ওম্“কেতুং কৃণ্বকেতবে পেশো মর্ষা অপেশসে সমুষদ্ভিরজায়থাঃ।।”
মানব তথা বিশ্বের কল্যাণে, মঙ্গলময় বিধাতা তাঁর কল্যাণময়ী বাণীকে ঋষির অন্তরে শতদলের মত বিকশিত করে সমগ্র সংসারে জ্ঞান প্রচারের প্রেরণা দিলেন। মন্ত্রদ্রষ্টা-ঋষি মঙ্গলময় বিধাতার প্রেরণায় অনুপ্রেনিত হয়ে মানব তথা বিশ্বের কল্যাণে যাহা প্রচার করলেন, তাহাই মানব ধর্মশাস্ত্র বেদ ।সৃষ্টির প্রথম হতে আরম্ভ করে আজও সেই বেদ জগতে প্রচারিত । বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান, তাই ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান তিন কালেই সমানভাবেই একই অবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত । এ জ্ঞানের নাশ নাই —কারণ ঈশ্বর অবিনাশী । এ জ্ঞান কল্যাণকারী—কারণ ঈশ্বর কল্যাণময় । বেদ নিত্য, সনাতন —কারণ ঈশ্বর নিত্য ও সনাতন। তাই বেদ চিরদিন অমৃতের বাণী শুনিয়েছে —
‘শৃন্বন্ত বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ —ওগো বিশ্ববাসী ! শোন —তোমরা যে অমৃতের সন্তান, তোমরা যে অমর তোমাদের মৃত্যু নেই কোন কালে। আজও সেই অমৃতবাণী মানবের হৃদয়-দ্বারে ঠিক তেমনি করে বলছে — ‘শৃন্বন্ত বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ —মানব! তুমি যে অমৃতের সন্তান, তোমার মৃত্যু নেই, তুমি অ-মৃত। মানুষ অমৃতের সন্ধান পেতে বিশ্বের একপ্রান্ত হতে আরম্ভ করে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত এই বাণীকে বহন করে নিয়ে গেছে। এ যে মঙ্গলময় বিধাতার আদেশ— ‘কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্য়ম্’— সমগ্র সংসারের নর নারীকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত কর। মানুষ তাহার মহত্ব নিয়ে বিশ্বে বাঁচুক, —মনুষত্ব হতে দেবত্বে উপনীত হোক্। এই মহান্ সঙ্গীত আর্য ভূমি ভারতের তপোবনে প্রথম উদ্গীত। ভারতের এই পূর্বাকাশে জ্ঞানের প্রথম সূর্য ঘোর তমিস্রা বিদীর্ণ করে প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল। এই ভারতের তপোবনেই ঋষি তাঁর হোমানল প্রজ্জ্বলিত করে বিশ্ব কল্যাণে উদ্গান করেছিলেন — ‘ওম্ উদ্বুধ্যস্বাগ্নে প্রতিজাগৃহি’ —মঙ্গলময় প্রভো! স্তুতি মুখরিত প্রভাবে তুমি বিশ্ব নরনারীর অন্তরে কল্যান হ’য়ে জেগে ওঠ। মানব তার অন্তরে তোমায় -অনুভব করে জগতের কল্যাণ করতে শিক্ষা করুক। ধুয়ে যাক্, মুছে যাক্ তার আবালিতা মলিনতা যত তোমা সাড়া পেয়ে মানুষ তা অন্তরকে পূত পবিত্র করে সংসারকে আনন্দময় করে তুলুক। আমাদের পূর্বপুরুষ আর্য ঋষিগণ এমনি ক’রে ঈশ্বরের বাণীকে জগতে প্রচার করেছেন আমাদেরই এই ভারত জগতের গুরু হয়ে বিশ্ববাসীকে জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন — “এতদ্দেশ প্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ। স্বং স্বং চরিত্রং শিক্ষেরণ পৃথিব্যাং সর্বমানবাং।।” মনু০ মনু এর সাক্ষ্য। এতো আজকের নূতন কথা নয় —বানান কথা নয়। এ যে বহুকালের বহুদিনের সত্য কথা। ভারত আজও সবার গুরু হয়ে শিক্ষা দিচ্ছে — —“মা গৃধঃ কস্যসিদ্ধনম্”। তাই ভারতের সাধনা ভারতের দর্শন, বিজ্ঞান, ভারতের কৃষ্টি, সভ্যতা, আজও জগতের গবেষণার বস্তু। ভারত চিরদিন গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত। জগৎ আজও ভারতকে ভুলতে পারেনি। মানুষ মননশীল, চিন্তাশীল। তাই তার চিন্তাধারা মহান্ হতে সুমহান্ বিষয়ে নিত্য ধাবিত। সে চায় মহৎ হতে মহত্তর বস্তুকে লাভ করতে। মহত্তর বস্তু লাভ হলে সে চায় আরও মহত্তরকে। এতেও তার জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত হয় না। সে চায় আরও অধিক জানতে, আরও অধিক পেতে। কিন্তু মানুষ অল্পজ্ঞ। জ্ঞান তার সীমাবদ্ধ। এই বিশাল বিশ্বে প্রতি আলোক কণায় যে স্পন্দন প্রতি নিয়ত বিচ্ছুরিত হচ্ছে, এই সূর্যের গতি, পৃথিবীর গতি। এদের গতি দেয় কে ? কার আদেশে বায়ু প্রতিনিয়ত সঞ্চালিত ? নিয়মবদ্ধ জগৎ আপন আপন কক্ষ আশ্রয় করে প্রধাবিত ? কে এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের চালক ? মানব কতটুকু চিন্তা করে এই মহান্ তত্ত্বের চরম ও পরম জ্ঞান লাভ করতে পারে । তাই জিজ্ঞাসুকে এর সন্ধান নিতে হয় তাঁর কাছে গিয়ে যিনি জ্ঞানে, তত্ত্বদর্শনে জিজ্ঞাসু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । জিজ্ঞাসু যায় ব্রহ্মজ্ঞ ঋিষির কাছে সমিৎপানি হয়ে । জিজ্ঞাসা করে,— হে গুরুদেব ! বলুন, তিনি কেমন যার নিয়ন্ত্রণাধীনে বিশ্বজগৎ সুনিয়ন্ত্রিত ? ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি বললেন — ‘অস্তীভী ব্রুবতোঅন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে’, “তিনি আছেন এ ছাড়া তাকে কিছুই বলা চলে না।” শ্রুতি বলে — “ন তস্য প্রতিমা অস্তি , য়স্য নাম মহদ্ য়শঃ।।” সেই মহান্ প্রসিদ্ধ যশস্বী পরমাত্মার কোন প্রতিমা নেই, তাঁকে কোন কিছু দিয়ে মাপা-যোখা করা যায় না । “ন ত্ববাঁ অন্যে দিব্যো ন পার্থিবো ন জাতো ন জনিষ্যতে” পৃথিবীতে তার মত অন্য কেউ হয়নি, হবেও না । তিনি, “অকায়মব্রমণস্নাবিরং শুদ্ধং অপাপবিদ্ধম্” — সর্বানিয়ন্তা কারণ, সূক্ষ্ণ ও স্থূল শরীর রহিত, অবিদ্যাদি দোষমুক্ত, অপাপবিদ্ধ, —তিনি ত্রিকালদর্শী । সীমার মধ্যে মানুষের জিজ্ঞাসা অসমাপ্ত রয়ে যায়। জিজ্ঞাসুর জানা এতেও শেষ হয় না । বলে, — ‘ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি’ — অল্পে সুখ নেই বৃহতেই সুখ । সে আরও জানতে চায়, বলে — আরও কি করে জানা যায় ? আরও জেনে কি করে সেই ভূমাকে পাওয়া যায় ? ব্রহ্মজ্ঞ বললেন, — এ পরমাত্মা বিশ্ব-পরমাত্মা। ‘সদা জানানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট’ — ইনি আছেন সর্বদা সর্বজরে হৃদয়ে । ‘য় আত্মা অপহতপাপ্মা বিজরো বিমৃত্যুর্ববিশোকো বিজিঘৎ সোহপিপাসঃ সত্যকামঃ সংকল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ’। “তোমার মধ্যে যে মহান্ আত্মা আছেন, যিনি জরা, মৃত্যু, শোক, ক্ষুধা তৃষ্ণার অতীত, যিনি সত্যকাম সত্য সঙ্কল্প তা'কে অম্বেষণ করতে হবে, তা'কে জানতে হবে ।”
“না বিরতো দুশ্চরিতান্ নাশান্তো না সমাহিতঃ। ন শান্তো মনসাবাপি প্রজ্ঞানেনৈব আপ্নুয়াৎ।।”
‘কেবল জানার দ্বারা তাকে পাওয়া যায় না, হওয়ার দ্বারা পেতে হবে, — দুশ্চরিত থেকে বিরত হওয়া, সমাহিত হওয়া, রিপু দমন করে অচঞ্চল মন হওয়ার দ্বারাই তাকে পেতে হবে, অর্থাৎ এমন পাওয়া যা আপনারই চিরন্তন সত্যকে পাওয়া । “তমেবৈকং জানথ আত্মানম্” — সেই আত্মাকে জান, — সেই এককে যাকে সকল আত্মার মধ্যে এক করে জানলে সত্যকে জানা যায়।” —য়স্যাত্মা বিরতঃ পাপাৎ কল্যাণে চ নিবেশিতঃ তেন সর্বমিদং বুদ্ধং প্রকৃতিবিকৃতিশ্চ।” “আত্মা যার পাপ থেকে বিরত ও কল্যাণে নিযুক্ত তিনি সমস্তকে বুঝেছেন। তাই তিনি সত্যকে ও জেনেছেন, অসত্যকেও জেনেছেন, বিদ্যাকেও জেনেছেন, অবিদ্যাকেও জেনেছেন— “বিদ্যাঞ্চাবিদ্যাঞ্চ য়স্তদ্বেদোভয়ংসহ। অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতসশ্নুতে।।” যিনি বিদ্যা অবিদ্যা উভয়কে জানেন, তিনি নিষ্কাম কর্মের দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্রম করে, পরাবিদ্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন । এমনি করে মানুষ তার জীবনে প্রথম ভাগ জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে, ব্রহ্মচর্য আশ্রম সতাপ্ত করে। এ আশ্রমে ব্যায় নেই, কেবল অর্জন । অটুট ব্রহ্মচর্য পালনে শরীরকে যে পাথরের মত শক্ত করেছে, নিরন্তর ব্রতানুশীলন করে যার ব্রত ভঙ্গ হয়নি, অনবরত যার বুদ্ধি নির্মলও পবিত্র, নিয়মিত সন্ধ্যা হবনাদির দ্বারা যার মন শিবময় —কল্যাণময়, সেই ব্রহ্মচারী এবার জীবনের দ্বিতীয় ভাগে প্রবেশ । এই তার গার্হস্থ্য আশ্রম, হিসেব করে চলার আশ্রম। এখানে বিশ্রাম নেই — আছে শুধু অবিশ্রাম কর্ম, হিমাচলের মত বিরাট্ দায়ীত্বের বোঝা নিয়ে ব্রতোযাপনের শুভ সংকল্প । অনন্ত আকাশের দিকে উন্মুখ হয়ে এতদিন যে কুঁড়িটী সরোবরের মধ্যে দিনের পরদিন মধু সঞ্চয় করছিল, এবার সে পরিপূর্ণ সৌন্দর্য্য নিয়ে নিজেকে বিকশিত করল— সকলের সামনে। ভ্রমর মধু আদি এখন বিকশিত শতদলের আশ্রয় । বিকশিত শতদল অম্লান বদনে তার সৌরভ ও মধু বিতরণ করে যায়। ব্রহ্মচারী যেন একটি শতদল-কলি। ব্রহ্মজ্ঞের আশ্রম সরোবরে, আকাশের মতো অন্তহীন বিধাতাকে সামনে রেখে সুমধুর জ্ঞানও পবিত্রতার সৌরভ অর্জন করেছে । সে এবার গৃহী হয়ে সবার সামনে নিজেকে শতদলের মত তুলে ধরল। পবিত্র সৌরভের মানব সমাজকে প্রফুল্ল করার জন্য যেন তার বিকাশ । গৃহী যেন অম্লান শতদল। সুখ দুঃখের ঘাত প্রতিঘাতেও তার সুখ সদাহাস্যময়। কবির ভাষায় ব’লতে গেলে — “সংসারের সুখে দুঃখে, চলিয়া যেও হাসি মুখে ভরিয়া রেখো সদা তাহারই সুধা ধারা।।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

0 মন্তব্য(গুলি)