https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

অসম্ভূতি সম্ভূতি নিয়ে পাখন্ডি কে পাল্টা জবাব

Wednesday, April 18, 2018

যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায়ের অন্তর্গত ঈশাবাস্যোপনিষদের ১২-১৪ মন্ত্রে অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি বিষয়ে শঙ্করাচার্য্য কে সমীক্ষা করে আমরা একটি নোট পাবলিশ করেছিলাম। এখান থেকে সে নোট পড়ে নিতে পারেন- অসম্ভূতি সম্ভূতি

পরবর্তীতে এক ভন্ড পাখন্ডি তার প্রত্যুত্তর লিখে শঙ্করাচার্যের পক্ষে সাফাই গাইতে স্বামী দয়ানন্দ জী কে নিয়ে অনেক অপশব্দ প্রয়োগ করে সাধারন পাঠকদের মগজ ধোলাই করেন। আমরা এই নোটে সেই পাখন্ডির ভন্ডামীর জবাব প্রদান করেছি।  নোট টি অনেক দীর্ঘ হেতু সময় নিয়ে পড়বেন সবাই।

আর্যঃ
|| শ্রী শঙ্করাচার্য জী এই মন্ত্রের বিপরীত করেছেন। এই মন্ত্রগুলোর মধ্যে প্রথম মন্ত্রের ব্যাখ্যায় শ্রী শঙ্করাচার্য লিখেছে - অসম্ভূতিম = সম্ভবনং সম্ভূতিঃ সা যস্য কার্যস্য সা সম্ভূতিঃ তস্যা অন্যা অসম্ভূতিঃ প্রকৃতিঃ কারণম্...... সম্ভূত্যাং কার্যব্রহ্মাণি হিরন্যগর্ভাখ্যে। অর্থাৎ সম্ভবন = উৎপন্ন হওয়ার নাম সম্ভূতি। তিনি যেই কার্যের ধর্ম তাকে সম্ভূতি বলেছেন। তাহা থেকে ভিন্ন কে অসম্ভূতি= প্রকৃতি বা কারণ বলেছেন। সম্ভূতির নাম কার্যব্রহ্ম।
এখানে শঙ্করভাষ্যে "অসম্ভূতি "র অর্থ ঠিক করেছেন কিন্তু সম্ভূতির অর্থ পূর্বাগ্রহ বশত কল্পিত করেছেন। যখন "অসম্ভূতি" র অর্থ "সম্ভূতির " অর্থ স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তো তাহার ভিন্নথা কেন? যদি "অসম্ভূতি" র অর্থ প্রকৃতি বা কারণ হয় তবে "সম্ভূতি " র অর্থ প্রকৃতি দ্বারা উৎপন্ন কার্য জগৎ হওয়া উচিত। অথবা শঙ্করাচার্যের অনুসারে যদি "সম্ভূতি "র অর্থ "কার্য-ব্রহ্ম " তো অসম্ভূতির অর্থ কারন ব্রহ্ম হওয়া উচিৎ। আর হিরণ্যগর্ভাখ্য কার্য ব্রহ্ম কি বস্তু? এবং অসম্ভূতি= প্রকৃতি কি বস্তু? কারণ অদ্বৈততবাদে তো ব্রহ্ম ভিন্ন তো দ্বিতীয় বস্ত নেই। ||

পাখন্ডিঃ
///সম্ভূতি শব্দ দিয়ে মূলত 'উৎপত্তি জাত কোনো কিছু কে বোঝানো হয়'। শঙ্করাচার্য তাই অসম্ভূতি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন "প্রকৃতিঃ কারণমবিদ্যা অব্যাকৃতাখ্যা"। উক্ত মন্ত্রের শঙ্করাভাষ্যের বঙ্গানুবাদ যিনি করেছেন সেই শ্রীযুক্ত পণ্ডিত দূর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ, তিনি শঙ্করাচার্যের অসম্ভূতি ব্যাখ্যাকে স্পস্ট করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন-
"জগতের মূল কারণ, অব্যাকৃত শব্দবাচ্য (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন) প্রকৃতি, জীবের সুখ-দুঃখ ভোগের কারণীভূত কর্ম্মময় বীজ এই অব্যাকৃত প্রকৃতিতেই নিহিত থাকে"।
কিন্তু কপটি আর্য সমাজীরা এখানে শঙ্করাচার্যের উক্তির দার্শনিক স্পষ্টতাই তুলে ধরলেন না!! উল্টে লিখে দিলেন "অসম্ভূতি= প্রকৃতি বা কারণ" উনারা এমন কপটতা দেখাচ্ছেন কারণ দয়ানন্দ জী এই অসম্ভূতির অর্থ - "অনাদি অনুৎপন্ন সত্ব, রজ ও তমো গুণময় প্রকৃতিরূপ জড় বস্তু" হিসাবে ধরেছেন যা স্পস্টত কিছুটা শঙ্করাভাষ্য বিরোধী ও অযথার্থ।
শঙ্করাচার্য উক্ত প্রকৃতির ব্যাখা করতে গিয়ে "অব্যাকৃতাখ্যা" শব্দ ব্যাবহার করেছেন, সুতরাং দয়ানন্দ জীর ব্যাবহার করা "সত্ব, রজ ও তমো গুণময়" শব্দগুলি ব্যাবহার অনুচিত এবং উক্ত প্রকৃতিকে "জড় বস্তু" হিসাবে অভিষিক্ত করাও অনুচিত।
স্পস্টত এখানে শঙ্করাচার্য যে প্রকৃতিকে বোঝাতে চেয়েছেন তা সৃষ্টির পূর্বের স্বরূপ এবং দয়ানন্দ জী যে প্রকৃতির কথা বলছেন তা বর্তমান স্বরূপ।
এই বিষয়ে শ্রীযুক্ত পণ্ডিত দূর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ এর পাদটীকাটি দেখতে পারেন :-
উক্ত ব্যাখা অনুসারে শঙ্করাচার্য এখানে যে প্রকৃতির কথা বলছেন তা সৃষ্টির পূর্ব অবস্থার প্রকৃতি। যার সত্ব, রজ ও তমো গুণত্রয় সাম্যাবস্থায় অর্থ্যাৎ তিনি সেই স্বরূপে কোনো কার্য্য (a physics term) করেন না। তাই এই প্রকৃতিকে সত্ব, রজ ও তমো গুণ দিয়ে অভিষিক্ত করা অনুচিত।
এই প্রকৃতি অচেতন অর্থ্যাৎ সৃষ্টির পূর্বে জড় পদার্থ, সমস্ত জগতের মূল কারণ ও সমস্ত শুভাশুভ ইহাতে লুক্কায়িত থাকে এবং এই প্রকৃতি থেকে বেদুক্ত হিরণ্যগর্ভের শরীর উৎপন্ন হয়। তাই এই প্রকৃতিকে জড় বস্তু হিসাবে অভিষিক্ত করাও অনুচিত।////

জবাবঃ

প্রথমে  দয়ানন্দ জী কর্তৃক উক্ত মন্ত্রের ভাষ্যটি দেখে নেওয়া যাক -

পদার্থঃ (যে) যে লোক পরমেশ্বর কে ছেড়ে (অসম্ভূতিম্) অনাদি অনুৎপন্ন সত্ব, রজ এবং তমোগুণময় প্রকৃতিরূপ জড় বস্তুকে (উপাসতে) উপাস্যভাব দ্বারা জানে, তিনি (অন্ধম্ তমঃ) আবরনকারী অন্ধকার কে (প্রবিশন্তি) উত্তম প্রকারে প্রাপ্ত হন এবং (যে) যিনি (সম্ভৃতাম্) মহত্তত্ত্বাদি স্বরূপ পরিণাম কে প্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টিতে (রতাঃ) রমণ করে (তে) তিনি (উ) বিতর্কের সাথে (ততঃ) তার থেকেও (ভূয় ইব) অধিক যেমন ওইরূপ (তমঃ) অবিদ্যারূপ অন্ধকার কে প্রাপ্ত হন।।

সত্যার্থ প্রকাশের একাদশ সমুল্লাসে উক্ত মন্ত্রের অর্থে  তিনি বলেছেন -

" যাহারা ব্রহ্মের স্থানে "অসম্ভূতি" অর্থাৎ অনুৎপন্ন অনাদি প্রকৃতি কারণের উপাসনা করে, তাহারা অন্ধকার অর্থাৎ দুঃখসাগরে নিমগ্ন হয়।  আর যাহারা ব্রহ্মের স্থানে "সম্ভূতি" অর্থাৎ কারণ হইতে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিব্যাদি ভূত,  পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে,  তাহারা উক্ত অন্ধকার অপেক্ষাও অধিকতর অন্ধকার অর্থাৎ মহামুর্খ চিরকাল ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হইয়া মহাক্লেশ ভোগ করে"


মহর্ষি দয়ানন্দ জীর ভাষ্য অনুসারে সম্ভূতির অর্থ প্রকৃতি, যা কখনো না উৎপন্ন হবার কারনে অনাদি। ইহা জড় বস্তু। এই প্রকৃতি দ্বারা যে মহত্তত্বাদি উৎপন্ন হয় তাকে সম্ভূতি বলে।এই মহত্তত্বাদি প্রকৃতি থেকে সম্ভূত= উৎপন্ন হবার কারণেই সম্ভূতি বলা হয়। উক্ত অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি আত্মার জন্য কিরূপ উপযোগ , তাহা এই মন্ত্রে বলা হয়েছে যে অসম্ভূতি = প্রকৃতির উপাসনা করে, সে ঘোর অন্ধকারে প্রবিষ্ট হয়, অর্থাৎ সে অবিদ্যাগ্রস্ত হওয়ার দ্বারা সদা দুঃখী হয়ে থাকে।আর যে সম্ভূতি= প্রকৃতির কার্য পৃথিবী আদি জড় বস্তুর উপাসনা করে সে তা থেকেও ঘোর অন্ধকারে প্রবেশ করে।

এর প্রেক্ষিতে পাখন্ডি মহাশয় লিখেছে - ///উক্ত মন্ত্রের শঙ্করাভাষ্যের বঙ্গানুবাদ যিনি করেছেন সেই শ্রীযুক্ত পণ্ডিত দূর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ, তিনি শঙ্করাচার্যের অসম্ভূতি ব্যাখ্যাকে স্পস্ট করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন-"জগতের মূল কারণ, অব্যাকৃত শব্দবাচ্য (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন) প্রকৃতি, জীবের সুখ-দুঃখ ভোগের কারণীভূত কর্ম্মময় বীজ এই অব্যাকৃত প্রকৃতিতেই নিহিত থাকে"।কিন্তু কপটি আর্য সমাজীরা এখানে শঙ্করাচার্যের উক্তির দার্শনিক স্পষ্টতাই তুলে ধরলেন না!! উল্টে লিখে দিলেন "অসম্ভূতি= প্রকৃতি বা কারণ /// আচ্ছা পাখন্ডি মহাশয় আপনার এই তথ্যের ভিত্তি তবে দূর্গাচরণের পাদ টিকা,  যা দেখে কোন বিচার না করেই সোজা আর্য সমাজ কে কপট বলে দিলেন। অর্থাৎ ব্যাপার টি হচ্ছে আপনার দূর্গাচরণের টিকা [যেটাকে শঙ্করাচার্যের দার্শিনকতা বলছেন সেটা]  কেউ তুলে না ধরলেই সেই  কপট।  আচ্ছা গীতা প্রেস থেকে প্রকাশিত শঙ্কর ভাষ্যের অনুবাদ টি তবে একটিবার দেখে নেওয়া যাক। গীতা প্রেসের অনুবাদে বলা হচ্ছে -

 "অন্য অসম্ভূতি- প্রকৃতি কারণ অথবা অব্যকৃত নামের অবিদ্যা। সেই অসম্ভূতি যা অব্যাকৃত নামের প্রকৃতি কারণ অর্থাৎ অজ্ঞানত্মিকা অবিদ্যা,  যা কামনা এবং কর্মের বীজ"


এখানে গীতা প্রেসের অনুবাদেও অসম্ভূতি কে - প্রকৃতির কারণ এবং অব্যকৃত নামের অবিদ্যা বলা হয়েছে ।  তারা তো আপনার দূর্গাচরণের মতো  অব্যকৃত শব্দবাচ্য কে (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন প্রকৃতি) এভাবে  আলাদা করে লেখেন নি, অথবা আলাদা করে নিচে পদাটিকা করে ব্যাখ্যাও করে নি। এখন কি গীতা প্রেসের অনুবাদকদের আপনি কপট বলবেন?  [যেহেতু আপনার মতে শঙ্করাচার্যের দার্শনিকতা তাদের ভাষ্যে অনুপস্থিত]।

এর পর পাখন্ডি মহাশয় লিখেছেন - ///উনারা এমন কপটতা দেখাচ্ছেন কারণ দয়ানন্দ জী এই অসম্ভূতির অর্থ - "অনাদি অনুৎপন্ন সত্ব, রজ ও তমো গুণময় প্রকৃতিরূপ জড় বস্তু" হিসাবে ধরেছেন যা স্পস্টত কিছুটা শঙ্করাভাষ্য বিরোধী ও অযথার্থ। শঙ্করাচার্য উক্ত প্রকৃতির ব্যাখা করতে গিয়ে "অব্যাকৃতাখ্যা" শব্দ ব্যাবহার করেছেন, সুতরাং দয়ানন্দ জীর ব্যাবহার করা "সত্ব, রজ ও তমো গুণময়" শব্দগুলি ব্যাবহার অনুচিত এবং উক্ত প্রকৃতিকে "জড় বস্তু" হিসাবে অভিষিক্ত করাও অনুচিত। /// আচ্ছা এবারও তবে আপনি দূর্গাচরণের উক্ত পাদটিকা তুলে যেখানে বলা হয়েছে -(জগতের মূল কারণ, অব্যাকৃত শব্দবাচ্য (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন, প্রকৃতি)  এই তথ্য অনুসারে দয়ানন্দ জীর প্রকৃতির পক্ষে সত্ব, রজ ও তমো গুণময়" এই ত্রিগুণাত্মক শব্দ গুলোর ব্যবহার কে অনুচিৎ বলছেন?  আপনার জ্ঞানের দৌড় যে,  দূর্গাচরণের টিকা পর্যন্তই এবার তা সবাই বুঝে যাবে । অব্যক্ত প্রকৃতিকে ত্রিগুণাত্মক বলা যায় কি না এবার তা নিজের চোখেই দেখুন।  বিবেকচুড়ামণি তে শঙ্কর বলছেন -

অব্যক্তনাম্নী পরমেশশক্তিরানদ্যবিদ্যা ত্রিগুণাত্বিকা পরা।
কার্যানুমেয়া সুধিয়ৈব মায়া যয়া জগৎ সর্বমিদং প্রসূয়তে।। ১০৮

=>>মায়া বা অবিদ্যা ব্রহ্মের শক্তি।  তাহাকে অব্যক্তও বলা হয়।  উহা আদি- রহিত,  সত্ব,  রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণ সমন্বিত এবং কারণরূপা।  সৃষ্টিরূপ কার্য হইতে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্যক্তি উহার অস্তিত্ব অনুমান করিতে পারেন। এই মায়া হইতে এই সকল জগৎ উৎপন্ন হয়।




 এখানে মায়া হচ্ছে প্রকৃতি (মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়ীনং তু মহেশ্বরম্; শ্বেতাঃ ৪।১০)  অর্থাৎ মায়াকে প্রকৃতি জানবে এবং মায়িন কে মহেশ্বর।  এই মায়া (প্রকৃতি) কে শঙ্করাচার্য্য অব্যক্ত,  অনাদি,  অবিদ্যা,  ত্রিগুণাত্বিকা অর্থাৎ সত্ব, রজঃ তম রূপে ভূষিত করেছেন। আর আপনি মশাই দূর্গাচরণের পাদটিকা তুলে ধরে দয়ানন্দ জীর প্রকৃতির পক্ষে সত্ব, রজ ও তমো গুণময়" এই ত্রিগুণাত্মক শব্দ গুলোর ব্যবহার কে অনুচিৎ বলেন কোন আক্কেলে?  অন্যদের কে কপট বলেন এবার তবে আপনাকে কি বলা উচিৎ! নিশ্চয় ভন্ড তাই না?

এরপর পাখন্ডি মহাশয় লেখেন -///স্পস্টত এখানে শঙ্করাচার্য যে প্রকৃতিকে বোঝাতে চেয়েছেন তা সৃষ্টির পূর্বের স্বরূপ এবং দয়ানন্দ জী যে প্রকৃতির কথা বলছেন তা বর্তমান স্বরূপ।/// হ্যা শঙ্করাচার্য্য প্রকৃতি অর্থে সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা বুঝিয়েছেন। কিন্তু দয়ানন্দ জী প্রকৃতি বলতে সৃষ্টির পরের অবস্থা বুঝিয়েছে এই তথ্য কই পেলেন?  দয়ানন্দ জী স্পষ্টভাবে প্রকৃতির অর্থে বলেছেন - অনদ্যনুতপন্নং প্রকৃত্যাখ্যং সত্বরজস্তমোগুণময়ং জড়ং বস্তু" অর্থাৎ অনাদি অনুৎপন্ন প্রকৃতি আখ্যায়িত সত্ব রজ তম গুণময় জড় বস্তু।  এখানে অনুৎপন্ন শব্দটি স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা।

 তাছাড়া ভাবার্থে তিনি আরো স্পষ্টকরে বলেছেন -  

" যে জনাঃ সকলজড়জগতোহনাদি নিত্যং কারণমুপাস্যতয়া স্বীকুর্বন্তি, তেহবিদ্যাং প্রাপ্ত সদা ক্লিশয়ন্তি" অর্থাৎ যে লোক সকল জড় জগতের অনাদি নিত্য কারণ কে উপাসনা ভাব দ্বারা স্বিকার করে তিনি অবিদ্যা প্রাপ্ত হয়ে সদা কলুষ কে প্রাপ্ত হন। এখানে দয়ানন্দ জী প্রকৃতি বলতে স্পষ্টতর সকল জড় জগতের মূল কারণ অনাদি নিত্য কারণ কে বুঝিয়েছেন। কেননা জগতের যে মূল কারণ তার নামই প্রকৃতি।


এর পরে পাখন্ডি মহাশয় লিখেছে - ///উক্ত ব্যাখা অনুসারে শঙ্করাচার্য এখানে যে প্রকৃতির কথা বলছেন তা সৃষ্টির পূর্ব অবস্থার প্রকৃতি। যার সত্ব, রজ ও তমো গুণত্রয় সাম্যাবস্থায় অর্থ্যাৎ তিনি সেই স্বরূপে কোনো কার্য্য (a physics term) করেন না। তাই এই প্রকৃতিকে সত্ব, রজ ও তমো গুণ দিয়ে অভিষিক্ত করা অনুচিত।/// কথাই আছে না ভন্ডের এক কথা বার বার।  উপরে  বিবেকচুড়ামনি থেকে আমরা দেখিয়েছি যে, শঙ্করাচার্য নিজেও অনাদি অব্যক্ত প্রকৃতিকে ত্রিগুণাত্মক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এ ভন্ডটা বলছে প্রকৃতিকে ত্রৈগুণ্য বলা অনুচিত।  সে কি শঙ্করাচার্যের  থেকেও বেশী বোঝে? প্রকৃতিকে ত্রিগুণাত্মক বলা চলে কি না সে সমন্ধ্যে গীতা ভাষ্যকার জগদীশ চন্দ্র বলেছেন -

প্রকৃতি - জগতের মূল কারণ তাহার নাম প্রকৃতি (প্রকৃতিরহ মূলকারণস্য সংজ্ঞামাত্রম্)। ইহা অনাদি, অন্তহীন,  নিত্য, অসীম, অতিসূক্ষ, অলিঙ্গ ও নিরবয়ব বা নির্বিশেষ। প্রধান, অব্যক্ত,  ত্রৈগুণ্য ইত্যাদি ইহার নামান্তর।  এই অব্যক্তের পরিণামেই ব্যক্ত জগৎ।  সত্ব, রজঃ তমঃ এই তিন গুণের সাম্যাবস্থাই এই অব্যক্ত অবস্থা,  এই হেতু ইহার নাম ত্রৈগুণ্য।

দেখা যাচ্ছে - জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ও অব্যক্ত প্রকৃতিকে ত্রৈগুণ অর্থাৎ সত্ব, রজঃ, তমঃ বলে আখ্যায়িত করেছে।  তাহলে এ মূর্খ কি শুধু ভন্ডামী প্রকাশ জন্য গলা বাজিয়ে যাচ্ছে?

এরপর পাখন্ডি আবারো লিখেছে - ///এই প্রকৃতি অচেতন অর্থ্যাৎ সৃষ্টির পূর্বে জড় পদার্থ, সমস্ত জগতের মূল কারণ ও সমস্ত শুভাশুভ ইহাতে লুক্কায়িত থাকে এবং এই প্রকৃতি থেকে বেদুক্ত হিরণ্যগর্ভের শরীর উৎপন্ন হয়। তাই এই প্রকৃতিকে জড় বস্তু হিসাবে অভিষিক্ত করাও অনুচিত।/// আবারো শঙ্করাচার্যের থেকে বেশী বোঝার চেষ্টা। শঙ্করাচার্য্য প্রকৃতিকে অনাত্মক অর্থাৎ আত্মাহীন (জড়) বলে স্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন।

তিনি ভাষ্যে লিখেছেন - অদর্শনাত্মিকাম্ উপাসতে যে তে তদনুরূপমেব অন্ধং তমোহদর্শনাত্মকং প্রবিশন্তি।

অর্থাৎ যাহারা অনাত্মক(জড়রূপা) এই অব্যাকৃত প্রকৃতির (অসম্ভূতির) উপাসনা করে তাহারা সেই উপাসনানুসারে অন্ধ তমে অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকারে প্রবেশ করে।



অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পাখন্ডি মহাশয় শঙ্করাচার্যের পক্ষে সাফাই লিখতে গিয়ে বার বার শঙ্কর বিরোধী তথ্য দিয়ে নিজের ভন্ডামি প্রকাশ করেছে।

আর্যঃ
||এখানে শঙ্করভাষ্যে "অসম্ভূতি "র অর্থ ঠিক করেছেন কিন্তু সম্ভূতির অর্থ পূর্বাগ্রহ বশত কল্পিত করেছেন। যখন "অসম্ভূতি" র অর্থ "সম্ভূতির " অর্থ স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তো তাহার ভিন্নথা কেন? যদি "অসম্ভূতি" র অর্থ প্রকৃতি বা কারণ হয় তবে "সম্ভূতি " র অর্থ প্রকৃতি দ্বারা উৎপন্ন কার্য জগৎ হওয়া উচিত||

পাখন্ডিঃ
///"অসম্ভূতির" অর্থ প্রসঙ্গে আর্য সমাজীদের বিচারে শঙ্করাচার্য এই জন্যই সঠিক, কারণ দয়ানন্দ জী উক্ত শব্দের অর্থটি শঙ্করাচার্যের কাছে থেকে ধার করেছেন এবং কিছুটা বিকৃত করে নিজের ভাষ্যে যুক্ত করেছেন। নইলে এখানেও বলে দিতেন শঙ্করাচার্যের অসম্ভূতি অর্থটি কল্পিত!
সম্ভূতি শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য উল্লেখ করছেন "সম্ভবনং সম্ভূতিঃ সা যস্য কার্য্যস্য" পরে আবার উল্লেখ করছেন "সম্ভূত্যাং কার্য্যব্রহ্মণি হিরণ্যগর্ভ"। সরল ভাবে বলতে গেলে - "যাহার উৎপত্তি আছে তাহার নাম সম্ভূতি, উৎপত্তিশীল কার্য্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ"।
এখানে দয়ানন্দ জী শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যা কে বিকৃত ও জটিল করে গ্রহণ করেছেন। যজুর্বেদ ৪০.৯ তে "সম্ভূত্যাম" এর অর্থ দেখিয়েছেন :- মহত্তত্ত্বাদি স্বরূপে পরিণামকে প্রাপ্ত হওয়া সৃষ্টি।
পরে যজুর্বেদ ৪০.১১ তে "সম্ভূতিম" এর অর্থ দেখাচ্ছেন :- "যা থেকে সব পদার্থ উৎপন্ন হয় সেই কার্যরূপ সৃষ্টি"
অর্থ্যাৎ দয়ানন্দ জী, শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যা করা সম্ভূতির অর্থকে বিকৃত করে গ্রহণ করলেন!!///

জবাবঃ
পাখন্ডি মশাই এর জ্ঞানের বাহার দেখেছেন - যেই না শঙ্করের সাথে দয়ানন্দ জীর অসম্ভূতি মিলে গেছে ওমনি বলে দিল দয়ানন্দ শঙ্কর থেকে তথ্য ধার করেছেন এবং বিকৃত করে উল্লেখ করেছেন।  ব্যাপার খানা এই রকম যে দয়ানন্দ জী বেদ ভাষ্য করার সময় শঙ্করচার্যের ভাষ্যের চিরকুট হাতে ধরে রেখেছিলেন আর সেটা পাখন্ডি মশাই দরজার আড়াল থেকে দেখেছিলেন।  কোন শব্দের সত্যার্থ সব ভাষ্যকারের ক্ষেত্রেই এক ঘটে, কারো তথ্যের সাথে কারো তথ্যের মিল হওয়া মানে এই নয় যে, সেসব ব্যক্তিরা তথ্য ধার করতেন।  উদাহরণ স্বরূপঃ ধরুণ পরীক্ষার খাতাই সহজ একটা প্রশ্ন এলো cow মানে কি?  সব ছাত্ররাই উত্তর লিখলো গরু। এখন কি তবে বলতে হবে সব ছাত্ররাই একে অপরের নকল করে উত্তর লিখেছিলো।  এরকম তারই মনে হতে পারে যে cow এর অর্থ নিজেই জানে না ।  পাখন্ডি মশাই লিখেছে দয়ানন্দ শঙ্করের অর্থ বিকৃত করেছে।  আচ্ছা পাখন্ডি মশাই দয়ানন্দ কি শঙ্করের ভাষ্যের অনুবাদ করতে বসেছিলেন?  তাই এরকম দোষারোপ করছেন?  দয়ানন্দ জী তার নিজের বেদ ভাষ্য সমন্ধে বলেছেন -

"এই ভাষ্য প্রাচীন (প্রামাণ্য) আচার্যগণের ভাষ্যের অনুকূল প্রণীত হইয়াছে,  রাবণ, উবট,  সায়ণাচার্য্য ও মহিধর আদি যে সকল বেদভাষ্য প্রণয়ণ করিয়াছেন,  তাহা বাস্তবিক বেদশাস্ত্রের মূলমন্ত্র ও (পুরাতন) ঋষি কৃত ব্যাখ্যানের বিরুদ্ধ লিখিত হইয়াছে।  উহাদিগের ন্যায় ভাষ্য প্রণয়ন করি নাই,  যেহেতু উপরোক্ত ভাষ্যকারগণ বেদের সমর্থন অথবা অপূর্বতা বিষয় কিছুই জ্ঞাত ছিলেন না।  আমার কৃত ভাষ্য বেদ,  বেদাঙ্গ ও ঐতেরীয় ও শতপথাদি সত্য ও প্রামাণ্য শাস্ত্রের  অনুযায়ী লিখিত হইতেছে। "

অর্থাৎ পাখন্ডি মশাই যে তথ্য ধারের দোষ দিচ্ছেন সেটা শঙ্করাচার্য্যকে শ্রেষ্ঠ প্রমান করতে আর দয়ানন্দ কে নিচু প্রমাণ করতে [যেহেতু দয়ানন্দের প্রতি ঈর্ষা বিদ্যমান]

এরপর পাখন্ডি লিখেছে - ///সম্ভূতি শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য উল্লেখ করছেন "সম্ভবনং সম্ভূতিঃ সা যস্য কার্য্যস্য" পরে আবার উল্লেখ করছেন "সম্ভূত্যাং কার্য্যব্রহ্মণি হিরণ্যগর্ভ"। সরল ভাবে বলতে গেলে - "যাহার উৎপত্তি আছে তাহার নাম সম্ভূতি, উৎপত্তিশীল কার্য্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ"।/// আচ্ছা পাখন্ডি মশাই আপনি কি পুরোপুরি সম্ভূতির অর্থ তুলে ধলেন?  উক্ত মন্ত্রের বাংলা অনুবাদে দূর্গাচরণ লিখেছেন -

"যাহার উৎপত্তি আছে তাহার নাম সম্ভূতি, আর যাহার উৎপত্তি নাই স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্ব তাহার নাম অসম্ভূতি। সূতারং সম্ভূতির অর্থ হইতেছে -, উৎপত্তিশীল কার্য্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ প্রভৃতি "





লক্ষ্য করুণ সম্ভূতির অর্থ লিখতে গিয়ে দূর্গাচরণ বলেছেন - উৎপত্তিশীল কার্য্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ প্রভৃতি "। অর্থাৎ সম্ভূতি অর্থ শুধু  কার্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ নয় আরো প্রভৃতি।  এখানে দূর্গাচরণ প্রভৃতি শব্দ দ্বারা আরো অনান্য উৎপত্তিশীল বস্তুকে নির্দেশ করেছেন।  মন্ত্রটির পাদটীকাই দূর্গাচরণ আরো পরিষ্কার করে বলেছেন -

সম্ভূতিঃ জাগতিক যে কোন পদার্থ এমন কি হিরণ্যগর্ভের শরীর পর্যন্ত এই প্রকৃতি হইতে সমুৎপন্ন হয় বলিয়া সম্ভূতি শব্দে অভিহিত হইয়া থাকে।




এখানে সম্ভূতি অর্থ জাগতিক যে কোন পদার্থ বলে অভিহিত করা হয়েছে।  এবং সেই সাথে  হিরণ্যগর্ভের শরীর কে নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ সম্ভূতি বলতে শুধু হিরণ্যগর্ভ নয় বরং হিরণ্যগর্ভের শরীর এবং জাগতিক যে কোন পদার্থ।  কিন্তু পাখন্ডি মশাই জাগতিক পদার্থ তথা প্রভূতি উৎপন্ন বস্তুর কথা  উল্লেখ করলেন না,  এটুকু এড়িয়ে গেলেন।

এবার পাখন্ড লিখলেন - ///এখানে দয়ানন্দ জী শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যা কে বিকৃত ও জটিল করে গ্রহণ করেছেন। যজুর্বেদ ৪০.৯ তে "সম্ভূত্যাম" এর অর্থ দেখিয়েছেন :- মহত্তত্ত্বাদি স্বরূপে পরিণামকে প্রাপ্ত হওয়া সৃষ্টি। পরে যজুর্বেদ ৪০.১১ তে "সম্ভূতিম" এর অর্থ দেখাচ্ছেন :- "যা থেকে সব পদার্থ উৎপন্ন হয় সেই কার্যরূপ সৃষ্টি" অর্থ্যাৎ দয়ানন্দ জী, শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যা করা সম্ভূতির অর্থকে বিকৃত করে গ্রহণ করলেন!!/// প্রথমে বলে রাখি দয়ানন্দ জী শঙ্কর ভাষ্যের অনুবাদ করতে বসেন নি তাই শঙ্করের ভাষ্য দেখিয়ে দয়ানন্দ জী কে বিকৃত বলবেন।  দয়ানন্দ ৪০। ৯ এবং ৪০।১১ দুটোতেই সম্ভূতি "মহত্তত্ত্বাদি স্বরূপে পরিণামকে প্রাপ্ত হওয়া সৃষ্টি এবং যাহাতে সব পদার্থ উৎপন্ন হয় সেই কার্যরূপ সৃষ্টি" দুটোতেই এক উৎপন্ন হওয়া বস্তুর কথাই বলা হচ্ছে। যা দূর্গাচরনের টিকার সাথে মিলে যায় কেননা দূর্গাচরণও সম্ভূতি অর্থ জাগতিক যে কোন পদার্থ বলে অভিহিত করেছেন।

আর্যঃ
|| যদি "অসম্ভূতি" র অর্থ প্রকৃতি বা কারণ হয় তবে "সম্ভূতি " র অর্থ প্রকৃতি দ্বারা উৎপন্ন কার্য জগৎ হওয়া উচিত। অথবা শঙ্করাচার্যের অনুসারে যদি "সম্ভূতি "র অর্থ "কার্য-ব্রহ্ম " তো অসম্ভূতির অর্থ কারন ব্রহ্ম হওয়া উচিৎ||

পাখন্ডিঃ
///ইহা উচিত নয় অনুচিত! কারণ বর্তমান কার্যজগৎ প্রকৃতি (সৃষ্টির পূর্ব স্বরূপ) থেকে একেবারে সরাসরি সৃষ্টি হয়নি! হয়েছে হিরণ্যগর্ভ বা ব্রহ্মা বা প্রজাপতির মাধ্যমে। তাই শঙ্করাচার্য "সম্ভূতির" অর্থ প্রকৃতি দ্বারা উৎপন্ন কার্য জগৎ হিসাবে উল্লেখ করেনি বরং সম্ভূতির অর্থ অসম্ভূতি থেকে উৎপন্ন ব্রহ্ম, যে কার্য করে সৃষ্টিকার্যের কল্পে, সেই হিরণ্যগর্ভ কে চিহ্নিত করেছেন।///

জবাবঃ
 প্রথমত সম্ভূতি শব্দের অর্থ উৎপন্ন নেওয়া কোন বস্ত। পাখন্ডির মত অনুসারে কার্য জগতের স্রষ্টা হিরণ্যগর্ভ এজন্য সম্ভূতি শব্দে অভিহিত। কিন্তু কোন উৎপন্ন বস্তুর অর্থে  যদি সেই বস্তুর স্রষ্টাকে নির্দেশ করা হয় তবে born শব্দই নিরর্থক। উদাহরণস্বরূপ মৃত্তিকা এবং মৃত্তিকা হতে উৎপন্ন মৃতশিল্প।  এখন আমাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় মৃৎশিল্প আনয়ন করো তাহলে তো আমাদের সেই কুমোর কে আনতে হবে যিনি মৃৎশিল্প তৈরী করেছেন। কেননা পাখন্ডির মতানুসারে মৃতশিল্প সরাসরি তেরী হয় নি হয়েছে কুমোর দ্বারা। কিন্তু এটা অনুচিৎ,  কেননা মৃতশিল্প বলতে মাটির তৈরী কোন শিল্প কেই বুঝাই কুমোর কে নয়। তেমনি সম্ভূতি অর্থ প্রকৃতি হতে উৎপন্ন জাত কোন বস্তুকেই বুঝাই সেই উৎপন্ন বস্তুর কারণ কে নয়। পাখন্ডি বলেছে কার্যজগৎ প্রকৃতি থেকে সরাসরি সৃষ্টি হয় নি হয়েছে হিরণ্যগর্ভ দ্বারা। এ কথা সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয় কেননা মহদাদি তত্ত্ব অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হয়েছে পরমাত্মা দ্বারা। এ বিষয়ে মনুস্মৃতি বলছে

ততঃ স্বয়ংভূর্ভগবানব্যক্তোহব্যঞ্জয়ন্নিদম্।
মহাভূতাদিবৃত্তৌজাঃ প্রাদুরাসীত্তমোনুদঃ।।
(মনুস্মৃতি ১।৬)

=>>তখন, স্বয়ম্ভূ পরমাত্মা অব্যক্ত  "তম" রূপ প্রকৃতির প্রেরক প্রকটবস্থা কে উন্মুখকারী অগ্নি, বায়ু আদি মহাভূতকে উৎপন্ন করে এই সমস্ত সংসার কে প্রকটবস্থায় গ্রহন করে প্রকট হলেন।



সাংখ্যদর্শনেও  মহতত্ত্বাদির সৃষ্টি প্রকৃতি থেকেই বর্ননা করা হয়েছে -

সত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা প্রকৃতিঃ প্রকৃতের্মহান্ মহতোহঙ্কারাত্ পঞ্চতন্মাত্রণ্যুভয়মিন্দ্রিয়ং তন্মাত্রেভ্যঃ স্থুলভূতানি পুরুষ ইতি পঞ্চবিংশতির্গণঃ।
(সাংখ্যদর্শন ১।৬১)

(সত্ত্বরজস্তমসাম্) সত্ত্ব, রজ, তম (সাম্যাবস্থা) সমাবস্থা-নিশ্চেষ্টাবস্থা-অপ্রকটরূপাবস্থা (প্রকৃতিঃ) প্রকৃতি যা প্রকৃতি বলা যায়,  (প্রকৃতেঃ - মহান্) প্রকৃতি থেকে মহতত্ত্ব প্রকট হয়।  (মহতঃ অহঙ্কারঃ) মহতত্ত্ব দ্বারা অহংকার নামের প্রকৃতির দ্বিতীয় বিকার প্রকট হয়, (অহংকারাত্) অহংকার দ্বারা (পঞ্চতন্মাত্রাণি) বাহ্য জগতের পাঁচ তন্মাত্র = সুক্ষ্ম ভূত তথা (উভয়ম্ - ইন্দ্রিয়ম্) দেহে উভয় জ্ঞান কর্ম ইন্দ্রিয়গণ উৎপন্ন হয়, (তন্মাত্রেভ্যঃ) তন্মাত্র দ্বারা = সুক্ষভূত দ্বারা (স্থুল - ভূতানি) পৃথিবী আদি স্থুল ভূত ব্যক্ত হয় - স্বরূপে আসে (পুরুষঃ) পুরুষ চেতন সত্বা তা থেকে ভিন্ন (ইতি) এই (পঞ্চবিংশতির্গণঃ) ২৫ পদার্থের গণ জানা - বোঝা এবং বিবেচনীয় - বিবেকে আবশ্যক।

এখানে স্থুল জগতের মূল কারণ রূপে প্রকৃতিকে স্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।  প্রকৃতি থেকে যে মহতত্ত্বাদির প্রকট হয় তা এখানে পরিষ্কার। দয়ানন্দজী সম্ভূতি অর্থাৎ উৎপন্ন অর্থে বলেছেন- "মহদাদিস্বরূপেন পরিণতায়াং সৃষ্টৌ " যা সম্পূ্ণরূপে সঠিক এবং মনু এবং সাংখ্য সমর্থিত। তাই সম্ভুতি অর্থ হিরণ্যগর্ভ গ্রহন করা অনুচিত। আর তাই দূ্র্গাচরণ সম্ভুতি  শুধু হিরণ্যগর্ভ অর্থে সন্তোষ লাভ করেন নি।  এজন্যই তিনি হিরণ্যগর্ভের সাথে প্রভৃতি শব্দ যুক্ত করে বলেছেন - জাগতিক যে কোন পদার্থ এমন কি হিরণগর্ভের শরীর পর্যন্ত এই প্রকৃতি হইতে সমুৎপন্ন হয় বলিয়া সম্ভূতি শব্দে অভিহিত হইয়া থাকে।

এরপর পাখন্ডি মহাশয় হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মার সমন্ধ্যে গীতা এবং মনু থেকে বেশ কিছু সাফাই গেয়েছেন।  সেগুলোও একটু দেখে নেওয়া যাক -

পাখন্ডিঃ
///অমরকোষে ব্রহ্মার প্রতিশব্দ হিসাবে - হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি, স্রষ্টা, নাভিজন্মাণ্ডজঃ, বিধাতা, রজোমূর্তি ইত্যাদি শব্দ গুলো ব্যাবহার করা হয়েছে। ইহা একটি সুস্পস্ট প্রমাণ আমাদের পূর্বজরা যদি হিরণ্যগর্ভ বলে কাউকে জানতো সেটা হল "ব্রহ্মা" কে। অতয়েব শঙ্করাচার্য কার্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ বলতে সৃজনকর্তা ব্রহ্মাকে বুঝিয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।/// অমরকোষ অত্যন্ত নবীন একটি গ্রন্থ যা মহারাজা বিক্রমাদিত্যের সময় অমর সিংহ দ্বারা লেখা। আর তিনি যে ব্রহ্মার প্রতিশব্দ হিসেবে হিরণ্যগর্ভ, প্রজাপতি প্রভূতি প্রতিশব্দের ব্যবহার করেছেন তাতে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই।  কেননা মন্ত্রে উল্লেখিত শব্দ এসেছে সম্ভূতি।  যদি সম্ভূতি শব্দের অর্থ হিরণ্যগর্ভ হয় তবে ব্রহ্মার প্রতিশব্দ হিসেবে সম্ভূতি শব্দেরও  ব্যবহার করা উচিৎ ছিলো অমর কোষে। অমর কোষের স্বর্গবর্গের প্রথম কান্ডের ১৬ এবং ১৭ নং শ্লোকে ব্রহ্মার মোট ২৯ টি নামের উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে সম্ভূতি নামের কোন উল্লেখই নেই।  





পাখন্ডি মহাশয় ব্রহ্মার নামের প্রতিশব্দ হিসেবে হিরণ্যগর্ভ দেখিয়েছেন।  যদি সম্ভূতি নাম ব্রহ্মারই হয়ে থাকে তবে সম্ভূতি নাম ব্রহ্মার নামের প্রতিশব্দ হিসেবে দেখাক।

আমরা যদি বৈদিক কোষ দেখি সেখানে  সম্ভব ( সম্ভূতি) [ঈশোপনিষদ্ ১৩ নং মন্ত্র হিসেবে ] এর অর্থ উৎপত্তি  এবং কার্য জগৎ করা হয়েছে।


এর পর পাখন্ডি লিখেছে - ///যদি ভগবদ গীতা ৮.১৬ দেখি তবে উল্লেখিত পাবো
আব্রহ্মভূবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন।
মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।
অর্থ্যাৎ হে অর্জুন! এই ভুবন থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত সমস্ত লোকই পুনরাবর্তনশীল অর্থ্যাৎ পুনর্জন্ম হয়। কিন্তু হে কৌন্তেয়! আমাকে প্রাপ্ত হলে আর পুনর্জন্ম হয় না।
Note :- হিরণ্যগর্ভ বা ব্রহ্মার পুনর্জন্ম হয়, অর্থ্যাৎ শঙ্করাচার্য হিরণ্যগর্ভের জন্য "সম্ভূতি" শব্দ ব্যাবহার করে অনুচিত কিছু করেনি। পুনর্জন্ম না হওয়ার অর্থ মোক্ষ, এই মোক্ষের ব্যাপারে ঈশোপনিষদের ১৪ নং মন্ত্রে অমৃত ভোগের কথা হিসাবে বলা হবে।/// আচ্ছা পাখন্ডি মহাশয় আপনি শঙ্করের সম্ভূতি শব্দের অর্থ হিরণ্যগর্ভ উচিৎ সিদ্ধ করতে গীতার যে ব্রহ্মার পূণর্জন্মের উল্লেখ করলেন তাতে কি অর্থ উচিৎ সিদ্ধ হলো?  কেননা ব্রহ্মার পূনর্জন্মের সাথে সম্ভূতির তো কোন সম্পর্ক নেই।  কারন সম্ভূতি অর্থ উৎপত্তশীল বস্তু যেটাকে জাগতিক বস্তু বলেও স্বিকার করেছেন দূর্গাচরণ।  কিন্তু পাখন্ডি এখানে সম্ভূতি অর্থ শুধু ব্রহ্মাকে দেখিয়ে তার পূনর্জন্ম ঘটিয়েছে তার কারণ ঈশোপনিষদের ১৪ নং মন্ত্রে উল্লেখিত বিনাশ শব্দের সাথে  মিল ঘটানোর জন্য।  তা যে কত ধূর্তামির প্রকাশ তা ১৪ নং মন্ত্রেই দেখানো হবে।

এর পর পাখন্ডি আবারো গীতা উল্লেখ করে লিখেছে -
///অব্যক্তাদ ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্রভবন্ত্যহরাগমে।
রাত্র্যাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে।। ১৮
ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্বা প্রলীয়তে।
রাত্র্যাগমেহবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে।। ১৯
অর্থ্যাৎ, ব্রহ্মার দিনের সমাগমে (সাধারণ মনুষ্য হিসাবে নয়) সমস্ত জীব অব্যক্ত থেকে অভিব্যক্ত হয় এবং ব্রহ্মার রাত্রির আগমে (সাধারণ মনুষ্য হিসাবে নয়) তা পুনরায় অব্যক্তে লয় প্রাপ্ত হয়। হে পার্থ! সেই ভূতসমূহ পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মার রাত্রি সমাগমে লয় প্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় দিনের আগমনে তারা আপনা থেকেই প্রকাশিত হয়।
Note :- শঙ্করাচার্যের অসম্ভূতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলাম "জগতের মূল কারণ, অব্যাকৃত শব্দবাচ্য (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন) প্রকৃতি, জীবের সুখ-দুঃখ ভোগের কারণীভূত কর্ম্মময় বীজ এই অব্যাকৃত প্রকৃতিতেই নিহিত থাকে"। এর মধ্যে অসম্ভূতি যে "জগতের মূল কারণ" তা ভগবদ গীতা ৮.১৮-১৯ দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেলো।/// জগতের মূল কারণ অব্যক্ত প্রকৃতি তা সাংখ্যদর্শনেও স্পষ্টই বলা আছে।  আর দয়ানন্দ জী তা স্পষ্ট রূপেই স্বিকার করেছেন। এখন গীতা থেকে আপনি তা দেখাচ্ছেন শঙ্কর কে সমর্থন করার  জন্য তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।  কেননা আমাদের বিচারেও শঙ্করাচার্য অসম্ভূতির অর্থ যেটা দিয়েছেন তা সঠিক।  তাই এক বিষয় পূণরায় আলোচনা করে লেখার পরিসর বাড়াতে চাই না।

পাখন্ডি গীতা থেকে আবারো লিখলেন -
///ভগবদ গীতা ৮.২০ -
পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ।
যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি।।
অর্থ্যাৎ, আর একটি অব্যক্ত প্রকৃতি রয়েছে, যা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত। সমস্ত ভূত বিনষ্ট হলেও তা বিনষ্ট হয় না।
Note :- শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যাতে যে অসম্ভূতি প্রকৃতি সনাতন,অব্যাকৃত শব্দবাচ্য নির্গুণ [কিন্তু দয়ানন্দ বিকৃত করে সগুণ করেছেন], সমস্ত জগতের মূল কারণ ও সমস্ত শুভাশুভ ইহাতে লুক্কায়িত থাকে এবং এই প্রকৃতি তেই বেদুক্ত হিরণ্যগর্ভের শরীর লয়প্রাপ্ত হয় - এগুলো সবই প্রমাণিত হল।/// ওহে পাখন্ডি মহাশয় এই শ্লোকে যে অব্যক্ত ভাবের কথা বলা হচ্ছে সেটা প্রকৃতির কথা নয়, এখানে অব্যক্ত প্রকৃতিরও উর্ধে অব্যক্ত পরমাত্মার কথা বলা হচ্ছে। শ্লোকটির অর্থ এই প্রকার -

[(তস্মাৎ অব্যক্তাত্) সেই অব্যক্তরূপ প্রকৃতি থেকে (অন্য অব্যক্তঃ ভাবঃ) অন্য অব্যক্তবাব = সুক্ষ্ম পরমাত্মা (তু) নিশ্চয় করে (পরঃ) পরে, তিনি (সনাতনঃ) সনাতন (সঃ যঃ) তিনি এই (সর্বেষু ভূতেষু) সমস্ত ভূতের (নশয়ৎসু) নাশ হওয়ার পরেও (ন বিনশ্যন্তি) নাশ কে প্রাপ্ত হন না। ]


শঙ্করাচার্য্য শ্লোকটির ভাষ্যে বলেছেন - "অক্ষরস্য বিবক্ষিতস্য অব্যক্তাদ্ বৈলক্ষণ্যপ্রদর্শনার্থঃ। ভাবঃ অক্ষরাখ্যং পরং ব্রহ্ম" অর্থাৎ (তিনি অব্যক্ত )ভাব জানবে অক্ষর নামক পরমব্রহ্ম পরমাত্মা অত্যন্ত ভিন্ন।




এখানে শঙ্করাচার্যও অব্যক্ত ভাব যা প্রকৃতি থেকে ভিন্ন তাকে পরম ব্রহ্ম পরমাত্মা বলে নির্দেশ করেছেন।  অথচ পাখন্ডি সেটাকে প্রকৃতি বানিয়ে ভন্ডামীর প্রকাশ করেছে। পাখন্ডি বলেছে - ///শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যাতে যে অসম্ভূতি প্রকৃতি সনাতন,অব্যাকৃত শব্দবাচ্য নির্গুণ [কিন্তু দয়ানন্দ বিকৃত করে সগুণ করেছেন]/// না জেনে কথা বললে যা হয় আর কি?  পুরণো কাসুন্দি ঘেটে গন্ধ ছাড়ানোর চেষ্টা। বিবেক চুড়ামনি থেকে যা উপরে বিস্তারিত বলা হয়েছে চেক করে নেবেন তার পর দয়ানন্দ কে বিকৃত বলবেন।

পাখন্ডি আবারো গীতা থেকে লিখেছে -  ///ভগবদ গীতা ৮.২১ -
অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম।
যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।
সেই অব্যক্তকে অক্ষর বলে, তাই সমস্ত জীবের পরমা গতি। কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।
Note :- শঙ্করাচার্য তার ভাষ্যে, ঈশোপনিষদের ১৪ নং মন্ত্রে অসম্ভূতির দ্বারা অমৃত ভোগ বা মোক্ষ এর কথা বলেছেন। যার পক্ষে ভগবদ গীতা সাক্ষ্য করছে।/// গীতার উপরের শ্লোকে স্পষ্টতর দেখানো হয়েছে সেখানে যে অব্যক্ত অক্ষর ভাবের কথা বলা হচ্ছে তা পরম ব্রহ্ম পরমাত্মার। আর পরমাত্মাকে পেলে মোক্ষ বা অমৃত প্রাপ্তি ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। আর শঙ্করাচার্য , ঈশোপনিষদের ১৪ নং মন্ত্রে অসম্ভূতির দ্বারা অমৃত ভোগ বা মোক্ষ এর কথা বলেছেন তা অব্যক্ত প্রকৃতির দ্বারা।  আর গীতার এই শ্লোকে যে মোক্ষের কথা বলা হচ্ছে তা অব্যক্ত পরম্ ব্রহ্ম দ্বারা। তাই গীতার এই শ্লোকের সাথে ঈশোপনিষদের শ্লোকের সাথে কোন সামন্জস্য নেই।

এরপর পাখন্ডি মহাশয় মনু সংহিতার ১।৫-১১ শ্লোকের হাজির করেছেন। আসুন দেখা যাক পাখন্ডি কি বলেছে -
(মনু ১।৫)
---প্রলয়কালে এই জগৎ এক প্রকারে প্রকৃতিতে লীন ছিল, উহা প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ, এই ত্রিবিধ প্রকার প্রমাণের বিষয় ছিল না ; যেন সকল জগৎ নিদ্রিতাবস্থায় ছিলো।৫।

 পাখন্ডি এ শ্লোকের ব্যাখ্যায় বলে- ///অতয়েব শঙ্করাচার্য অসম্ভূতি কে অব্যাকৃত শব্দবাচ্য (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন) হিসাবে দেখিয়েছেন তা পুরো সঠিক! ভুল করেছে দয়ানন্দ জী।/// যাই হোক মশাই দূর্গাচরনের উক্ত লাইন আপনাকে না জানি কতই লজ্জার মুখে ফেলবে।  যে বড়াই নিয়ে দূর্গাচরনের লাইন টি তুলে ধরে দয়ানন্দ জী কে ভূল দেখানোর চেষ্টা করলেন।  শঙ্করচার্য বিবেক চুড়ামণির শ্লোক দ্বারা আপনার গুড়ে বালি মিশিয়ে দিলো। বিবেক চুড়ামনি তে শঙ্করাচার্য স্পষ্ট প্রকৃতিকে ত্রিগুণাত্মক বলেছেন যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই দয়ানন্দ জী কে ভূল বলার আগে শঙ্কর কে ভূল বলতে রাজী আছেন তো?

(মনু ১।৬)
---প্রলয়ান্তর বহিরিন্দ্রিয়ের অগোচর অব্যাহত সৃষ্টি সামর্থ্য সম্পন্ন ও প্রকৃতিপ্রেরক পরমেশ্বর স্বেচ্ছাকৃত দেহধারী হইয়া এই আকাশাদি পঞ্চ ভূত ও মহদাদি তত্ত্ব, যাহা প্রলয়কালে সূক্ষ্মরূপে অব্যক্তাবস্থায় ছিল, সেই সমুদয় স্থূলরূপে প্রকাশ করতঃ আপনিই প্রকাশিত হইলেন। ৬।

(মনু ১।৭)
---যিনি সকল লোক বেদ পুরাণ ইতিহাসাদিশাস্ত্রে প্রসিদ্ধ, যিনি মনোমাত্র গ্রাহ্য, অবয়ববিহীন, নিত্য ও সকল ভূতের অন্তরাত্মা হয়েন, এবং যাঁহার ইয়ত্তা করা যায় না, তিনি স্বয়ংই মহদহঙ্কারাদি কার্য্যরূপে প্রাদুর্ভূত হইলেন। ৭।

(মনু ১।৮)
---সেই পরমাত্মা প্রকৃতিরূপে পরিণত আপন শরীর হইতে নানা প্রকার প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে, কিরূপে সৃষ্টি সম্পাদন হইবে এই সঙ্কল্প করিয়া প্রথমতঃ জল হউক বলিয়া আকাশাদি ক্রমে জলের সৃষ্টি করিলেন ও তাহাতে আপন শক্তিরূপ বীজ অর্পণ করিলেন। ৮।

(মনু ১।৯)
---অর্পিতবীজ সুবর্ণ নির্ম্মিতের ন্যায় ও সূর্য্যসদৃশপ্রভাযুক্ত একটি অণ্ড হইল, ঐ অণ্ডে সকল লোকের জনক স্বয়ং ব্রহ্মাই শরীর পরিগ্রহ করিলেন। ৯।

পাখন্ডি এ শ্লোকের ব্যাখ্যায় বলে-///শঙ্করাচার্য বলেছিলেন অসম্ভূতি প্রকৃতি থেকে সম্ভূত হিরণ্যগর্ভ বা ব্রহ্মার উৎপত্তি হয়েছিলো। ইহা যে সঠিক তা প্রমাণিত হল।/// পাখন্ডি মহাশয় কথাটা যেরকম ভাবে বলছে কথা সেরকম টা নয়।  কেননা প্রকৃতি কোন কিছুর জন্ম নিজে নিজে দিতে পারে না।  যেমন ধরুন একটি বীজ যদি মাটিতে ফেলা হয় তবেই তা থেকে চারা উৎপন্ন সম্ভব।  আপনা আপনি চারা উৎপন্ন সম্ভব না। তেমনি পরমাত্মা শক্তিরূপ বীজ অর্পন করেছে বলেই ব্রহ্মার সৃষ্টি হয়েছে। আর এখানে ব্রহ্মার সৃষ্টি বলতে ব্রহ্মার দেহের সৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে প্রকৃতি থেকে। যেমন টা আমাদের দেহের সৃষ্টি প্রকৃতি দ্বারা আর আমাদের ভিতরের মূল সত্বা জীবাত্মা তো অমর তথা জন্ম মৃত্যু রহিত।  তাই প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন বস্তু বলতে শুধু ব্রহ্মার শরীর নয় মানুষেরও শরীর। এ জন্য দয়ানন্দ জী সম্ভূতি অর্থে মনুষ্য আদির শরীর কেও উল্লেখ করে বলেছেন - "সম্ভূতি" অর্থাৎ কারণ হইতে উৎপন্ন কার্যরূপ পৃথিব্যাদি ভূত,  পাষাণ ও বৃক্ষাদির অবয়ব এবং মনুষ্যাদির শরীরের উপাসনা করে,  তাহারা উক্ত অন্ধকার অপেক্ষাও অধিকতর অন্ধকার অর্থাৎ মহামুর্খ চিরকাল ঘোর দুঃখরূপ নরকে পতিত হইয়া মহাক্লেশ ভোগ করে" 

(মনু ১।১০)
---নরনামক পরমেশ্বরের দেহ হইতে জলের সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া উহাকে নারাশব্দে বলা যায়, যেহেতু ঐ জল সকল প্রলয়কালে পরমাত্মার অয়ন অর্থাৎ স্থান হয়, এই জন্য পরমাত্মা নারায়ণ শব্দে কথিত হইয়াছেন। ১০।

(মনু ১।১১)
---যে পরমাত্মা সৃষ্ট বস্তু মাত্রেরই কারণ, যিনি ইন্দ্রিয়ের অগোচর, যাঁহার ক্ষয়োদয় নাই, যিনি সৎপদের প্রতিপাদ্য এবং যিনি প্রত্যক্ষের বিষয় নহেন বলিয়া অসৎশব্দেও কথিত হইয়াছেন, সেই পরম পুরুষ পরমেশ্বর হইতে উৎপন্ন এই অণ্ডজাত পুরুষ লোকে ব্রহ্মা বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছেন।১১।

উপরের শ্লোকগুলোর উপর ভিত্তি করে পাখন্ডি বলে - /// মনুর ভাষাই, শঙ্করাচার্যের উল্লেখিত অসম্ভূত প্রকৃতি যে নারায়ণ তা প্রমাণিত হয়ে গেলো। এই নারায়ণ দ্বারা সম্ভূত পুরুষ ব্রহ্মা বা হিরণ্যগর্ভ তা প্রমাণিত হয়ে গেলো। এই নারায়ণ যে জগতের মূল কারণ ও অব্যাকৃত শব্দবাচ্য তা প্রমাণিত হয়ে গেলো।/// কি যুক্তি মশাই আপনার,  আচ্ছা অসম্ভূতি অর্থ নারায়ন ওটা কোথাই পেলেন?  প্রকৃতি যেখানে জড় বস্তু সত্ব রজ তম ময় এই ত্রিগুণাত্মক। শঙ্করাচার্যও যেখানে অসম্ভূতিকে অনাত্মক অর্থাৎ জড় রূপ বলে আখ্যায়িত করেছে।   আর কোথাই নারায়ন  যাহাকে পরমাত্মা বলে আখ্যায়িত করা যায়  এবং যিনি অব্যক্তেরও উর্ধে তাকে অসম্ভূতি  বলা কত বড় মূর্খামী।  নারায়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে দয়ানন্দ জী বলেছেন -

আপো নারা ইতি প্রোক্তা আপো বৈ নরসূনবঃ।
তা য়দস্যায়নং পূর্বং তেন নারায়ণঃ স্মৃত। মনুঃ ১।১০
অর্থাৎ জল এবং জীবগণের নাম নারা।  সেই আয়ন অর্থাৎ নিবাস স্থান যাহা। অতএব সর্ব জীবে ব্যাপক পরমাত্মার নাম নারায়ণ।


এর পর পাখন্ডি উপনিষদ থেকে লিখেছে -/// বৃহদারণ্যকোপনিষৎ ৫.১.১ তে ব্রহ্মের পূর্ণত্বের ব্যাপারে বলা হচ্ছে। এখানে বলা হচ্ছে পূর্ণ থেকে পূর্ণ উৎপন্ন হয় অর্থ্যাৎ অমূর্ত্তিমান ব্রহ্ম থেকে মূর্ত্তিমান ব্রহ্ম উৎপন্ন হয়।/// শ্লোকটি হচ্ছে -

পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণ্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।

সরলার্থঃ  তিনি [ব্রহ্ম] পূর্ণ এই জগৎ ও পূর্ণ [কারণ] পূর্ণ ব্রহ্ম থেকেই পূর্ণ জগৎ উদিত হয়।  এই পূর্ণ জগতের পূর্ণ কে নিয়ে নিলে পূর্ণ ব্রহ্মই  অবশিষ্ট থাকে।।

এই সন্দর্ভের সার প্রথম দুই পদে নিহিত, শেষ সব তারই ব্যাখ্যা।  ওই দুই পদ হচ্ছে - "অদস" এবং "ইদম্"।
"অদস্" পরোক্ষ "ইদম্" প্রত্যক্ষ।  "অদস্ " চেতন "ইদম্" অচেতন, জড়। "অদস" পরোক্ষ পরব্রহ্ম পরমাত্মা, "ইদস্" প্রত্যক্ষ অচেতন (জড়) অগণিত লোক - লোকান্তরের রূপে ছড়িয়ে পড়া বিশ্ব। সন্দর্ভে বলা হয়েছে - এই সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্ম পুরুষোত্তম   সর্বপ্রকারে সদা সর্বদা পরিপূর্ণ।  এই জগতও সেই পরব্রহ্মের দ্বারাই পূর্ণ।  কারন পূর্ণ (জগৎ) সেই পূর্ণ পরমেশ্বর হতেই উৎপন্ন হয়েছে।

আমরা মনুস্মৃতি ১।৫ দেখিয়েছি যে জগৎ কে পরমাত্মাই প্রকট করেছেন।  এইরূপে পরব্রহ্মের পূর্ণতা দ্বারাই জগৎ পূর্ণ,  সেজন্য তাও পরিপূর্ণ। সেই পূর্ণ ব্রহ্ম হতে পূর্ণ কে বাদ দিলে পূর্ণই অবশিষ্ঠ থাকে। পাখন্ডি বলেছে ///অমূর্ত্তিমান ব্রহ্ম থেকে মূর্ত্তিমান ব্রহ্ম উৎপন্ন হয়/// কিন্তু শ্লোকে এরকম কিছুই বলা হয় নি।  শ্লোকে পূর্ণ ব্রহ্ম থেকে পূর্ণ  জগৎ  উৎপত্তির কথা রয়েছে। অদ্বৈতবাদ জগৎ কে স্বপ্নবৎ মিথ্যা বলে। কিন্তু এ শ্লোক প্রমাণ করে জগৎ মিথ্যা নয় তাও পূর্ণ অর্থাৎ সত্য।  যেহেতু সত্য পরব্রহ্ম থেকে কোন কিছু মিথ্যার সৃষ্টি হয় না।

পাখন্ডি মোটের উপর বলে -/// অতয়েব অসম্ভূতি ও সম্ভূতি যে উভয়ে ব্রহ্মের স্বরূপ তা প্রমাণিত হল। যদিও আগেও গীতা ও মনুসংহিতা থেকে ইহা প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণ ১১.১.৬.২ তে অসম্ভূতি অর্থ্যাৎ প্রজাপতি বা ব্রহ্মা সংজ্ঞক পুরুষের দ্বারা, সম্ভূতি অর্থ্যাৎ হিরণ্যগর্ভ বা ব্রহ্মার ধারণের কথা উল্লেখিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ যুক্তি ও প্রমাণ সাপেক্ষে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে শঙ্করাচার্য অসম্ভূতি ও সম্ভূতির অর্থ একেবারে সঠিক ধরেছেন। তিনি অসম্ভূতি শব্দ দিয়ে নারায়ণ কে ও সম্ভূতি শব্দ দিয়ে ব্রহ্মাকে বোঝাতে চেয়েছেন।/// সম্ভূতি অর্থ জাগতিক যে কোন পদার্থ অর্থাৎ কার্য জগৎ এবং অসম্ভূতি অর্থ অব্যক্ত জড় ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি। আর  হিরণ্যগর্ভ (ব্রহ্মার) শরীর প্রকৃতিজাত এর বীজ দাতা পরমাত্মা এটা আমরা মনুসংহিতা থেকেও দেখেছি। শতপথে হিরন্যময় অন্ডের মধ্য দ্বারা প্রজাপতির জন্মের কথা রয়েছে যা মনুতেও বর্ণিত। আর সম্ভূতি অর্থ শুধু হিরন্যগর্ভের শরীর নয় ।দূর্গাচরণ টীকাতে সম্ভূতি অর্থ জাগতিক যে কোন পদার্থ বলে স্বীকার করছেন।  কিন্তু পাখন্ডি মহাশয় শুধু অর্থটি ব্রহ্মার দিকে টেনে অর্থটিকে নিজের অনুকুলে করার চেষ্টা করেছে। এবং শেষ পর্যায়ে অসম্ভূতিকে নারায়ন বানিয়ে দিয়েছে। কোথাই নারায়ন পরমব্রহ্ম পরমাত্মা যিনি ত্রিগুণাতীত আর কোথাই ত্রৈগুণ্য জড় প্রকৃতি,  দুটো কি এক হলো?  ব্যাপার টি আম আর আমড়া কে এক বলার চেষ্টা।  পাখন্ডি মহাশয় অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি কে ব্রহ্মের স্বরূপ বলেন। কিন্তু ব্রহ্ম সম্পূ্র্ণ আলাদা সত্বা, তিনি জগৎ, জীব থেকে ভিন্ন। এ বিষয় বেদ বলছে-
ন ত্বং বিদাথ য ইমা জজানন্যদুষ্মাকমন্তরং বভূব।
নীহারেন প্রাবৃতাজল্প্যা চাসুতৃপ উকথশাসশ্চরন্তি।।
(ঋগবেদ ১০।৮২।৭)

অর্থাৎ হে জীব! তুমি সেই পরমেশ্বরকে জানো না, যে  এই সমস্ত লোক কে উৎপন্ন করেছে তোমা হইতে ভিন্ন হয়ে  তোমার হৃদয় মধ্যে বিদ্যমান। অজ্ঞান অন্ধকার দ্বারা আচ্ছাদিত জন বহু তর্ক কারী প্রাণ পোষনে সংলগ্ন হয়ে কেবল শব্দের উচ্চারনকারী  ইতস্তত ভ্রমন করে।



আর্যঃ
|| আর হিরণ্যগর্ভাখ্য কার্য ব্রহ্ম কি বস্তু? এবং অসম্ভূতি= প্রকৃতি কি বস্তু? কারণ অদ্বৈততবাদে তো ব্রহ্ম ভিন্ন তো দ্বিতীয় বস্ত নেই ||

পাখন্ডিঃ
আমি আগেই অমরকোষ, ভগবদ গীতা, মনু সংহিতা, শতপথ ব্রাহ্মণ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের ব্যাখা দিয়ে স্পস্ট করেছি শঙ্করাচার্য সম্ভূতি ও অসম্ভূতি প্রসঙ্গে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা যথার্থ। আর এটা সঠিক অদ্বৈতবাদে ব্রহ্ম ভিন্ন দ্বিতীয় বস্তু নেই, কিন্তু অদ্বৈতবাদে ব্রহ্মের নির্দিষ্টি একটি স্বরূপ ব্যাতিত দ্বিতীয় কোনো স্বরূপ নেই, তা অস্বীকার করেও না।
সম্ভূতি ও অসম্ভূতি ব্রহ্মেরই দুটি স্বরূপ, তাই বৃহদারণ্যকোপনিষৎ ৫.১.১ তে বলা হয়েছে পূর্ণ থেকে পূর্ণ উৎপন্ন হয় অর্থ্যাৎ অমূর্ত্তিমান ব্রহ্ম থেকে মূর্ত্তিমান ব্রহ্ম উৎপন্ন হয়।
কিন্তু জ্ঞানপাপী দয়ানন্দ জীর কাছে ব্রহ্ম মানেই হামেশা নিরাকার! আর নিরাকার! যার জন্য উনি কাইদা করে যজুর্বেদ সংহিতার এমন ভাষ্য করেছেন যাতে ব্রহ্মের মূর্ত্তিমান স্বরূপের ব্যাপারে ছিটাফোঁটা উল্লেখ না থাকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ ও অরণ্যকের বিভিন্ন অংশ বিচারে যে উনার কাইদা ফাঁস হয়ে যাবে সেটা বোধয় উনি ভুলে গিয়েছিলেন।

জবাবঃ
পাখন্ডি মহাশয় অমরকোষ, গীতা , মনু থেকে যেসব শ্লোক উল্লেখ করে সম্ভূতির পক্ষে ভোট দেবার চেষ্টা করেছে সেগুলোর সব আমরা বিচার করে দেখিয়েছি যে পাখন্ডি কতটা চতুর ভাবে সেগুলোর উল্লেখ করেছে।  একের পর একেক শ্লোক উল্লেখ করে সবগুলো মিলিয়ে খিচুরী রান্না করে শেষ পর্যন্ত অসম্ভূতি কে নারায়ন বানিয়ে ফেলেছে। যেখানে শঙ্করাচার্য স্পষ্টভাবে অসম্ভূতিকে অব্যক্ত জড় প্রকৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। অদ্বৈতবাদ মতে সকল কিছুই ব্রহ্ম কিন্তু শঙ্করাচার্য এখানে স্থুল জগতের মূল কারণ অব্যক্ত সত্ব,রজঃ, তম ময় প্রকৃতি কে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। পাখন্ডি মহাশয় বৃহঃ উপঃ ৫।১।১ দিয়ে অমূর্ত ব্রহ্ম থেকে মূর্ত ব্রহ্ম উৎপন্নের ব্যাখ্যা করে।  আসলে শ্লোকটিতে কি মূলত তাই বলা ছিলো?  শ্লোকটির উদ্ধৃতি ব্যাখ্যা আমরা আগেই দিয়েছি এখানে তার ব্যাখ্যাটুকু বোঝার সুবিধার্তে উল্লেখ করা হলো - এই সচ্চিদানন্দ পরব্রহ্ম পুরুষোত্তম   সর্বপ্রকারে সদা সর্বদা পরিপূর্ণ।  এই জগতও সেই পরব্রহ্মের দ্বারাই পূর্ণ।  কারন পূর্ণ (জগৎ) সেই পূর্ণ পরমেশ্বর হতেই উৎপন্ন হয়েছে।  এইরূপে পরব্রহ্মের পূর্ণতা দ্বারাই জগৎ পূর্ণ,  সেজন্য তাও পরিপূর্ণ। সেই পূর্ণ ব্রহ্ম হতে পূর্ণ কে বাদ দিলে পূর্ণই অবশিষ্ঠ থাকে।  পূর্ণ ব্রহ্ম থেকে এই শ্লোকে পূর্ণ জগৎ উৎপত্তির কথা মূলত এই শ্লোকের মূল বর্ণনা কোন মূর্ত ব্রহ্মের নয়। যেখানে অদ্বৈতবাদ জগতের অস্তিত্ব স্বীকারই করে না তাহার মতে এটা স্বপ্নবৎ মিথ্যা।

 Read also;  ঈশ্বরের রূপ বিষয়ক মূর্ত অমূর্ত ব্যাখ্যা

এরপর পাখন্ডি নিজেকে মস্ত বড় হনু সাজিয়ে বলছেন -// /কিন্তু জ্ঞানপাপী দয়ানন্দ জীর কাছে ব্রহ্ম মানেই হামেশা নিরাকার! আর নিরাকার! যার জন্য উনি কাইদা করে যজুর্বেদ সংহিতার এমন ভাষ্য করেছেন যাতে ব্রহ্মের মূর্ত্তিমান স্বরূপের ব্যাপারে ছিটাফোঁটা উল্লেখ না থাকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ ও অরণ্যকের বিভিন্ন অংশ বিচারে যে উনার কাইদা ফাঁস হয়ে যাবে সেটা বোধয় উনি ভুলে গিয়েছিলেন।///  এই হচ্ছে এই ভন্ডদের মূল স্বরূপ।  কটু বাক্য অপশব্দ প্রয়োগ এদের মূল অস্ত্র।  অর্থাৎ ব্যাপার খানা এই যে এই ভন্ডের থেকে বেদ ব্যাখ্যা করা দয়ানন্দ জী কে শিখতে হবে [যেখানে অনেক বিদ্বান প্রমুখ দয়ানন্দ জীর ভাষ্যের সুনাম করেছেন] আচ্ছা পাখন্ডি মশাই আপনি কোন ভাষ্যকারের বেদ পড়ে নিজেকে হনু ভাবতে শুরু করেছেন?  আমার জানা মতে শঙ্করাচার্য্য তো বেদের একটা মন্ডলও  অনুবাদ করেন নি।  আর আপনার সাধের অনুবাদক মহিধর উব্বট এর যজুর্বেদ ভাষ্যের যদি দু একটা নমুনা তুলে ধরি তবে তো আপনার ধুতি খোলার জোগাড় হবে তখন লুকাবেন কোথাই?  দয়ানন্দ জী যজুর্বেদের  মহিধরকৃত অশ্লিল ভাষ্য কে দূরীকরণ করে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করে যজুর্বেদের মর্যাদা কে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আপনার মতো ভন্ডের চোখ সেসব দেখতে ব্যর্থ।

আর্যঃ
|| এখানে শঙ্কারাচার্য জগতের কারনভূত প্রকৃতির সত্তাকে স্বীকার করেছেন। যখন "স পর্যগাত্ " মন্ত্রে ব্রহ্ম কে ব্যাপক সর্ববিধশরীর থেক রহিত, অবিনশ্বরাদি বলা হয়েছে। তখন কারণ ব্রহ্ম থেকে কার্যব্রহ্ম কি করে উৎপন্ন হতে পারে? যখন এই মন্ত্রে স্পষ্টরূপে জড় পদার্থের উপাসনাকে নিষেধ করেছে। তখন এই কার্যব্রহ্ম = হিরণ্যগর্ভের বর্ননা এখানে কিভাবে সম্ভব?||

পাখন্ডি
///এখানে আর্য সমাজী এজেন্ট গুলো তাদের চিরাচরিত "নিরাকারবাদী" এজেণ্টা চালাচ্ছে! এখানে আর্য সমাজীরা বলছে ব্রহ্মের উদ্দেশ্যে ঈশোপনিষৎ ৮ নং মন্ত্রে ব্রহ্ম কে ব্যাপক সর্ববিধশরীর থেকে রহিত, অবিনশ্বরাদি বলা হয়েছে। তারপর প্রশ্ন করছেন "তখন কারণ ব্রহ্ম থেকে কার্যব্রহ্ম কি করে উৎপন্ন হতে পারে?" অবশ্যই হয়েছিলো! আমি মনুসংহিতা থেকে প্রমাণ আগেই দেখিয়েছি কিভাবে অব্যাক্ত প্রকৃতি (নারায়ণ) থেকে হিরণ্যগর্ভের (ব্রহ্মার) উৎপত্তি হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে প্রমাণ দিয়েছি হিরণ্যগর্ভের ধারণের ব্যাপারে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে প্রমাণ দেখিয়েছি অদৃশ্য ব্রহ্ম থেকে দৃশ্য ব্রহ্ম উৎপত্তি হবার। ভগবত গীতা থেকে প্রমাণ দিয়েছি হিরণ্যগর্ভের লয় হয়, অব্যক্ত প্রকৃতি সনাতন ও জীবের মোক্ষের কারণ।/// এখানে এই ভন্ড পাখন্ডির ভন্ডামীর কয়েটা নমুনা দেখুন - তিনি মনু থেকে দেখাচ্ছেন //অব্যাক্ত প্রকৃতি (নারায়ণ) থেকে হিরণ্যগর্ভের (ব্রহ্মার) উৎপত্তি হয়েছে/// এখানে পাখন্ডী অব্যক্ত প্রকৃতি লিখে ব্রাকেটে নারায়ন লিখেছে। আচ্ছা অব্যক্ত প্রকৃতি যা জড়, ত্রিগুণাত্মক আর নারায়ন যিনি পরমাত্মা দুটো কি এক বস্তু?  যদি এক না হয় তবে তিনি কি করে বলেন নারায়ন থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি?  দূর্গাচরণের টিকাই দেখবেন - সেখানে বলা হিরণ্যগর্ভের দেহ প্রকৃতি জাত।  কিন্তু প্রকৃতি তো নারায়ন নয় তিনি তো প্রকৃতিরও উর্ধে পরম ব্রহ্ম।  প্রকৃতি, পুরুষ, জীব এই তিনটিই আলাদা অনাদি সত্বা। প্রলয়ে এই জগৎ সুক্ষ অবস্খায় থাকে, সৃষ্টিতে পরমাত্মা তা স্থুল রূপে প্রকট করেন।  আর জাগতিক সমস্ত বস্তু এই প্রকৃতি হতে জাত হয় (মনু ১।৫-৬ দ্রষ্টব্য)। আর পাখন্ডির বৃহঃ উপঃ ৫।১।১ আগেই ব্যাখা করা হয়েছে পূণঃ উল্লেখ অনাবশ্যক।

পাখন্ডি এরপর বলে -
///এগুলো কোনো পরস্পর বিরোধী মন্তব্য নয়! বরং ঈশোপনিষৎ ৮ নং মন্ত্রে যে ব্রহ্মের কথা বলা হচ্ছে তা অমূর্ত্তিমান স্বরূপ! তাই তাকে সর্ববিধশরীর রহিত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ব্রহ্মের স্বরূপ কেই ১২নং মন্ত্রে "অসম্ভূতি" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ ব্রহ্মের এই স্বরূপের কোনো উৎপত্তি নাই, স্বতঃসিদ্ধ। মনু সংহিতার ভাষাই ব্রহ্মের এই স্বরূপ "নারায়ণ" নামে পরিচিত। শঙ্করাচার্যের ভাষাই যিনি জগতের মূল কারণ, অব্যাকৃত শব্দবাচ্য (কোন নাম ও রূপে অভিব্যক্ত নহে এমন) প্রকৃতি।
আর ঈশোপনিষদের ১২ নং মন্ত্রে ও শঙ্করাভাষ্যে কোথাও স্পষ্টরূপে জড় পদার্থের উপাসনাকে নিষেধ করেনি! বস্তুত এই বিকৃতি করেছে খোদ দয়ানন্দ জী। উনিই "অসম্ভূতি" শব্দের অর্থ লিখছেন "অনাদি অনুৎপন্ন সত্ব রজ ও তমো গুণময় প্রকৃতিরূপ জড় বস্তু" ও সম্ভূতির অর্থ দেখিয়েছেন :- মহত্তত্ত্বাদি স্বরূপে পরিণামকে প্রাপ্ত হওয়া সৃষ্টি। পরে আবার "সম্ভূতিম" এর অর্থ দেখিয়েছেন :- "যা থেকে সব পদার্থ উৎপন্ন হয় সেই কার্যরূপ সৃষ্টি"/// পাখন্ডির জ্ঞানের নমুনা দেখুন এবার - ১২ নং মন্ত্রে নাকি ব্রহ্মের স্বরূপ কে অসম্ভূতি বলা হয়েছে। আচ্ছা ব্রহ্মের স্বরূপ কি ত্রিগুণাত্মক, অনাত্ম অর্থাৎ জড়?  নাকি গুণাতিত চেতন সত্বা। কারন  প্রকৃতি তো নিজে জড় ত্রিগুনাত্মক অপর দিকে পরামাত্মা নির্গুণ।  এ বিষয়ে গীতা বলছে -( "अनादित्वान्निर्गुणत्वात्परमात्मायमव्ययः অনাদিত্বান্নির্গুণত্বাৎ পরমাত্মমায়মব্যয়"; গীতা ১৩।৩2) অর্থাৎ পরমাত্মা অনাদি নির্গুণ অব্যয় অর্থাৎ অবিকারী।  কিন্তু অপর দিকে প্রকৃতি ত্রিগুণাত্মক,  বিকারী কারণ প্রকৃতির বিকারই এই কার্য জগৎ। তাহলে পাখন্ডি কি করে বিকারী, জড়, ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতিকে ব্রহ্মের স্বরূপ বলে?  আলোতেও  কি রজ্জুকে সর্প জ্ঞান করছেন না কি?   এর পর পাখন্ডি বলেছে ১২ নং মন্ত্রের কোথাও নাকি শঙ্কর ভাষ্যে জড় পদার্থের  উপাসনাকে নিষেধ করে নি। আপনার নিজের চোখেই তবে দেখুন একবার। শঙ্করাচার্য বলেছে -

तामसंभूतिमव्याकृताख्यां प्रकृतिं कारणमविद्यां कामकर्मबीजभूतामदर्शनात्मिकाम् उपासते ये ते तदनुरूपमेवान्धं तमः अदर्शनात्मकं प्रविशन्ति।

তাম্ অসম্ভূতিম্ অব্যাকৃতাখ্যাং প্রকৃতিং কারণমবিদ্যাং কাম কর্ম্মবীজভূতাম্ অদর্শনাত্মিকাম্ উপাসতে যে তে তদনুরূপমেব অন্ধং তমোহদর্শনাত্মকং প্রবিশন্তি।

অর্থাৎ যাহারা অনাত্মক(জড়রূপা) এই অব্যাকৃত প্রকৃতির (অসম্ভূতির) উপাসনা করে তাহারা সেই উপাসনানুসারে অন্ধ তমে অর্থাৎ অজ্ঞানান্ধকারে প্রবেশ করে।


দেখলেন তো শঙ্করাচার্য নিজেও অসম্ভূতি অর্থাৎ জড় প্রকৃতির  উপাসনা কারী কে অন্ধকারে প্রবেশের কথা উল্লেখ করেছেন।  আর এ ভন্ড নিজের ভন্ডামী প্রচারের জন্য দয়ানন্দ জীকে ভূল বলে চালাচ্ছে। ভন্ডটা ভেবেছে তার এই গরুর রচনায় সবাই গরু হয়ে যাবে। কিন্তু এটা ভাবে নি যে তার ভন্ডামীর ফাঁস হবে এখানে।

আর্যঃ
|| এবং তৃতীয় মন্ত্রে "অসম্ভূতি" ও "অসম্ভূতি"র ফল বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় মন্ত্রে কথিত ফল কে উপেক্ষা করে শঙ্কর ভাষ্যে লিখেছেন -" সম্ভূতেঃ কার্যব্রহ্মোপাসনাদ্ অণিমাদৌশ্বর্যলক্ষণং ব্যাখ্যাতবন্ত ইত্যর্থঃ।.. অসম্ভবাদ্ = অসম্ভূতেরব্যাকৃতাদ্ অব্যাকৃতপানাত্। যদুক্তমন্ধন্তমঃ প্রবিশন্তীতি প্রকৃতিলয় ইতি চ পৌরাণিকৈরুচ্যতে।"
অর্থাৎ সম্ভূতি = কার্যব্রহ্ম কে উপাসনা দ্বারা অণিমাদি ঐশ্বর্যরূপ ফল প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং অসম্ভূতি = অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনার দ্বারা, যাকে "অন্ধনন্তমঃ প্রবিশন্তি" এই বাক্য দ্বারা বলা হয়েছে তথা পৌরাণিক তাহাকে প্রকৃতিলয় বলে।
এই মন্ত্রের ব্যাখ্যাই শ্রী শঙ্করাচার্য জী সম্ভূতি এবং অসম্ভূতি কে উপাসনার ফল অনিমাদি ঐশ্বর্য প্রাপ্তি আদি বর্ণনা করেছেন। যখন ইহার প্রথম মন্ত্রেই সম্ভূতিকে উপাসনাকারী কে ঘোরতম অন্ধকারে প্রবেশ করে বলা হয়েছে। তখন তার দ্বারা ঐশ্বর্য প্রাপ্তি কিভাবে সম্ভব? আর এই মন্ত্রে "উপাসনা" শব্দই নেই। মন্ত্র মধ্যে যেই উপযোগরূপ ফলের সঙ্কেত করা হয়েছে তার ফল তো আগের মন্ত্রেই বর্ণনা করা হয়েছে। তাহার কি ফল মধ্যে এবংপূর্বক্ত মন্ত্র প্রোক্ত ফলের মধ্যে সমতা রয়েছে? যদি না হয় তবে তাহার ব্যাখ্যা মূল মন্ত্রের বিরুদ্ধ।
বাস্তবে তৃতীয় মন্ত্রে তাহার উপযোগীতার বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ অসম্ভূতি বিজ্ঞান দ্বারা মৃত্যুকে পার করে। এবং সম্ভূতি বিজ্ঞান দ্বারা মোক্ষ কে প্রাপ্ত করা যায়। এজন্য মন্ত্রে " বেদ= জানা " ক্রিয়া রয়েছে, উপাসনা নয়||

পাখন্ডিঃ
ঈশোপনিষদ ১২ নং মন্ত্রের ভাষ্যের শুরুতে শঙ্করাচার্য বলেছিলেন ব্যষ্টি ও সমষ্টির একত্র উপাসনা বিধানার্থ তদুভয়ের পৃথক উপাসনার নিন্দা করা হচ্ছে। অর্থ্যাৎ সম্ভূতি ও অসম্ভূতির উভয়ের উপাসনা করতে বলা হচ্ছে এবং ১২ নং মন্ত্রেও "উপাসতে" শব্দটিও আছে। ১৩ নং মন্ত্রটি উক্ত সমুচ্চয় বা একত্র উপাসনা অনুষ্ঠান করলে এক একটি থেকে কি কি ফল পাওয়া যায় তার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আলাদা আলাদা সম্ভূতি বা অসম্ভূতি উপাসনার ফলাফল নয়!
এখানে কপটাচারী আর্য সমাজীরা শঙ্করা ভাষ্যের পুরো অংশটি উল্লেখ করেনি!! কিছুটা অংশ বাদ দিয়েছে, চাইলে আগের দেওয়া স্কিনশটের সাথে আর্য সমাজীদের উক্তিতে বলা অংশটুকু মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন। এরসঙ্গে কপটাচারীরা বলছে নাকি ১৩নং মন্ত্রে "বেদ= জানা ক্রিয়া রয়েছে, উপাসনা নয়" কিন্তু ১৩নং মন্ত্রে ও উক্ত মন্ত্রের শঙ্করাভাষ্যতে বেদ জানার কথাই উল্লেখই নেই।
আর ১৩ নং মন্ত্রের উপাসনা শব্দটি নেই ঠিকই কিন্তু এখানে যে ফলাফলের কথা বলা হচ্ছে সেটা ১২ নং মন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত, যেখানে উপাসনার প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে। আর 'বেদ কে জানা' খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়! কারণ অথর্ব্বেদীয় মূন্ডকোপনিষদ ১.১.৫ তে বেদ বেদাঙ্গের বিদ্যাকে অপরা বিদ্যা বলা হয়েছে এবং অক্ষর ব্রহ্মকে জানার বিদ্যা কে পরা বিদ্যা বলা হয়েছে।

জবাবঃ
শঙ্করাচার্য্য যে ব্যষ্টি ও সমষ্টি উপাসনার প্রসঙ্গ এনেছেন তা ১২ এবং ১৪ নং মন্ত্রের মিল করানোর জন্য। ১২ নং মন্ত্রে যেখানে  অসম্ভূতি ও সম্ভূতির উপাসনা করলে অন্ধকারে প্রবেশ করার কথা স্পষ্টরূপে বলা আছে সেখানে ১৪ নং মন্ত্রে সেই অসম্ভূতি ও সম্ভূতির উপাসনা দ্বারা অমৃত প্রাপ্তি এবং মৃত্যুভয় দূর কি করে হতে পারে?  তাহলে বেদ কি পরস্পর বিরোধী বাক্য বলেন?  এ দোষ কাটাতে শঙ্করাচার্য্য ব্যষ্টি সমষ্টির প্রসঙ্গ এনে মন্ত্রার্থকে অনুকুলে করলেন। কিন্তু বেদ পরস্পর বিরোধী বাক্য বলেন নি।  ১২ নং মন্ত্রে সম্ভূতি অসম্ভূতির উপাসনা কারীকে অন্ধকারে প্রবেশের বর্ণনা রয়েছে।  কিন্তু ১৪ নং মন্ত্রে উপাসনা নামে কোন পদই আসে নি।  সেখানে উপাসনার স্থলে বেদ শব্দটি এসেছে যা জানা (know) অর্থে। মন্ত্রটির পদার্থ দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন -

संभूतिं च विनाशं च यस्तद्वेदोभयँ सह ।
विनाशेन मृत्युं तीर्त्वा संभूत्याऽमृतमश्नुते ।
সম্ভুতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ ।
বিনাশেন মৃত্যুং তীর্ত্বা সম্ভূত্যামৃতমশ্নুতে।।১৪।।  

পদার্থঃ
হে মনুষ্য! (যঃ) যে বিদ্বান্ (সম্ভূতিম্) যাহাতে সমস্ত পদার্থ উৎপন্ন হয় সেই কার্যরূপ সৃষ্টি (চ) এবং তাহার গুণ কর্ম,  স্বভাব কে তথা (বিনাশম্) যাহাতে পদার্থ নষ্ট হয় সেই কারণরূপ জগৎ (চ) এবং তাহার গুন কর্ম স্বভাব কে (সহ)  এক সাথে (উভয়ম্) উভয় কে (তত্) সেই কার্য ও কারণ স্বরূপ কে (বেদ) জানে,  সেই বিদ্বান (বিনাশেন) নিত্যস্বরূপ বিদিত কারণের সাথে (মৃত্যুম্) শরীর ছাড়ার দুঃখ থেকে (তীর্ত্বা) পার হয়ে (সম্ভূত্যা) ইন্দ্রিয় এবং অন্তঃকরণরূপ উৎপন্ন কার্যরূপ ধর্মে প্রবৃত্ত করানো সৃষ্টির সাথে (অমৃতম্) মোক্ষসুখ কে (প্রাপ্ত) হয়।


পাঠকগণ ভালো করে মন্ত্রে দেখুন তো উপাসনা পদ মন্ত্রটির কোথাই এসেছে?  বরং দেখুন উপাসনা স্থলে "বেদ" পদটি এসেছে যার অর্থ হচ্ছে know। কিন্তু এই গন্ড মূর্খ এখানে বেদ শব্দে বেদ কে জানা বুঝেছে এবং বেদ কে পরা অপরা অপ্রাঙ্গিক আলোচনা এনেছে।  আপনারা ভালো করে অর্থটা দেখবেন সেখানে অসম্ভুতি ও সম্ভূতিকে জানতে বলেছে বেদ কে জানতে বলে নি।  বেদ এখানে know verb রূপে এসেছে noun হিসেবে নয়।  কিন্তু শঙ্করাচার্য ১৪ নং মন্ত্রেও উপসনা শব্দের ব্যবহার করে ব্যষ্টি সমষ্টির প্রসঙ্গ এনেছেন।  কিন্তু ১২ নং মন্ত্রে স্পষ্টভাবে সম্ভূতি অসম্ভূতির  উপাসনার নিন্দা করা হয়েছে সেখানে ১৪ নং মন্ত্রে সেগুলোরই উপাসনা দ্বারা মৃত্যৃ ভয় দূর করা  পরস্পর বিরোধী উক্তি। তাই তো বেদ বলছে -  তোমরা অসম্ভূতি ও সম্ভূতি কে জানো। কারণ সম্ভূতি অসম্ভূতি কে উপাসনা করতে বেদ নিষেধ করেছেন তাদের কে জানতে নিষেধ করেন নি।  এ বিষয় গীতা বলে -

य एवं वेत्ति पुरुषं प्रकृतिं च गुणैःसह।
सर्वथा वर्तमानोऽपि न स भूयोऽभिजायते।।

য এবং বেত্তি প্রকৃতিঞ্চ গুণৈঃ সহ।
সর্বথা বর্তমানোহপি ন স ভূয়োহভিজায়তে।। (গীতা ১৩।২৩)

অর্থাৎ যিনি এই  প্রকারে পুরুষ ও প্রকৃতি কে গুণের সহিত জানেন তিনি যে অবস্থায় থাকুন না কেন,  পুণরায় জন্মলাভ করেন না অর্থাৎ মুক্ত হন।।

দেখুন গীতাও প্রকৃতিকে পুরুষের সাথে জানতে বলেছে উপাসনা করতে বলেন নি।  কারন প্রকৃতি কে পুরুষের সাথে জানার দ্বারাই মুক্তি সম্ভব। এজন্যই গীতা "উপাসনা" শব্দের প্রয়োগ না করে "বেত্তি" শব্দের প্রয়োগ করেছেন।

এরপর পাখন্ডি লিখেছে - /// এই সমুচ্চয় উপাসনাই সম্ভূতি থেকে যে ফলটি পাওয়া যায় সেটি হল অণিমাদি ঐশ্বর্য্য লাভ। এটা শঙ্করাচার্যের ব্যাক্তিগত অভিমত নয়, বরং ইহা প্রাচীন পণ্ডিতদের অভিমত, যা ঐতিহাসিক প্রমাণ। সম্ভূতি ও অসম্ভূতির ফলাফল যে পৃথক ইহাও শঙ্করাচার্যের ব্যাক্তিগত অভিমত নয়, বরং মন্ত্রতেই উল্লেখ করা হয়েছে ইহা প্রাচীন পণ্ডিতদের অভিমত।
দার্শনিক দৃষ্টিতে এই অণিমাদি ঐশ্বর্য্য গুলি কি কি? সেই বিষয়ে শ্রীযুক্ত পণ্ডিত দূর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ তার পাদটীকাতে পরিস্কার করেছেন। নিম্নরূপ  -
অর্থ্যাৎ অণিমাদি ঐশ্বর্য্য প্রাপ্তি হল বাস্তবে বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্তি। যাকে আমরা চলিত ভাষাই "বর" পাওয়া বলি। উপনিষদে পঞ্চম বেদ হিসাবে স্বীকৃত ইতিহাস পুরাণ (রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ) আদিতে বহু ঘটনার উল্লেখ আছে যেখানে তপস্য করে যোগীগণ, ঋষিগণ, মুনিগণ, দেবগণ, অসুরগণ ইত্যাদিরা উক্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। সুতরাং শঙ্করাচার্য এখানে কোনো অনুচিত কিছু লিখে নাই! ইতিহাস পুরাণ সমূহ উনার মন্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দান করে।/// আচ্ছা পাখন্ডি মশাই সমুচ্চয় উপাসনার ফল [যদিও উপাসতে ক্রিয়া নেই]  অণিমাদি ঐশ্বর্য্য লাভ হয় এই অষ্ট সিদ্ধির কথা মন্ত্রের কোথাই বলা আছে? মন্ত্রে কি অষ্ট সিদ্ধির কথা এসেছে?  মন্ত্রে বিনাশ অর্থাৎ কারণ দ্বারা মৃত্যু কে অতিক্রম করার কথা বলা হয়েছে।  কিন্তু শঙ্করাচার্য মৃত্য কে অতিক্রম অষ্ট সিদ্ধির নাম দিয়ে অর্থ করলেন। আচ্ছা অষ্ট সিদ্ধি আর মৃত্যু অতিক্রম কি এক বস্তু? বেদের মৃত্যুন্জয় মন্ত্রে বলা হচ্ছে   "উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্।।"  আমাকে মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত করুন যেমন একটি পাকা ফল লতা থেকে মুক্ত হয়।

 এই মন্ত্রে সুন্দর ভাবে মৃত্যুর বন্ধন কে উদাহরণের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু শঙ্করাচার্যের মৃত্যু কে অতিক্রম অষ্ট সিদ্ধির নামে চালানো আর পাখন্ডি তার সাফাই গাইতে রামায়ন মহাভারতের ঋষিদের বর পাওয়ার ঘটনার সাথে চালিয়ে দিচ্ছেন। যেন ঘরে বসে পিসি মা'র বাড়ির গল্প। 

আর্যঃ
|| তৃতীয় মন্ত্রের ব্যাখ্যায় শ্রী শঙ্করাচার্য জী লিখলেন - "সম্ভূতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্ বেদোভয়ং সহ বিনাশো ধর্মো যস্য কার্যস্য স তেন ধর্মিনা অভেদন উচ্যতে বিনাশ ইতি, তেন তদুপাসনেনানৈশ্বর্যম-ধর্মকামাদদিোষজাতং চ মৃত্যুং তীর্ত্বা হিরণ্যগর্ভোপাসনেন হ্যাণিমাদি প্রাপ্তিঃ ফলম্ তেনানৈশ্বর্যাদি মৃত্যুমতীত্য অসম্ভুত্যা অব্যাকৃতোপসনায়া অমৃতং প্রকৃতিলয়লক্ষণমশ্নুতে।।"
অর্থাৎ যে পুরুষ সম্ভূতি এবং বিনাশ এই দুই কে একসাথে জানে, তিনি - যাহার কার্যের ধর্ম বিনাশ এবং সেই ধর্ম দ্বারা অভেদ হওয়ার কারণে যাকে স্বয়ং বিনাশ বলা যায়, সেই বিনাশ কে উপাসনা দ্বারা
অনৈশ্বর্য, অধর্ম তথা কামনাদি দোষ দ্বারা উৎপন্ন মৃত্যু কে পার করে। হিরণ্যগর্ভ (সম্ভূতি) কে উপাসনা দ্বারা অণিমাদি ঐশ্বর্য প্রাপ্তি রূপ ফল মিলে। এবং অসম্ভূতি= অব্যক্ত প্রকৃতিকে উপাসনা দ্বারা অমৃত = প্রকৃতিলয়ত্ব কে প্রাপ্ত হয়। এখানে শ্রী শঙ্করাচার্য জী "বিনাশ " পদের অর্থ যথার্থ ব্যাখ্যা করেন নি । নিজে "বিনাশ" এর অর্থ বিনাশ হওয়া কার্য পদার্থ করেছেন। মন্ত্রে কার্য পদার্থের জন্য যখন "সম্ভূতি " পদ যখন পড়া হয়েছে, যাহার বর্ণনা তিনি স্বয়ং " কার্য ব্রহ্ম " অর্থ করেছেন। যদি মন্ত্রে " সম্ভূতি " এবং "বিনাশ " পদের অর্থ একই হয় তবে মন্ত্রে পূণরুক্তি দোষ ঘটবে ||

পাখন্ডিঃ
///১২ নং মন্ত্রে শঙ্করাচার্য সম্ভূতির অর্থ শুধু "কার্য ব্রহ্ম" হিসাবে উল্লেখই করেনি! সম্ভূতি শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য উল্লেখ করছেন "সম্ভবনং সম্ভূতিঃ সা যস্য কার্য্যস্য" পরে আবার উল্লেখ করছেন "সম্ভূত্যাং কার্য্যব্রহ্মণি হিরণ্যগর্ভ"। অর্থ্যাৎ উনি কার্যব্রহ্ম [সৃজনকারী কার্য] হিরণ্যগর্ভ কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন সম্ভূতি।আর আমি পূর্বেই প্রমাণ করেছি আমাদের পূর্বজরা যদি হিরণ্যগর্ভ বলে কাউকে জানতো সেটা হল "ব্রহ্মা" কে, আর ভগবদ গীতা ৮.১৬ তে উল্লেখিত হয়েছে :- "আব্রহ্মভূবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন" অর্থ্যাৎ হে অর্জুন পৃথিবী থেকে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত লোকসমূহ পুনঃরাবর্তনশীল অর্থ্যাৎ তার বিনাশও হয় আবার পুনঃউৎপন্ন হয়। সুতরাং ব্রহ্মা বা হিরণ্যগর্ভ বিনাশের উপরে নয়! সুতরাং শঙ্করাচার্য এখানে কোনো অনুচিত কিছু বলেননি।
আর ১৪ নং মন্ত্রে যে অমৃত ভোগের কথা বলছে সেটা মোক্ষ। এই বিষয়ে শঙ্করাচার্য লিখছেন :-
"সেই ব্যাক্তি প্রথমে বিনাশ (হিরণ্যগর্ভ আদির) উপাসনা দ্বারা অণিমাদি ঐশ্বর্য্য লাভ করেন, পশ্চাদে সেই ঐশ্বর্য্য দ্বারা অনৈশ্বর্য্য, অধর্ম্ম ও বিষয় বাসনা প্রভৃতি দোষরূপ মৃত্যুকে অতিক্রম করেন। অনন্তর, প্রকৃতিসংজ্ঞক অসম্ভূতির উপাসনা দ্বারা অমৃত লাভ করেন অর্থ্যাৎ প্রকৃতিতে বিলীন থাকেন।"///  এই মন্ত্রে শঙ্করচার্য যে কত বড় চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে আর পাখন্ড কত বড় ভন্ডামী করেছে তার উন্মোচন হবে।  ১২ নং মন্ত্রে অসম্ভূতি ও সম্ভূতি পদ এসেছে,  ১৩ নং মন্ত্রে অসম্ভূতির স্থলে অসম্ভব এবং সম্ভূতির স্থ্লে সম্ভব পদ এসেছে এবং শেষ ১৪ নং মন্ত্রে অসম্ভূতির স্থলে বিনাশ এবং সম্ভূতির স্থলে পূর্বের মন্ত্রের সমান সম্ভূতি পদ যথাবত রয়েছে।  কিন্তু ১৪ নং মন্ত্রে এসে শঙ্করাচার্য্য পুরো উল্টো অর্থ করলেন।
এখানে শ্রী শঙ্করাচার্য জী  "বিনাশ" এর অর্থ হিরণ্যগর্ভ করেছেন।   মন্ত্রে হিরণ্যগর্ভের  জন্য যখন "সম্ভূতি"  পদ যখন স্পষ্ট তখন বিনাশ এর অর্থ হিরণ্যগর্ভ কি করে?   আচ্ছা  বিনাশ এর অর্থ যদি হিরণ্যগর্ভ হয় তবে সম্ভূতি অর্থ কি?  কেননা সম্ভূতি অর্থ হিরণ্যগর্ভ  তা পূর্বের মন্ত্রে শঙ্করাচার্য্য নিজেই বলেছেন।   তাহলে কি মন্ত্রে পুনরুক্তি রয়েছে?  কিন্তু শঙ্করাচার্য এই সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য নিজের মতো করে মন্ত্রার্থ পরিবর্তন করে বললেন -
" সম্ভূতি বিনাশং চেত্যত্রাবর্ণলোপেন নির্দশো দ্রষ্টব্যঃ"  অর্থাৎ বিনাশ অর্থ বিনাশ ধর্মযুক্ত (বিনাশী) হিরণ্যগর্ভাদিকেই এখানে বিনাশ বলা হইয়াছে। আর ছন্দের অনুরোধে অসম্ভূতি শব্দের অকারের লোপ করিয়া সমর্ভূতি করা হইয়াছে,  সতুরাং উহার অর্থ অসম্ভূতি প্রকৃতি।



এখানে মন্ত্রের পরিবর্তন করার দুঃসাহস তো শঙ্করাচার্য জী নিজে করেছেন।  কেননা বেদ মন্ত্রের শব্দ কে তিনি নিজের মতো করে পাল্টিয়ে অর্থ করেছেন যেখানে মন্ত্রে সম্ভূতি পদ স্পষ্ট সেখানে সেই শব্দটি কে অসম্ভূতির অ কারের লোপ ঘটিয়ে তিনি সম্ভূতিকে  অসম্ভূতি বলে চালিয়ে দিলেন। এবং বিনাশ পদ টিকে তিনি সম্ভূতি অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ বলে চালালেন।  কিন্তু দয়ানন্দ জী তথা অনান্য বিদ্বানরা শঙ্করাচার্য জীর মতো মন্ত্রের শব্দ পরিবর্তনের মতো দুঃসাহস করেন নি।

যোগী অরবিন্দ বিনাশ পদ টিকে অসম্ভূতির অর্থে করেছেন এবং সম্ভূতি অর্থ পূর্ববত ঠিক রেখেছেন [যেখানে শঙ্করাচার্য বিনাশ = সম্ভূতি/ হিরণ্যগর্ভ   এবং সম্ভূতি = অসম্ভূতি / প্রকৃতি করেছিলেন ]



সাধক অণির্বান বিনাশ পদটিকে অসম্ভূতি অর্থেই গ্রহন করেছেন।  তিনি বলেছেন এখানে অসম্ভূতিকে বলা হয়েছে বিনাশ। শব্দটি এসেছে নশ্ ধাতু থেকে। সংহিতায় তার দুটি অর্থ এক লুপ্ত হওয়া, আরেক লক্ষ্যে পৌছান।  এখানে দুটি অর্থই এসে গেছে,  তাই শব্দটি শ্লিষ্ট।



দেখা যাচ্ছে অরবিন্দ,  অনির্বান বিনাশ শব্দটির অর্থ অসম্ভূতিই করেছে। কিন্তু শঙ্করাচার্য বিনাশ শব্দটির অর্থ পরিবর্তন করে হিরণ্যগর্ভ অর্থাৎ সম্ভূতি করেছে।

 দয়ানন্দ জী ও এই রহস্যকে উত্তমরূপে উন্মোচন করেছেন।  তিনি লিখেছেন - মন্ত্রে " সম্ভূতি"র অর্থ তো "কার্য পদার্থ" কিন্তু "বিনাশ" এর অর্থ কারণরূপ প্রকৃতি। স্বামী জী লিখেছেন - " বিনশ্যন্ত্যদৃশ্যাঃ পদার্থ ভবন্তি যস্মিন " অর্থাৎ যাহার মধ্যে সব কার্য পদার্থ বিনষ্ট = অদৃশ্য হয়ে যায় তাকে বিনাশ= প্রকৃতি বলে। দেখুন কত সুন্দর তথা ব্যকরনসম্মত ব্যাখ্যা।

এভাবে প্রথম ১২ নং  মন্ত্রে বলা হয়েছে যে, সম্ভূতি এবং অসম্ভূতির উপাসনা নিষেধ। কিন্তু শঙ্করাচার্য পূনরায় ১৪ নং মন্ত্রে " উপাসনা" শব্দের প্রয়োগ করেছেন। মূলতমন্ত্রে সম্ভূতি তথা অসম্ভূতির বিজ্ঞান কে আত্মার জন্য উপযোগীতা বর্ণনা করা হয়েছে।কারন তৃতীয় মন্ত্রে "উপাসতে" ক্রিয়া নেই বরং বেদ = জানা ক্রিয়া রয়েছে।অতঃ মন্ত্রে ইহার বিজ্ঞানের নির্দেশ। শঙ্করভাষ্যে বিনাশের বিজ্ঞান এর স্থলে বিনাশোপসনার বর্ননা শুধু কল্পনাই নয়, বরং মূল মন্ত্রের বিরুদ্ধ ।

আর্যঃ
|| কি প্রকৃতিলয় এবং অমৃত এক হতে পারে? ||

পাখন্ডিঃ
তাহলে এইসব কপটিরা ভগবদ গীতার ব্যাপারে কি বলবে?
ভগবদ গীতা ৮.২০ -
পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ।
যঃ স সর্বেষু ভূতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি।।
অর্থ্যাৎ, আর একটি অব্যক্ত প্রকৃতি রয়েছে, যা নিত্য এবং ব্যক্ত ও অব্যক্ত বস্তুর অতীত। সমস্ত ভূত বিনষ্ট হলেও তা বিনষ্ট হয় না।
ভগবদ গীতা ৮.২১ -
অব্যক্তোহক্ষর ইত্যুক্তস্তমাহুঃ পরমাং গতিম।
যং প্রাপ্য ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।
সেই অব্যক্তকে অক্ষর বলে, তাই সমস্ত জীবের পরমা গতি। কেউ যখন সেখানে যায়, তখন আর তাঁকে এই জগতে ফিরে আসতে হয় না। সেটিই হচ্ছে আমার পরম ধাম।

জবাবঃ একটু দাঁড়ান পাখন্ডি মশাই। অন্যদের কপট বলার আগে নিজের ভন্ডামী একটু কমান। গীতার শ্লোকের সঠিক অর্থ না দিয়ে সবার চক্ষু ওয়াস করতে বসেছেন দেখছি। আগেও শ্লোক দুটির অর্থ আমরা ব্যাখ্যা করেছি - উপরের দুটি  শ্লোকে যে অব্যক্ত ভাবের কথা বলা হচ্ছে সেটা প্রকৃতির কথা নয়, এখানে অব্যক্ত প্রকৃতিরও উর্ধে অব্যক্ত অক্ষর  পরমাত্মার কথা বলা হচ্ছে। শ্লোকটির অর্থ এই প্রকার -

[(তস্মাৎ অব্যক্তাত্) সেই অব্যক্তরূপ প্রকৃতি থেকে (অন্য অব্যক্তঃ ভাবঃ) অন্য অব্যক্তভাব = সুক্ষ্ম পরমাত্মা (তু) নিশ্চয় করে (পরঃ) পরে, তিনি (সনাতনঃ) সনাতন (সঃ যঃ) তিনি এই (সর্বেষু ভূতেষু) সমস্ত ভূতের (নশয়ৎসু) নাশ হওয়ার পরেও (ন বিনশ্যন্তি) নাশ কে প্রাপ্ত হন না। ]

শঙ্করাচার্য্য শ্লোকটির ভাষ্যে বলেছেন - "अक्षरस्य विवक्षितस्य अव्यक्तात् वैलक्षण्यविशेषणार्थः অক্ষরস্য বিবক্ষিতস্য অব্যক্তাদ্ বৈলক্ষণ্যপ্রদর্শনার্থঃ। ভাবঃ অক্ষরাখ্যং পরং ব্রহ্ম" অর্থাৎ (তিনি অব্যক্ত )ভাব জানবে অক্ষর নামক পরমব্রহ্ম পরমাত্মা অত্যন্ত ভিন্ন।

এখানে শঙ্করাচার্যও অব্যক্ত ভাব যা প্রকৃতি থেকে ভিন্ন তাকে পরম ব্রহ্ম পরমাত্মা বলে নির্দেশ করেছেন।

 অথচ পাখন্ডি সেটাকে প্রকৃতি বানিয়ে ভন্ডামীর প্রকাশ করেছে। এই প্রকার পরের শ্লোকে সেই অব্যক্ত অক্ষরের কথা বলা হচ্ছে -

[(অব্যক্তং অক্ষরঃ ইতি উক্তঃ) এই যে অব্যক্ত অক্ষের কথন করা হয়েছে (তং) তাকে (পরমাং গতি আহুঃ) পরমগতি বলে (যং প্রাপ্য) যাকে প্রাপ্ত হয়ে (ন নিবর্ত্তন্তে) তাহার নিবৃত্ত হয় না (তত্) তাহা (পরমং) সবচেয়ে উত্তম (মম ধাম) আমার স্থান।]

আর্যঃ
শ্রী শঙ্করাচার্য জী অন্যত্র " অমৃতম" শব্দের অর্থ "অমরণধর্মকং ব্রহ্ম " অর্থাৎ মোক্ষ অথবা "অমৃতম= সুখরূপম" করেছেন। দেখুন -
"পরামৃতাঃ পরিমুচ্যন্তি সর্ব ( মুন্ডক ৩।২।৬)
পরামৃতাঃ = পরমমৃতম = অমরণধর্মকং ব্রহ্ম আত্মভূতং যেষাং তে ।

পাখন্ডিঃ
///এখানে আর্য সমাজীরা নিজের অবুঝতা কে শঙ্করাচার্যে উপরে আরোপ করেছে!! সবার আগে মুণ্ডকোপনিষৎ ৩.২.৫-৯ এর বিষয়বস্তু দেখুন :-
এখানে আত্মবিৎ পুরুষের মৃত্যুর পরে ব্রহ্মভাবপ্রাপ্তির বা মোক্ষের ব্যাপারে উল্লেখ করা হচ্ছে। যদিও মোক্ষ প্রাপ্তির ও অমরত্ব প্রাপ্তির ব্যাপারটি স্পস্ট ভাবে মূন্ডকোপনিষৎ ৩.২.৭-৯ তে উল্লেখিত হয়েছে।
তো এখানে উল্লেখিত ব্রহ্মের স্বরূপটি কিরূপ?
সেই প্রসঙ্গে মূন্ডকোপনিষৎ ৩.২.১ তে কি উল্লেখিত হয়েছে সেটি দেখুন :-
অর্থ্যাৎ এখানে ব্রহ্মের সেই স্বরূপের কথা বলা হচ্ছে - যার মধ্যে সমস্ত বিশ্ব নিহিত এবং যিনি বিশুদ্ধরূপে প্রতিভাত হচ্ছে, সেই আত্মজ্ঞ পুরুষ।
অর্থ্যাৎ ঈশোপনিষদে ১২ নং মন্ত্রে উল্লেখিত অসম্ভূতি যাকে ভগবদ গীতা, মনু সংহিতা, বৃহদারণ্যক উপনিষদের ব্যাখাতে সনাতন ও মোক্ষ প্রদানকারী বলা হয়েছে, সেই ব্রহ্মের অসম্ভূতি স্বরূপকে এখানে আত্মজ্ঞ পুরুষ বলা হচ্ছে। তিনি মূন্ডকোপনিষদে উক্ত অংশে উল্লেখিত ব্রহ্ম। এখানে ব্রহ্ম হিসাবে সম্ভূতি বা কার্য্যব্রহ্ম হিরণ্যগর্ভ কে উল্লেখ করা হয়নি! কারণ মোক্ষের দ্বারা অমৃত দান অসম্ভূতিরই দ্বারা সম্ভব।///

জবাবঃ আমরা শঙ্করাচার্যের অমৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম যে, তিনি অমৃত অর্থ মুন্ডক উপনিষদে কি করেছেন। কিন্তু এই পাখন্ডি উল্টো মুন্ডকোপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বের আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। আমরা শঙ্করাচার্যের বেশ কিছু স্থলে অমৃত শব্দের অর্থ দেখাবো যার কোনটাতেই শঙ্করাচার্য এক অর্থ ঘটান নি।

(i) আনন্দরূপমমৃতং যদ্ বিভাতি।। (মুন্ডক ২।২।৮)
आनन्दरूपं सर्वानर्थदुःखायासप्रहीणं सुखरूपम् अमृतं यद्विभाति विशेषेण स्वात्मन्येव भाति सर्वदा।।
"আনন্দরূপং সর্বানর্থদুঃখায়্সপ্রহীণং সুখরূপম্ অমৃতং যদ্ বিভাতি (শঙ্কর ভাষ্য)
অর্থাৎ যে আনন্দস্বরূপ অর্থাৎ সর্বপ্রকার অনর্থ দুঃখ যন্ত্রণারহিত ও অমৃতস্বরূপ।


(iil বিদ্যায়ামৃতমশ্নুতে।। (ঈশঃ ১১নং মন্ত্র)
देवताज्ञानेन अमृतं 
দেবতাজ্ঞানেনামৃতম্ = দেবতাত্মভাশ্নুতে প্রাপ্নোতি।। (শঙ্কর ভাষ্য)
অর্থাৎ দেবতা ভাব দ্বারা দেবত্ববাব কে প্রাপ্তি।

বিদ্যয়া = আত্মশুদ্ধান্তঃকরণসংযোগধর্মজনিতেন যথাদর্শনেন অমৃতম্ = নাশরহিতং স্বস্বরূপং পরমাত্মানং বা অশ্নুতো।। (দয়ানন্দ ভাষ্য)
অর্থাৎ আত্মা এবং শুদ্ধ অন্তঃকরণের সংযোগধর্ম দ্বারা উৎপন্ন যথার্থ জ্ঞান দ্বারা অমৃতম্ = অবিনাশি আত্মস্বরূপ যা পরমাত্মাকে প্রাপ্ত করায়।


(iii) সম্ভূত্যামৃতমশ্নুতো (ঈশঃ ১৪ নং মন্ত্র)
সম্ভূত্যা (অসম্ভূত্যা) অব্যকৃতোপনসনয়া অমৃতম্ = প্রকৃতিলয় লক্ষণমশ্নুতে।।  (শঙ্কর ভাষ্য)
অর্থাৎ অব্যকৃতপোসনা দ্বারা অমৃতম্ = প্রকৃতিলয় রূপ অমৃত কে প্রাপ্ত করা।

সম্ভূত্যা = শরীরেন্দ্রিয়ান্তঃকরণরূপয়োৎপন্নয়া কার্যরূপয়া ধর্মে প্রবর্ত্তয়িত্র্যা সৃষ্টয়া অমৃতম্ = মোক্ষমশ্নুতে।। (দয়ানন্দ ভাষ্য)
অর্থাৎ শরীর ইন্দ্রীয় অন্তঃকরণ রূপ উৎপন্ন হওয়া কার্যরূপ ধর্মকার্যে প্রবৃত্ত করানোকারী সৃষ্টির সহযোগ দ্বারা অমৃতম্ = মোক্ষসুখ কে প্রাপ্ত করা।

(iii) বায়ুরনির্মলমমৃতম্।।  (ঈশঃ ১৭ নং মন্ত্র)
বায়ুঃ প্রাণোহধ্যাত্মপরিচ্ছেদং হিত্বাধিদৈবতাত্মানং সর্বাত্মকমনিলমমৃতং = সুত্রাত্মানং প্রতিপদ্যতাম্।।
অর্থাৎ মরণশীল বায়ু (প্রাণ) নিজ অধ্যাত্ম পরিচ্ছেদ কে ত্যাগ করে অধিদৈবরূপ সর্বকত্মক বায়ুরূপ অমৃত = সুত্রাত্মা কে প্রাপ্ত হয়।

অত্রস্থো বায়ুঃ ধনন্জয়াদিরূপঃ অনিলং কারণরূপং বায়ুম্ অনিলেহমৃতং নাশরহিতং কারণং ধরতি (দয়ানন্দ ভাষ্য)
অর্থাৎ এখানে বিদ্যমান ধনন্জয়াদিররূপ বায়ু কারণরূপ বায়ু কে এবং অমৃতং = নাশরহিত কারণ কে ধারণ করে।

উপরিউক্ত তিন উদ্ধরণে শঙ্কর ভাষ্যে অমৃত অর্থ - দেবত্ম ভাব, প্রকৃতিলয়,  সুত্রাত্মা বায়ু।  এবং দয়ানন্দ ভাষ্য অনুসারে  - অবিনাশি আত্মস্বরূপ বা পরমাত্মা,  মোক্ষসুখ  এবং নাশরহিত কারণ। 

 অর্থাৎ শঙ্করাচার্য্য অমৃত শব্দের অর্থ সর্বদা এক ঘটান নি।  ১৪ নং মন্ত্রে বলেছেন সম্ভূতি যা অকারের লোপ ঘটার কারনে অসম্ভূতি তাহার উপাসনা দ্বারা প্রকৃতিলয় ঘটে। এই প্রকৃতিলয় কে পাখন্ডি পরম গতি বোঝাতে এনে গীতা এনেছিলেন।  এখানে অসম্ভূতি শব্দে যে প্রকৃতি বোঝায় তা সত্ব রজ তম ময় অব্যক্ত  জড়া প্রকৃতি।  এই প্রকৃতির উপাসনা দ্বারা প্রকৃতি লয় অর্থাৎ এই জড়া প্রকৃতির মধ্যে লয় ঘটা  আর অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্তি কি এক হলো? শঙ্কর প্রকৃতিকে নিজেই অনাত্মক বলেছে । কিন্তু আত্মা চেতন , প্রকৃতি লয় মানে চেতন জড় তে লীণ হতে পারে কিরূপে !

 উপরিউক্ত সমস্ত বিচার বিশ্লেষনে এটা স্পষ্ট যে শঙ্করাচার্যের কৃত অর্থের পক্ষে  পাখন্ডি যে সাফাই গেয়েছিলো তা কতটা ভন্ডামীর ছিলো। আর মনু গীতার শ্লোক গুলো চটকদার শব্দার্থে সবার নিকট উপস্খাপন সবার আই ওয়াশ করেছিলো।  আর সাধারন পাঠকদের মনে যে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিলো তা  এই জবাবে নিরসন হয়েছে আশা করি।







Author

Unknown