ম্যাকস্ মূলার প্রমুখ পন্ডিতগণ এই তত্ত্ব যখন বাজারে ছাড়লেন — তখন আর্কিওলজি —প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার জন্মই হয়নি। ফলে এদের এই তত্ত্বও সিদ্ধান্তগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সাল তারিখগুলি একেবারেই কাল্পনিক।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, খৃষ্টান বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীর জন্ম ৪০০৪ খৃষ্ট পূর্বাব্দের ২৩ অক্টোবর। এই বিশ্বাসের কারণে এই খৃষ্টান পন্ডিতরা তাদের যাবতীয় সাল তারিখ ৪০০৪ খৃ. পূ. পরে বসিয়েছিলেন। বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে যে সৃষ্টিতত্ত্ব আছে ম্যাকস্ মূলার নিজে তাকে ইতিহাস বলেই মনে করতেন। তার কথায়ঃ I look upon the account of creation given in the Genesis simply historical. (Max Muller F- 1902 P -481-482) (বাইবেলের জেনেসিসে উল্লিখিত সৃষ্টিতত্ত্ব কে আমি ইতিহাস মনে করি —ম্যাকস্ মূলার) ম্যাকস্ মূলারের কালে প্রত্নতত্ত্ব ছিল না। অতএব তার সমস্ত তত্ত্বের সাল তারিখ তার মনগড়া — যেমন বিশ্বাস করতো ৪০০৪ খৃস্ট পূর্বাব্দের পূর্বে পৃথিবী ছিল না। সেই মনগড়া সাল তারিখ আজও চলছে এবং পরবর্তীকালের প্রত্নতত্ত্বর আবিষ্কৃত তথ্যগুলিকে সেই মনগড়া তত্ত্বের সংগে খাপ খাওয়ানো হয়েছে। অর্থাৎ তথ্যের ভিত্তিতে তত্ত্ব সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয় —তত্ত্বের অনুকূলে তথ্যকে খাপ খাওয়ানোর অবৈজ্ঞানিক, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও অযৌক্তিক পদ্ধতি। মূলারের তত্ত্বের পদ্ধতির যে মূল ভিত্তি — ভাষা তত্ত্ব, তাও তখনকার দিনে কোন উচ্চ মার্গের ছিল না। তবু সেই ভাষা তত্ত্বের উপর ভিত্তি করা পদ্ধতি অর্থাৎ বৈদিক ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় কোন ভাষার মিল দেখে উনি সিদ্ধান্ত করলেন আর্যরা বিদেশ থেকে এসেছিল। ৪০০৪ খৃ. পূর্বাব্দের আগে যেহেতু পৃথিবী ছিল না তাই ভারতবর্ষও ছিল না। আর ধরে নেওয়া হল বাইরে থেকে ঐ ভাষা ভারতে এসেছে। ভারত থেকেও যে বাইরে যেতে পারে এ চিন্তা মূলার করেন নি — কারণ তার প্রতিপাদ্যই ছিল ভারতের নিজস্ব কিছু ছিল না এবং ভারত বরাবরই বিদেশী অধিকৃত। তাই ইংরাজরা ভারত শাসন করছে এতে আপত্তির কিছু নাই। মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও আবিষ্কার হয়েছিল —আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রচারিত হওয়ার পর। এহ তত্ত্ব রচিত হয় উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। আর হরপ্পা খনন ১৯২১ এবং ১৯২২ -এ। দয়ারাম সাহানী ১৯২১ সালে এবং আর. ডি. ব্যানার্জী ১৯২২ সালে খনন করে যা পেলেন — তারা ভারতীয় হওয়ায় ইংরাজরা তাদের সেই আবিষ্কারের মূল্য দিতে রাজী হয়নি। ১৯২৪ সালে জন মার্শাল সেই বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করলেন। ঐ সময়ের পর মহেঞ্জেদাড়ো হরপ্পা সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কার হয়েছে। এখন জানা গেছে যে তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতার প্রাণ সিন্ধুনদ নয়, সরস্বতী। এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল সাড়ে দশ লক্ষ বর্গ কিঃমিঃ. এলাকা জুড়ে। এই সভ্যতার কালে মেসোপটেমিয়া ও সুমেরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। সোভিয়েত সেন্ট্রাল এশিয়ার তুর্কমেনিস্থান এমনকি বাহারিনের সঙ্গেও বাণিজ্য ছিল। গুজরাটের লোথালে খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক এস আর রাও দেখিয়েছেন যে ঐ যুগে ভারতীয়দের জলপথেও কত ক্ষমতা ছিল। প্রাচীন সরস্বতী নদীর উল্লেখ বেদ গ্রন্থে পাওয়া যায়। তথাকথিত সিন্ধু সভ্যতা সরস্বতী -সিন্ধুকে কেন্দ্র করে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার শেষ দিকের কথা। ভি. এস. ওয়ানকার এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিকের আবিষ্কৃত তথ্য থেকে এখন জানা গেছে যে সরস্বতী কয়েকবার গতিপথ পরিবর্তন করে অানুমানিক ২০০০ খৃ. পূর্বাব্দে সম্পূর্ণ শুষ্ক হয়ে যায় এবং হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হওয়ার কারণ পরিবেশগত। আনুমানিক ২২০০ খৃ.পূ. থেকে ভয়াবহ খরার কারণে সিন্ধু বা হরপ্পা ধ্বংস হয়। বিদেশ থেকে কোন আর্যজাতি এসে তা করেনি। হরপ্পায় আবিষ্কৃত শীলমোহরগুলির ভাষা দ্রাবিড়িয় বলে দাবী করা হয়েছিল। এস. আর. রাও (ডন এণ্ড ডেভলিউশন অফ দি ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন) এখন যতটা আবিষ্কার করেছেন তার থেকে জানা গেছে শীলমোহরগুলির ভাষাও সংস্কৃতর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত, দ্রাবিড়িয় না। ক্রিপটোলজিষ্ট (লিপিবিদ্যা বিশারদ) সুভাষ কাক কম্পিউটার বিশ্লেষণ করেও প্রমাণ করেছেন যে ঐ ভাষা সংস্কৃতর সঙ্গেই যুক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি আর্য আক্রমণ তত্ত্বের সমর্থন করে না শুধু নয় — তার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করে। J.G.Shaffer প্রণীত ইন্দো-ইউরোপীয়ান ইনভ্যাসনঃ কালচার্যাল মিথ এণ্ড আর্কিওলজিক্যাল রিয়ালিটি গ্রন্থে বলেছেন যে আর্য আক্রমণতত্ত্ব একটি অলীক কল্পনা — ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভাবেই নিজস্ব (পৃ.৮৮) এই তত্ত্ব অনুসারে যেহেতু আর্যরা ১৫০০ খৃ.পূ. নাগাদ ভারতে এসেছিল সেহেতু হরপ্পা সভ্যতা আর্য পূর্ব ভারতীয় সভ্যতা যা আর্য আক্রমণে পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে আশ্রয় নেয়। আর্য দ্রাবিড় সংঘর্ষের গল্প এইভাবে তৈরী। এরে কিছু কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও তারা খারা করলেন। মার্টিমার হুইলার বৃটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক মহেঞ্জোদারো কয়েকটি কঙ্কাল দেখতে পেয়ে সিদ্ধান্ত করলেন যে আর্যরা যে গনহত্যা করেছিল এ তারই প্রমাণ। পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এস আর রাও প্রমাণ করলেন যে আক্রমণকারী ও আক্রান্তর হাড়গুলি বা কঙ্কালগুলির মধ্যে কয়েকশত বছরের সময় ব্যবধান আছে। সিমেট্রি আর ৩৭ এবং সিমেট্রি এইচ এই সময় ব্যবধান এমনই যে তথাকথিত আক্রমণকারীরা যখন এসেছিল তখন তথাকথিত আক্রান্তরা ছিল না। ফলে গণহত্যার তত্ত্ব হাস্যকর। খননে প্রাপ্ত কতকগুলি পাথর ও পোড়ামাটির বস্তু দেখিয়ে হুইলার, মার্শাল, পিগট প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিক আর্য আক্রমণতত্ত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বললেন যে —এগুলি প্রমাণ করে যে লিঙ্গ পূজা সে যুগে ছিল — এদেরই পরে দাক্ষিণাত্যে লিঙ্গ পুজক দ্রাবিড়ীয় বলে আমরা দেখতে পাই। এস. আর. রাও বলেলেন যে ওগুলি কোন দেবমূর্তি নয় —ওজনের বাটখারা যা নাকি গুজরাট এলাকাতেও খনন করে পাওয়া গেছে (The Aryan Invasion Theory A Repraisal by Srikant G. Talageri উদ্ধৃত পৃ. VI)। তা ভারতে কয়েকশত বছর প্রচলতি ছিল। আর্য আক্রমণ তত্ত্বের এই সব তাত্ত্বিকরা ধরেছেন শিবপুজা মানেই দ্রাবিড়ীয় এবং দক্ষিণাত্য। প্রকৃত কথা হল শিব পূজা প্রধানত হিমালয় ভিত্তিক অর্থাৎ নেপাল, কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ প্রভৃতি এলাকার। ঐ সব তাত্ত্বিকেরা যে শিব পূজা সংক্রান্ত কোন তথ্য পেয়েছিলেন হরপ্পায় তাও নয় — সেটাও কাল্পনিক। দ্রাবিড় তত্ত্ব আর শিব পূজাকে এক করে দিয়ে দক্ষিণাত্যে পাঠিয়ে দেওয়া এবং বলা হল যে আর্য আক্রমণের ফলে হরপ্পীয়রা পালিয়ে গেছিল — বাকিরা ধ্বংস হয়ে গেছিল। এই তাত্ত্বিকরা আরও বলেন যে হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়ার ব্যবহার ছিল না, আর্যরাই ঘোরা এনেছিল —চাল সম্পর্কেও তারা একই কথা বলেন। এস. আর. রাও দেখালেন যে নোথাল, কালিবান গাঁও, সূরকোটাডা, রোপার এবং অধুনা পাকিস্তানের মহেঞ্জোদাড়োতে খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিক যে নিদর্শণ পাওয়া গেছে তা ঐ তত্ত্বের সমর্থন করে না বরং পরিস্কারভাবে প্রমাণ করে যে সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক আর্যদের সভ্যতারই অঙ্গ। আর্য যুগেই ঘোড়া এবং চালের ব্যবহার ছিল। পরে তা সিন্ধু যুগে এসেছে।
0 মন্তব্য(গুলি)