https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বেদ কি শুধুমাত্র অপরাবিদ্যার গ্রন্থ ?

Wednesday, November 28, 2018



বেদ বিষয়ে আমাদের এই বিশ্বাস চলে এসেছে যে, বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান। পরম কল্যাণকারী সর্বজ্ঞ পরমেশ্বর সমস্ত মনুষ্যমাত্রের কল্যাণের জন্য সৃষ্টির প্রারম্ভে এই পবিত্র জ্ঞান প্রকট করেছেন। যেমনটা মহাভারতে বলা হয়েছে,


ঋষয়স্তপসা বেদানধ্যৈষন্ত দিবানিশম
অনাদিনিধনা বিদ্যা বাগৎসৃষ্টা স্বয়ম্ভুবা।। 
(মহাঃ, শান্তি পর্ব ২৩২।২৪)


অর্থাৎ মহর্ষিগণ তপোবলেই দিবানিশি বেদ অধ্যয়ন করিয়া থাকেন। সৃষ্টির প্রথমে জগদীশ্বর আদি অন্তশূণ্য বেদরূপী বিদ্যার সৃষ্টি করিয়াছেন ।  যে বিদ্যার দ্বারা মনুষ্য তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা বিশ্ব বিষয়ক সমস্ত কর্তব্যের যথার্থ জ্ঞান প্রাপ্ত করতে পারে এবং তার দ্বারা সুখ, শান্তি তথা পরমানন্দ কে প্রাপ্ত করতে পারে। এজন্য প্রাচীন সকল স্মৃতিকাররাই বেদ কে স্বতঃ প্রমান মান্য করে এসেছেন। উদাহরণার্থে মহর্ষি মনু বলেছেন -

"বেদোহখিলো ধর্মমূলম্।" 
(মনু০ ২।৬) 
অর্থাৎ বেদ ধর্মের মূল 


এবং ধর্ম জিজ্ঞাসায় বেদকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন
"ধর্ম জিজ্ঞাসমানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ।।" 
(মনু০ ২।১৩
অর্থাৎ যে ধর্মের বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত করতে চায় তাহার জন্য বেদই মূখ্য প্রমাণ । 


বেদের মহত্ব বর্ণনা করে মনু মহারাজ আরো বলেছেন -


বিভর্তি সর্বভূতানি বেদশাস্ত্রং সনাতনম্।

তস্মদেতৎপরং মন্যে যজ্ঞন্তোরস্য সাধনম্।। 
(মনু০ ১২।৯৯)


অর্থাৎ সনাতন বেদশাস্ত্র সম্পূর্ণ জীবের সর্বদা ধারণ তথা পোষণ করেন এইজন্য ইহা প্রাণীবর্গের পরম সাধন।


এভাবে বেদ কে ধর্মের মূল তথা সনাতন ঈশ্বরীয় জ্ঞান জানার পরও একটি শঙ্কার উদ্ভব হয় যে, মুণ্ডকোপনিষৎ ১।১।৫ তে বেদসমূহকে অপরাবিদ্যা বলা হয়েছে। যথা,

তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ

শিক্ষা কল্পো ব্যকরণং নিরুক্তং ছন্দ জ্যোতিষমমিতি।

অথ পরা যয়া তদক্ষরসমধিগম্যতে।।


অর্থাৎ বিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প ব্যকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিষ ইহা অপরা বিদ্যা এবং যাহা দ্বারা সেই অবিনাশী পরমাত্মা প্রাপ্ত হয়, তাহা পরা বিদ্যা।


এস্থলে সবারই এই ভ্রান্তি যে ঋগ্বেদাদি চার বেদ "অপরা" বিদ্যা এবং উপনিষদ্ পরাবিদ্যা অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যার গ্রন্থ। তাহলে প্রশ্ন এই যে, বেদে কি পরা বিদ্যা নেই। এ বিষয়ে গীতা প্রেস থেকে প্রকাশিত উপনিষদের উক্ত শ্লোকের ভাষ্যে বলা হয়েছে - এইভাবে চতুর্বেদ এবং ছয় বেদাঙ্গ- এই দশটি অপরা বিদ্যা। যার দ্বারা পরব্রহ্ম অবিনাশী পরমাত্মার তত্বজ্ঞান হয়,তাই পরা বিদ্যা। তার বর্ণনাও বেদেই বিদ্যমান। অতএব, এই অংশটুকু বাদ দিয়ে অবশেষ বেদ এবং বেদাঙ্গ অপরা বিদ্যার অন্তর্গত



এই ভাষ্যে স্পষ্ট যে, বেদেও পরাবিদ্যা রয়েছে। কেননা শুধুমাত্র উপনিষদই যদি পরাবিদ্যার গ্রন্থ হতো তবে যেই প্রকার এখানে অপরা বিদ্যার গ্রন্থের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে সেই প্রকারে পরা বিদ্যার গ্রন্থের সংখ্যাও গণনা করা হতো, কিন্তু তা করা হয় নি। এতে স্পষ্ট যে উপনিষৎকারের পরা এবং অপরা উভয় বিদ্যাই বেদে অভিপ্রেত।

এখন দেখার বিষয় এই যে, বেদ দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় কি না? এ বিষয়ে সর্বপ্রথম গীতার মান্যতা দেখুন - 
গীতার ১৫ অধ্যায়ের ১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো" অর্থাৎ সমস্ত বেদ দ্বারা আমি (পরমাত্মাই) জানার যোগ্য।


 শঙ্করাচার্য্যও তার ভাষ্যে বলেছেন - "বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব চ পরমাত্মা বেদ্যা বেদিতব্যঃ" অর্থাৎ সর্ব বেদ দ্বারা পরমাত্মাই জানার যোগ্য। গীতার এই শ্লোক স্পষ্ট করে দেয় যে, বেদ দ্বারা পরমাত্মাকে জানা যায়।

কঠোপনিষৎ ২।১৫ তে বলা হয়েছে
" সর্বে বেদা যত্ পদমামনন্তি তপা্ঁসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি ৷ " অর্থাৎ চার বেদ যাহার স্বরূপের বর্ণনা করে এবং সকল তপস্যা যাহার বর্ননা করে সেই পদ কে তোমার জন্য সংক্ষেপে বলছি। 


উপনিষদের এই বক্তব্যেও স্পষ্ট যে, চার বেদ সেই পরম পদের বর্ননা করে।


মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে,

দ্বে ব্রহ্মণী বেদিতব্যে শব্দব্রহ্ম পরং চ যৎ।
শব্দব্রহ্মণি নিষ্পাতঃ পরং ব্রহ্মাধিগচ্ছতি।। 
(মহাঃ শান্তি পর্ব ২৩২।৩০)

অর্থাৎ বেদ ও বেদ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম উভয়ই পরিজ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বেদশাস্ত্র বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন, তিনিই অনায়াসে পরব্রহ্ম লাভে সমর্থ হন। 

এখানে, আরো সুস্পষ্ট যে, বেদশাস্ত্র কেউ বিশেষভাবে অবগত হতে পারলে সে পরমব্রহ্ম লাভ করতে পারে।


বেদ স্বয়ং বলছে -

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্যাতি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়।। (যজু ৩১।১৮)
-- অর্থাৎ আমি সেই মহান পূর্ণ পরমেশ্বর কে সূর্যের সমান তেজস্বী এবং অন্ধকারের পরে জানি। তাকে জেনেই মৃত্যুকে পার করা যায়, এছাড়া মোক্ষলাভের জন্য জন্য অন্য কোন মার্গ নেই।


এরপরও কোন মূর্খ বলবে যে, বেদ দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না। এখন কেউ যদি কুতর্ক করে একগুঁয়ে স্বভাব ধরে বলে, না, শুধু উপনিষদই পরাবিদ্যার গ্রন্থ তাহলে বলতে হয় উপনিষদের তালিকায় প্রথম যে, ঈশোপনিষদ্ তা তো পুরোটাই যজুর্বেদের ৪০ তম অধ্যায়। এখানে আপনি যদি এই উপনিষদকে পরাবিদ্যার গ্রন্থ মান্য করেন তবে তো পরোক্ষভাবে বেদেই পরাবিদ্যা মান্য করলেন। শুধু ঈশোপনিষদ্ নয়, যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায় তো অধিকাংশ উপনিষদেরই বিভিন্ন জায়গাতে বেদের মন্ত্র সরাসরি এসেছে। যথাঃ



কঠোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।১।১৮ (ঋগবেদ ৩।২৯।২)
(ii) অধ্যায় ২।১।৯ (অথর্ববেদ ১০।৮।১৯)
(iii) অধ্যায় ২।২।২ (যজুর্বেদ ১০।২৪)

শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২। ১-৫ (যজুর্বেদ ১১।১-৫)
(ii) অধ্যায় ৩।১৪-১৫ ( যজুর্বেদ ৩১।১-২)
(iii) অধ্যায় ৩। ৫-৬ (যজুর্বেদ ১৬।২-৩)

প্রশ্নোপনিষৎ
(i) প্রথম প্রশ্ন ১১ ( ঋগবেদ ১।৬৪।১২)

ঐতেরীয়পনিষৎ >
(i) শিক্ষাবল্লী প্রথম অনুবাক (ঋগবেদ ১।৯০।৯)
(ii) শিক্ষাবল্লী দ্বাদশ অনুবাক (যজুর্বেদ ৩৬।৯)

বৃহদারণ্যকোপনিষৎ
(i) অধ্যায় ২।৫।১৬ (ঋগবেদ ১।১১৬।১২
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৭ (ঋগবেদ ১।১১৭।২২)
(ii) অধ্যায় ২।৫।১৯ ( ঋগবেদ ৬।৪৭।১৮)

যে মুণ্ডকোপনিষদে পরা অপরার ভেদ দেখানো হয়েছে সে উপনিষদেও বেদের মন্ত্র এসেছে। যথা,
(i) মুণ্ডক ২।২।১ (অথর্ববেদ ১০।৮।৬)
(ii) মুণ্ডক ৩।১।১ (ঋগবেদ ১।১৬৪।২০)

অতএব বেদ যদি অপরা বিদ্যার গ্রন্থই হয়ে থাকে তবে পরা বিদ্যার গ্রন্থ উপনিষদে বেদের মন্ত্র কেন গ্রহন করা হলো। এ থেকে স্পষ্ট যে, বেদে শুধু অপরা বিদ্যাই নেই বরং পরা বিদ্যাও রয়েছে। অর্থাৎ "স পর্য্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণম্" যজু০ ৪০।৮ ইত্যাদি মন্ত্রে যেখানে পরমব্রহ্মের প্রতিপাদন করা হয়েছে তাহা "পরা" বিদ্যা, আর যেখানে অগ্ন্যাদি ভৌতিক পদার্থের যজ্ঞপোযোগী হওয়ার বর্ণনা অথবা বিবাহ,উপনয়নাদি সংস্কারের বর্ণনা রয়েছে তাহা "অপরা" বিদ্যা। এখানে অপরা কোন নিন্দাসূচক শব্দ নয়, বিষয়ের প্রকারের দৃষ্টি দ্বারা বিদ্যার পরা অপরা দুটি ভেদ দেখানো হয়েছে। এখন যদি কেউ বেদ পাঠ করে অর্থ না বুঝে বলে যে, বেদে পরা বিদ্যা নেই সেটা তার মূর্খতা। যাস্কাচার্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন -

স্থাণুরয়ং ভারহারঃ কিলাভূদধীত্য বেদং ন বিজানাতিয়োহর্থম্।
য়োহর্থজ্ঞইত্যকলং ভদ্রমশ্নুতে নাকমেতি জ্ঞানবিধূতপাপ্মা।।
(নিরুক্ত নৈগম কাণ্ড ১/১৮)

-- অর্থাৎ- যে বেদ পড়ে তাহার অর্থ বোঝে না সে শুধু ভারবহনকারীই হয়, কিন্তু যে বেদের অর্থ বুঝতে পারে, সে সমস্ত সুখ আর কল্যাণ প্রাপ্ত হয়। সে ওই পবিত্র জ্ঞানের দ্বারা পাপকে নষ্ট করে পরমানন্দ রূপে মোক্ষ প্রাপ্ত করে নেয়।

মহাভারতেও একই কথা বলা হয়েছে,

য়ো বেদে চ শাস্ত্রে চ, গ্রন্থধারণতপ্তরঃ।
ন চ গ্রন্থার্থতত্বজ্ঞঃ, তস্য তদধারণংবৃথা।।
ভারং স বহতে তস্য, গ্রন্থস্যার্থ ন বেক্তি য়ঃ।
য়স্তু গ্রন্থার্থতত্বজ্ঞো, নাস্য গ্রন্থাগমোবৃথা।।
(মহাঃভারত শান্তিপর্ব অঃ ৩০৫/১৩-১৪)

--অর্থাৎ যে বেদ এবং শাস্ত্রীয় গ্রন্থকে ধারণ করতে তৎপর, কিন্তু তার যথার্থ তত্ত্বকে না বোঝে তার এ ধারণ করা বৃথা। যে গ্রন্থের অর্থকে না বোঝে সে কেবল উক্ত গ্রন্থের ভারই বহন করে। কিন্তু যে গ্রন্থের অর্থ বুঝতে পারে তার জন্য সেই গ্রন্থের অধ্যয়ন ব্যর্থ নয়।




অতএব নিষ্কর্ষ এই যে, বেদ অপরা বিদ্যার সাথে সাথে পরাবিদ্যারও গ্রন্থ। মধ্যকালে কিছু সাম্প্রদায়িক লোক প্রচার করেছে বেদে পরা বিদ্যা নেই। কিন্তু আমরা দেখিয়েছি বেদেও পরাবিদ্যার সমাহার রয়েছে, অপরদিকে উপনিষদ শুধুমাত্র পরা অথবা অধ্যাত্মবিদ্যারই গ্রন্থ, এতে লৌকিক জীবনের বর্ণনা নেই। কিন্তু সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাণ্ডার যে বেদ তা কেবল পরা বিদ্যার গ্রন্থ না হয়ে অপরাবিদ্যারও গ্রন্থ। বেদ যেখানে ব্রহ্মবিদ্যার মূল, তদ্রুপভাবে মানুষের লৌকিক অথবা ভৌতিক জীবনের জন্য অপৈক্ষিত অনান্য জ্ঞানেরও আদিমূল।