের বর্ণনা রয়েছে।
.
=>> সমাধানঃ-
ঋগবেদের মধ্যে দস্যু সংশ্লিষ্ট ৮৫ টি মন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে কিছু মন্ত্র আমরা পর্যালোচনা করবো-
=> হে শূরবীর রাজন! বিবিধ শক্তিযুক্ত আপনি একাকি বিচরন করে নিজ শক্তিশালী অস্ত্র দ্বারা ধনিক দস্যু (অপরাধী) এবং সনকঃ ( অধর্ম দ্বারা অন্যের ধন ছিনতাইকারী) কে বধ করুন। আপনার অস্ত্র দ্বারা তাহার মৃত্যু প্রাপ্ত হোক।
(ঋগবেদ ১।৩৩।৪)
.
এখানো "সতকঃ" শুভ কর্ম রহিত। এবং দস্যুর জন্য "অয়জ্ব" বিশেষন এসেছে অর্থাৎ যে সৎকর্ম রহিত। এবং ওইরূপ ব্যক্তিই পাপকারী ও অপরাধী হয়। অতএব এখানে রাজা প্রজার রক্ষার জন্য ঐ রূপ লোককে বধ করার জন্য বলছেন। সায়ন এই মন্ত্রে দস্যু শব্দের অর্থ চোর করেছেন। দস্যু শব্দটি "দস" ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ " উপক্ষয়া"যে নাশ করে। অতএবঃ দস্যু কোন আলাদা জাতি নয়। পরন্তু দস্যু শব্দের অর্থ বিনাশকারী এবং অপরাধী প্রকৃতির লোক।
.
=>> যে দস্যু (দুষ্ট জন) শুভ কর্ম রহিত ও শুভকারীর সাথে দ্বেষ রাখে, আপনার রক্ষার প্রতাপ দ্বারা সে দূরে যাক। হে পরাক্রমী রাজেন্দ্র! আপনি সব স্থানে "অব্রত" (শুভ কর্ম রহিত) জন কে বাহিরে দূর করুন।
(ঋগবেদ ১।৩৩।৫)
.
এখানেও দস্যুর বিশেষন এসেছে "অয়জ্ব"( শুভ কর্ম রহিত এবং "অব্রতঃ (নিয়ম অপলানকারী তথা অনাচারী। পরিষ্কার যে, দস্যু শব্দ অপরাধীর জন্য এসেছে এবং সভ্য সমাজে ঈশ্বর ঐ সব লোক কে দন্ডের বিধান দিয়েছে।
.
=>> হে বীর রাজন! এই রোদনরত বা হাস্যরত দস্যু কে এই লোক থেকে দূর করে দিন এবং তাকে নষ্ট করে দিন। তথা যে শুভ কর্মযুক্ত তথা ঈশ্বরের গুনগান কারী মানুষ তাকে রক্ষা করুন।
(ঋগবেদ ১।৩৩।৭)
.
=>> হে রাজেন্দ্র! আপনি নিজের দক্ষতা দ্বারা কম্পনযুক্ত "অয়জ্বা , অব্রতী " দস্যুকে কম্পায়মান করুন। যে প্রত্যেক বস্তুর উপভোগ কেবল স্বয়ং এর জন্য করে সেই দুষ্ট কে দূর করুন। হে মানুষের রক্ষক! আপনি উপদ্রব, অশান্তি উৎপন্নকারী দস্যুর নগর কে নষ্ট করুন।
(ঋগবেদ ১।৫১।৫)
.
এই মন্ত্রে দান পরোপকার রহিত, সবকিছু স্বয়ং ব্যায়কারী কে দস্যু বলা হয়েছে। কৌষিতকী ব্রাহ্মণে ঐ সব লোক কে অসুর বলা হয়েছে। অতএব দস্যু এবং অসুর দুইএর তাৎপর্য দুষ্ট অপরাধী।
.
=>> পরমেশ্বর আপনি আর্য ও দস্যুকে উত্তম প্রকারে জানেন। শুভ কর্মকারীর জন্য আপনি অব্রতী (শুভ কর্মের বিরোধী) দস্যুকে নষ্ট করুন। হে ভগবন! আমি উত্তম কর্মের প্রতি পালনের জন্য আপনার প্রেরনা সদা প্রার্থনা করি।
(ঋগবেদ ১।৫১।৭)
.
=>> হে রাজেন্দ্র! আপনি নিয়মের পালনকারী তথা শুভকর্ম কারীর কল্যান হেতু ব্রতরহিত দস্যুকে সংহার করুন। স্তুতি কারীর সাথে দ্বেষ রাখা,অনাচারী ঈশ্বরের গুনগান রহিত লোক কে বশে রাখুন।
(ঋগবেদ ১।৫১।৯)
.
=>> হে পরম ঈশ্বর্যবার রাজা! আপনি তিন প্রকারে সাধারন,স্পর্ধা ও সুখ কে বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম মধ্যে যজমানস্ আর্যম( উত্তম,গুন ও স্বভাব লোক) কে রক্ষা করুন। এবং অব্রতান্ (দুষ্ট আচরনকারী) যার অন্তঃকরন মলিন হয়ে গেছে। হিংসারত ও হিংসা ইচ্ছাকারী কে নষ্ট করুন।
(ঋগবেদ ১।১৩০।৮)
.
এখানে কৃষ্ণ ত্বক শব্দটি এসেছে যার অর্থ অন্তঃকরনের দুষ্ট ভাব। এবং সাথে তনৃষাণাম এবং অর্শসানম শব্দ এসেছে। যার অর্থ হিংসা করতে চায় বা হিংসা রত। ইহার বিপরীত শব্দ আর্য এখানে শ্রেষ্ঠ এবং পরোপকারী মানুষের জন্য এসেছে।
.
অতএব উত্তম স্বভাববান শান্তিপ্রিয়, পরোপকারী কে আর্য তথা অনাচারী এবং অপরাধী প্রবৃত্তিবান কে দস্যু বলে। ঋগবেদ ৬।২২।১০ এ আমাদের দাসকেও আর্য বানানোর শিক্ষা দেয়। পরিষ্কার যে আর্য ও দস্যু একটি ব্যক্তির গুনবাচক নাম কোন জাতিবাচক নাম নয়।
ঋগবেদ ৩।৩০।২৭ তথা ৭।১০৪।২ মন্ত্রে ব্রহ্মদ্বেষী, নরভক্ষক এবং কুটিল লোককে যুদ্ধের দ্বারা বশ রাখতে বলেছেন। ব্রহ্মদ্বেষী, নরভক্ষক এবং কুটিল লোক ও কোন আলাদা জাতি নয়। অপরাধী প্রবৃত্তির লোক কে দাস,দস্যু এবং ব্রহ্মদ্বেষী বলে।
বিদ্বান ব্যক্তিরা ইহা জানে যে, সৎ (সত্য) এবং অসৎ (অসত্য) পরস্পর সংঘর্ষ করতেই থাকে। সৎ অসৎ কে এবং অসৎ সৎ কে সর্বদা বশে রাখার চেষ্টা করে। এই দুই এর মধ্যে যে সৎ এবং ঋত (শাশ্বত সত্য) তাহকেই ঈশ্বর সদা রক্ষা করেন। এবং অসৎ কে হনন করেন।
তাই আসুন মিথ্যা অভিমান ত্যাগ করে ফিরে আসি ঋত ঋদ্ধির পথে।
৪। সঙ্গম_সাহিত্য_থেকে_প্রমাণঃ
আমরা এখন তামিলদের সাহিত্যের দিকে নজর
দেই। আমরা দেখি আসলেই কি তামিলরা তথাকথিত
দ্রাবিড় যারা আর্যদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিল।
সঙ্গম সাহিত্যে পৃথিবীকে ভাগ করা হয়েছে
মুল্লাই (বন), কুরিঞ্ছি (পাহাড়), মারুদাম (কৃষি ভূমি),
নেইদাল (সমুদ্র সৈকত) এবং পালাই (খোলা ভূমি) এই
পাঁচ ভাগে।
তল্কাপ্পাইয়াম সাহিত্যে আছে এই জায়গাগুলোর
দেবতা হচ্ছে মুল্লাইঃ তিরুমাল/ বিষ্ণু। কুরিঞ্ছিঃ
সেয়ন ( কুমার/মুরুগুয়া/ কার্ত্তিকেয়)। মারুদামঃ
ভেন্দান/ইন্দ্র। নেইদালঃ বারুনান/ বরুণ। পালাইঃ
কররাভাই/ শক্তি।
সঙ্গম সাহিত্যের আরেকটি অংশ হচ্ছে পুরানানুরু।
সেখানে আছে শিব তিনটি শহরকে ধ্বংস
করেছেন (ত্রিপুরা সামহারা)। সেখানে আছে শিব
এক হাতে মেরু পর্বত তুলে নেন তীরধনুক
হিসেবে। একটা ভয়ংকর সরীসৃপকে তীর
ধনুকের ছিলা হিসেবে ব্যবহার করেন। একটা
তীরের আঘাতে শহর তিনটিতে আগুন লেগে
যায় এবং তা ধ্বংস হয়ে যায়। পুরানানুরু সাহিত্যে
কার্তিককে বারবার দেখা যায় শিবের ছেলে
হিসেবে।
এটা আমাদের অগ্নিকুমার যিনি পুরাণের কার্তিকেয়র
প্রতিচ্ছবি তার সাথে শিবের সম্পর্ক স্থাপনে
সহায়তা করে। আর্য আক্রমণ তত্ত্বের
সমর্থকদের দেখা যায় শিবকে শুধু দ্রাবিড়দের
দেবতা বলতে দেখা যায়। সত্য এই যে
বেদের রুদ্র থেকে পৌরাণিক শিবের উৎপত্তি।
তৈত্তিরীয় সংহিতা বা কৃষ্ণ যজুর্বেদ এর রুদ্রম
ভাগের বিভিন্ন ভাগে রুদ্র সম্পর্কে নির্দিষ্ট
ধরনের বেশকিছু বৈশিষ্ঠ্য উল্লেখিত হয়েছে।
আর শিব হল সেই বেশ কিছু গুলের একটি নির্দিষ্ট
অংশের প্রতীক।পরবর্তীতে রুদ্রের বদলে
অধিকাংশ স্থানেই শিব শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।তামিল
গ্রন্থসমুহ যেমন পেরিয়া বা পুরানাম সমুহে শিবের
যে বৈশিষ্ঠ্য দেখানো হয়েছে তা বেদের
রুদ্রের সমরুপ।চিদাম্বরাম,থেবারাম
এলাকাগুলোতে এখনও রুদ্রাম/চমকম পাঠ করা হয়।
যদি তামিলদের শিব আর বৈদিক শিব আলাদা হত তবে
তা নিশ্চয় করা হতনা।আসলে তৈত্তিরীয় সংহিতার
রুদ্রাম সংস্কৃতিটাই এখনো তামিলনাড়ু, কর্ণাটকে
বিদ্যমান।
৫। কেন এই আর্য আক্রমণ তত্ত্বঃ
ইন্দোইউরোপিয়ান ভাষাগুলোর পারস্পরিক মিল
দেখে ধারণা করা হয় যে এই ভাষাভাষীরা সকলে
একই পূর্বআবাসস্থল থেকে এসেছে।
সংস্কৃতের সাথে ইউরোপিয়ান বেশ কয়েকটি
ভাষার মিল দেখে কেবল ভাষাগত মিল দেখেই
জার্মান ইন্ডোলোজিস্ট ম্যাক্স মুলারই প্রথম
আর্য আক্রমণ তত্ত্বের সূচণা করে। এই তত্ত্ব
অনুযায়ী আর্যরা রাশিয়ার দক্ষিণ অংশ থেকে
মাইগ্রেট করে ভারতীয় উপমহাদেশের আদিম
অধিবাসীদের আবাস তথা সিন্ধু উপত্যকায় পৌছে।
ম্যাক্স মুলারের এই তত্ত্বে কেবল ভাষাগত
মিলকে বিবেচনায় নিয়েই এরকম একটি তত্ত্বকে
দাঁড় করানো হয়। সিন্ধু সভ্যতার কোন
আর্কিওলজিকাল এভিডেন্স তখনও আবিস্কৃত হয়নি।
পরবর্তীতে ১৯২০ সালের দিকে যখন হরপ্পা,
মহেঞ্জোদারো ও লোথাল নগর সভ্যতা
আবিস্কৃত হয় তখন তত্ত্বটির খানিকটা পরিবর্তন হয়।
যাযাবর বর্বর আর্যরা ইউরোপ থেকে এসে
উন্নত নগর সভ্যতায় আক্রমণ করে এবং
তাদেরকে পরাজিত করে সভ্যতাগুলোকে ধ্বংস
করে। মহেঞ্জোদারো খনন করতে গিয়ে
মন্টিমার হুইলার একেবারে উপরের অংশে কিছু
মানুষের খুলি-হাড়গোড় পেলে এ তত্ত্বটি
আরো দৃঢ় হয় এবং মোটামুটি সর্বজনবিদিত
তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়। তত্ত্বটি অনুযায়ী
খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে আর্যরা
ভারতের প্রাচীন কিন্তু সভ্য অধিবাসী
দ্রাবিড়দের আক্রমণ করে। এই অসভ্য-বর্বর-
যাযাবর-পশুপালক জাতিই আর্য জাতি। এদের হাতেই
ঋগ্বেদ রচিত হয়।
কী সহজ ইতিহাস!
এবারে দেখি তাদের এ ধরণের ইতিহাস লেখার
কারণগুলো কী কী।
ম্যাক্স মুলার বা অন্য যারা এই তত্ত্বের প্রবক্তা ও
প্রচারক তারা সবাইই মনে করতেন বাইবেলের
সৃষ্টিতত্ত্ব নির্ভুল। সুতরাং পৃথীবীর বয়স
কোনক্রমেই খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের
বেশী যেতে পারে না। সুতরাং খ্রীষ্টপূর্ব
১৫০০ এর বেশি তারা মোটেই ভাবতে পারেনি
কারণ বাইবেল অনুযায়ী নুহের প্লাবন হয়েছে
খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ সালের দিকে। কেউ কেউ
অবশ্য আরো নিচে নেমে এসেছেন।
কারো কারো মতে খ্রীষ্টপূর্ব ১১০০-৯০০
সালও হতে পারে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে
জার্মান আর্যশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব। যেহেতু
ঋগ্বেদের রচয়িতারা নিজেদেরকে আর্য
বলেছেন সুতরাং ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল।
এবার আসি এই ইতিহাসের পূনর্মূল্যায়নে।
ঋগ্বেদে আর্য শব্দটি কি একটি জাতিকে
বুঝিয়েছে? ঋগ্বেদে আর্য শব্দটি গৌরব বা
মর্যাদার অর্থ বহন করেছে, মোটেই কোন
জাতিকে বুঝায়নি। ইরানী আবেস্তায়ও আর্য শব্দটি
গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ববোধের পরিচায়ক। আর্য ও
দ্রাবিড় যদি দুটো ভিন্ন জাতি হত তাহলে উত্তর ও
দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীদের একই দেবতা,
একই ঈশ্বর, প্রায় একই ভাষা (সংস্কৃত থেকে
উদ্ভুত), একই পৌরাণিক বিশ্বাস ও গল্প হতে পারত না।
দ্রাবিড়িয়ান কি কোন আলাদা জাতিগোষ্ঠী? তা
তো নয়। তাহলে দাড়ায়- ককেশিয়ানরা দুই ভাগে
ভাগ হয়ে একদল আর্য আরেকদল দ্রাবিড়িয়ান
হয়েছে। দুই মহাদেশের বিশাল অঞ্চলে
বসবাসকারী মানুষদের ভাষা একই পরিবারভুক্ত হওয়ায়
এবং একইসাথে আবেস্তা ও ঋগ্বেদের মিল
দেখে পণ্ডিতগণ অনুমান করেছিলেন যে এরা
একই আদি জনগোষ্ঠী থেকে ছড়িয়ে পড়ে
সভ্যতা গড়ে। তাদের অনুমান ঠিকই ছিল কিন্তু যখন
তারাই এই আর্যদের যাযাবর পশুপালক বর্বর বলেন
আবার ঋগ্বেদও তাদের দ্বারা রচিত বলেন তখন
তাদের ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে উতড়ে
যেতে পারে না।
ঋগ্বেদ যদি তথাকথিত আর্যদের দ্বারা রচিত হয়
তাহলে কেন ঋগ্বেদে কোথাও
ইউরোপীয় স্থান, নদী ইত্যাদির নামও নেই?
তারা যখন বলেন আর্যরা খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে
সিন্ধু সভ্যতা আক্রমণ করে আর এদিকে আমরা
ঋগ্বেদে খরস্রোতা স্বরস্বতী নদী
দেখতে পাই, যে নদী খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০০
অব্দে মরে যায় (সম্ভবত প্লেট
টেকটোনিক মুভমেন্টের জন্য) তখন এ
ইতিহাস যে মিথ্যা তা আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না।
তাছাড়া পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মেহরগড়
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি খননের পর দেখা যায় প্রায়
৯৫০০ বছর আগে নবপ্রস্তর যুগে এখানকার
অধিবাসীরা যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থিতিশীল
গ্রামীণ কৃষি জীবনে চলে গিয়েছিল।
খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ সাল পর্যন্ত সেখানে কোন
বাইরের জনগোষ্ঠীর আগমণ ঘটেনি।
ঋগ্বেদ যে কোন যাযাবর জনগোষ্ঠীর
রচিত হতে পারে না তা ফুটে ওঠে এর সমাজচিত্র
রূপায়নে, গৃহনির্মাণের উপমা প্রয়োগে,
অট্টালিকা, তন্তুবায়, ভেষজ চিকিৎসা ইত্যাদি
শব্দপ্রয়োগে। চান্দ্রমাসে হিসাব করলে যে
প্রতি তিন বছর একটি ১৩ মাসে বছর হতে হয় (যা
কৃষিকাজ ইত্যাদির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়),
যাকে বৈদিক সমাজ মলমাস বলত (এখনো হিন্দুরা
বলে) তাও বেদে উল্লেখ পা্ওয়া যায়। এরকম
কয়েকশ উদাহরণ দেয়া যাবে যাতে প্রমাণিত হয়
যে বেদের রচয়িতা মোটেই তথাকথিত আর্যরা
হতে পারে না।
প্রত্মতাত্ত্বিকভাবে এখন জানা যাচ্ছে যে
মেহেরগড়ে মৃৎশিল্প-পূর্ব যুগে এখানকার মানুষ
স্থিতিশীল বসতি গড়ে এবং পশুপালন ও কৃষিকাজ শুরু
করে। পরবর্তীতে কালক্রমে তারা বৃহত্তর
সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। তাম্রযুগ
ও আদি হরপ্পান পর্যায় পেরিয়ে তারা প্রায় ২৬০০
খ্রীস্টপূবাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ
পর্যন্ত এক স্থায়ী নগর সভ্যতা গড়ে তোলে
যাকে হরপ্পান সভ্যতাও বলা হয়।
শেয়ার করে সকলকে জানিয়ে দিন।
নমস্কার।