মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর জ্ঞান, সমাজ সংস্কার ও বেদভাষ্যের জন্য ভারতের ইতিহাসে এমন এক মহান স্থান জুড়ে আছেন যে তাঁকে আধুনিক ভারতের পিতামহ বলা হয়ে থাকে।
তাঁর রচিত বেদভাষ্য আজ বিশ্বনন্দিত। যখন সারা বিশ্ব থেকে মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বেদ নিয়ে অপপ্রচার করে, তখন তার হাত থেকে রক্ষা পেতে সকলে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ও আর্যসমাজের বেদভাষ্য ব্যবহার করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পূর্বোক্ত সেই সকল ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীগণও
সেই সকল ভণ্ডরা যখনই মহর্ষির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, তখনই তাদের মুখচন্দ্রিকায় পাদুকার চপেটাঘাত করে অপপ্রচারে দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়। এখন তাঁরা নতুন গান ধরেছে, দয়ানন্দ সরস্বতীকে কেন মহর্ষি বলা হয়। দয়ানন্দজীকে নাকি মহর্ষি বলা অশাস্ত্রীয়। সেইসব মূর্খরা নিজেদের জ্ঞানী বলে প্রচার করে কিন্তু তাদের জ্ঞানের লেভেল যে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে, তা আজকের লেখা পড়লে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রথমে কথা বলি ঋষি শব্দটি নিয়ে। আমরা সকলে জানি, সংস্কৃত ভাষায় একটি শব্দের একাধিক অর্থ থাকে। তেমনি প্রাচীন শাস্ত্রে 'ঋষি' শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। নিরুক্তে বলা আছে, "ঋষিণাং মন্ত্রদৃষ্টয়ো ভবন্তি" [নিরুক্ত- ৭।৩] অর্থাৎ নানা প্রকার অভিপ্রায় দ্বারা ঋষিদের মন্ত্রদর্শন হয়।
এটি মূলত বৈদিক ঋষিদের মুখ্যার্থ। কিন্তু এখন প্রশ্ন হতে পারে, বেদমন্ত্র দ্রষ্টা ছাড়া অন্য মানুষও কি ঋষি হতে পারেন? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, হতে পারেন। কারণ মহাভারত, রামায়ণসহ বিভিন্ন গ্রন্থে ব্যাসদেব, যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখকে অসংখ্য বার মহর্ষি,ঋষি ইত্যাদি বলা হয়েছে। এই তালিকা এতই দীর্ঘ যে তা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। এনারা কিন্তু বেদ মন্ত্র দ্রষ্টা ছিলেন না। আবার মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে 'মহষয়ঃ' শব্দের ভাষ্য করতে গিয়ে মেধাতিথি লিখেছেন, "ঋষির্বেদঃ। তদধ্যয়ন-বিজ্ঞান
মেধাতিথির এই উক্তি হতে বোঝা যায়, যে কোনো মানুষ যদি বেদজ্ঞানী হয়, তবে তাঁর উপর ঋষি শব্দ প্রয়োগ হতে পারে। আবার ঋষি বলতে এমন জ্ঞানীদের বোঝায়, যাঁরা বেদের মন্ত্রের অর্থ বা তাৎপর্য সঠিক ভাবে জানতে পারেন। এই বিষয়ে শতপথ ব্রাহ্মণে [৬।১।১।১] বলা আছে, "তে যৎ পুরা অস্মাৎ সর্বস্মাৎ ইদমিচ্ছন্তঃ শ্রমেণ তপসারিংষতস্মাদ্
শতপথের এই বাক্য থেকেও স্পষ্ট হয় যে, শুধু মন্ত্র দ্রষ্টাই ঋষি নন, যারা কঠোর পরিশ্রম বা তপস্যা করে বেদ মন্ত্রের সঠিক তাৎপর্য জানতে পারেন, তাঁরাই ঋষি। আর এখন যদি আমরা বেদজ্ঞানী বা বেদ মন্ত্রের সঠিক অর্থের কথা বলি, তবে এক বাক্যেই স্বীকার্য যে, দয়ানন্দ সরস্বতীজীর বেদভাষ্যেই বেদের প্রকৃত অর্থ প্রকাশ পেয়েছে।
https://
আর দয়ানন্দজীর এই অপূর্ব বেদভাষ্য রচনার পেছনে ছিলো তাঁর দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিরুক্ত, নিঘণ্টু, অষ্টাধ্যায়ী, মহাভাষ্য, ব্রাহ্মণাদি অধ্যয়ন করেছেন। এরপরেই তিনি বেদভাষ্য রচনার মাধ্যমে বেদ মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ উদ্ঘাটন করেছেন। তাই শতপথ ব্রাহ্মণের উপর্যুক্ত বচন থেকে দয়ানন্দজীর ঋষিত্ব সিদ্ধ হয়।
এছাড়া বেদজ্ঞানী মানুষ যে ঋষিপদ বাচ্য, এই বিষয়ে আরও প্রমাণ রয়েছে। বোধায়ন ধর্মসূত্রের ২।৬।৩৬ সূত্রে ঋষি শব্দটি রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় গোবিন্দ স্বামী লিখেছেন, 'ঋষি মন্ত্রার্থজ্ঞঃ'
https://
এরপরও যদি সেইসকল কুৎসারটনাকারীগণ
দয়ানন্দজীর বেদ ব্যাখ্যা যে কি পরিমাণ অতুলনীয় তা শুধু তাঁর 'ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা' গ্রন্থটি পড়লে সহজেই অনুধাবন করতে পারা যায়। এমনকি সেইসব ধর্মব্যবসায়ী, যারা বেদে ইতিহাস খোঁজে, তাদের পশ্চিমা পিতা ম্যাক্সমুলারও মহর্ষির ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা পড়ে বলেছেন, "সংস্কৃত সাহিত্য শুরু হয় ঋগ্বেদ দিয়ে এবং শেষ হয় দয়ানন্দের ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা দিয়ে।" [উৎস- ম্যাক্সমুলারের 'আমরা ভারত থেকে কি শিখবো' নামক সংকলিত ভাষণের তৃতীয় ভাষণ]
এছাড়াও Max Muller এর লেখা তাঁর কিছু পছন্দের ব্যক্তির জীবনী দেখুন যার ভেতর দয়ানন্দ জী স্থান পেয়েছেন
https://
আমরা Max Mullerএর আদর্শ হয়তো সমর্থন করি না, বা উনি ও পুরোপুরি আর্যসমাজের আদর্শ মানেন নি; উনি প্রথম জীবনে খৃস্টান মিশনারিদের কাজ নিয়ে ভারতে আসলেও শেষ জীবনে অনুরক্ত ছিলেন বেদ ও সনাতনী শাস্ত্র নিয়ে। তাঁর Gifford Lectures এ তিনি বলেছেন,
"বেদ যে সময়েই আসুক না কেন, বেদের বাণীর ঐশ্বরিকত্ব ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কেউ সন্দেহ করতে পারবে না।"
এবার আসি অন্য দিকে, নিরুক্ত পরিশিষ্টে বলা হয়েছে, "মনুষ্যা বা ঋষিষূৎক্রামৎসু দেবানব্রুবননকো ন ঋষির্ভবিষ্যতীতি
[নিরুক্ত- ১৩।১২ তথা নিরুক্ত পরিশিষ্ট- ১।১২]
অর্থাৎ প্রাচীন কালে মনুষ্যগণ দেবতাদের (বিদ্বানদের) প্রশ্ন করেছিলেন যে, মনুষ্যদের মধ্যে কারা ঋষি হবেন। এর উত্তরে দেবতাগণ (বিদ্বানগণ) বলেছিলেন যে, তর্কই ঋষি। অর্থাৎ যাঁরা তর্কের মাধ্যমে গবেষণা পূর্বক বেদার্থ বুঝতে পারবেন, তাঁরাই আর্ষ ঋষি।
নিরুক্ত পরিশিষ্টের এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, তর্কের মাধ্যমে যাঁরা বেদার্থ জ্ঞাত হন, তাঁরাই ঋষি। এখন দয়ানন্দজীর জীবনী যদি আপনারা দেখেন, তবে দেখতে পারবেন তিনি এক জীবনে সহস্রাধিক তর্কসভায় অংশ গ্রহণ করেছেন এবং বিজয়ী হয়েছিলেন। এমনকি এমনও অবস্থা হয়েছে, মহর্ষির সাথে তর্কে না পেরে তৎকালীন পণ্ডিতগণ অনেক কূটকৌশল, ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই এমন সুতার্কিক বেদজ্ঞকে কি মহর্ষি বলাটা অন্যায়, অশাস্ত্রীয়?
এখন সেইসব কুচক্রী, অপপ্রচারকারী গন্ধমূষিকগণ নিশ্চয়ই ত্যানা নিয়ে বসবেন যে, এসব গ্রন্থে তো প্রাচীন কালের ঋষিদের কথা বলা হয়েছে। আধুনিক যুগের কেউ কিভাবে ঋষি হতে পারে? এর উত্তর হচ্ছে, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ও অরবিন্দ বুঝি প্রাচীন বৈদিক যুগের মানুষ? বঙ্কিমচন্দ্রকেও
যাই হোক, আধুনিক যুগে দয়ানন্দজীকে শুধু ঋষি না বলে মহর্ষি বলা হবে কেন, তা না হয় আরেক আধুনিক ঋষি অরবিন্দের মুখেই শুনে নিন।
অরবিন্দের "বঙ্কিম-তিলক-দয
https://
ঋষি অরবিন্দের কথাতেই মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর জ্ঞান, বেদভাষ্যের উৎকৃষ্টতা প্রকাশিত হচ্ছে। এমন ঋষিকে মহর্ষি না বলে আর কি বা বলা যায়?
পুনশ্চ, যেসব কুচক্রীর মনে বড়ই বেদনা যে কেন দয়ানন্দজীকে মহর্ষি বলা হবে, তারাই কিন্তু আবার নরেন্দ্র মোদী ২য় বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শ্রদ্ধেয় নরন্দ্রে মোদীকে 'রাজর্ষি' সম্বোধন করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছিলো। এখন সেইসব কুচক্রী যদি মহর্ষিকে নিয়ে শ্রদ্ধেয় নরেন্দ্র মোদীজীর এই ভিডিওটা দেখতো, তবে নিশ্চয়ই তারা দয়ানন্দজী ও আর্যসমাজকে নিয়ে মিথ্যাচার করার আগে একবার ভেবে দেখতো।
https://
https://
যোগী আদিত্যনাথের মুখে শুনুন সত্যার্থ প্রকাশ এর প্রশস্তি
এখানে তিনি বলছেন, জনৈক মুসলিম হিন্দু হবার জন্য তাঁর কাছে আসলে সবার আগে গীতা আর সত্যার্থ প্রকাশ পড়তে বলেন তিনি।
এরা আরো বলে আর্যসমাজ নাকি কমিউনিস্ট!এ
এরা এমনকি এটাও জানে না যে ১৯৪০ সালের আগে আর এস এস এও আর্যসমাজের প্রার্থনা অনুসারে প্রার্থনা করা হত। RSS এর অফিসিয়াল মুখপত্র organiser এও এই কথার উল্লেখ পাওয়া যায়।
https://
এদের মিথ্যাচারের কারণ সহজেই বোঝা যায়! এরা চায় বেদকে নিজের বাপের সম্পত্তি বানিয়ে রাখতে, যদিও বেদের ব্যাখ্যা বাপজন্মেও বোঝার ক্ষমতা নাই! কিংবা বেদের একটা মন্ত্রের অর্থ বোঝাও সম্ভব না তাদের দ্বারা! তাই আজ যখন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসরণ করে ভারতে ছড়িয়ে থাকা আর্যসমাজের আদর্শ বাংলা অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ক্রমশ, বাংলায় বেদ চর্চা বাড়ছে, তখন এসব ব্রাহ্মণদের জ্বলুনি হওয়া স্বাভাবিক বটে!
আর এক মিথ্যাচার এরা কত দিনই বা করবে? এক হরিয়ানার কবিরপন্থী রামপাল মহর্ষির নামে মিথ্যাচার করে আজ নারী কেলেঙ্কারির দায়ে জেলে রয়েছে। কয়েকদিন পর যে বাংলার সেই রামপালের অবৈধ যৌন কেলেঙ্কারিতুতো সন্তান, ব্যাঙের মতো লম্ফকারী, সারমেয় ও বরাহের ক্রাস ছানাটির ভাগ্যেও রামপালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? কাজেই অনলাইনে ধর্মচক্রের নামে মধুচক্র চালানো রাম রহিম, রামপাল, আশারাম বাপুর ভবিষ্যৎ বাংলা ভার্সন থেকে সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হল।
0 মন্তব্য(গুলি)