https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতা বিশ্লেষনঃ ২৫ -গীতায় যে ব্রহ্মার কথা বলা হয়েছে তিনি আসলে কে?

Tuesday, June 20, 2017
প্রশ্ন - আর্যরা ব্রহ্মা বলতে ঈশ্বরের একটা গুণবাচক নামকে বুঝেন, কিন্তু গীতার ১১।১৫নং এ তো চার মাথা যুক্ত পৌরাণিক দেবতা ব্রহ্মার কথা বলেছে। এখন কি বলবেন আপনারা? অথবা যদি আপনাদের কথানুসারে ধরে নেই যে এটা ঈশ্বরের গুণবাচক নাম তাহলে কি বলতে হয় যে ঈশ্বরের মধ্যে আরেকটা ঈশ্বরকে দেখা যাচ্ছে?

উত্তর- গীতার ১১।১৫নং শ্লোকে ব্রহ্মা বলতে ঈশ্বরের গুণবাচক নাম ব্রহ্মাকে বুঝানো হয়নি। কারণ ঈশ্বরের মধ্যে একই ঈশ্বরকে আবার কি করে দেখা যাবে? আবার এখানে কোন চারমুখি পৌরাণিক দেবতা বা অবতারের কথাও বলা হয়নি। এখানে মূলত ব্রহ্মা নামক এক ঋষির কথা বলা হয়েছে। যাকে আমরা উপনিষদ ও মনুসংহিতায়ও দেখতে পাই। গীতা থেকে দেখুন -
পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে
সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্৷
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থ-
মৃষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্৷৷11.15৷৷

"হে দিব্যগুনসম্পন্ন! তোমার এই বিরাটরুপ দেহ মধ্যে সূর্যাদি দেব পৃথিবী আদি
ভূতবিশেষ সমুদায় নক্ষত্র (ঋষিন) ঋষি এবং
উদরের বলে চলসকারী সর্প এই সব এবং ( ব্রহ্মানং ইশং কমলাসন্থাং পশ্যামি) পদ্মাসনে
স্থিত ঈশ্বর ব্রহ্মাকে দেখিতেছি।"
(গীতা. ১১।১৫)

এখানে ঈশ্বর ব্রহ্মা এই শব্দটা দেখে অনেকেই বলেন যে এটা আবার কোন ঈশ্বর ব্রহ্মা? প্রকৃত পক্ষে এখানে ঋষি ব্রহ্মাকেই উপাদিস্বরূপ ঈশ্বর বলেছেন অর্জুন। প্রশ্ন আসতে পারে ঋষিদের কি করে ঈশ্বর বলা যায়? এর উত্তরও পরিষ্কার, না গেলে অর্জুন কি করে বলল? তাছাড়া গীতাতে আরো অনেক জায়গায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই সকল জীবাত্মাকেই অর্থাৎ দেহের স্বামীকেই ঈশ্বর বলে ডাকেছেন। গীতা থেকেই দেখুন-

यस्मात्क्षरमतीतोऽहमक्षरादपि चोत्तमः।
अतोऽस्मि लोके वेदे च प्रथितः पुरुषोत्तमः।।15.18।।
"শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুক্রামতীশ্বরঃ।"
(গীতা ১৫/৮)
অর্থাৎ দেহের ঈশ্বর জীবাত্মা যখন শরীর গ্রহণ করে এবং যখন উৎক্রমণ করে বা মৃত্যুকালে দেহ ত্যাগ করে।
প্রশ্ন আসতে পারে ব্রহ্মা ঈশ্বর ও স্বয়ং ঈশ্বর কি এক? না, এক নয়। কারণ তাহলে আমারই প্রশ্ন আপনার প্রতি, ঈশ্বরের মধ্যে আবার ঈশ্বরকে কিভাবে দেখা গেলো? তাছাড়া এক যে নয় তার প্রমাণ গীতা ১১/১৬. দেখুন-

अनेकबाहूदरवक्त्रनेत्रं
पश्यामि त्वां सर्वतोऽनन्तरूपम्।
नान्तं न मध्यं न पुनस्तवादिं
पश्यामि विश्वेश्वर विश्वरूप।।11.16।।

"হে বিশ্বের ঈশ্বর! বিশ্বরূপ! তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত দেখতে পারছি না।" এখানে বিশ্বেশ্বরের আদি মধ্য ও অন্ত পাচ্ছে না অর্জুন, অথচ ঐ শ্লোকে স্পষ্ট করেই ব্রহ্মাকে ও অন্যান্য অনেক কিছুই দেখতে পেয়েছে। অর্থাৎ ঐ ঈশ্বর ব্রহ্মা ও স্বয়ং ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য আছে।
অনেকে আবার এটাও বলে যে আর্য সমাজ কি এই ধরণের বহু ঈশ্বরকে স্বীকার করে? এর উত্তরও পরিষ্কার, এখানে বহু ঈশ্বর পেলেন কোথায়? একটা হল উপাদিরূপে ঈশ্বর, যাকে ব্রহ্মা বলা হয়েছে, আর অন্যটা হল স্বয়ং প্রভু বা ঈশ্বর বা বিশ্বেশ্বর। তাছাড়া উপাদিরূপে সখল জীবাত্মাকেই যে ঈশ্বর বলা যায় তা তো দেখালামই। কেন আর্যরা এই ধরণের তত্ত্ব স্বীকার করবে না? আর্যরা তো নতুন কোন মতবাদ তৈরি করছে না, পূর্বের ঋষিদের বৈদিক পরাম্পরার ধারাই বহন করছে মাত্র। তবে স্বয়য়ং ঈশ্বর বা পরমেশ্বর এক, কিন্তু সামর্থবান ব্যক্তি, জীবাত্মা ও ঋষিদেরকেও ঈশ্বর বলা যায়। প্রমাণ স্বরূপ আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী রচিত সত্যার্থ প্রকাশের ১ম সমুল্লাস(ঈশ্বর নাম ব্যাখ্যা) এর ৭(ঈশ্বর) ও২৩(পরমেশ্বর) নং পয়েন্ট দেখুন-

ঈশ্বরঃ "ঈশ ঐশ্বর্য়ে" এই ধাতু থেকে 'ঈশ্বর' শব্দ সিদ্ধ হয়। যার সত্য বিচারশীল জ্ঞান এবং অনন্ত ঐশ্বর্য আছে, তার নাম "ঈশ্বর"।
পরমেশ্বরঃ যিনি সামর্থবান,তাহার নাম ঈশ্বর। 'য় ঈশ্বরেষু সমর্থেষু পরমঃ শ্রেষ্টঃ স পরমেশ্বরঃ' অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরদের বা সামর্থবানদের মধ্যে সমর্থ, যাহার তুল্য কেহই নেই, তাঁহার নাম 'পরমেশ্বর'।
মনুসংহিতায়, উপনিষদ ও ব্রহ্মণ গ্রন্থগুলোকে ভালো করে পর্যালোচনা করলে আমরা ঋষি ব্রহ্মাকে দেখতে পাই। কিন্তু কোন চার মাথাযুক্ত কোন পৌরাণিক দেবতা বা অবতারকে দেখিনা। দেখুন শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কি আছে-

তেব্যস্তপ্তেভ্যস্ত্রয়ো বেদা অজায়ন্তে ঋগ্বেদো বায়োর্য়জুর্বেদঃ সূর্য়াৎ সামবেদঃ।
শতপথব্রহ্মণ . কাংন্ড ১১। অধ্যায় ৫.
অর্থাৎ অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা এই চার ঋষিগণের মধ্যে পরমেশ্বর বেদ প্রেরণা দিয়ে ছিলেন।
মহর্ষি মনু মহারাজ রচিত মনুসংহিতায়ও আমরা পাই-
অগ্নি বায়ু রবিভ্যস্তু ত্রয়ং ব্রহ্ম সনাতনম্।
দুঃদোহ যজ্ঞসিদ্ধ্যর্থমৃগযজুঃ সামলক্ষণম্।।
(মনুসংহিতা ১।২৩)

অর্থাৎ সেই পরমাত্মা (যজ্ঞসিদ্ধয়র্থম)জগতের মধ্যে সমস্ত ধর্ম অর্থকাম মোক্ষ আদি ব্যবহারকারীকে সিদ্ধির জন্য অথবা জগতের
সিদ্ধি অর্থাৎ জগতের সমস্ত রূপের জ্ঞানের জন্য (অগ্নি-বায়ু-রবিভ্যতু) অগ্নি, বায়ু এবং আদিত্য দ্বারা অর্থাৎ তাদের মাধ্যম দ্বারা
(ঋগযজুঃ সামলক্ষণং ত্রয়ং সনাতনং ব্রহ্ম) ঋগ বা কর্ম, যজু বা জ্ঞান, সাম বা উপাসনা রূপে ত্রিবিধ জ্ঞানবান নিত্য বেদকে (দুদোহ) উদ্ধৃত করে প্রকট করেছেন।
যেই পরমাত্মা আদি সৃষ্টি মধ্যে মানুষ্যের উৎপন্ন করে অগ্নি আদি চার মহর্ষিদের দ্বারা তথা মাধ্যমে চার বেদ ব্রহ্মাকে প্রাপ্ত করিয়াছেন এবং
সেই ব্রহ্মা অগ্নি বায়ু আদিত্য এবং অঙ্গিরা দ্বারা ঋগ যজু সাম এবং অথর্ববেদ গ্রহন বা শিক্ষা করেছেন। তার প্রমাণও মনুসংহিতা থেকে দেখুন-
অধ্যাপয়ামাস পিতন শিশুরাংগিরসঃ
কবিঃ।
(মনুঃ ২।১৫১)

মনুর এই শ্লোকই সাক্ষী যে পূর্বে অগ্নি বায়ু আদিত্য এবং অঙ্গিরা দ্বারা ব্রহ্মা বেদ পড়েছিলেন।
(অঙ্গিরসঃ শিশুঃ কবিঃ) অঙ্গিবংশি "শিশু" নামক বালক বিদ্বান (পিতৃন্) নিজ পিতার সমান কাকা আদি পিতৃব্য কে (অধ্যাপয়ামাস) পড়িয়েছেন(জ্ঞানেন পরিগৃহ্য) জ্ঞান দেবার
কারনে (তান পুত্রকা ইতি উবাচ) তাদেরকে "হে পুত্র" এই শব্দ দ্বারা সম্বোধিত করেছেন।
উপনিষদ্ থেকেও দেখুন-

যো ব্রহ্মানং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ প্রহিণোতি তস্মৈ।
তং হ দেবমাত্মবুদ্ধিপ্রকাশং মুমুক্ষুর্বৈ শরণমহং প্রপদ্যে।।
(শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্ ৬।১৮)
অর্থাৎ যিনি (পরমাত্মা) সৃষ্টির প্রথমে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি তাঁহার উদ্দেশ্যে (অগ্নি, বায়ু, আদিত্য ও অঙ্গিরা ঋষির মাধ্যমে ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে) বেদবিদ্যা প্ররণ করিয়াছেন, আত্ম বিষয়ক বুদ্ধির প্রকাশময় সেই পরমেশ্বরের তথা প্রসন্নতাকারী দেবের নিকট মুক্তিকামী আমি শরণাপন্ন হইয়াছি।
অর্থাৎ উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে গীতার ঐ শ্লোকে অর্জুন যখন পরমেশ্বরের মধ্যে নানাবিধ জিনিস দেখছিলেন তখন তিনি ব্রহ্মা ঋষিকেও দেখেছিলেন। বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় এই যে, প্রায় সকল গীতা ভাষ্যকারই উক্ত শ্লোকের
ঈশং শব্দের অর্থ করেছেন ঈশ্বর। কিন্তু ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শীলপ্রভুপাদ ঐ শব্দের অর্থ করেছেন শিব.। অর্থাৎ তিনি বলেছেন-

पश्यामि देवांस्तव देव देहे
सर्वांस्तथा भूतविशेषसङ्घान्।
ब्रह्माणमीशं कमलासनस्थ
मृषींश्च सर्वानुरगांश्च दिव्यान्।।11.15।।

পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে
সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘান্৷
ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থ-
মৃষীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্৷৷11.15৷৷

"...কমলাসনে (পদ্মাসনে) স্থিত ব্রহ্মা, শিব, ঋষিদের ও দিব্য সর্পদেরকে দেখছি।"
(গীতা ১১।১৫)

যদি প্রভুপাদের অনুবাদ ঠিক ধরেই নেই(যদিও তা ভুল) তারপরও এখানে শিব বলতে গলায় সাপ প্যাচানো, ত্রিশূল ধারী ও মাথায় ঝটাধারী পৌরাণিক দেবতা শিব হবে না। এখানেও মূলত শিব বলতে এক ঋষিকেই বুঝতে হবে। কারণ প্রাচীন ঋষিদের মধ্যে শিব নামকও এক জন ঋষি ছিলেন। তার প্রমাণ আমি নিজেই, কারণ আমি নিজেই ঐ ঋষি গোত্রীয়। অর্থাৎ আমি নিজেই শিব গোত্রীয়।
সকলের অজ্ঞনতার অন্ধকার দূর হোক, হৃদয়ে সত্যের প্রদীপ প্রজ্বলিত হোক ঈশ্বরের নিকট এই কামনাই করি।