https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বেদে কি নৃসিংহ অবতারের কথা রয়েছে?

Monday, July 24, 2017


ঈশ্বরের অবতারত্বের পক্ষে ওকালতি করতে পৌরানিকদের যেন জুড়ি নেই।  সঙ্কটকালে তাদের মতে  ঈশ্বর  মৎস, কচ্ছপ, বরাহের মতো প্রানী হয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করেন। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের  শক্তি সমন্ধ্যে এই হচ্ছে তাদের ধারণা । যে ঈশ্বর সমস্ত বিশ্বকে ধারন করে আছেন সে বিশ্বকে রক্ষা করতে কি তার এরূপ প্রানী সেজে আসার প্রয়োজন আছে?
 ধরে নেওয়া যাক, সেসব প্রাণীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি এরূপ কাজ করেছেন।  কিন্তু পৃথিবীতে কি আদৌ সেসব প্রাণীরা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে?   মৎস, কচ্ছপ,  শুকর এসব প্রাণীরা কি তাদের  ভোজন থেকে রেহাই পেয়েছে?? দেখা যায় যে, সঙ্কটকালে  ভারতবর্ষেই অবতারের আবির্ভাব বেশী হয়।   কিন্তু সে ভারতবর্ষেই বরাহ অবতার  প্রচলিত ভাষায় শূকর মাংসের প্রচলন বেশী।  এতে করে কি অবতারের সম্মান হানি হয় না??  মৎস, কচ্ছপ, শুকর বাদই দিলাম,  তারা ঈশ্বরকে ভক্ত উদ্ধারের জন্য এমন এক দূর্লভ প্রাণী সেজে অবতরন করেন  যার অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে খুজে পাওয়া কঠিন। আমি "নৃহিংস" অবতারের কথা বলছি।  যে প্রাণীর অর্ধেক শরীর মানুষের মতো অর্ধেক সিংহের মতো। পুরাণ মতে তিনি ভক্ত প্রহ্লাদ কে রক্ষা করেন এবং  হিরণ্যকশিপুর মতো দৈত্যকে বধ করেন। গল্পটি বেশ প্রসিদ্ধ পৌরানিকদের কাছে। গল্পের ভীত শক্ত করতে তারা বেদের নিম্ন মন্ত্রটি উপস্থাপন করেন -

প্র তদ্বিষ্ণুঃ স্তবতে বীর্যেণ মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ।
যস্যোরুষু ত্রিষু বিক্রমণেষ্বধিক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা।।২।।
(ঋগবেদ ১।১৫৪।২)

অর্থাৎ বিষ্ণু সিংহের ন্যায় ভয়ংকর সমস্ত লোক লোকান্তর কে প্রসংসিত করেন। 

মন্ত্রের এই লাইনটিকে হাইলাইট করে তারা বিষ্ণুর নৃসিংহত্ব প্রতিপাদনের চেষ্টা করে। মন্ত্রটিকে আরো রসালো করতে এবং নৃসিংহের সর্বব্যপকত্ব প্রতিপন্ন করতে তারা ভাগবতের নিম্ন গল্পটির উপস্থাপন করে।

হরিণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করে- তোর হরি কোথাই আছে?  প্রহ্লাদ উত্তর করে সর্বত্র। হিরণ্যকশিপু জিজ্ঞেস করে এই স্তম্ভে আছে?  প্রহ্লাদ বলে - হ্যা আছে। তখন হিরণ্যকশিপু স্তম্ভ টিকে ভেঙ্গে ফেলেন।  আর সেখান থেকে নৃসিংহ বের হয়ে এসে হিরণ্যকশিপু কে বধ করেন। (ভাগবত স্কন্ধ ৭ সংক্ষেপিত)

গল্পটি পড়লে নৃসিংহকে বেশ পরাক্রমী মনে হয়।  আচ্ছা  নৃসিংহের গল্পটায় পরেই না হয় আসছি প্রথমত বেদ মন্ত্রটির উপর সমীক্ষা করা যাক -

মন্ত্রটির সম্পূর্ণ শব্দার্থ হচ্ছে -
 হে মনুষ্যো! (যস্য) যেই জগদীশ্বরের নির্মাণ কৃত (ত্রিষু) জন্ম, নাম এবং স্থান এই তিন (বিক্রমণেষু) বিবিধ প্রকারের সৃষ্টিকর্মে (বিশ্বা) সমস্ত (ভূবনানি) লোক- লোকান্তর (অধিক্ষিয়ন্তি) আধাররূপে নিবাস করে (তত) তিনি (বিষ্ণুঃ) সর্বব্যাপী পরমাত্মা নিজ (বীর্যেন) পরাক্রম দ্বারা (কুচরঃ) কুটিলগামী অর্থাৎ উচু নিচু নানা প্রকার বিষম স্থলে চলনশীল এবং (গিরিষ্ঠাঃ) পর্বতে স্থিত (মৃগঃ) সিংহের (ন) সমান (ভীমঃ) ভয়ংকর সমস্ত লোক লোকান্তরকে (প্রস্তবতে) প্রসংশিত করেন।

ভাবার্থঃ কোনও পদার্থ ঈশ্বর এবং সৃষ্টির নিয়ম কে উলঙ্ঘন করতে পারে না।  যিনি ধার্মিক জনকে মিত্রের সমান আনন্দ দানকারী ,দুষ্টকে সিংহের সমান ভয় দানকারী এবং ন্যায়াদি গুণের ধারনকারী পরমাত্মা,  তিনিই সবার অধিষ্ঠাতা এবং ন্যায়াধীশ, ইহা জানা উচিৎ। (ভাষ্যঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী)

মন্ত্রটিতে "মৃগ" শব্দটি  উল্লেখযোগ্য।  মৃগ এখানে "সিংহ" বা "বাঘ" অভিপ্রেত।  মৃগ অর্থে বিভিন্ন বন্যপশুর নাম।  এই জন্য সিংহকে মৃগেন্দ্র বলা হয়। মন্ত্রে মূলতো সিংহের উপমা দেওয়া হয়েছে।  নিরুক্তাকার যাস্ক এ সমন্ধ্যে বলেন -  " মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ। মৃগ ইব ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠা,   নিরুঃ ১।২০"   এখানে "" উপমা অর্থে এইজন্য মৃগ ইব ভীমো কুচরো গরিষ্ঠাঃ করা হয়েছে।




অর্থাৎ মন্ত্রে সিংহের উপমা দিয়ে বলা হয়েছে ঈশ্বর সিংহের সমান দুষ্টকে ভয় প্রদান করেন।  এখানে "নৃসিংহের " কোন প্রসঙ্গই আসে নি যে সিংহের অর্ধেক মানুষের মতো।  মন্ত্রটিতে "সিংহ" শুধু উপমা মাত্র। যেমন কোন ব্যক্তিকে যদি কোন প্রানীর সাথে উপমা দিয়ে বর্ণনা করা হয় তার মানে সেই ব্যক্তিটি উল্লেখিত সেই প্রানী হয়ে যায় না।  উদাহরনস্বরূপ- মাতা সীতার স্বয়ংম্বরে বিশ্বামিত্র রাম ও লক্ষণকে নিয়ে জনকপুরীতে উপস্থিত হলে রাজা জনক তাদের দেখে একথা বলেন-

গজসিংহগতী বীরৌ মার্ভূল বৃষভৌপমৌ।
যদমপত্রবিশালাক্ষী খঙ্গাতুণীর্ধনুর্ধারী।।
(বাল্মিকী রামায়নঃ বাল কান্ড ৫০।১৮)

" হে মুনিবর! হস্তি এবং সিংহের সমান চলনশীল,  দেবতার সমান পরাক্রমি তথা অশ্বিনী কুমারের মতো সমান সুন্দর এবং যৌবন কে প্রাপ্ত এই দুই কুমার কে?



এস্থলে রাম ও লক্ষণকে হস্তি এবং সিংহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাহলে কি রাম এবং লক্ষনকে "নরহস্তি"  অথবা "নরসিংহ"  বলতে হবে?

অথর্ববেদ ৭।২৬।২ এর প্রথমাংশে ঋগবেদের উক্ত মন্ত্রটি এসেছে।  মন্ত্রটির ভাবার্থে ক্ষেমকরন দাস ব্যাখ্যা করেছেন -

" যেমন সিংহের পরাক্রম জঙ্গলী পশুর মধ্যে বিদিত হয়,  ওইরূপই সর্বব্যাপী,  পাপীদের দন্ডদানকারী পরমাত্মার সামর্থের নিকট এবং দূর সব লোক প্রসিদ্ধ।" 


এবার আসি ভাগবতের সেই প্রসিদ্ধ গল্পে যেখানে  নৃসিংহের স্তম্ভ ভেঙ্গে বের হয়ে আসার গল্প রয়েছে।  নৃসিংহের  আবির্ভাবের ঘটনা অনান্য পুরাণেও এসেছে সেখানে কিন্তু নৃসিংহ মোটেও স্তম্ভ ভেঙ্গে বের হন নি।  মৎস পুরাণে  এরকম বর্ননা এসেছে যে, হিরণ্যকশিপুর অত্যাচারে দেবতাকর্তৃক প্রার্থীত হয়ে বিষ্ণু নৃসিংহ হয়ে এসে হিরণ্যকশিপুর সভা পরিদর্শন করেন -

ততোহপশ্যতবিস্তীর্ণাদিব্যাং রম্যাংমনোরমাম্।
'সর্ব্বকামসুতাং শুভ্রাং হিরন্যকশিপঃ সভাম্।।
(মৎসপুরাণ ১৬১। ৩৮)

তিনি অদূরে হিরন্যকশিপুর সভা সন্দর্শ করিলেন।  দেখিলেন - ঐ সভা শতযোজন বিস্তীর্ণ, দিব্য রম্য, মনোজ্ঞ, সর্ব্বকাম সমৃদ্ধ। 




তং দৃষ্টা রুক্নশৈলাভমপূর্ব্বাং তনুমাশ্রিতম্।
বিস্মিতা দানবাঃ সর্ব্বে হিরণ্যকশিপুশ্চ সঃ।।
(মৎসপুরাণ ১৬২।৩)

তখন সেই কনকগিরিনিভ অপূর্ব্ব দেহধারী হরিকে দেখিয়া স্বয়ং হিরণ্যকশিপু এবং অনান্য সমস্ত দানবই বিষ্ময়াপন্ন হইলো।


এরপরের শ্লোকগুলোতে হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে  নৃসিংহের সাথে দানবদের ঘোর যুদ্ধ বাধে।  এবং অন্তিমে নৃসিংহের হাতে হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু ঘটে।
অর্থাৎ মৎসপুরানের পুরো ঘটনা অনুযায়ী নৃসিংহ কোন স্তম্ভ ভেঙ্গে বের হন নি।   এমন কি নৃসিংহকে নিয়ে রচিত নারসিংসপুরাণেও এরকম কোন ঘটনার উল্লেখ নেই।  নারসিংহ পুরাণের ৩৮ তম অধ্যায়ে এরকম বর্ণনা এসেছে - 

"দানবদিগের ভয়ঙ্কর অতি রৌদ্রতর, মহাকায় মহানেত্র, মহাবক্ত্র, মহাদ্রংষ্ট্র, মহানখ, মহাবক্ষ, মহাপাদ, কালাগ্নিসদৃশ দীপ্তানন নারসিংহ আকার স্বীকার করিলেন। অনন্তর ত্রিবিক্রম বিষ্ণু মুনিগনকর্তৃক স্তত হইয়া হিরণ্যকশিপুর পুরোভাগে গমন করিয়া ভীমনাদে দিঙ্মন্ডল নিনাদিত করিতে লাগিলেন। " 


এই বর্ননা অনুযায়ী এখানেও নৃসিংহের স্তম্ভ ভেঙ্গে বের হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।  শুধুমাত্র ভাগবতেই স্তম্ভ ভাঙ্গার রসালো গল্পটি পাওয়া যায়।  অন্যান্য পুরাণ এ ঘটনার কোনরূপ সমর্থন করে নি।

যাই হোক হিরন্যকশিপুর শেষ পরিণাম সমন্ধ্যে তো আপনারা সবাই জানেন যে, নৃসিংহের হাতে তার মৃত্যু ঘটে।  কিন্তু নৃসিংহের শেষ পরিণাম সমন্ধ্যে জানতে ইচ্ছে করে না??  চলুন পুরাণেই দেখে নেওয়া যাক নৃসিংহের শেষ পরিণাম।

  লিঙ্গ পুরাণ পূর্বভাগের ৯৬ তম অধ্যায়ে  এরকম বর্ণনা এসেছে - "দেবদেব সেই সুরগণ ও মহর্ষিকে বললেন, যেমন জলে জল, দুগ্ধে দুগ্ধ, ঘৃতে লীন হইয়া থাকে, সেই প্রকার এই নৃহিংসরূপী বিষ্ণুও আমাতে লীণ হইয়াছেন,  আমরা উভয়ে ভিন্ন নহি জানিবে। " 



 ভগবান মহাবল বীরভদ্র এই কথা বলে সেই দেবগনের সম্মুখেই অদৃশ্যভািে অন্তর্হিত হইলেন। শঙ্করের সেই অবধিই নৃসিংহ চর্ম বসন হইলো, সেই নৃসিংহের ছিন্নমস্তকই মুন্ডমালার মধ্যস্থলে মধ্যমণিস্বরূপ ভাসমান হইতে লাগিলো। 




অর্থাৎ আমরা শিবের চিত্রে তার যে আসন এবং বসন  দেখতে পাই তা আর কারো নয় তা স্বয়ং নৃসিংহের গায়ের চর্ম।  এভাবে নৃসিংহের অন্তিম পরিণাম শিবের বসনে পরিণত হবার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে।

[পাঠকবৃন্দ এ লেখার উদ্যেশ্য আপনাদের বিশ্বাসে আঘাত করার জন্য নয়।  বরং এ লেখার মাধ্যমে  সত্য উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।  কারণ অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে কখনোই  ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা সম্ভব নয়। বরং সত্য ও অসত্যের নির্ণয় দ্বারা সঠিক জ্ঞান প্রবাহের মাধ্যমেই ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বোঝা সম্ভব ]