https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

গীতা বিশ্লেষণ-পর্ব-৫২প্রশ্ন- গীতায় কোন আসুরীয় জ্ঞান আছে কিনা?

Saturday, September 1, 2018

প্রশ্ন- গীতায় কোন আসুরীয় জ্ঞান আছে কিনা?

উত্তর- খুবই সুন্দর প্রশ্ন, ধন্যবাদ আপনাকে। হুম, গীতায়ও আসুরীয় জ্ঞান বিদ্যমান। আর সেই জ্ঞানগুলো সম্পর্কে জানার পূর্বে উপনিষদ সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরী। তাই আমরা সকলে উপনিষদ কি তা দেখি প্রথমে।
সংস্কৃত শব্দ উপনিষদ্‌ শব্দটি উপ- (কাছে), নি- (সঠিক জায়গায়, নিচে) এবং ষদ্‌ (বসা)―এই তিনটি শব্দাংশের সমষ্টি। অর্থাৎ, এই শব্দের অর্থ কাছে নিচু আসনে বসা বা শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে গুরু বা শিক্ষকের কাছে নিচু আসনে এসে বসা।
অন্যমতে, এই শব্দের অর্থ (গুরুর) পদতলে বসা বা গুরুর শরণাগত হওয়া।

মনিয়ার-উইলিয়ামসের উনিশ শতকের শেষভাগে লেখা অভিধানে পাওয়া যায়-
"দেশীয় পণ্ডিতদের মতে উপনিষদ্‌ শব্দের অর্থ 'সর্বোচ্চ আত্মার জ্ঞানলাভের দ্বারা অজ্ঞান দূরীকরণের জন্য বসা"।
আদি শঙ্করাচার্যের কঠ্‌ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ্‌ ভাষ্যে উপনিষদ্‌ শব্দের যে সংজ্ঞা পাওয়া যায়, তাতে একে আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যান্য অভিধানে "গোপনীয় তত্ত্ব" বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ইহা সত্যিই গোপনীয় তত্ত্ব! যার ফলে দেখা যায়, শিষ্য বারংবার গুরুকে শ্রদ্ধারর সহিত প্রশ্ন করিলে তারপর গুরু তার উত্তর প্রদান করিতেন। গুরু মূলত জ্ঞান অর্জনের প্রতি শিষ্যের আগ্রহ, ধৈর্য্যেরও পরীক্ষা নিতেন। যখন দেখতেন যে শিষ্য সেই গোপনীয় তত্ত্ব গ্রহণে প্রস্তুত এবং সেই জ্ঞান ধারণ করতে সমর্থ তখন কোন বিষয়ে পরম গোপনীয় জ্ঞান প্রদান করতেন। যেমন কিনা কঠ উপনিষদে গুরু যম ও শিষ্য নচিকেতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঠিক তেমনি ছান্দোগ্য উপনিষদের গুরু প্রজাপতি ও শিষ্য ইন্দ্র এবং বিরোচন এর কথা বলা যেতে পারে।

গুরু প্রজাপতি নিকট যখন শিষ্যদ্বয় উপস্থিত হইলেন তখন প্রজাপতি শিষ্যদ্বয়কে ৩২ বছর ব্রহ্মচর্য বাস করাইলেন (ছাঃউঃ ৮/৭/৩)। এভাবে তিনি তাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিলেন, যখন দেখলেন শিষ্যরা জ্ঞান অর্জনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তখন প্রজাপতি তাদের বলিলেন-
"কি প্রয়োজনে তোমরা এখানে বাস করিলে?"
প্রতিউত্তরে শিষ্যরা বলিলেন-
"আত্মাকে জানিবার অভিপ্রায়ে আমরা এখানে বাস করিয়াছি।"
উপনিষদগুলোতে দেখা যায় গুরু সরাসরি কোন প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিতেন না, বলা চলে তিনি ১ম অবস্থায় ভুল উত্তর দিতেন। যদি শিষ্য গুরুর সেই বাক্য শ্রবণ করার পর মনন ও নিদিধ্যাসন না করে মনের আনন্দে ঘরে ফিরে যায় তাহলে তিনি মূলত ভুল জ্ঞান গ্রহণ করেই যাত্রা করেছেন বলা চলে। এই কারণে সনাতন শাস্ত্রগুলোতে শ্রবণের পশ্চাৎ মনন ও নিদিধ্যাসন এর উপর খুব বেশী গুরুত্ব আররোপ করা হয়। যখন কোন বুদ্ধিমান শিষ্য নিদিধ্যাসন করে বুঝতে পারে যে, পূর্বে দেওয়া গুরুদেবের জ্ঞান সঠিক নয় বা অসার তখন তিনি পুনরায় গুরুর নিকট প্রশ্ন করেন। ঠিক এরূপই দেখা যায় প্রজাপতি, ইন্দ্র ও বিরোচনের মধ্যে। প্রজাপতি বলিলেন-
"জলের মধ্যে দৃশ্যমান তোমাদের দুই জনের যে সুন্দর অলঙ্কারে ভূষিত, সুবসন পরিহিত ও সুপরিষ্কৃত বিম্বই আত্মা, এই আত্মাই অমৃত ও অভয়। ইনিই বহ্ম্র।"
গুরু প্রদত্ত ১ম উপদেশে সন্তুষ্ট হয়ে সেই জ্ঞানকে নিদিধ্যাসন না করে মনের আনন্দে ঘরের উদ্দ্যেশ্যে যেতে দেখা যায় বিরোচন ও ইন্দ্রকে। তা দেখিয়া প্রজাপতি বলিলেন-
"আত্মাকে না জানিয়া এবং তাঁহাকে স্বাত্মপ্রত্যক্ষ না করিয়াই দুইজন চলিয়া যাইতেছে। যারাই এই প্রকার উপনিষদ (জ্ঞান) গ্রহণ করিবে তারাই পরাজিত হইবে।"
অসুর রাজা বিরোচন সন্তুষ্ট চিত্তে অসুরগণের নিকট গুরু প্রদত্ত এই উপনিষদ বলিলেন যে-
"দেহরূপী আত্মার পূজা করা উচিত, এরই সেবা করা উচিত। এই জগতে এই দেহরূপী আত্মার পূজা ও সেবা করিলে ইহলোক ও পরলোক, উভয় লোকই লাভ হয়।"
এই জন্য আজও দানহীন, শ্রদ্ধাহীন ও যজ্ঞহীন ব্যক্তি সম্বন্ধে লোকে বলে, "এই লোক সত্যই অসুর স্বভাব"-কারণ ইহা আসুরী উপনিষদ। তাহারা মৃত ব্যক্তির দেহকে ভোগ্যদ্রব্য, বসন ও অলঙ্কারে সজ্জিত করে। কারণ তারা মনে করে, এই মৃতদেহের পূজা ও সেবার দ্বারাই পরলোক জয় করবে। (ছাঃউঃ৮/৮/৩-৫)
উপরন্তু দেখা যায়, দেবরাজ ইন্দ্র দেবগণের নিকট উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই গুরু প্রদত্ত জ্ঞান এর নিদিধ্যাসন করার কারণে নতুন প্রশ্ন মনে জাগ্রত হয়। যার ফলে পুনরায় গুরুর নিকট ফিরে যায়, এরূপ ঘটনা কয়েকবার হওয়ার পরই দেখা যায় গুরু সত্যই দেবরাজ ইন্দ্রকে পরম গোপনীয় সেই আত্মতত্ত্ব প্রদান করেন।

আমরা সকলেই জানি শ্রীমদভাগবত গীতাকেও গীতোপনিষদ্ বলে। আর এই উপনিষদেও ছান্দগ্যোপনিষদের ন্যায় আসুরী উপনিষদ (জ্ঞান) বিদ্যমান। অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসতে পারে যে তা কি করে হতে পারে! সেটাই এখন বিস্তারিত উপস্থাপন করছি, ছান্দোগ্য উপনিষদের ন্যায় গীতায়ও গুরি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিষ্য অর্জুনকে ক্রমান্বয়ে তম, রজঃ ও সৎ গুণ সম্পন্ন জ্ঞান প্রদান করেন। যেমনটা কিনা প্রজাপতিও ইন্দ্র ও বিরোচনকে বলেছিলেন। এখানে দেখা যায় বিরোচন শুধু মাত্র প্রাথমিক জ্ঞানটুকুই গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ তমগুণযুক্ত জ্ঞানই গ্রহণ করেছেন। আর সেই তম বা অন্ধকারাচ্ছন্ন জ্ঞানই হল মূলত আসুরীয় জ্ঞান বা উপনিষদ।
গীতায়ও ভগবান অর্জুনকে বলেছেন-

যত্তু কৃত্স্নবদেকস্মিন্কার্যে সক্তমহৈতুকম্৷
অতত্ত্বার্থবদল্পং চ তত্তামসমুদাহৃতম্৷৷
গীতা ১৮/২২
"যে জ্ঞান কোন একটি দেহে বা প্রতিমাতে, সম্পূর্ণ আত্মা বা ঈশ্বর এই পর্যন্তই, এই রকম উপলব্দি করে সেই অযৌক্তিক, অযথার্থ ও তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক বা আসুরীয় জ্ঞান বলে।"


অর্থাৎ সর্বত্র যারা ঈশ্বর চিন্তন না করে শুধু মাত্র কোন বস্তু, দেহ বা প্রতিমাতে ঈশ্বর চিন্তন করে তারা অসুর স্বভাবের। ঠিক যেমনটা ছান্দোগ্য উপনিষদে গুরু প্রজাপতি বলেছিলেন।

অনুরূপ গীতায় আরো আসুরীয় জ্ঞান বিদ্যমান! যেমন কিনা বলা চলে-

 যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৃ়ন্যান্তি পিতৃব্রতাঃ৷
ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্যাজিনোপি মাম্৷৷
 গীতা 9.25
 "ভূত উপাসকগণ ভূতগণকেই প্রাপ্ত হয়।"

ঠিক তেমনি- "যে যে ভাবে উপাসনা করে তারা আমারই উপাসনা করে।"
"মনুষ্যগণ সর্বোতভাবে আমারই মত অনুসরণ করে।"

ইত্যাদি উক্তিগুলো আসুরীয় উপনিষদ বা জ্ঞান এর অন্তর্গত। কারণ, সকল প্রকার উপাসনা পদ্ধতি এবং জ্ঞানও যদি এক সাথে সঠিক ও সম মর্যাদা সম্পন্ন হতো তাহলে বেদ এ পরম পিতা পরমাত্মা কখনোই বলতো না যে-
"দেবাভাগং যথাপূর্বে সংজানানা উপাসতে।
 ঋগবেদ ১০/১৯১/২.
 অর্থাৎ পূর্বকালীন মহাজ্ঞানী পুরূষেরা যেমন করে কর্তব্য কর্ম ও আমার উপাসনা করেছেন তোমরাও সেইরূপ কর।"

তাই শেষ করার পূর্বে বলতে চাই, গীতায় উক্ত আসুরীয় জ্ঞান কে বুঝারর চেষ্টা করুন এবং সেগুলো ত্যাগ করে জীবনে চলতে শিখুন।
নমষ্কার।