https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বেদ-কেন এবং কি ? [ পর্ব ১] - অধ্যাপক রাজেন্দ্র জিজ্ঞাসু

Tuesday, February 13, 2018

ও৩ম্

বেদ-কেন এবং কি ?
লেখক
অধ্যাপক রাজেন্দ্র জিজ্ঞাসু (পাঞ্জাব) 
                            
 বেদে কি আছে ?:
          কিছু লোক জিজ্ঞাসা করে যে বেদে কি আছে ?  ঋষি উত্তর দিচ্ছেন যে বেদো অখিলো ধর্মমূলম্ বেদ হলো সমস্ত ধর্মের মূল ।  মানব কল্যাণের জন্য প্রভু বেদের মধ্যে বীজরূপে সারা জ্ঞান চার ঋষির হৃদয় গুহাতে প্রকাশিত করে দিয়েছেন ।
সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধির একমেব মার্গঃ

     সমস্ত প্রাণী সুখ চায় । কেউ-ই দুঃখ চায় না ।  মনুষ্য তো সুখ সমৃদ্ধিকে চায়-ই ।  সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তির একটিই মার্গ ।  অন্য কোন দ্বিতীয় বিকল্প নাই ।  এই মার্গ ঋগ্বেদের অন্তিম সূক্তে পরমাত্মা মানবকে দেখিয়েছে ।  এই সূক্ত সংগঠন সূক্তনামে প্রসিদ্ধ ।  এই সূক্তের সাথে দেশ, কাল বা কোন বর্গ বিশেষের সাথে কোন সম্বন্ধ নাই ।  আজ সারা সংসারে যুদ্ধের ভয় ব্যপ্ত রয়েছে ।  এই সূক্তের প্রথম মন্ত্রে মনুষ্যের জন্য মানব হিতে সমানো মন্ত্রাঃ” - মিলে মিশে বিচার করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে ।  এর জন্য সমিতি সমানী-র আদেশ-ও দেওয়া হয়েছে ।  মিলে মিশে বিচার তখনই হবে যখন সব জাতি এবং দেশের একটিই সমিতি হবে।  সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধির যে উপায় এই মন্ত্রে বলা হয়েছে এঁকে মিথ্যে করতে পারবে ?  আজ মিলেমিশে, মুখোমুখি বসে বিচার করার উপরে-ই প্রত্যেক সমস্যার সমাধান খোঁজার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে ।
    তারপর সংগচ্ছধং”- মিলেমিশে চলার, মিলেমিশে বলার, সংবাদ করার উপদেশ রয়েছে ।  এই Walk together এবং Talk together -ই হচ্ছে আদর্শ সংসারের স্বরূপ ।  এই সমান মন্ত্র, সমান সমিতির স্বাভাবিক ফল ।  পরের এক মন্ত্রে সমান হৃদয় এবং সমান মনের কথা বলা হয়েছে ।
উপরোক্ত যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তদনুসার আচরণের সুখদায়ী পরিণাম হবে, মন এবং হৃদয়ের অনুুকূলতা তথা একই রকমের ভাবনা ।
        এই সূক্তে আর একটি মার্মিক শব্দ এসেছেসুসহাসতি- অর্থ হোল ভালোভাবে মিলেমিশে বসবাস করা ।  কখনও ভারত এবং চীন মিলে গিয়ে পঞ্চশীলের ঘোষণা করেছিল ।  তাতে একটি সিদ্ধান্ত ছিল সহ-অস্তিত্ব (Co-existence)  মিলেমিশে থাকা তো ভালো কথা পরন্তু এই শব্দে ভালোভাবে থাকার ভাবনা ব্যক্ত হয় না ।  সাথে সাথে থাকার জন্য পরস্পর সহযোগের আদেশ এই সুসহাসতিশব্দে দেওয়া হয়েছে ।  যেখানে পরস্পর সহযোগের ভাবনা হবে সেখানেই সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তি হবে । ভালোভাবে জীবন ব্যতীত করার এইটিই একমাত্র  মার্গ ।

বৈদিক প্রার্থণাঃ
     মানবের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য যা কিছু চাই,  তার জন্য বেদে সুন্দর প্রার্থনা রয়েছে ।  মনুষ্য সবকিছু পেয়ে-ও, সবকিছু নাশ করে ফেলে,  হারিয়ে ফেলে কেবল বুদ্ধি না থাকার জন্য এবং কিছু না থাকার পরেও সবকিছু পেয়ে যায় কেবল নিজের উত্তম বুদ্ধির দ্বারা ।  
বেদের প্রসিদ্ধ মন্ত্র ও৩ম্ ভূ ভুর্বঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং”.....  গায়ত্রী মহামন্ত্র দিয়ে গুরু বিদ্যা আরম্ভ করে আসছেন ।  এই মন্ত্রে পরমেশ্বরের কাজ থেকে উত্তম নির্মল বুদ্ধির কামনা করা হয়েছে ।  এমন বুদ্ধির যাচনা করা হয়েছে যা সৎকর্মের দিকে প্রেরনা দেবে ।  সংসারের  কোন মত, পন্থ বা গ্রন্থে এমন প্রার্থনা পাওয়া যাবে না ।   এই মন্ত্রে স্তুতি, প্রার্থনা এবং উপাসনা তিনটিই রয়েছে ।  এও একটি বিশেষতা ।   এ কেবলমাত্র বিশেষতা-ই নয়,  বিলক্ষণতাও বটে ।  অথর্ববেদের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে যেহে বুদ্ধি !  তুই আমার কাছে সর্বপ্রথম অর্থাৎ আমার প্রথম প্রাথমিকতা ।

বেদের ভাষাঃ
         বেদের ভাষার অর্থ -গৌরব এবং সৌন্দর্য সংসারে সে নিজে নিজেই তাঁর উদাহরণ ।  এমনিতে তো সংসারের প্রত্যেক ভাষাতে একটি শব্দের জন্য অন্য অন্য পর্যায়বাচী শব্দ-ও প্রাপ্ত হয় । এবং এমন অনেক শব্দ রয়েছে যার অনেক অর্থ হয় । ফার্সী ভাষার মহান কবি শেখ সাদীর একটি পদ্য উল্লেখনীয়ঃ
 সাদিয়া দরী দয়ার তূ মর্দে মুসাফির ।  
বা কস সুখন ন গোঈ কি গুজরাতিয়া জনন্দ।।
   প্রথম পংক্তির অর্থ হোল-  ও সাদী !  তুই হচ্ছিস এখানকার যাত্রী ।  দ্বিতীয় পংক্তির দুইটি অর্থ- প্রথমতঃ তুই কারো সাথে কথা বলবি না  -নাহলে গুজরাটীরা লোকেরা তোকে পিটাবে ।  দ্বিতীয়তঃ- কাউকে বলবি না যে গুজরাটীরা হোল মেয়ে মানুষ ।  পরন্তু বেদের একটি শব্দের অনেক অনেক অর্থ বা সমানার্থক শব্দ হওয়ার কারণে বৈদিক মন্ত্রের অর্থ-গৌরব, সৌন্দর্য তথা গাম্ভীর্য অদ্ভুত ।  এঁর থেকে বেদ মন্ত্রের গূঢ় ভাবকে দেখে ব্যক্তি আশ্চর্যচকিত হয়ে যায় ।  ঋগ্বেদে এসেছেঃ
সূর্যচন্দ্রমসৌ ধাতা য়থা পুর্বমকল্পয়ৎ।
অর্থাৎ পরমাত্মা যেমনভাবে এই সৃষ্টিতে সূর্যচন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে পূর্ব-সৃষ্টিতেও এইরকম সূর্যচন্দ্রকে তৈরি করে এসেছেন ।  এখানে য়থাপূর্ব (Cyclic order) শব্দে সৃষ্টি রচনার সিদ্ধান্তকে তো রাখাই হয়েছে- ঈশ্বরের নিয়মসমূহের অটলতার সিদ্ধান্তকেও প্রস্তুত করা হয়েছে । অন্যান্য মত পন্থে ঈশ্বরের নিয়মের পরিবর্তন, চমৎকার হওয়া ইত্যাদি নিজের মত বা গ্রন্থের মহিমার প্রমাণ মেনে আসছে । ঋগ্বেদেই অন্য জায়গায় বলা হয়েছে যে বিধাতা সৃষ্টিকে নিয়মের মধ্যে সাজিয়েছেন । এটি হোল বেদের অদ্ভুত অবদান।  বন্ধুগণ ! একটুখানি বিচার করুনযদি জগৎ নিয়মবদ্ধ না হোত তাহলে বিজ্ঞান (Science)  কোথায় টিকতো ? “perhaps lawlessness would have gone more against the theistic conception then the existence of law” —অর্থাৎ নিয়মবদ্ধতার জায়গায় অনিয়মিততা আস্তিকতার অধিক বিপরীত হয় ।  

     জগতের সর্বত্র ব্যবস্থা রয়েছে এবং ক্রিয়ার কিছু প্রয়োজন রয়েছে ।  ব্যবস্থা দিয়ে নিয়মের মহত্ত্বকে জানা যায় ।  বেদে বারম্বার অটল তথা সত্য নিয়মের গুণগান দৃষ্টিগোচর হয় ।  এ হোল বেদের মহান অবদান।

        উক্ত মন্ত্রে য়থাপূর্বম্”-র সাথে ঈশ্বরের জন্য ধাতাশব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে ।  এই শব্দে গাগরের (কলশী) মধ্যে সাগরকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ।  এঁর জন্য কোনো-ই ভাষাতে কোনো শব্দ নেই ।  ধাতার অর্থ বিধাতা,  Creator  রচয়িতা-তো বটেই,  এর জন্য আর একটি অর্থ হোল ধারণ করা শক্তি ।  ঈশ্বর জগতের রচনা,  পালন তথা সংহার করেন ।  সে ধারন করার কারনেই তো তিনটি কার্য করতে পারেন ।  প্রভু যদি সর্বব্যাপক না হন তাহলে না তো সৃষ্টি রচনা করতে পারেন,  না পালন করতে পারেন,  না সংসারকে চালাতে পারেন এবং না সংহার করতে করতে পারেন ।  সৃষ্টিতে প্রতিক্ষণ কিছু তৈরি হচ্ছে এবং কিছুর পরিবর্তন হচ্ছে।  
         ঈশ্বর হলেন সর্বব্যাপক ।  তিনি হলেন ধাতা,  তাইতো সহজ রীতিতে এইরকম হচ্ছে ।  ঈশ্বর সর্বজ্ঞ তথা সর্বশক্তিমান-ও এই কারণে ।
ধাতা হওয়ার ফলেই তিনি হলেন সর্বাধার ।  পাঠকবৃন্দ!  দেখলেন তো!  বেদের একটি শব্দেই কতখানি গূঢ় অথচ সহজ রীতিতে  বোঝার দার্শনিকভাব পরমাত্মা ভাবনা ভরে দিয়েছেন ।

      এখানে প্রসঙ্গবশে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়  যে, ইংরেজদের শাসনকালের ইতিহাস তথা অন্য গ্রন্থে-ও বেদকেচাষাঢ় গান’ (ভেড়া চরানো লোকেদের গীত)  বলার একটা ফ্যাশান চলেছিল ।  বেদের অবমূল্যায়নের জন্য তথা হিন্দুদেরকে বেদের থেকে ঘৃণা করানোর জন্যই (বেদ বিরদ্ধ )  এই সব শব্দের সৃজন হয়েছিল ।  এটা ঠিক যে প্রাণী জগতের প্রতি,  বনস্পতির প্রতি,  সূর্য, চন্দ্র, ঊষার এবং  সাগর  তরঙ্গাদির    প্রতি  ভালোবাসা  রাখা  আর্যগণ সব বেদ মন্ত্রের গান গাইতো।  আমাদের পশুপালকও বেদ ঋচার গান গাইতো ।  পশুপালক যদি বেদ ঋচার গান গায় তাহলে কি এতে বেদ ঋচার গৌরব হ্রাস হবে ?

পশুপ্রেমী মহাপুরুষঃ
      হজরত মোহাম্মদ বিড়ালকেও ভালোবাসতেন।  তাঁকে উটওয়ালা বলা হোত ।  হজরত ঈসাকে কি ভেড়াওয়ালা বলা হোত না ?  সে কি পশুদেরকে ভালোবাসতেন না ?  আমাদের যোগেশ্বর কৃষ্ণ আদি সব মহাপুরুষ গোপাল ছিলেন ।  শ্রী গুরু নানক দেবজী মহিষ চরাতেন ।  কোরান এবং বাইবেলের আয়তকে কি এইজন্য হীনদৃষ্টিতে দেখা যাবে ?   এই কারণে গীতা বা গুরুবাণীর মহিমা কি কম হতে পারে ?  বেদকে (Primitive)  আাদিম লোকেদের কাব্য বলে অভিহিত করার কি অর্থ ?  বেদ হোল প্রত্যেক যুগের জন্য,  তেমনই যেমনটি সৃষ্টির অন্য নিয়ম বা বিজ্ঞান প্রত্যেক যুগের জন্য ।  এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ের উপর বিচার করা আবশ্যক।  

      যে সব মুসলমান ভাই পূর্বের আসমানী পুস্তক (তৌরত, ইঞ্জিল) কে বাতিল হওয়া স্বীকার করে এবং এরকম বলে যে, আল্লাহ্ এবারে কোরানের সুরক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছেন এবং দায়ীত্বও নিয়েছেন ।  এখন কোরানে কিছু কম হবে না , কিছু বাড়বে না,  কিছু পরিবর্তন হবে না ।  প্রলয় পর্যন্ত এই নিয়মই (কোরান) চলতে থাকবে ।  এই প্রকার চিন্তা-ভাবনা রাখা সজ্জনদেরকে আমরা জিজ্ঞাস করছি যে সময়ের সাথে সাথে  আল্লাহ্-ই বদলে গেছে বা তাঁর গুণ,  কর্ম, স্বভাব বদলে গেছে ?  যখন সে পূর্ব গ্রন্থকেই বাতিল করে দিয়েছে এবং তাঁর রক্ষা করতে পারেনি তাহলে বর্তমানে কি গ্যারান্টি যে,  কোরাণ-কেও একদিন বাতিল করে দেবে না ?

রোগী সংসার এবং বেদঃ
       আজ সংসারের বিকাশশীল দেশও ক্যান্সার,  সুগার,  হৃদয় রোগ এবং রক্তচাপ ইত্যাদি রোগের কারণে আতঙ্কিত ।  অথর্ববেদের ব্রহ্মচর্য সূক্তের ২৬ টি মন্ত্রে দশবারতপশব্দ এসেছে ।  এই সূক্তেই শ্রম,  তপ,   মেখলা এবং সমিধা -এগুলি বিদ্যার্থীর চার অলঙ্কার বলে বলা হয়েছে ।  আজ বৈজ্ঞানিক এক স্বরে বলছেন যে শ্রমবিহীন এবং তপরহিত থাক-খাওয়াটাই হোল ঘাতক রোগের মুখ্য কারণ ।  যে অথর্ববেদকে পশ্চিমদেশীয় লেখকেরা জাদু -টোনার গ্রন্থ বলে তিরস্কার করেছে,  সেই বেদেই তপ এবং শ্রমের এই মহিমার কথা বলা হয়েছে । তপস্বী এবং ক্রমশীল-ই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে।   অথর্ব শব্দের অর্থ হোল অকম্প (Unshakable)    আদিম মনুষ্য (Primitive) কি কোন গ্রন্থের এই রকম মার্মিক নামকরণ করতে পারবে ?  কদাপি নয়।  এতো সর্বজ্ঞ প্রভুর দান ।