আর্যরা গুরুবাদী কিনা ?

প্রশ্ন- আর্যরা গুরুবাদী কিনা ?
উত্তর- এই ব্যাপারে সত্যই চর্চা হওয়া আবশ্যক, কেন না অনেকে ভাবে আর্যরা গুরুবাদী নয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল আর্যরাও গুরুবাদী। কেননা গুরু ভিন্ন জ্ঞান অর্জন অসম্ভব এবং গুরু বিনা অন্ধকার দূর করে আলোর দিকে অগ্রসর হওয়া যায় না। তবে আর্যরা অন্যান্ন সংস্থা বা সংগঠনের মত গুরুবাদী নয়, এই দুই এর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। নিচে এই ব্যাপারে বিষদ আলোচনা করা হল-

আর্যরা সাংখ্য দর্শনের নিম্নোক্ত বাণীর মতই গুরুবাক্য মান্য করে-
"বহুশাস্ত্রগুরুপাসনে অপি সারাদানং ষট্পদবৎ।।"
সাংখ্য দার্শন ৪/১৩.
সরলার্থ-
ভ্রমর যেমন পুষ্পের রক্ততা ও শ্বেততার দিকে লক্ষ্য না করিয়া বহুপুষ্পের মধ্য হতে মধু সংগ্রহ করে, মুমুক্ষু পুরুষও মুক্তিরূপ অমৃতের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া বহু শাস্ত্র ও অনেক গুরুর উপদেশের মধ্য হতে মুক্তির উপযোগী উপদেশের সার সংগ্রহ করিবেন।
গীতায়ও ভগবান গুরু থেকে জ্ঞান গ্রহণে এইরূপ মার্গই প্রদান করেছেন। যথা-
"তৎ বৃদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবায়া।
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।।"
গীতা ৪/৩৪
অর্থাৎ যে উপায়ে সেই জ্ঞান লাভ করছি তা বলছি শোন- আচার্যের নিকট গিয়ে দীর্ঘ প্রণামের দ্বারা তাঁকে প্রসন্ন করলে, তত্ত্বদ্রষ্টা জ্ঞানী, তোমাকে তত্ত্বদর্শন উপযোগী জ্ঞান উপদেশ করবেন।


উপনিষদকারও গুরুর জ্ঞান গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুরূপ মন্ত্রনাই আমাদের উদ্দ্যেশ্যে প্রদান করেছেন তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ এর শিক্ষা বল্লবী এর মধ্যে। যথা-

"যে সকল কর্ম অনিন্দিত তাহাই অনুষ্ঠান কর, অপরগুলি নয়। আমাদের যাহা সদাচার তাহাই তোমরা অণুষ্ঠেয়। অপরগুলি নয়, যে সকল ব্রাহ্মণ আমাদিগের মধ্য হইতে শ্রেষ্ঠতর, তুমি তাঁহাদেরকে আসনাদি দিয়া তাঁহাদের শ্রম দূর করিবে। শ্রদ্ধা সহকারে দান করিবে, অশ্রদ্ধাদ সহিত দান করিবে না। সামর্থ্যানুসারে দান করিবে, বিনম্রভাবে দান করিবে। সভয়ে দান করিবে, মিত্য ব্যবহারের সহিত দান করিবে। আর যদি কর্ম সম্বন্ধে তোমার সংশয় উপস্থিত হয়, অথবা আচার সম্বন্ধে সাংশয় উপস্থিত হয়, তবে- ঐ স্থানে বা ঐ সময়ে যে সকল বিচারক্ষম, কর্মপরায়ণ, কর্মাদিতে স্বতঃপ্রবৃত্ত, অক্রুরমতি ও নিষ্কাম ব্রাহ্মণ থাকিবেন, তাঁহারা ঐ কর্ম বা আচারে যেরূপ নিরত থাকেন, তুমিও উহাতে তদরূপই থাকিবে। আবার পূর্বোক্ত ব্যক্তিগণের কাহারো আচরণে যদি কেহ সংশয় উপস্থিত করে, তবে ঐ কালে বা স্থানে যে সকল বিচারক্ষম, কর্মনিষ্ঠ, কর্মাদিতে স্বতঃপ্রবৃত্ত, অক্রুরমতি ও নিষ্কাম ব্রাহ্মণ থাকিবেন, তাঁহারা ঐ সকল বিষয়ে যেরূপ নিরত থাকেন, তুমিও সেইরূপই কর। ইহাই বিধি, ইহাই উপদেশ, ইহাই বেদের রহস্য, ইহাই ঈশ্বরের আজ্ঞা। এই প্রকারেই সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে, এই প্রকারেই সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে।"
তৈত্তিরীয়োপনিষদ ১/১১/২-৪.
.
উপনিষদের আজ্ঞানুসারে আমরা দেখতে পাই যে-আপনি যাকেই গুরু মান্য করেন না কেন যদি ওনার জ্ঞান এর উপর আপনার কোন সংশয় থাকে তাহলে আপনি অন্য গুরু থেকেও জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। ইহাই জ্ঞানার্জনের সুপ্রাচীন প্রণালী, যার কারণ মহর্ষি পতঞ্জলি ওনার যোগ দর্শনে সকল গুরুর ও গুরু হিসেবে স্বয়ং ঈশ্বরকেই মান্য করেছেন। যথা-

"পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ।"
যোগ দর্শন ১/২৬
অর্থাৎ সেই ঈশ্বরই সকল গুরুরও গুরু, কেননা কালের দ্বারা তার অবচ্ছেদ নেই।

কালের পরিক্রমায় জাগতিক সকলগুরুরই ভুল ত্রুটি দেখা দিলেও যেসকল গুরু নির্দিধায় বলেন যে ওনার কেন ভুল থাকলে তা ত্যাগ করে সত্যি গ্রহণ করতে, বাস্তবে তিনিই সৎ গুরুর মর্যাদার যোগ্য। তাই একেবারে অভ্রান্ত সৎ গুরু হলেন স্বয়ং পরমেশ্বর, তথা পরম পিতা পরমাত্মা।

আর্যরাও তাই বলে এবং তাদের গুরুরাও তাই বলে। আর্য সমাজের সংস্থাপক মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীও আর্য সমাজের দশ নিয়মের ৪র্থ নিয়ম ও ৮ম নিয়মে বলেছেন-
"সত্য গ্রহণে ও অসত্য পরিত্যাগে সদা উদ্যত থাকা উচিত।"
"অবিদ্যার নাশ ও বিদ্যার বৃদ্ধি করা উচিত।"
তাই আপনারা কেহ যদি বলেন যে আর্যরা ভুল বলছে বা তাদের গুরুরা ভুল বলছে, এতে আমরা বিন্দু মাত্রও বিচলিত নই। বরং আমরা তখন আনন্দিত হই এটাই ভেবে যে আমার ও আমাদের গুরুরা সত্যই আমাদের সঠিক শিক্ষাই দিয়েছেন। ভুল কোন শিক্ষাই দেননি। কারণ, ওনারা পূর্বেই আমাদের ঐরূপ ধর্মীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। কেননা, বাস্তবে ওনাদের তো কোন ভুলই নেই!

শেষ করবো প্রার্থনা মূলক একটি শ্লোক ও একটি মন্ত্র দিয়ে-

"ও৩ম্ অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৩/২৮.
হে সর্বরক্ষক প্রভো! তুমি আমাদের অসত্য মার্গ থেকে সরিয়ে সত্য মার্গে, অজ্ঞান, অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে বৈদিক জ্ঞানররূপী প্রকাশের দিকে নিয়ে যাও, মৃত্যু আদি দুঃখ থেকে অমৃতত্বের দিকে নিয়ে যাও।"

"ও৩ম্ অগ্নে ব্রতপতে ব্রতং চরিষ্যামি তচ্ছকেয়ং তন্মে রাধ্যতাম্। ইদমহমনৃতাৎ সত্যমুপৈমি।।
যজুর্বেদ ১/৫.
সরলার্থ- হে ব্রতপতে অগ্নে! আমি ব্রত ধারণ করছি যে, অসত্যকে ছেড়ে সত্যকে জানি, সত্যকে মানি ও সদা সত্য ব্যবহার করি। হে প্রভো! তুমি আমাকে এমন সামর্থ প্রদান করো যেন আমার এই সত্য ব্রত সদা সত্য সিদ্ধ হয়।"

ও৩ম্ শান্তি শান্তি শান্তি