ব্রাহ্মণ শব্দ নিয়ে অনেক ভ্রান্তি রয়েছে। ইহার সমাধান করা অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ হিন্দু সমাজে সবচেয়ে বড় জাতিবাদ প্রথা বিদ্যমান। ব্রাহ্মণ শব্দের সত্য অর্থ কে না বোঝার কারণে জাতিবাদের আধিক্য ঘটেছে।
শঙ্কা ০১ - ব্রাহ্মণ এর পরিভাষা বর্ণনা করুন? সমাধানঃ পড়া -পড়ানোর দ্বারা, চিন্তন মনন করার দ্বারা, ব্রহ্মচর্য, অনুশাসন, সত্যভাষন আদি ব্রত পালন করার দ্বারা , পরোপকার আদি সৎকর্ম করার দ্বারা, বেদ, বিজ্ঞান আদি পড়ার দ্বারা, কর্ত্যবের পালন দ্বারা, দান করার দ্বারা এবং আদর্শের প্রতি সমর্পিত থাকার দ্বারা মানুষের এই শরীর ব্রাহ্মণের শরীরের পরিণত হয়। - মনু ২।২৮
শঙ্কা ০২ - ব্রাহ্মণ জাতি অথবা বর্ণ?
সমাধানঃ ব্রাহ্মণ বর্ণ জাতি নয়। বর্ণের অর্থ চয়ন বা নির্ধারন এবং সামান্যতঃ শব্দ বরণেও এই অর্থ ব্যবহৃত হয়। ব্যক্তি নিজ রূচি, যোগ্যতা এবং কর্মরন অনুসারে ইহাকে স্বয়ং বরণ করে, এই জন্য ইহার নাম বর্ণ। বৈদিক বর্ণ ব্যবস্থা মধ্যে চার বর্ণ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র।
গীতার বাণী দেখুন -
ब्राह्मणक्षत्रियविशां शूद्राणां च परंतप।
कर्माणि प्रविभक्तानि स्वभावप्रभवैर्गुणैः।।18.41।।
ব্রাহ্মণক্ষত্রিযবিশাং শূদ্রাণাং চ পরংতপ৷
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ৷৷18.41৷৷
হে পরন্তপ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্রদের কর্মসকল স্বভাবপ্রভব গুণ সকল দ্বারা প্রভাবিত। গীতা ১৮।৪১।
शमो दमस्तपः शौचं क्षान्तिरार्जवमेव च।
शमो दमस्तपः शौचं क्षान्तिरार्जवमेव च।
ज्ञानं विज्ञानमास्तिक्यं ब्रह्मकर्म स्वभावजम्।।18.42।।
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ৷
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্৷৷18.42৷৷
শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষমা, আর্জ্জব, জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং আস্তিক্যতাই ব্রাহ্মণের স্বভাবজ কর্ম। গীতা ১৮।৪২।
शौर्यं तेजो धृतिर्दाक्ष्यं युद्धे चाप्यपलायनम्।
दानमीश्वरभावश्च क्षात्रं कर्म स्वभावजम्।।18.43।।
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ৷
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্৷৷18.42৷৷
শম, দম, তপ, শৌচ, ক্ষমা, আর্জ্জব, জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং আস্তিক্যতাই ব্রাহ্মণের স্বভাবজ কর্ম। গীতা ১৮।৪২।
शौर्यं तेजो धृतिर्दाक्ष्यं युद्धे चाप्यपलायनम्।
दानमीश्वरभावश्च क्षात्रं कर्म स्वभावजम्।।18.43।।
শৌর্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলাযনম্৷
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্৷৷18.43৷৷
শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন, দান এবং ঈশ্বরভাব এগুলো ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজ কর্ম। গীতা ১৮।৪৩।
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্৷৷18.43৷৷
শৌর্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, যুদ্ধে অপলায়ন, দান এবং ঈশ্বরভাব এগুলো ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজ কর্ম। গীতা ১৮।৪৩।
कृषिगौरक्ष्यवाणिज्यं वैश्यकर्म स्वभावजम्।
रिचर्यात्मकं कर्म शूद्रस्यापि स्वभावजम्।।18.44।।
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্৷
পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্৷৷18.44৷৷
কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য এগুলো বৈশ্যের স্বভাবজ কর্ম, পরিচর্য্যাত্মক কর্মই শুদ্রের স্বভাবজ কর্ম। গীতা ১৮।৪৪।
শঙ্কা ০৩ - মানুষ কোন জাতি?
সমাধানঃ মানুষ কেবল এক জাতি। তাহা "মনুষ্য"। অন্য কোন জাতি নেই।
শঙ্কা ০৪ - চার বর্ণের বিভাজনের আধার কি?
সমাধানঃ বর্ণ তৈরী করার মুখ্য প্রয়োজন কর্ম বিভাজন। বর্ণের বিভাজনের আধার ব্যক্তির যোগ্যতা। আজও শিক্ষা প্রাপ্তির উপরান্ত ব্যক্তি ডক্টর, ইন্জিনিয়ার, উকিল আদি পদ প্রাপ্ত হন। জন্ম থেকেই কেউ ডক্টর, ইন্জিনিয়ার, উকিল হন না। ইহাকেই বর্ণ ব্যবস্থা বলে।
শঙ্কা - ০৫ কোন ব্রাহ্মণ জন্ম থেকেই হয় না কি গুণ কর্ম স্বভাব দ্বারা?
সমাধান - ব্যক্তির যোগ্যতার নির্ধারণ শিক্ষা প্রাপ্তির পশ্চাতেই হয়। জন্মের আধারের উপর হয় না। কোন ব্যক্তির গুণ, কর্ম এবং স্বভাবের আধারের উপরই তার বর্ণের নির্ধারণ হয়। কোন ব্যক্তি যদি অশিক্ষিত হন এবং নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে তো তাহা ভূল।
মনুর বচন দেখুন -
যেমন কাষ্ঠন নির্মিত হস্তি এবং চর্ম নির্মিত হরিণ কেবল নাম মাত্র হস্তি এবং হরিণ বলা হয় তেমনি বিদ্যাহীন ব্রাহ্মণ কেবল নাম মাত্র ব্রাহ্মণের নাম ধারণ করেন।
মনু২।১৫৭
শঙ্কা ০৬ - ব্রাহ্মণ পিতার সন্তান কি কেবল এইজন্য ব্রাহ্মণ বলা হয় যে তার পিতা ব্রাহ্মণ?
সমাধানঃ ইহা এক ভ্রান্তি যেমন এক ডাক্তারের সন্তান তখনই ডাক্তার হবে যখন তিনি mbbs উত্তীর্ণ করবে। এরূপ ব্রাহ্মণের সন্তান তখনই ব্রাহ্মণ হবে যখন সে ব্রহ্মবিদ্যাই উত্তীর্ণ হবে।
মনুর উপদেশ দেখুন -
মাতা-পিতা দ্বারা উৎপন্ন সন্তান মাতার গর্ভ দ্বারা প্রাপ্ত সাধারন জন্ম। বাস্তবিক জন্ম তো শিক্ষা পূর্ণ করার পরই হয়ে থাকে। - মনু ২।১৪৭।
শঙ্কা ০৭ - প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য কি করতে হতো?
সমাধান- প্রাচীন কালে ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য শিক্ষিত এবং গুণবান উভয় হওয়ার প্রয়োজন পড়তো।
মনুর উপদেশ দেখুন -
বেদে পারদর্শী আচার্য দ্বারা শিষ্যকে গায়ত্রী মন্ত্রের দীক্ষা দেওয়ার উপরান্ত তাহার বাস্তবিক মনুষ্য জন্ম হয়ে থাকে। মনু ২।১৪৮।
আজকাল কিছু লোক কেবল নিজে নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে জাতির অভিমান দেখায় কারন তার পূর্বজ ব্রাহ্মণ ছিলো। ইহা একদম ভ্রান্ত ধারণা। যোগ্যতা অর্জিত করা বিনা কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারে না। আমাদের প্রাচীন ব্রাহ্মণ নিজ তপ দ্বারা নিজ বিদ্যা দ্বারা নিজ জ্ঞান দ্বারা সংসারের মার্গদর্শন করিয়েছিলেন।
শঙ্কা ০৮ - ব্রাহ্মণ কে কেন অধিক সম্মান করা হয়?
সমাধানঃ ব্রাহ্মণ এক গুণবাচক বর্ণ। সমাজের সবচেয়ে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, সমাজের মার্গদর্শন কারী, ত্যাগী, তপস্বী ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ বলার অধিকারী হয়ে থাকে। এইজন্য ব্রাহ্মণ বর্ণ কে অধিক সম্মান দেওয়া হয়। বৈদিক বিচারধায় ব্রাহ্মণকে যেমন অধিক সম্মান দেওয়া হয়েছে তেমনি ব্রাহ্মণের খারাপ কার্য পরার পর তাকে অধিক দন্ডও দেওয়া হয়েছে।
মনুর উপদেশ দেখুন -
একই অপরাধ করার জন্য শুদ্রের সবচেয়ে কম দন্ড, বৈশের দ্বিগুন, ক্ষত্রিয়ের তিন গুন এবং ব্রাহ্মণের ষোল বা ১২৮ দন্ডের বিধান। মনু ৩৩৭-৩৩৮।
এই শ্লোকের আধারের উপর মনু কোন পক্ষপাত করেন নি।
শঙ্কা ০৯ - শুদ্র কি ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ শুদ্র হতে পারে?
সমাধানঃ ব্রাহ্মণ, শুদ্র, আদি বর্ণ গুণ কর্ম এবং স্বভাবের উপর বিভাজিত। এইজন্য ইহার পরিবর্তন। কোন ব্যক্তি জন্ম থেকেই ব্রাহ্মণ হয় না। বরং শিক্ষা প্রাপ্তির পশ্চাৎ তাহার বর্ণের নির্ধারণ হয়।
মনুর বচন দেখুন -
ব্রাহ্মণ ও শুদ্র হতে পারে এবং শুদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে। এই প্রকার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যও নিজ নিজ বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে। মনুস্মৃতি ১০।৬৫।
শরীর এবং মন দ্বারা শুদ্ধ - পবিত্র এবং উৎকৃষ্ট লোকের সান্নিধ্যে স্থিত। মিষ্টিভাষী, অহংকার রহিত, নিজ থেকে উৎকৃষ্ট বর্ণের সেবাকারী শুদ্রও উত্তম ব্রহ্ম জন্ম বা দ্বিজ বর্ণকে প্রাপ্ত করতে পারে।মনুস্মৃতি ৯।৩৩৫।
যে মনুষ্য নিত্য প্রাত এবং সন্ধ্যায় ঈশ্বরের আরাধনা করে না তাহাকে শুদ্র বলে জানবে।মনুস্মৃতি ২।১০৩
যে ব্যক্তি বেদের শিক্ষাই দীক্ষিত হয় নি সে শুদ্র তুল্য।মনুস্মৃতি ২।১৭২।
যে ব্রাহ্মণ বেদের অধ্যয়ন বা পালন ছেড়ে অন্য বিষয়ে প্রযত্ন করেন সে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। মনুস্মৃতি ২।১৬৮।
ব্রাহ্মণ বর্নস্থ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ অতিশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সঙ্গ করে এবং নিচ থেকে নিচতর ব্যক্তির সঙ্গ ছেড়ে অধিক শ্রেষ্ঠ হয়। ইহার বিপরীত আচরনে পতিত হয়ে সে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়।মনুস্মৃতি ৪।২৪৫।
এমনকি কেন ব্রাহ্মণ হোক, কিন্তু যদি সে অভিবাদনের উত্তর শিষ্টতার সহিত দিতে না জানে, তবে সে শুদ্র।মনুস্মৃতি ২।১২৬।
অতঃএব ইহা স্পষ্ট যে, ব্রাহ্মণ উত্তম কর্ম কারী বিদ্বান কে বলে। এবং শুদ্রের অর্থ অশিক্ষিত ব্যক্তি। ইহা কোন জন্মগত সমন্ধ্য নয়।
শঙ্কা ১০ - আজ যে, নিজেকে নিজে ব্রাহ্মণ বলছে তারা কি আমাদের প্রাচীন বিদ্যা এবং জ্ঞানের রক্ষাকারী ছিলো?
সমাধানঃ আজকাল যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণ কুলে উৎপন্ন হয়ে প্রাচীন ব্রাহ্মণের সমান বৈদিক ধর্মের রক্ষার জন্য পুরুষার্থ করছে তারা নিশ্চিৎরূপে ব্রাহ্মণের সম্মানের পাত্র। কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ কুলে উৎপন্ন হয়েই ব্রাহ্মণ ধর্মের বিপরীত কর্ম করে। তারা কোনরূপ ব্রাহ্মণ বলার যোগ্য নয়। যেমনঃ কোন ব্যক্তি যদি শাকাহারী, সৎ চরিত্রবান, ধর্মের জন্য পুরুষার্থ করেন তাহার বর্ণ ব্রাহ্মণ বলার যোগ্য হোক সে শুদ্র সন্তান। অপরদিকে মাংসাহারী, অসৎচরিত্র, সমাজের কোন হিত করে না। সে কখনো ব্রাহ্মণ বলার যোগ্য নয় যদিও সে ব্রাহ্মণ সন্তান হোক। কেবল বসন ধারন করলেই সে ব্রাহ্মণ হয়ে যায় না। সাথে বৈদিক ব্রত, ধর্মের পালন অনিবার্য। প্রাচীন কালে ধর্মরূপী আচরন এবং পুরুষার্থের কারণে ব্রাহ্মণ মানা হয়েছিলো।
এই লেখার মাধ্যমে বৈদিক বিচারধারায় ব্রাহ্মণ শব্দের ভ্রান্তির নিরাকরনের প্রয়াস করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ শব্দের বেদে অনেক মহত্ত্বতা। ইহার মুখ্য কারণ জন্মগত ব্রাহ্মণ নয় বরং কর্মগত ব্রাহ্মণ। মধ্যকালে আমাদের বৈদিক বর্ণ ব্যবস্থা পরিবর্তন হয়ে জাতি ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। জাতিবাদ দ্বারা হিন্দু সমাজের একতা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে। হিন্দুর ১২০০ বর্ষের দমনের কারণের যদি কোন মুখ্য কারণ থাকে তাহা জাতিবাদ। জাতিবাদই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আসুন এই জাতিবাদ রূপী শত্রু কে নষ্ট করার সংকল্প গ্রহন করি।
Good lesson.
ReplyDeleteঅসাধারন ।প্রণাম করি আপনাকে।
ReplyDelete