https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

ঈশ্বরের গর্ভে জন্ম বিষয়ক ভ্রান্তি নিবারন

Sunday, August 13, 2017


ঈশ্বর সমন্ধ্যে আলোচনার পূর্বে ঈশ্বর কে তা জানা আবশ্যক। মহর্ষি পতন্জলী তার যোগদর্শনে বলছেন - "ক্লেশকর্মবিপাকশৈয়রপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ; ১।২৪"  অর্থাৎ ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয় এই চারের সঙ্গে যার কোন সম্বন্ধ নেই যিনি সমস্ত পুরুষের মধ্যে উত্তম, তিনিই ঈশ্বর। 

এখানে,
 ক্লেশঃ অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ, অভিনিবেশ।
কর্মঃ পূণ্য, পাপ, পূণ্যও পাপমিশ্রিত এবং পাপপূণ্যরহিত।
বিপাকঃ কর্মফলের নাম বিপাক।
আশয়ঃ যাবতীয় কর্ম সংস্কারের নাম আশয়।
এই চারের সাথে সমন্ধহীন উত্তম পুরুষই ঈশ্বর পদবাচ্য।

 এজন্যই ঈশ্বরকে "আনন্দময়" বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি কখনো দুঃখ, ক্লেশ, কর্মফল ভোগ করেন না।  তিনি সর্বদা আনন্দময় স্বরূপে স্থিত। যদি এরূপ বলা হয় যে, ঈশ্বর পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেন তবে বলতে হবে তিনি তার আনন্দময়  স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হলেন। কারন  জন্মগ্রহনকারীর গর্ভস্থ যন্ত্রনা, কর্মফল এবং  ত্রিতাপ জ্বালা ভোগ করার প্রয়োজন পড়ে।  যদি ঈশ্বর এক মুহুর্তের জন্যও তার আনন্দময় স্বরূপ থেকে বিচ্যুত হন।  তবে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গা কদাপি প্রাপ্ত হতে পারবেন না।
অনেকে বলেন ঈশ্বর পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করলেও তিনি তার স্বরূপ চ্যুত কখনো হন না।  এটা অনেক বড় ভূল কথা।  কারন পঞ্চভৌতিক  দেহ ধারণ করলে সে দেহে জরা ব্যাধি, দুঃখ আসবেই।  এমন কোন উদাহরন কেউ দিতে পারবেন না যিনি এই ভৌতিক দেহে এক মুহুর্তের জন্যও দুঃখ পান নি।

এ জন্য দেবীভাগবতে ব্যাস বলছেন -

মায়া বিমোহিতা মন্দাঃ প্রবদন্তি মণীষিণঃ।  করোতি স্বেচ্ছয়া বিষ্ণুরবতারনকেশঃ।।
মন্দোহপি দুঃখগহনে গর্ভবাসেহতিসঙ্কটে। ন করঁতি মতিং বিদ্বান্ কথং কুর্য্যাৎ স চক্রভৃৎ।।
কৌশল্যা দেবকী গর্ভে বিষ্ঠামল সমাকুল।  স্বেচ্ছয়া প্রবদং ত্যদ্ধ্যগতো হি মধুসূদনঃ।।
বৈকুন্ঠং ত্যক্ত্বা সুখং ন কিম্?। চিন্তাকোটি সম্মুখানে দুঃখদে বিষ সম্মিতে।।
(দেবী ভাগবতঃ ৫।১।৪৭-৫০)



অর্থাৎ মায়াবিমোহিত হয়ে মন্দমতি পন্ডিতেরা বলেন, ভগবান বিষ্ণু স্বেচ্ছায় অবতার গ্রহন করেন। একান্ত মূর্খ্য ব্যক্তিও দুঃখময় গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করে দুঃখময় সংসার আবর্তে আসতে চায় না। তাহলে চক্রধারী বিষ্ণু কিসের জন্য বৈকুন্ঠ ত্যাগ করে কৌশল্যা দেবকীর মলবিষ্ঠা দূষিত গর্ভে জন্ম গর্ভযন্ত্রণা ভোগ করবেন?  যে ক্লেশকর বিষময় সেই গর্ভে শত শত চিন্তার উদয় হয়ে থাকে,  হরি বৈকুন্ঠ ত্যাগ করে সেই গর্ভবাস করবেন কি সুখে?  কেন?  



এর পরেও কিছু ব্যক্তিরা আছেন যারা ঈশ্বর কে গর্ভ যন্ত্রণা ভোগ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।  তাই তারা ঈশ্বরের জন্ম সিদ্ধ করতে বেদ হতে কিছু মন্ত্রের উদ্ধৃতি করেন -

=>> দাবী - ০১

এষো হ দেবঃ প্রদিশো নূ সর্বাঃ পূর্বো হ জাতঃ স গর্ভে অন্তঃ।
স এব জাতঃ স জনিষ্যমাণঃ প্রত্যঙ জনাস্তিষ্ঠতি সর্বতোমুখ।।
(যজুর্বেদ ৩২।৪)

অর্থাৎ এই দেব পূর্বে জন্মগ্রহন করেছিলো তিনিই মাতৃগর্ভে স্থিত এবং তিনিই ভবিষ্যতে জন্মগ্রহন করবেন।

মন্ত্রার্থ বিশ্লেষনঃ  ঈশ্বর সমন্ধ্যে বেদ বলছে তিনি স্বয়ম্ভূ (যজুঃ ৪০।৮) অর্থাৎ তিনি নিজে থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। কেউ তাকে জন্মদান করেন নি। যদি বলা হয় যে,  তিনি পূর্বে জন্মগ্রহন করেছিলেন তবে একথা সর্বদা মিথ্যা। কারণ সৃষ্টির প্রারম্ভে যখন কোন মনুষ্যেরই সৃষ্টি হয় নি তবে তিনি কার গর্ভে জন্মগ্রহন করবেন?  গর্ভে জন্মগ্রহরকারীর অবশ্যই জনক অর্থাৎ জন্মদাতা থাকবে। কিন্তু স্বয়ম্ভূর কিরূপে জনকঃ থাকতে পারে?  এ জন্য শ্বেতাশ্বতরোপনিষদঃ বলছে -

" ন চস্য কশ্চিজ্জনিতা চ চাধিপঃ ; শ্বেতা ৬।৯" 
অর্থাৎ তার কোন জনক,  স্বামী নেই



অনেকে উল্লেখিত মন্ত্রে "গর্ভ" আদি শব্দে  মাতৃগর্ভ মনে করে।  কিন্তু ঠিক এর পূর্বের মন্ত্র (৩২।৩) এ "হিরণ্যগর্ভ" এর উল্লেখ রয়েছে।  হিরণ্য অর্থাৎ সমস্ত তৈজস পদার্থ যাহার গর্ভে অথবা যিনি সমস্ত পদার্থের গর্ভে রয়েছেন।  এখনে "গর্ভ" বলতে কোন মানুষের "গর্ভাশয়" নয়।  গর্ভ বলতে কোন বস্তুর অভ্যন্তর বুঝায় , যেমনঃ নদীগর্ভ ইত্যাদি। অর্থাৎ সেই পরমাত্মা প্রতিটি পদার্থের গর্ভ অর্থাৎ অভ্যন্তরে ব্যাপক হয়ে রয়েছেন।  এই পরমাত্মাই পূর্বে প্রকট হয়েছেন। এ সমন্ধ্যে মনু মহারাজ বলেছেন -

তখন, স্বয়ম্ভূ পরমাত্মা অব্যক্ত  "তম" রূপ প্রকৃতির প্রেরক প্রকটবস্থা কে উন্মুখকারী অগ্নি, বায়ু আদি মহাভূতকে উৎপন্ন করে এই সমস্ত সংসার কে প্রকটবস্থায় গ্রহন করে প্রকট হলেন। (মনুস্মৃতি ১।৬)

পরমাত্মার প্রকট হওয়ার অভিপ্রায় এই তাৎপর্য্য "জগতের প্রকটাবস্থাকে গ্রহন করে প্রকট হওয়া " এই ভাবের ইঙ্গিত করেই মনু "ব্যঞ্জয়ন ইদম্" পাঠের প্রয়োগ করেছেন। যদি  স্বতন্ত্র রূপে অথবা বিনা জগতের প্রকটে পরমাত্মার প্রকটতা অভিষ্ট হতো তো তিনি পরমাত্মার প্রকটতার সাথে জগতের ব্যক্ত বর্ণনা করতেন না। বরং প্রথমে স্বতন্ত্র রূপে পরমাত্মার উৎপত্তি দর্শাতেনন, এবং পরমাত্মার উৎপত্তির পরেই জগতের উৎপত্তির বর্নন করতেন।  মূলত জগতের প্রকটতা দেখেই পরমাত্মার সত্তার প্রতীত হয়। জগতের প্রকটাবস্থাই পরমাত্মার প্রকটতা এবং জগতের প্রলয়াবস্থা তাহার অপ্রকটতা।

এক্ষণে দাবীকৃত মন্ত্রের প্রতিটি "পদ" এর অর্থ বিশ্লেষন করা যাক -

১। (এষঃ) এই প্রভূ (হ) নিশ্চয়রূপে (দেবঃ) দেব।  দেবের অর্থ যাস্কানুসারে এই প্রকার -

ক. (দেবো দানাত্) সেই প্রভূ দানকারী। প্রভূ জীবের হিতের জন্য কি দান করেন নি? তিনি সব শক্তির দানকারী।
খ. (দেবো দীপনাদ্) সেই প্রভূ দেদীপ্যমান। সেই সর্বত্র দেদীপ্যমান দেবের দীপ্তির কল্পনা আকাশে চমককৃত হাজারো সূর্যের চমকের ন্যায়।
গ. (দেবো দ্যোতনাত্) সেই প্রভূ সমস্ত পিন্ডকে দ্যোতিত করেন। প্রভূর সেই দদীপ্তি দ্বারা সমস্ত সূর্য চন্দ্র ও তারকারাজী দীপ্তমান।
২। (সর্বাঃ প্রদিশঃ) এই প্রভূ সমস্ত বিস্তৃত দিশার মধ্যে (অণুঃ) ব্যপ্ত হয়ে রয়েছে। কোন স্থান নেই যেখানে এই প্রভূ নেই। কণা কণা মধ্যে সেই প্রভূর অভিব্যপ্তি।
৩। ( পূর্বো হ জাতঃ) এই প্রভূ নিশ্চয়রূপে পূর্বে প্রকট হয়েছিলেন।   অর্থাৎ  এই প্রভূ সমস্ত সৃষ্টির আদিতে প্রকট হয়েছিলেন। এইজন্য তিনি "স্বয়ম্ভূ"।
৪। (সঃ উ গর্ভ অন্তঃ) এই প্রভূ সমস্ত হিরণগর্ভ  আদি পদার্থের মধ্যে স্থিত।  সবার অন্তরে স্থিত হয়ে সবাইকে নিয়ম দ্বারা চালিত করছেন।
৫। (সঃ এব জাতঃ) তিনিই প্রকট হয়েছেন। কারন সমস্ত সৃষ্টিতেই তাহার উপস্থিতি।  অথবা তিনি সমস্ত সৃষ্টির জন্ম দিয়েছেন।  "মাতা প্রজাতা" র অর্থ যেমন মাতা সন্তান কে জন্ম দিয়েছেন সেরূপ তিনি সমস্ত সৃষ্টির জন্ম দিয়েছেন।
৬। (সঃ জনিষ্যমাণঃ) তিনি ভবিষ্যতেও প্রকট হবেন।  অর্থাৎ প্রতি কল্পারম্ভে তিনি সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে প্রকট হবেন।  অথবা তিনি ভবিষ্যতেও এই সৃষ্টিকে জন্ম দেবেন।
৭। (জনাঃ) হে মনুষ্য! এই প্রভূ (প্রত্যঙ) প্রত্যেক পদার্থের মধ্যে (তিষ্ঠতি) স্থিত হয়ে (সর্বতোমুখঃ) সর্বতমুখ হয়ে আছেন।  অর্থাৎ সেই প্রভূকে খোজার জন্য কোন স্থানে যাবার প্রয়োজন নেই।

মন্ত্রটির মূল ভাবঃ

ঈশ্বর  জগৎকে উৎপন্ন করে প্রকাশিত হয়ে সমস্ত দিশায় ব্যপ্ত হয়ে ইন্দ্রিয় বিনা সব ইন্দ্রিয়ের কার্যে সর্বত্র ব্যপ্ত হয়ে, সমস্ত প্রানীর হৃদয়ে স্থির,  তিনি ভূত, ভবিষ্যত কল্পে জগৎ কে উৎপত্তির জন্য প্রথমে প্রকট হয়েছেন, তিনি ধ্যানশীল মনুষ্যের জানার যোগ্য, অন্যের জানার যোগ্য নয়।



=>> দাবী - ০২ 

প্রজাপতিশ্চরতি গর্ভেহঅন্তরজায়মানো বহুধা বি জায়তে।
তস্য যোনিং পরি পশ্যন্তি ধীরাস্তস্মিন্হ তস্থুর্ভূবনানি বিশ্বা।।
(যজুর্বেদ ৩১।১৯)

অর্থাৎ প্রজাপতি গর্ভমধ্যে বিচরন করেন,  যিনি নিত্য হয়েও বহুরূপ মায়ার প্রপঞ্চে অবতীর্ণ হন।

মন্ত্রার্থ বিশ্লেষনঃ যদি বলা হয় যে, ঈশ্বর মায়াবী তো ইহা ঠিক নয়।  কারন ছল, কপট অর্থে মায়া শব্দ প্রসিদ্ধ। কেউ যদি বলে তিনি মায়াবী,  ইহাতে কি জ্ঞান হতে পারে?  তিনি কি ছল কপটি?? মূলত  ঈশ্বর মায়া এবং অবিদ্যা দোষ রহিত।  এজন্য তিনি নির্মল, নিরঞ্জন, নিত্য, শুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাবযুক্ত। আর এ মন্ত্রে তো "মায়া" শব্দে কোন পদ ই আসে নি।

দ্বিতীয়ত "গর্ভ" বিষয়ক ব্যাখ্যা পূর্বেই করা হয়েছে। এখানে কোন "মাতৃগর্ভের" প্রসঙ্গ আসে নি। হিরণ্যগর্ভ,  প্রাণীদের হৃদয়দেশ অথবা প্রত্যেক পদার্থের মধ্যে ব্যাপক প্রসঙ্গে এসেছে।

মন্ত্রটির "পদ" ব্যাখ্যা নিম্নরূপ -

ক. (প্রজাপতি) সেই প্রভূ প্রজার পতি।  সবার রক্ষক।
খ. (গর্ভ অন্তঃ চরতি) জীবাত্মার মধ্যে অথবা হিরন্যগর্ভ আদির মধ্যে ব্যাপক হয়ে বিচরন করছেন।
গ. (অজায়মানঃ) [জনী প্রাদুর্ভাব) সবার অভ্যন্তরে হয়েও তিনি অপ্রদুর্ভাব- অব্যক্ত। সেই প্রভূ কখনো শরীর ধারন করেন না (অকায়ম্ অস্নাবিরং যজু ৪০।৮)
ঘ. (বহুধা বিজায়তে) শরীর ধারন না করেও সেই প্রভূ নানা রূপে বিশেষরূপ দ্বারা প্রাদুর্ভুত হন। হিমাচ্ছাদিত পর্বতে,  অনন্ত বিস্তারশীল সমুদ্রে, অনন্তভার বহনকারী পৃথিবীর মধ্যে,  নক্ষত্রের মধ্যে সেই প্রভূর মহিমা দেখা যায়।  শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের রচনায় সেই রচয়িতার রচনা কৌশল দেখা যায়। কণা থেকে কণাই সেই প্রভূ প্রকট হয়ে রয়েছেন। অজায়মান প্রভূ বিজায়মান হয়ে রয়েছেন।
ঙ. (তস্য যোনিম্) সেই প্রভূর কারণস্বরূপ কে (ধীরাঃ) বিচারশীল  লোকই (পরিপশ্যন্তি) সর্বত্র দেখেন (তস্মিন) তাহার আধারে (হ) নিশ্চয়রূপে (বিশ্বা ভূবনানি)  সমস্ত লোক (তস্থুঃ) স্থিত।

মন্ত্রটির মূল ভাবঃ

যে এই সর্বরক্ষক ঈশ্বর স্বয়ং উৎপন্ন না হয়েও নিজ সামর্থ দ্বারা জগৎ কে উৎপন্ন করে তাহার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে সর্বত্র বিচরন করেন। যেই অনেক প্রকার দ্বারা প্রসিদ্ধ ঈশ্বর কে বিদ্বান্ লোক জানেন,  সেই জগতের আধারস্বরূপ সর্বব্যাপক পরমাত্মা কে জেনেই মানুষ কে আনন্দ ভোগ করা উচিৎ।



সন্দর্ভঃ যজুর্বেদ (পন্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তলংকার), যজুর্বেদ (মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী),  যোগদর্শন, দেবী ভাগবত পুরাণ, বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি (ডঃ সুরেন্দ্রকুমার)