https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

ব্রহ্ম তত্ত্ব, প্রতীক উপাসনা এবং অবতার

Wednesday, July 26, 2017
                             

ওঁঙ্কার তত্ত্ব মানুষ চেতন হইয়াও জন্মাবধি জড়বস্তুর চিন্তার দ্বারা জড়ত্ব অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া রহিয়াছে। ফলে জড়ের যেসব ধর্ম, যেমন —শারীরিক রোগ, মানসিক শোক, জন্ম -মৃত্যু ইত্যাদি নৈসর্গিক অবস্থার দ্বারা উৎপীড়িত হইয়া পশুভাবে জীবনযাপন করিতে বাধ্য হইতেছে। “আহার নিদ্রা-মৈথুন-ভয় পশু-নরের সমান হয়”।
পশুর জন্য কোন ধর্মের প্রয়োজন হয় না। তাহারা নিরুপায় হইয়া প্রকৃতির মধ্যে বসবাস করিয়া পুনঃ পুনঃ জন্ম-মৃত্যু এবং শারীরিক মানসিক দুঃখ যাতনা ভোগ করে। কিন্তু মানুষ তাহার বিদ্যাবুদ্ধির দ্বারা উপায় উদ্ভাবন করিয়া কিভাবে এই সব অবস্থা হইতে মুক্ত হইয়া এই মনুষ্য জীবনেই পরমশান্তি লাভ লাভ করিতে পারা যায়, সেই উদ্দেশ্যেই সাধন-ভজনের ব্যবস্থা করিয়া লইয়াছে।
জড়ত্ব অবস্থা হইতে মুক্ত হইয়া চেতনত্ব অবস্থা লাভই সাধনার লক্ষ্য। সাধারন ক্রম অনুসারে বেদ ওঁঙ্কার সাধনার পদ্ধতি নির্দেশ দিয়াছেন। উপনিষৎ বলেন, — এতদালম্বনং শ্রেষ্ঠং এতদালম্বনং পরম্। এতদালম্বনং জ্ঞাত্বা ব্রহ্মলোকে মহিয়তে।। (কঠো উপঃ ১।২।১৭) অর্থ —যে সব উপায় অবলম্বন পূর্বক ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়া পরম শান্তির অধিকারী হওয়া যায়, তন্মধ্যে ওঁঙ্কার অবলম্বনই শ্রেষ্ঠ । তস্য বাচক প্রণবঃ। (পাতঞ্জল যোগ দর্শন) —ওম্ শব্দটি ব্রহ্মের প্রতীক। এই প্রতীকের উপাসনার দ্বারা ব্রহ্মকে (ভগবান) কে লাভ করা যায়। গীতা বলেন, — ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যহরন্ মামনুস্মরন্। যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং স যাতি পরমাং গতিম্।। (৮/১৩) অর্থ—ব্রহ্মের প্রতীক ওম্ শব্দটিকে ভালভাবে জানিয়া লইয়া আমাকে (আত্মাকে) স্মরণ করিতে করিতে যে দেহ ত্যাগ করে সে পরমগতি (মোক্ষ) লাভ করে। ওম্ শব্দটি কি তাহা জানিয়া লইয়া ভগবানকে স্মরণ করিতে বলা হইয়াছে। ব্যাহরণ্ (বি+আহরণ্ ) =ব্যাহরণ্। ‘বি’ (বিশেষরূপে, ভালভাবে) + ‘আহরণ্’ (আহরণ্ করিয়া, জানিয়া লইয়া) ব্যাহরণ্ অর্থ উচ্চারণ করা নহে। সুতরাং ভগবানকে স্মরণ করিতে করিতে যে দেহত্যাগ করে সে মোক্ষলাভ করে। এখানে ভগবানের নাম মুখে মুখে উচ্চারণ করার কথা গীতা বলেন নাই। ভগবানের কোন নাম নাই —তিনি অনামী। সুতরাং যেরূপ শব্দের দ্বারা ভগবৎ তত্ত্বের স্মরণ হয়, তাহাই ভগবানের নাম। যে সব শব্দের দ্বারা চিন্ময় স্বরূপের স্মরণ হয় না পরন্তু মনের সম্মুখে একটি মনুষ্যকৃতি বা রূপময় কোন মূর্তি ভাসিয়া উঠে, ঐ সব শব্দ ভগবন্নামীয় নহে -ঐসব সাম্প্রদায়িক শব্দ। ভগবানের নাম বলিয়া যে সব শব্দ প্রাচারিত হইয়াছে সকলই মানুষের দেওয়া নাম।
প্রশ্নঃ —ওম্ শব্দের দ্বারা যদি ভগবানের স্মরণ হয়,তবে কেন অন্যান্য শব্দের দ্বারা ভগবানের স্মরণ হইবে না কেন ?
উত্তরঃ —ওম্ শব্দটির দ্বারা কোন রূপ বুঝায় না। ওম্ শব্দটির মধ্যে জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি এই তিনটি মনের অবস্থা এবং তুরীয় নামে অবস্থার অতীত আরও একটি বস্তু আছে। ওঁম্কারের নিচের অংশটি জীবের জাগ্রত অবস্থা, মাঝখানের পুটুলিটি স্বপ্ন অবস্থা এবং মস্তকটির দ্বারা সুষুপ্তি গাঢ় নিদ্রা বুঝায়। এই তিনটিই জীবত্ব। প্রতি জীবের মধ্যে যে চেতন স্বরূপ পরমাত্মা রহিয়াছেন, যিনি দেহ ত্যাগ করিলে জীব মৃত বলিয়া পরিগনিত হয়, সে চৈতন্যসত্তার নামই তুরীয় ব্রহ্ম। (ঁ) এই চিহ্নটিই তুরীয় ব্রহ্মের প্রতীক। মনের তিনটি অবস্থা প্রকৃতির অন্তর্গত এবং তুরীয় ব্রহ্ম প্রকৃতির অতীত বা অপ্রাকৃত। এই অপ্রাকৃত বস্তুটিই ওম্ শব্দের লক্ষ্য।
সুতরাং ওম্ শব্দের দ্বারা কোন মনুষ্যমূর্তি বুঝায় না, পরন্তু তুরীয় ব্রহ্মকে (চৈতন্যসত্তাকে) স্মরণ করাইয়া দেয়। মনুষ্যমূর্তি প্রকৃতির অন্তর্গত বলিয়া উহা ধ্যানের অযোগ্য। প্রকৃতি জড়া বলিয়া তাঁহার চিন্তনের দ্বারা জড়ত্বই প্রাপ্তি ঘটে। ওম্ কার প্রকৃত ও অপ্রাকৃত অবস্থার মিলনের সেতুস্বরূপ। ইহা সকল জীবের মধ্যেই আছে। তাই ইহা বাস্তব; কোন কাল্পনিক দেবতার রূপ নহে। ওম্ কার জড় ও চেতন সকলকে ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে। ব্রহ্মও সর্বব্যাপী। এইজন্য ওম্ কারই ব্রহ্ম। ওম্ কারকে ব্রহ্ম বলিয়া উপাসনা করিলে মানবের সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। — — — — শব্দ ব্রহ্ম শব্দকে ব্রহ্ম বলা হইয়াছে। “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—সকলই ব্রহ্মময়। এই অর্থে শব্দও ব্রহ্ম। শব্দ যদি ব্রহ্মই হইয়া থাকে, তবে শব্দ উচ্চারণ করা মাত্রইতো ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হইতে পারে। কিন্তু কার্যতঃ কি তাহা হয় ? মানবমাত্রই ব্রহ্ম হইলেও ব্রহ্মের অনুভব না হওয়া পর্যন্ত যেমন তাহাকে ব্রহ্মবিৎ বলা যায় না, সেইরূপ শব্দ ব্রহ্ম হইলেও যেসব শব্দ ব্রহ্মের বাচক নহে অর্থাৎ যে শব্দ উচ্চারণের দ্বারা ব্রহ্ম বা সচ্চিদানন্দের স্মরণ হয় না, কিন্তু মনের সম্মুখে একটি নাম ও রূপময় ব্যক্তি বা বস্তু ভাসিয়া উঠে, উহা শব্দব্রহ্ম নহে । সুতরাং যে শব্দ উচ্চারণের দ্বারা মন নাম-রূপহীন হইয়া সচ্চিদানন্দের স্মরণ মনন করে তাহাকেই শব্দব্রহ্ম বলে । রাম, শ্যাম, কালী, কৃষ্ণ, যিশু, প্রভৃতি যেসব শব্দের দ্বারা মনের সম্মুখে একটি রূপময় ব্যক্তি ভাসিয়া উঠে, এইসব নাম ও রূপ প্রকৃতির অন্তর্গত । রূপ প্রকৃতির স্থুল অবস্থা এবং নাম সুক্ষ্ম অবস্থা —উভয়ই প্রকৃতি । প্রকৃতি ও পুরুষ একবস্তু নহে । প্রকৃতি দৃশ্য বস্তু আর পুরুষ দ্রষ্টা ; প্রকৃতি অচেতন বা জড়, আর পুরুষ চেতন । অচেতন বস্তুর চিন্তাদ্বারা মনও অচেতনত্ব প্রাপ্ত হয়, অতএব জড়ত্বে পরিণত হয়। অনেকের ধারণা বেদ, গীতা, বাইবেল প্রভৃতি শাস্ত্রের বাণী উচ্চারণ করিলেই মানব মুক্ত হইয়া যায়। কিন্তু যে পর্যন্ত নাম বা বাণী হৃদয়ের দুয়ার খুলিয়া না দেয়, সে পর্যন্ত শাস্ত্রীয় বাণী হইলেও উহা জড়বস্তু । “মুক্তিস্তু ব্রহ্মতত্ত্বস্য জ্ঞানাদেব ন চান্যথা” (পঞ্চদশী) —ব্রহ্মতত্ত্বের (নিজস্বরূপ) পরিজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি লাভ হয় না । কোন শব্দই মানুষকে মুক্ত করিতে পারে না। একটি লৌহখণ্ডকে অগ্নিতে উত্তপ্ত করিলে যেমন সেই জলন্ত লৌহখণ্ডের দ্বারা অন্য কোন দাহ্যবস্তুকেও দগ্ধ করা যায়, কিন্তু ঐ জলন্ত লৌহখণ্ডকে অগ্নি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিলে উহা পুুনরায় নিজ স্বভাব (আগ্নিহীনতা) প্রাপ্ত হয়, তখন উহাদ্বারা কোন কিছুই দগ্ধ করা যায় না। এইজন্য কোন ধর্মগ্রন্থে লিখিত কোন বাণী পাপীর পাপ দূর করার নিজস্ব কোন শক্তি নাই—কোন জীবন্ত জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট হইতে সেই বাণী শ্রবণের বা গ্রহণের সার্থকতা স্বীকৃত হয় । শাস্ত্রলিখিত বাণী কেহ যদি গ্রহণ না করে, তবে তাহাদ্বারা পাপীর পাপ-তাপ দূর হইবে কিরূপে ? গ্রহণ করা বা না-করা গ্রহীতার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে—শব্দের জোরপূর্বক কাহাকেও কিছু করাইবার ক্ষমতা নাই। তারপরে, একই শব্দের বহু অর্থ হইতে পারে । যেমন, ‘ভগ্’ শব্দের অর্থ ভগবানের ঐশ্বর্য । আবার একই শব্দের দ্বারা স্ত্রীযোনিও বুঝায়। গ্রহীতার মানসিক ভাব অনুসারে প্রথমটির দ্বারা মনে ভগবৎ ভাব জাগিয়া উঠে, দ্বিতীয়টির দ্বারা মনে কুৎসিত ভাবের সঞ্চার হয় । আবার যে শিশু ভগ শব্দের কোন অর্থই জানে না, তাঁহার মনে সৎ -অসৎ কোন ভাবেরই স্ফুরণ হয় না । শব্দের যদি নিজস্ব কোন শক্তি থাকিত, তবে উচ্চারণ করামাত্র সকলের মনে একই প্রকার ক্রিয়া হইত । সুতরাং চেতন মনের সহিত যে পর্যন্ত শব্দ (বাণী) যুক্ত না হয়, সে পর্যন্ত উহা জড় বা শক্তিহীনই থাকিয়া যায় । মনের সচেতনতা যাহার মধ্যে যতটা স্ফুরিত হয়, বাণীরও বেগ ততটা বৃদ্ধি পায় । মনের চেতনতা (জ্ঞানের অংশ) কম থাকিলে বাণীরও ক্রিয়া কম হয় । অতএব আমরা এই সিদ্ধান্তে আসিতে পারি যে, চেতনের দ্বারাই সমস্ত ক্রিয়া সাধিত হইতেছে —জড়ের দ্বারা কোন কর্ম হয়না এবং নাম ও রূপ উভয়ই জড় পদার্থ । অগ্নিদ্বারা লৌহ উত্তপ্ত হইয়া যেমন কোন দাহ্যবস্তুকে দগ্ধ করে, সেইরূপ কোন জ্ঞানী পুরুষের জ্ঞানের দ্বারা অগ্নির মত জড়শব্দ চৈতন্যময় হইয়া অপরের উপরে ক্রিয়া প্রকাশ করে । অতএব কোন সত্যে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট হইতে ধর্মগ্রন্থের বাণী শ্রবণ না হইলে, যেরূপ ব্যক্তির নিকট হইতে ঐ বাণী শ্রবণ হইবে সেই ব্যক্তিবিশেষের মনের অবস্থানুসারে বানী ভাল বা মন্দ ক্রিয়া করিবে । অর্থাৎ ধর্মযাজক উন্নত হইলে শ্রোতারাও উন্নত হইতে পারে এবং ধর্মযাজক অনুন্নত হইলে শ্রোতারাও উন্নত হইতে পারে না ।
প্রশ্ন— কোন ব্যক্তি সত্যে প্রতিষ্ঠিত তাহা কিরূপে বুঝা যাইবে ?
উত্তর— যে ব্যক্তি প্রকৃতিজ বস্তু বা বিষয়ের আসক্তি (বন্ধন) হইতে মুক্ত হইয়াছেন, তিনিই মুক্ত । তিনিই সত্যে প্রতিষ্ঠিত । আর যাহার মনে দেহের উপরে আমিত্ব বোধ, নাম -রূপের উপরে সত্যতাবুদ্ধি, ধন-যশঃ-মান প্রভৃতি লাভের আকাঙ্ক্ষা, ধন-জন বিয়োগে ব্যথিত হওয়া ইত্যাদি অজ্ঞানমুলক ভাবগুলি বিরাজ করে, তিনি কখনও সত্যে প্রতিষ্ঠিত নহেন । কে সত্যে প্রতিষ্ঠিত এবং কে প্রতিষ্ঠিত নহে তাহা বাহির হইতে বুঝিবার উপায় নাই । তাহার আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা এবং চালচলন দেখিয়া অনুমান করা যাইতে পারে মাত্র । সত্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি নিজেই নিজের মনকে বুঝিতে পারেন । নিজের বক্ষদেশে হস্ত রাখিয়া কেহ যদি প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতে পারে যে, “আমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছি, আমার হৃদয়ে এখন আর প্রাকৃত কোন বস্তু লাভের জন্য ইচ্ছা জাগে না” এবং “আমি যদি মিথ্যা বলিয়া থাকি, তবে আমার জীবন অন্ধকারে ডুবিয়া যাইবে, আমার পুত্রকন্যা মারা যাইবে” তবেই বুঝা যাইবে তিনি কতটুকু সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন । — — — — অনাহত নাদ ‘নাদ’ অর্থ ধ্বনি যাহা শঙ্খের শব্দের মত উচ্চারিত হয় এবং যাহার বর্ণগত কোন অর্থ হয় না । যেমন, অ….অ….অ….অ একটি ধ্বনি। এই ধ্বনিটির কোন অর্থ নাই কিন্তু একটি শব্দ ধ্বনিত হয় । সকল মানবের মধ্যে জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত একটি ধ্বন্যা শব্দিত হইতেছে । বিশেষভাবে মনযোগ সহকারে দক্ষিণ কর্ণের উপর নীরবস্থানে বসিয়া লক্ষ্য করিলে এই শব্দ বাহির হইতেও শোনা যায় । এই ধ্বনির আদি নাই অন্ত নাই —ইহা জন্মের সঙ্গে আসে এবং দেহাবসান পর্যন্ত থাকে । এই ধ্বনি আঘাতপ্রাপ্ত হয় না বা খণ্ড খণ্ড হয় না বলিয়া ইহাকে অনাহত নাদ বা ধ্বনি বলে । এই নাদই খণ্ডিত হইয়া অ ....আ….ক….খ….গ….ঘ. ইত্যাদি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে । এই বর্ণমালার দুইটি, তিনটি বা ততোধিক বর্ণ মিলিত হইয়া এক একটি শব্দের সৃষ্টি হইয়াছে । এক একটি শব্দের দ্বারা এক একটি অর্থ প্রকাশ পায় এবং এক একটি রূপের জন্ম হয় । শব্দেরই স্থূল রূপ এই জগত । নাদ স্থূল ও সূক্ষ্ম দ্বিবিধ —যাহা কর্ণের দ্বারা শোনা যায় তাহা স্থূল নাদ । ওঁকারের স্থূল রূপই স্থূল নাদ । সৃষ্টির পূর্বে মন হইতে যে ধ্বনি উঠে অর্থাৎ সৃষ্টির জন্য যে ইচ্ছা জাগে, উহাই সূক্ষ্ম নাদ । মনের সঙ্কল্পই এই সূক্ষ্ম নাদ । জ্ঞানোজ্বলা সূক্ষ্ম নাদই প্রকৃত ওঁকার । এই সূক্ষ্ম নাদকেই তারকব্রহ্ম নাম বলে । বিভিন্ন বর্ণ হইতে সৃষ্ট যে শব্দ, সেই শব্দ স্থূল ওঁকারে আসিয়া লীন হয় এবং পরে স্থূল ওঁকার সূক্ষ্ম নাদে বিলিন হয় । এই সূক্ষ্ম নাদই সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্মের নিকট গমন করে বা ব্রহ্মেতে লীন হয় । “যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ” (গীতা ৩।৪২) —বুদ্ধিরও পরে যিনি অবস্থান করেন তিনিই ব্রহ্ম । এই ভাবেই মানবের ব্রহ্মতত্ত্বের পরিজ্ঞান হয় । রাম, যদু, কালী, কৃষ্ণ প্রভৃতি নামের সাক্ষাৎভাবে ব্রহ্মের সহিত মিলনের ক্ষমতা নাই । এই জন্যই এইসব বর্ণযুক্ত নামের তারকব্রহ্ম নাম বলিয়া আখ্যাত হইবার যোগ্যতা নাই। নাম -জপ মন স্থির না হইলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। ইহা সকল শাস্ত্রের ও সকল সম্প্রদায়েরই সিদ্ধান্ত । পুকুরের জল আলোড়িত হইলে যেমন গগনে উদিত পূর্ণচন্দ্রের প্রতিবিম্ব সেই জলের উপরে ঠিকভাবে দেখা যায় না, সেইরূপ মনও সুস্থির না হইলে মানবের অন্তঃস্থল হইতে ভগবানের ভাব ফুটিয়া উঠে না । মনস্থিরের জন্য সকল সমাজেই মন্ত্রজপ একটি মহৌষধ হইয়া দ্বাড়াইয়াছে । মুখে মুখে ভগবানের নামীয় কোন মন্ত্র পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ. করার নাম মন্ত্রজপ । মন্ত্রজপের সময়ে দুইটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন ঃ— ( ১) মন্ত্রটির অর্থ কি ? (২) মন্ত্রকে চৈতন্যময় করিবার কৌশল । মন্ত্রের অর্থ জ্ঞান না হইলে মন লক্ষ স্থলে পৌঁছিতে পারে না । যেমন — “আয় ছাগলী পাতা খা। পাতা খেয়ে স্বর্গে যা।” একটি মন্ত্র । এরূপ মন্ত্রের মধ্যে কোথাও পৌঁছিতে হইবে এরূপ উদ্দেশ্যমূলক কোন ভাব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না । সুতরাং এরূপ মন্ত্রের দ্বারা উদ্যেশ্য সিদ্ধ না হইয়া পরিশ্রমই সার হয়। কাহারও মন্ত্র আছে, “দধি ভক্ষকায় নমঃ” —যিনি দধি খাইয়াছিলেন তাঁহাকে নমস্কার । কাহারও মন্ত্র আছে “গোপিজন বল্লভায় নমঃ” ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের মন্ত্র আছে । এই সব মন্ত্রের দ্বারা সচ্চিদানন্দ স্বরূপ ভাষিয়া না উঠিয়া মনের সম্মুখে একটি মনুষ্যকৃতি মূর্তিই ভাসিয়া উঠে । এই সব মন্ত্রের দ্বারা মন বৃত্তিশূণ্য হয় না বলিয়া মুক্ত হইতে পারে না পরন্ত একটি রূপময় স্মৃতির বাগুড়ায় (জালে) মন আবদ্ধ হইয়া পড়ে । পরম শান্তি বা সচ্চিদানন্দ প্রপ্তিই সকলের লক্ষ্য । সুতরাং যে সব মন্ত্রের দ্বারা মন নাম -রূপের চিন্তা বিহীন হইয়া সচ্চিদানন্দ ভাব প্রাপ্ত হয় অথবা মন চঞ্চলতা ত্যাগ করিয়া পরম শান্তভাব ধারণ করে, তাহাই মন্ত্র শব্দের লক্ষ্য । নিজের ইচ্ছামত একটি শব্দকে মন্ত্ররূপে ব্যবহার করিলেই মন্ত্রজপের উদ্যেশ্য সিদ্ধ হয় না । গীতা বলেন,— যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ। ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্।। (১৬/২৩) অর্থ —শাস্ত্রবিধি অমান্য করিয়া যাহারা নিজেদের খেয়ালখুশীমত সাধন -ভজন করে, তাহার সিদ্ধিলাভ করিতে পারে না ; তাহাদের জীবনে সুখ মিলে না —মুক্তি তো দূরের কথা । মনকে শান্ত করিবার জন্য নামজপ প্রযুক্ত হইয়া থাকে । এক্ষণে প্রশ্ন হইতেছে —মুখে মুখে নাম জপের দ্বারা চঞ্চল মন শান্ত বা স্থির হয় কিনা ? এ সম্বন্ধে যোগাবাশিষ্ঠ রামায়ণে বশিষ্ঠদেব রামকে উপদেশ দিতেছেন — “দেখ রাম ! কোন রাজার সঙ্গে প্রজার লড়াই হইলে অধিক ধন ও জনবলের বলিয়ান্ রাজাই যেমন জয়ী হয়, সেইরূপ শব্দের সহিত মনের লড়াই হইলে শক্তিহীনতার দরুন শব্দ পরাজয় স্বীকার করিতে বাধ্য।” কাজেই শব্দের মনকে রুদ্ধ করার কোন ক্ষমতা নাই । শব্দের জননী হইতেছে মন । মন দেহে না থাকিলে শব্দও উচ্চারিত হইতে পারে না । এইজন্য শব্দের দ্বারা (মুখে মুখে নাম জপের দ্বারা) মদকে নিরোধ বা স্থির করা যায় না —শব্দের চাপে পড়িয়া কিছু সময়ের জন্য মন একটু শান্ত থাকে মাত্র, পরক্ষণেই সে আবার অস্থির হইয়া উঠে । কাহারও শরীরে কোন রোগের বীজানু বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত যেমন সেই ব্যক্তি রোগমুক্ত হইতে পারে না, সেইরূপ মনের মধ্যে নানারূপ সংস্কার (সৎ -অসৎ, শত্রু -মিত্র ভাব, আমি পুরুষ, আমি স্ত্রী, আমি মানুষ —সকলই এক একটি সংস্কার বিশেষ) বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত আমরা মুখে মুখে যতই নামজপ করি না কেন, মনকে তাহাদ্বারা চিরতরে স্থির রাখার উপায় নাই —মন চঞ্চল হইবেই । মন হইতে কামনা- বাসনার বীজ উন্মুলিত হইয়া মন বৃত্তিশূন্য না হইলে ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় হয় না । ব্রহ্মজ্ঞানের উদয় না হওয়া পর্যন্ত মন চঞ্চল থাকিবেই এবং মন চঞ্চল থাকা পর্যন্ত ভগবৎ দর্শন কখনই হইতে পারে না । কর ভগবৎ দর্শন না হওয়া পর্যন্ত “পুনরপি জননং পুনরপি মরণং পুনরপি জননী জঠরে শয়নং” হইবেই ; দিনের পর রাত, রাতের পর দিন, একটার পর একটা অশান্তি জীবনে আসিবেই —পরমশান্তি সুখ কখনই মিলিবে না। “পরং দৃষ্টা নিবর্ত্ততে” (গীতা -২/৫৯) —ভগবৎ দর্শন হইলেই ভোগাশক্তির নিবৃত্তি হয়। নাম (শব্দ) হইতে মনের শক্তি অধিক হওয়ার দরুন নাম করার সময়েও মন অন্যত্র ছুটিয়া যায়—নাম তাহাকে নিরোধ করিতে পারে না । ইহা সহজেই ধরা যায় । যেমন, —কেহ কেহ মুখে মুখে ‘রাম রাম’ জপ করিতেছে কিন্তু মন তাহার অলক্ষ্যে বাজারে গিয়া মৎস্য খরিদ করিতেছে, অথবা অপর কাহাকেও কোন কর্ম করার জন্য নির্দেশ দিতেছে। ব্রহ্ম তত্ত্ব ———————————— ‘ব্রহ্ম’ অর্থ বৃহৎ। তিনি এত বৃহৎ যে, তাঁহার আদি ও অন্ত নাই। বিশ্বে যে কোন ব্যক্তি বা বস্তুই হউক না কেন, প্রত্যেকেরই একটি নাম ও রূপ আছে —সকলই সীমাবিশিষ্ট। একমাত্র ব্রহ্মই আদি অন্তহীন ও অসীম। ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, নিরবয়ব ও অনামী (নামহীন) এবং একমেবাদ্বিতীয়াম্ —তাঁহাতে দুইয়ের কল্পনা হয় না। (কল্পনা বা মন থাকিলেই দুই থাকে, তখন এই ব্রহ্মকেই জীব আখ্যা দেওয়া হয়)। ব্রহ্ম আস্তিবাচক সত্তাবিশেষ। ব্রহ্মের অস্তিতেই জগতের অস্তিত্ব কিন্তু জগৎ না থাকিলেও তাঁহার অস্তিত্বের অভাব হয়না। ‘ব্রহ্ম’ যখন কোন দেহের মধ্যে অবস্থান করেন কিন্তু কোন ইন্দ্রিয়ের বশ হন না, নিজেকে নাম-রূপহীন একটি স্বচ্ছ পদার্থ বলিয়া জানেন, তখন তাহাকেই আত্মা বলা হয়। ব্রহ্ম নাম-রূপের অতীত, মনের অতীত একটি সর্বব্যাপী সত্তাবিশেষ ; আর আত্মা নিজে নাম-রুপহীন হইয়া মনের দ্বারা দর্শন -স্পর্শনাদি সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার সম্পন্ন করিতে পারেন কিন্তু কোন ইন্দ্রিয়ের রংয়ের রঞ্জিত হন না। একটি চতুষ্কোণ বিশিষ্ট হারিকেনের চিমনীর আলোর একদিকে লাল একদিকে হলুদ, একদিকে কালো ও একদিকে নীল রংয়ের কাচ দেওয়া থাকে তাহার রং সাদা হইলেও চতুষ্পার্শ্বের কাচের মধ্যদিয়া যখন আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, তখন কাঁচের অনুরূপ আলোর রং দেখা যায় অর্থাৎ লাল কাঁচটির মধ্যদিয়া লালবর্ণ আলোকরশ্মি নির্গত হয় ; অন্যান্য দিক দিয়াও কাঁচের অনুরূপই আলোক দর্শন হয়। এখানে মনে কর, চিমনীর ভিতরের মূল সাদা আলোটি যেন আত্মা এবং চতুষ্পার্শ্বের বিভিন্ন রংয়ের আলোকগুলি হইতেছে মনের বিভিন্ন অবস্থা। আত্মা সর্বদেহে একজন হইলেও মনের অবস্থাগুণে ভিন্ন ভিন্ন এবং বহু রূপের ন্যায় দেখায়। এই দেহ -গৃহের অভ্যান্তরে থাকিয়া চক্ষু-কর্ণাদি জানালাদ্বারা যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধশক্তি বহির্দিকে বিচ্ছুরিত হইতেছে, উহা আত্মারই শক্তি। বিশ্বে যেখানে যে কোন কর্ম হইতেছে সকল মূলে আত্মার শক্তিই বিদ্যমান। দেবতাগণের অস্তিত্ব মনের কল্পনার উপর নির্ভর করে ; মনের অভাবে দেবতাগণেরও অভাব হইয়া যায়। কিন্তু আত্মার অস্তিত্ব মনের কল্পনার উপর নির্ভর করে না —আত্মার শক্তি দ্বারাই মন কল্পনা করিতে সক্ষম হইতেছে। আত্মা ও ব্রহ্ম উভয়ই একার্থবাচক শব্দ। ‘ব্রহ্ম’ সর্বদাই নির্গুণ ও নিরাকার। নিরাকার উপাসনা ক্লেশের কারণ হয় বলিয়া উপাসনার জন্য ঐ নির্গুণ ও নিরাকার ব্রহ্মকেই সগুণ বা সাকাররূপে উপাসনা করার বিধি শাস্ত্রে প্রচলিত আছে। এই সগুণ বা সাকার ব্রহ্মকেই ভগবান শব্দে অভিহিত করা হয়। স্বগুণ ব্রহ্ম! ‘সগুণ’ অর্থ —যাহা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ নামক তিনটি গুণের সহিত বর্তমান আছে। যিনি মূলে নির্গুণ হইয়াও গুণত্রের সহিত নির্লিপ্তভাবে যুক্ত থাকিয়া যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করিতেছেন, তাঁহাকেই সগুণব্রহ্ম বা আত্মা বলে। কর্মদ্বারা বন্ধন সৃষ্টি হইলেও নির্লিপ্তভাবে কর্ম করার দরুন এইরূপ কর্মের দ্বারা ভগবানের কোন বন্ধন সৃষ্টি হয় না। সাকার ব্রহ্ম! ‘সাকার’ অর্থ —যাহা আকারের সহিত বিদ্যমান। আকার, সকার, ও নিরাকার —শব্দভেদে এই তিনটি অবস্থা প্রযুক্ত হয়। 'আকার' অর্থ আকৃতিবান—স্থুল চেহারা বা আকৃতির নাম আকার। যাহা নিরাকার হইয়াও আকারের সহিত অবস্থান করে, কিন্তু আকৃতির সহিত লিপ্ত হন না, তাহেরকে সাকার বলে। স্থুলদেহ বা মনকে সাকার বলা হয় না, স্থুলদেহ বা মনের মধ্যে যে নিরাকার সত্ত্বা অবস্থান করে, আকারের মধ্যে থাকার দরুন সেই নিরাকার সত্ত্বাকেই সাকার বলে। ভগবানেরই নাম সাকারব্রহ্ম। সাকারব্রহ্ম বলিতে মৃত্তিকা, কাষ্ট, প্রস্তর বা ধাতুনির্মিত কোন ভগবানের মূর্তি বা কাগজের পটে অঙ্কিত কোনও ছবি (ফটো) বুঝায় না। এই সকলই প্রকৃতির অন্তর্গত সুতরাং উপাসনার যোগ্য নহে। নিরাকার বা নির্গুণ ব্রহ্ম! ‘নিরাকার’ অর্থ —যাঁহার কোন আকার নাই বা কোনও আকারের সহিতও যিনি বাস করেন না, —তিনিই নিরাকার ব্রহ্ম। যেই আধারে প্রাণের স্পন্দন নাই, যাহার অনুভব বা বোধ নাই, তাহাকে ব্রহ্ম বলে না। ব্রহ্ম চিৎ এবং প্রাণময়। প্রাণহীন বস্তুর নাম ব্রহ্ম নহে —উহাকে জড়বস্তু বলে। জড়বস্তুর সাধনায় জড়ত্ব প্রাপ্তি ঘটে —চেতনত্ব লাভ হয় না। তাই জড়ের উপাসনা দ্বারা চেতন ভগবানকেও লাভ করা যায় না। উপাসনার লক্ষ্য হইতেছে মনের মলিনতা (জরত্ব) নষ্ট করিয়া মনকে চেতন ও শুদ্ধ করিয়া তোলা। উপাস্যের গুণ উপাসকে সংক্রমিত হয়। তাই জড়ের উপাসনায় জড়ত্ব প্রাপ্তি ঘটে এবং চেতনের উপাসনায় চেতনত্ব লাভ হয়। ——— পাঠক ভেবে দেখুনঃ আপনি কার উপাসনা করবেন? ★প্রতীক উপাসনা ★ সাধারণ মানব কোন একটি বস্তুকে অবলম্বন না করিয়া কোন কিছু চিন্তা করিতে পারে না। তাই তাহাদের জন্য প্রতীক উপাসনা কল্পিত হইয়াছে। যাহা যাহার বাচক অর্থাৎ যাহাকে দেখিলে যাহার কথা স্মরণ হয়, তাহাকেই তাহার বাচক বলে। যেমন,— তোমার একখানা ফটো দেয়ালে টাঙ্গানো রহিয়াছে। ঐ ফটোখানা তোমার প্রতীক। ভগবানের যে ফটো তাহা ভগবানের প্রতীক। এক্ষনে প্রশ্ন হইতেছে, ভগবানকে কি কেহ স্বচক্ষে দেখিয়াছেন ? যদি তিনি “অশব্দং অস্পর্শং অব্যয়ং” (কঠ উপঃ —১/৩/১৫) হইয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে কে, কি রূপে দেখিয়াছেন ? তিনি কি কোন স্থুলাব্যক্তি বা বস্তুবিশেষ যে স্থুল চক্ষুদ্বারা তাঁহাকে দেখা যাইবে ? প্রশ্নঃ — না তিনি স্থুল বস্তু নহেন এবং স্থুলচক্ষু দিয়াও তাঁহাকে দেখা যায় না। ঋষিগণ চক্ষুমুদ্রিত করিয়া ভগবানকে যেই রূপে দেখিবার ইচ্ছা করিয়াছেন, তিনি সেই রূপেই তাঁহাদের (ঋষিগণের) হৃদয়রাজ্যে আবির্ভূত হইয়া তাঁহাদিগকে দেখা দিয়াছিলেন। সুতরাং ঋষিগণ মনশ্চক্ষেই ভগবানকে দেখিয়াছিলেন। অতএব ভগবন্নামীয় যেসব মূর্তি দেখা যায়, সকলেই ভগবানের মূর্তি উত্তরঃ —যাঁহাকে চক্ষুর দ্বারা দেখা যায় না, “যং মনস ন মনুতে” ( কেন উপঃ —১/৬) —মন যাহাকে মনন করিতে পারে না যিনি অরূপ, ঋষিগণ তাহাকে কিরূপে মনন করিলেন ? পূর্ব হইত কাহাকেও দেখা না থাকিলে তাহার কি কোন রূপ কল্পনা করা যায় ? যে জীবনে কখনও জেব্রা দেখে নাই, সেই জেব্রা পশুটি তাহার নিকটে আসিলে সে কি তাহাকে চিনিতে পারিবে ? সুতরাং ঋষিগণ যদি তাঁহাদের ধ্যানে ভগবানের রূপ দেখিয়া থাকেন তবে ঐ সকল রূপ ঋষিদের মনোকল্পিত রূপ —ভগবানের রূপ নহে। বেদ বলেন, “ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদ্ যশঃ” (ঋগ্বেদ) যিনি নিজের প্রকাশে নিজেই প্রকাশিত, তাহাকে কেহই প্রকাশ করিতে পারে না। তাঁহারই তেজের দ্বারা সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি জ্যোতিষ্কগণ প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছেন। সামান্য একটি প্রদীপের আলোদ্বারা যেমন সূর্যকে দেখা যায় না, সূর্যের নিকটে গেলে প্রদীপের আলো যেমন নিস্প্রভ হইয়া যায় সেইরূপ গ্রহ -উপগ্রহ, দেহ -ইন্দ্রিয়গণ সকলই জড়বস্তু বা ভৌতিক পদার্থ। ইহাদের দ্বারা চেতন ভগবানকে দেখা যায় না। সূর্য গগনে উদিত হইলেও মৃত মনুষ্য কি সূর্যকে দেখিতে পায় ? আত্মার আলোতেই সব কিছু দেখা -শোনা যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলেন “বিজ্ঞাতামরে কেন বিজানিয়াৎ” (২/৪/১৪) —যিনি সকলের জ্ঞাতা তাঁহাকে কিসের দ্বারা জানা যাইবে ? সুতরাং ঋষিগণ যে ভগবানের রূপের কল্পনা করিয়াছেন অথবা ধ্যানে ভগবানকে দেখিয়াছিলেন, উহা নিজ মনেরই রূপ। ঋগ্বেদ বলেন, “ন প্রতীকে ন হি সঃ” —ভগবান কোন প্রতীকের মধ্যে থাকেন না। অতএব প্রতিকের পূজা বা উপাসনা দ্বারা ভগবানের পূজা বা উপাসনা হয় না। মনে কর তোমারই একখানা ফটো দেয়ালে টাঙ্গানো আছে। আমি সেই ফটোখানাকে স্নান করাইলে বা খাওয়াইলে কি তোমার স্নান হইবে বা তোমার পেট ভরিবে ? তাহা যেমন হয় না, সেইরূপ প্রতীকের উপাসনার দ্বারাও ভগবানের উপাসনা হয় না। একটি মানুষ মরিয়া গেলে যেমন সে কথা বলিতে পারে না, দেখিতে পায় না, কিছু খাইতে পারে না, কিছু জানিতে পারে না প্রাণহীন প্রতীকও মৃত ব্যক্তিসদৃশ। এরূপ মৃত প্রতীকের পূজা করিলে তাহার নিকট হইতে কিছু পাওয়া যায় কি ? প্রশ্নঃ —আমরা জর মূর্তির পূজা করি না —ঐমূর্তির মধ্যে ভগবানের পূজা করি। উত্তরঃ —ভগবানের তত্ব সম্বন্ধে যাহার কোন জ্ঞান নাই, ভগবান কি বস্তু তাহা যে জানে না, তেনিজং কোথায় থাকেন সেই সম্বন্ধে যাহার কোন বোধ নাই, সে জড়মূর্তির মধ্যে ভগবানের পূজা বা উপাসনা কিরূপে করিতে পারে ? ভগবান মনুষ্য, পশু পক্ষী বা বৃক্ষজাতীয় কোন বস্তু কিনা তাহা না জানিলে কিরূপে তাঁহার সেবা হইতে পারে ? সেবা অর্থই পূজা। প্রশ্নঃ — কেন, ভগবান সর্বব্যাপী হইলে জড়মূর্তির মধ্যে তাঁহার থাকিতে বাঁধা কি আছে ? ভগবান প্রস্তর স্তম্ভের মধ্য হইতে বাহির হইয়া নরসিংহরূপ ধারণ করিয়া প্রহ্লাদের পিতা হিরণ্যকশিপুকে নিহত করিয়াছিলেন কিরূপে ? উত্তরঃ — ভগবানের দুইটি অবস্থাঃ —(১) সগুণ বা সক্রিয়, (২)নির্গুণ বা নিস্ক্রিয়। একটি দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মধ্যে কতগুলি বারুদযুক্ত কাঠি থাকে কিন্তু সেই বারুদের দ্বারা বাক্সটি পুড়িয়া যায় না। দিয়াশিলাইয়ের কাঠির মধ্যে বারুদ (অগ্নি) থাকা সত্ত্বেও যে আগুনের প্রকাশ নাই ইহাই অগ্নির নির্গুণ বা নিষ্ক্রিয় অবস্থা । একখণ্ড প্রস্তরের মধ্যে অগ্নি আছে কিন্তু সেইজন্য প্রস্তর খণ্ডটি উত্তপ্ত হইয়া কাহাকেও দগ্ধ করে না। ইহাই প্রস্তরের মধ্যে অগ্নির নিষ্কৃয়ভাবে অবস্থান করেন। এক্ষণে কোন সগুণব্যক্তি (যাহার মধ্যে গুণ বা প্রাণের চেতনা আছে) যদি উক্ত দিয়াশলাইয়ের কাঠিটি লইয়া অপর কোন বারুদের সহিত ঘর্ষণ করে, তবে তৎক্ষণাৎ অগ্নি জ্বলিয়া উঠে । ইহা ঐ বারুদের সগুণ বা সক্রিয় অবস্থা । অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি যদি উপরোক্ত প্রস্তরখন্ডকে অপর কোন প্রস্তরের উপর নিক্ষেপ করে, তবে তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তর হইতে অগ্নি না থাকিলে নিক্ষেপ মাত্র কোথা হইতে অগ্নি প্রকট হইল ? তাই দেখা যায়, কোন প্রাণের স্পর্শ না পাওয়া পর্যন্ত সমস্ত বস্তুই জড় বা অচেতন থাকে, তাহাদের দ্বারা কোন কর্ম নিস্পন্ন হয় না। অতএব তোমাদের কল্পিত যাবতীয় মূর্তিই জড় বা অচেতন। উহার মধ্যে ব্রহ্মচেতনা বা সামান্যচেতনা থাকিলেও উহা নিস্ক্রিয়ভাবে আছে। উহার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার না হওয়া পর্যন্ত উহা মৃতই। বিশ্বের স্রষ্টা ব্রহ্মা ব্যতীত কোন মনুষ্যের পক্ষে, সে ভগবান আখ্যা পাইলেও কাহারও মধ্যে প্রাণের সঞ্চার তাহাকে বাঁচাইয়া তোলা সম্ভব হয় না। যদি তাহাই সম্ভব হইত, তবে কোন মহাপুরুষই নিজে মরিতেন না এবং মৃত সকল ব্যক্তিকেই বাঁচাইয়া দিতে পারিতেন। ভগবান প্রাণস্বরূপ যেখানে প্রাণ নেই, সেখানে ভগবানকে পাওয়া যায়না। ভগবান সর্বব্যাপীত্ব নিবন্ধন সর্ববস্তুতেই থাকিতে পারেন এরূপ উক্তিও যথার্থ নহে। কারণ সর্বব্যাপীরূপে যে চেতনা রহিয়াছে তাহাকে নির্গুণ ব্রহ্ম বলে। উহা মৃত মানুষের মধ্যে থাকিলেও মনুষ্য তদ্বারা বাঁচিয়া উঠে না, ইষ্টক খণ্ডকে আঘাত করিলেও সে উঃ হুঃ উঃ হুঃ করে না ; মূর্খ সেই নির্গুণ ব্রহ্ম চেতনার দ্বারা জ্ঞান লাভ করিয়া পণ্ডিত হইয়া যায় না। কাজেই তোমার কল্পিত নরসিংহমূর্তির রূপক অর্থ বিস্মৃত হইয়া উহার তাত্ত্বিক অর্থ গ্রহণ করা উচিৎ। সর্বত্রই জানিও যে, যে আধারে প্রাণ নাই সেখানে ভগবানকে পাওয়া যায় না। ভগবান ত্রিগুণাম্বিত মনের মধ্যে লুক্কায়িত হইয়া রহিয়াছেন । হংস যেমন দুগ্ধের সহিত জল মিশ্রিত করিয়া দিলেও মিশ্রিত দুগ্ধ হইতে জলকে পৃথক করিয়া লইবার কৌশল অবগত হইয়া শুধু দুগ্ধটুকু পান করিয়া লয়, জল পাত্রে পড়িয়া থাকে, সেইরূপ জ্ঞানীর নিকট হইতে ভগবৎ তত্ত্ব অবগত হইয়া নিজ মনের মধ্যে অম্বেষণ করিলেই তাঁহাকে পাওয়া যাইতে পারে —প্রাণহীনের মধ্যে প্রাণকে অম্বেষণ করিলে কোনদিনই পাওয়া যাইবে না। দুগ্ধের মধ্যে মাখন থাকিলেও ঐ দুগ্ধকে যেমন কোন দণ্ডদ্বারা আলোড়িত না করা পর্যন্ত মাখন দৃষ্ট হয় না সেইরূপ এই দেহের মধ্যে ভগবান থাকিলেও কৌশল জানিয়া সাধন -ভজন না করিলে তিনি চিরকাল অদৃশ্য হইয়াই থাকিবেন। এ-বিষয়ে শিব সংহিতা বলেন, — আত্মসংস্থ শিবং ত্যক্ত্বা বহিঃস্থং যঃ সমর্চয়েৎ। হস্তস্থং পিণ্ডমুৎসৃজ্য ভ্রমতে জীবতাশয়া।। অর্থ —নিজের ভিতরে শিব (ভগবান) থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া ভগবানকে বাহিরে জড়মূর্তির মধ্যে অর্চনা করে, সে জীবন ধারণের জন্য হস্তস্থিত অন্নের গ্রাস ফেলিয়া দিয়া বাঁচিবার জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়। আত্মলিঙ্গার্চণং কুর্যাৎ অনালস্যং দিনে দিনে। তস্য স্যাৎ সকলা সিদ্ধিঃ নাত্র কার্য বিচারণা ।। অর্থ —এইজন্য প্রতিদিন অনলসভাবে আত্মার অর্চনা করিবে তাহার সকল ইচ্ছাই পূর্ণ হইবে। ইহাতে বিচারের কোন প্রয়োজন নাই। প্রশ্ন —আপনার অকাট্য যুক্তিগুলি খণ্ডন করিবার মত কোন উত্তর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তথাপি প্রশ্ন থাকিয়া যায় যে, মূর্তিপূজা যদি সত্য না হয়, তবে ঋষিগণ এত পূজার প্রচলন করিয়া গিয়াছেন কেন ? উত্তরঃ —বৈদিক ঋষিগণ কোন মূর্তিপূজার প্রচলন করিয়া যান নাই। তাই বেদে মূর্তিপূজার কোন কথা নাই। বেদ একেশ্বরবাদ ঘোষণা করিয়াছেন। বুদ্ধ পর্যন্ত এদেশে মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল না। বুদ্ধের পরে যখন ব্রাহ্মণগণ এদেশে প্রধান্য লাভ করিলেন তখন তাঁহারা আর্য-অনার্যের মধ্যে মিলনের সেইরূপে একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করিয়াছিলেন। অনার্যগণ জড়মূর্তির উপাসক ছিল। তাই একেশ্বরবাদী আর্যদের সহিত তাহাদের লড়াই লাগিয়াই থাকিত। এই লড়াইয়ের অবসানের জন্য আর্যগণ জড়মূর্তির মধ্যে সচ্চিদানন্দ ভগবানের আরোপ করিয়া ভগবদারাধনার ব্যবস্থা দিলেন। কারণ দীর্ঘদিন যাবৎ অভ্যাসের ফলে মিথ্যাকেও পরিত্যাগ করা কষ্টকর হইয়া পড়ে। অনার্যদের পক্ষেও মূর্তি ত্যাগ করা সম্ভব হইত না। তাই অনার্যদের সহিত মিলনের জন্য এইরূপ পন্থা অবলম্বন করিতে হইয়াছিল। কিন্তু ভগবান তো সচ্চিদানন্দ। তাঁহাকে কোন বস্তুর মধ্যে আরোপ করিলেই চক্ষুদ্বারা দেখা যায় না। শশকের মস্তকে শিং আরোপ করিলেই যেমন সেখানে শিং কখনও গজাইতে পারে না, বন্ধ্যা নারীর মধ্যে পুত্রের আরোপ করিলেও যেমন তাহার পুত্র হইতে পারে না, পুত্র হইলে আর বন্ধাত্ব থাকে না। (পুত্র হয়না বলিয়াই তাহাকে বন্ধা বলা হয়), তেমনি জড়ের মধ্যে চেতন আরোপ করিলেই সেখানে চৈতন্য আসে না। চৈতন্য না আসিলে সমস্ত পূজার্চনাই বিফলে পরিণত হয়। সৎসঙ্গ ও শাস্ত্রপাঠ দ্বারা মন হইতে হিংসা -দ্বেষ, কাম -ক্রোধ, পরনিন্দা-পরচর্চা প্রভৃতি অসৎ বৃত্তিগুলি বিদূরিত না হওয়া পর্যন্ত শত শত নাম -জপ, সংকীর্তন, পূজার্চনা, তীর্থ ভ্রমণ ও পিণ্ডদানাদি করিলেও কোনই ফল হয় না। মনের অসৎ বৃত্তিগুলি দুর করিবার কোনও কোন ক্ষমতাই উক্ত পূজার্চনা বা কোন ক্রিয়াকাণ্ডে নাই। ফটো বা মূর্তিচিন্তকের মন সেই মূর্তির দিকেই ধাবিত হয়। যে পর্যন্ত মনের গতি থাকে, গতি থাকিতে স্থিতিলাভ কিরূপে হইবে ? কারণ গতি ও স্থিতি বিরুদ্ধ ধর্ম। মনের স্থিরত্ব লাভ না হইলে ভগবৎ দর্শন হয় না —শান্তিও পাওয়া যায় না। “মনঃ সত্যেন শুদ্ধন্তি”— একমাত্র সত্যের দ্বারাই মন শুদ্ধ হয়। সত্য কথা বলা, পরোপকার, শিবজ্ঞানে জীবের সেবা, রোগীর সেবা, ক্ষুধার্থকে অন্নদান, মনে-মুখে সত্য ব্যবহার করা এবং আন্তচিন্তনের দ্বারা মন শুদ্ধ হয়। এই শুদ্ধ মনই ভগবৎ লাভের যোগ্য হয়। ————— ★অবতার ★ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদেরই বিশ্বাস আছে যে, স্বয়ং ভগবানই পাপীদিগকে উদ্ধারের জন্য মানবদেহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহাদিগকে অবতার বলা হয়। ভগবান স্বয়ং যদি অবতার হইয়া আসেন, তবে তিনি তো সকল দেশের মানবগণের উদ্ধারের নিম্মিত্তই আসিবেন। কারণ ভগবান সকল দেশের জন্য একজনই আছেন। কিন্তু কার্যতঃ দেখা যায়, যিশু বা ভারতীয় অবতারগণ কেহই তাঁহাদের জীবদ্দশায় সকল দেশের পাপী মানবগণকে উদ্ধার করিতে আসেন নাই বা পারেন নাই। ভগবান একজন হইলেও এক অবতারের সহিত অপর অবতারের খাদ্যাখাদ্য, মতবাদ ও ব্যবহারের মিল নাই। কোন অবতার গোমাংস খাইতেন, অপরের তুলশিপত্রযুক্ত না হইলে অন্ন গলাধঃকরণ হইত না, কোন অবতার একেশ্বরবাদের অনুগামী, আবার অপর কেহ বহুমূর্তির পূজারী, কেহ ব্যবহার সরল আবার অপর কেহ ছল-চাতুরীপূর্ণ। উপনিষদ্ বলেন, ভগবান অবতারের রূপ গ্রহণ করিলে তাঁহার “স্বাভাবটিকে জ্ঞানবল-ক্রিয়াশ্চ” (শ্বেতাশ্বতর উপঃ ৬/৮) -(অবতারের) আত্মজ্ঞান স্বাভাবিক থাকিবে জন্মহেতু তাহা লুপ্ত হইবে না, ভগবান যেমন অখণ্ড শক্তির আশ্রয়, অবতারের মধ্যেও অখণ্ড শক্তির বিকাশ থাকিবে। ভগবান যেমন সমস্ত কর্মের উৎস, বিশ্ব সৃষ্টি করা যেমন তাঁহার স্বাভাবিক কাজ, অবতারও সেইরূপ সমস্ত কর্মের উৎস হইবেন। কিন্ত কার্যতঃ কোন অবতারকেই ভগবানের সমকক্ষ হইতে দেখা যায় নাই। সকল অবতারকেই আত্মজ্ঞান লাভের জন্য অপর একজন গুরু গ্রহণ করিতে হইয়াছে। কেহ কেহ একাধিক গুরু গ্রহণ করিয়াছেন। ভগবানের জন্ম-মৃত্যু হয় না কিন্তু সকল অবতারকেই জন্ম-মৃত্য বরণ করিতে হইয়াছে, কোন অবতারই আজ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে বাঁচাইয়া দিতে পারেন নাই। এইসব অবতারগণের মধ্যে কাহার কতটুকু আত্মজ্ঞানের বিকাশ হইয়াছিলাম তাহা বেদ তথা শ্রুতির সহিত মিলাইলে ধরা পড়ে। ভগবান গীতাতে কোথাও বলেন নাই যে, ধর্মের গ্লানি হইলে তিনি মানবদেহ ধারণ করিয়া ধরাধামে আবির্ভূত হন ; যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজামহম্।। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্। ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। (গীতা ৪/৭) অর্থঃ —যখনই প্রকৃতির মধ্যে গ্লানি উপস্থিত হয়, তখনই আমার আবির্ভাব হয়। আমি শান্ত কিন্তু প্রকৃতি অশান্ত হইয়া উঠিলে আমি আমার শক্তিদ্বারা পুনরায় তাহাকে শান্ত করিয়া দিই। আমি প্রকৃতিকে শান্ত করিবার জন্য বহুরূপে আসিতে পারি। নিদাঘ প্রবল হইয়া প্রখর রৌদ্রতাপে মানুষ ও অন্যান্য জীব তাপিত হইলে আমি বর্ষারূপে আসি, কোথাও ঝড়রূপে আসি, আবার সমষ্টিগত মানবের মধ্যে হইতেও আবির্ভূত হই। আমার আবির্ভাবে প্রকৃতি পুনরায় শান্তভাব ধারণ করে। সৎ ব্যক্তিগণ প্রকৃতির দুর্যোগ (রোগশোক, মহামারী, প্লাবন ইত্যাদি) হইতে রক্ষা পায় এবং নিজেদের সাধন-ভজনের বিঘ্নহেতু যে অশান্তি ভোগ করে তাহা হইতে মুক্ত হইয়া যায়। দুষ্কর্মকারীগণ তাহাদের অসৎ কর্ম ত্যাগ করে এইরূপেই সমাজে পুনঃ পুনঃ শান্তি স্থাপিত হয়। ভাগবত বলেন, “অবতারাঃ হি অসংখ্যায়াঃ” অবতারগণ অসংখ্য। যেহেতু সমস্ত জীবের মধ্যেই ভগবান অবস্থান করিতেছেন, সুতরাং জীবমাত্রেই অবতার। এই অর্থে বিশেষ কোন মানবকে অবতার বলার কোন হেতু নাই। ভগবানের যদি কোন পরিবর্তন নে হয়, তবে অবতারগণের মনেরই বা পরিবর্তন হইবে কেন ? কোন্ অবতার বলিতে পারেন যে, তাঁহার শিশুকালের মন ও বৃদ্ধকালের মন অথবা আত্মজ্ঞান হওয়ার পরের মন একভাবেই আছে ? ভগবান গুণাতীত “গুণাতীত স উচ্চতে” (গীতা ১৪/২৫) কিন্তু অবতারগণের কেহ কি গুণাতীত হইয়া জন্ম নিয়াছিলেন ? গুণ ব্যতীত কোন সৃষ্টিই হয় না । গুণের পরিবর্তনের সঙ্গে মনেরও পরিবর্তন হয় । ত্রিগুণের দ্বারাই মন গঠিত হয়। এইজন্য কোন অবতারই গুণাতীত নহেন । ন তদন্তি পৃথিব্যাং বা দিবি দেবেষু বা পুনঃ। সত্ত্বং প্রকৃতিজৈর্মুক্তং যদেভিঃ স্যাৎ ত্রিভিগুর্ণৈঃ।। (গীতা ১০ /৪০) অর্থ — পৃথিবীতে, স্বর্গে অথবা দেবগণের মধ্যে এমন কেহ নাই যিনি সত্ত্বঃ রজঃ ও তমঃ প্রকৃতিজ এই গুণত্রয় হইতে মুক্ত আছেন । ভগবান গুণাতীত বলিয়াও অবতারদের জন্ম হইতে পারে না। দেহ জন্মগ্রহণের পরে সাধন-ভজন করিয়া যাহারা গুণমুক্ত হইতে পারেন, তাহাদিগকে জীবমুক্ত পুরুষ বলে —অবতার বলে না । সুতরাং অবতারবাদ অসিদ্ধ। ‘অবতার’ অর্থ যাহারা অবতরণ হইয়াছে অর্থাৎ আত্মস্বরূপ হইতে চ্যুত হইয়া যিনি জীবরূপ ধারণ করিয়াছেন। এই অর্থে সমস্ত জীবই অবতার । ————