https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বরুণের রথ ও ঈশ্বরের সাকারত্ব নিরাকরণ

Friday, May 29, 2020


অধুনা পৌরাণিকবৃন্দ ঈশ্বরকে সাকার প্রমাণে নানাবিধ প্রমাণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। তাদের দাবি অনুযায়ী ঈশ্বর রথে করে ভক্তের ডাকে পৃথিবীতে আগমন করেন। আসুন তাদের এই দাবির যথার্থতা যাচাই করি ।

দর্শং নু বিশ্বদর্শতং দর্শং রথমধি ক্ষমি ।
এতা জুষত মে গিরঃ ।। 

ঋগ্বেদ ১.২৫.১৮

সায়ণ ভাষ্যঃ "বিশ্বদর্শতং সর্বৈর্দর্শনীয়ম্ অস্মদনুগ্রহার্থমত্রাবির্ভূতং বরুণং "দর্শং "নু অহং দৃষ্টবান্ খলু । " ক্ষমি ক্ষমায়াং ভূমৌ"রথং বরুণসংবন্ধিনম্ "অধি “দর্শম্ আধিক্যেন দৃষ্টবানস্মি । "এতাঃ উচ্যমানাঃ "মে “গিরঃ মদীয়াঃ স্তুতীঃ "জুষত বরুণঃ সেবিতবান্ ॥ দর্শম্ । দৃশেঃ ‘ইরিতো বা ' (পা. সূ. ৩. ১. ৫৭ ) ইতি চেঃ অঙাদেশঃ । ‘ঋদৃশোঽঙি গুণঃ' (পা. সূ. ৭. ৪. ১৬ ) ইতি গুণঃ । বিশ্বদর্শতম্ । দৃশেঃ ‘ ভৃমৃদৃশি° ' ( উ. সূ. ৩. ৩৯০ ) ইত্যাদিনা অতচ্প্রত্যযান্তো দর্শতশব্দঃ । মরুদ্বৃধাদিৎবাৎ পূর্বপদান্তোদাত্তৎবম্ ( পা. সূ. ৬. ২. ১০৬. ২ )। যদ্বা । বিশ্বং দর্শনীয়মস্যেতি বহুব্রীহিঃ । ‘বহুব্রীহৌ বিশ্বং সংজ্ঞায়াম্ ' ইতি পূর্বপদান্তোদাত্তৎবম্ । ক্ষমি । আতো ধাতোঃ ' (পা. সূ. ৬. ৪. ১৪০) ইত্যত্র আতঃ ইতি যোগবিভাগাৎ আকারলোপঃ ॥ বরুণপ্রঘাসেষু ‘ইমং মে বরুণ ' ইতি বারুণস্য হবিষঃ অনুবাক্যা । ‘পঞ্চম্যাং পৌর্ণমাস্যাম্' ইতি খণ্ডে সূত্রিতম্-' ইমং মে বরুণ শ্রুধি তত্ত্বা যামি ব্রহ্মণা বন্দমানঃ ' ( আশ্ব. শ্রৌ. ২. ১৭) ইতি ॥


রমেশচন্দ্র দত্তঃ সকলের দর্শনীয় বরুণকে আমি দেখেছি, ভূমিতে তার রথ বিশেষ করে দেখেছি, আমার স্তুতি তিনি গ্রহণ করেছেন।
শ্রীদূর্গাদাস লাহিড়ী শর্ম্মা  অনুবাদ করেছেনঃ 

সেই সর্ব্বদর্শী ভগবানকে আমি নিশ্চয় দেখিয়াছি ; পৃথিবীতে তাঁহার গতিবিধি সম্যকরূপে আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে ৷ আমার উচ্চারিত স্তোত্রসমুদায় তাঁহার নিকট পৌছিয়েছে । ( তিনি আমার স্তোত্র সমুদয় প্রাপ্ত হইয়াছেন) 


Ralph T.H. Griffith, [1896] - 
Now saw I him whom all may see, I saw his car above the earth:
He hath accepted these my songs.
[ https://www.sacred-texts.com/hin/rigveda/rv01025.html  ]

লক্ষ্যণীয় শ্রী দূর্গাদাস লাহিড়ী তার অনুবাদে কোথাও রথের কথা উল্লেখ করেননি । তাহলে এই রথ আসলে কি ? বৈষ্ণবগণ কি এখানের বরুণকে ঈশ্বর মানেন নাকি দেবতা ?    সর্বব্যাপক ঈশ্বরের রথ কিভাবে থাকে এবং তিনি যখন সর্বত্রই বিরাজমান তার রথের আবশ্যকতা কি ?  রথের উপাদান কি ও তিনি কি রূপে তাতে ভ্রমণ করেন ?  রথে করে ভ্রমণ করে কোথায় এবং কোন স্থানে এসেছেন তার প্রমাণ  কি ? 

আমরা কিছু শব্দ নিয়ে আগে পর্যালোচনা করি -
▶ ক্ষমিঃ-  সায়ণাচার্য এই ক্ষমিকে পরিবর্তন করে লিখেছেন 'ক্ষমি ক্ষমায়াং ভূমৌ' । কিন্তু নিঘণ্টু ১.১ এ  পৃথিবীর নাম হিসেবে আছে - ক্ষা, ক্ষ্মা এবং ক্ষমা । 


এখান থেকে পৃথিবী অর্থ করা নিতান্তই কষ্টকল্পনা মাত্র এবং ব্যাকরণ সিদ্ধও নয় । সায়ণাচার্য সাকারপ্রিয়তার ঝোঁকে আশেপাশে পাণিনীয় সূত্র ব্যবহার করলেও এই স্থলে মোটেও তা করেননি । কারণ তিনিও জানেন এরপক্ষে কোন প্রমাণ নেই ।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী এর ব্যাখ্যা করেছেন -
(ক্ষমি) ক্ষাম্যন্তি সহন্তে জনা যস্মিন্ ব্যবহারে তস্মিন্ স্থিৎবা । অত্র কৃতো বহুলম্ ইত্যধিকরণে ক্বিপ্ । বা ছন্দসি সর্বে বিধয়ো ভবন্তি ইতি অনুনাসিকস্য ক্বিঝলোঃ ক্ঙিতি । (অষ্টা০৬.৪.১৫) ইতি দীর্ঘো ন ভবতি


▶ দর্শং - সাধারণতঃ অর্থ দেখা । কিন্তু শাস্ত্রপ্রমাণে ঈশ্বর নিরাকার, শুদ্ধসত্ত্ব, সর্বব্যাপক প্রমাণিত । 
(1)ঈশ—৮ (অকায়ম্ বা শরীর রহিত)
(2)কেন—১/৩ (ঈশ্বরকে চোখে দেখা যায় না)
(3)কেন—১/৭ (যেসব দৃশ্যমান বস্তুর লোকে উপাসনা করে সেগুলো ব্রহ্ম বা ঈশ্বর নয়।)
(4)কঠ—১/২/২২(অশরীরী)
(5)কঠ—১/৩/১৫(অরূপ বা রূপহীন)
(6)কঠ—২/৩/৮(অলিঙ্গ বা লিঙ্গহীন বা চিহ্নহীন)
(7)কঠ—২/৩/৯(চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না)
(8)কঠ—২/৩/১২(ব্রহ্ম-বাক্য,মন,চক্ষুর অগোচর)
(9)প্রশ্ন—৪/১০(অশরীরী)
(10)মুণ্ডুক—১/১/৬(অপাণিপাদম্ অচক্ষুশোত্রম্ অর্থাৎ ব্রহ্মের হাত,পা,চক্ষু,কর্ণ নেই।)
(11)মুণ্ডুক—২/১/২(অমূর্ত)
(12)মুণ্ডুক—৩/১/৭(অচিন্ত্যরূপ বা ব্রহ্মের রূপ চিন্তা করা সম্ভব নয়)
(13)মুণ্ডুক—৩/১/৮(চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না।)
(14)তৈত্তেরীয়—২/৭/২(ব্রহ্ম দর্শনাতীত এবং অশরীরী)
(15)শ্বেতাশ্বতর—২/১৫(জন্ম রহিত)
(16)শ্বেতাশ্বতর—৩/১০(অরূপ বা রূপহীন)
(17)শ্বেতাশ্বতর—৩/১৯(অপাণিপাদম্ অর্থাৎ ব্রহ্মের হাত পা নেই)
(18)শ্বেতাশ্বতর—৪/১(বর্ণ রহিত)
(19)শ্বেতাশ্বতর—৪/১৯(মূর্তি বা প্রতিমা নেই)
(20)শ্বেতাশ্বতর—৪/২০(চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন)
(21)শ্বেতাশ্বতর—৪/২১(জন্ম রহিত)
(22)শ্বেতাশ্বতর—৫/১৪(অশরীরী)
(23)শ্বেতাশ্বতর—৬/৮(ব্রহ্মের শরীর এবং ইন্দ্রিয় নেই)
(24)শ্বেতাশ্বতর—৬/৯(লিঙ্গ বা চিহ্ন নাই এবং তাঁর কোন জনক বা পিতা নেই)
বেদাদি মন্ত্রের ত্রিবিধ অর্থ হয় । সুতরাং আধিদৈবিক বা আধিভৌতিক অর্থে দর্শন  বা পশ্য অর্থ দেখা হলেও আধ্যাত্মিক ভাবে এর অর্থ নিজ হৃদয়ে ও সর্বত্র উপলব্ধি  ।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী আধিদৈবিক অর্থে লিখেছেন - 

(দর্শম্) পুনঃ পুনর্দ্রষ্টুম্


পণ্ডিত ধর্মদেব বিদ্যামার্তণ্ড উক্ত অর্থের পক্ষে অতিরিক্ত প্রমাণ উদ্ধৃত করে লিখেছেন -

দর্শতঃ - দৃশেঃ ভৃম দৃশিয়জিপর্বি পচ্যমিতমিনমি হর্য্যিভ্যৌsতচ্


প্রসঙ্গতঃ অনেকেই ইংরেজি অনুবাদে Seen বা see দেখলে অবোধের ন্যায় উল্লাস প্রকাশ করে থাকেন । আমাদের তাদের নিকট প্রশ্ন যদি অর্থ  দেখা-ই হয় তাহলে পাঠক্রমে দর্শন নামক বিষয়ের পঠিতব্য বিষয় কি ?  সেখানে দর্শন অর্থ  কি ?  আমরা ঋষিদের বলি মন্ত্রদ্রষ্টা । তারা মন্ত্রার্থ দর্শন করেছিলেন। তাহলে সেই মন্ত্র বা অর্থ  কি তাদের চোখের সমানে দেবনাগরী হরফে স্ক্রিনের ন্যায় ভেসে উঠেছিলো ?  নিশ্চয়ই নয় । তাহলে দর্শন অর্থ যে উপলব্ধি তা সহজেই অনুমেয় । আর বেদেই স্পষ্টতঃ আমরা উল্লেখ পাই পরমাত্মাকে হৃদয়ে অনুভবের কথা -

অতঃ উক্ত মন্ত্রের অর্থ আমরা পাচ্ছি -

সংস্কৃতভাষ্যঃ (দর্শম্) পুনঃ পুনর্দ্রষ্টুম্ (নু) অনুপৃষ্টে (বিশ্বদর্শতম্) সর্বৈর্বিদ্বদ্ভির্দ্রষ্টব্যং জগদীশ্বরম্ (দর্শম্) পুনঃ পুনঃ সম্প্রেক্ষিতুম্ (রথম্) রমণীয়ং বিমানাদিয়ানম্ (অধি) উপরিভাবে (ক্ষমি) ক্ষাম্যন্তি সহন্তে জনা যস্মিন্ ব্যবহারে তস্মিন্ স্থিৎবা । অত্র কৃতো বহুলম্ ইত্যধিকরণে ক্বিপ্ । বা ছন্দসি সর্বে বিধয়ো ভবন্তি ইতি অনুনাসিকস্য ক্বিঝলোঃ ক্ঙিতি । (অষ্টা০৬.৪.১৫) ইতি দীর্ঘো ন ভবতি (এতাঃ) বেদবিদ্যাসুশিক্ষাসংস্কৃতাঃ (জুষত) সেবধ্বম্ (মে) মম (গিরঃ) বাণীঃ ।


ভাষানুবাদঃ হে মনুষ্যগণ ! তুমি (অধিক্ষমি) যে ব্যবহার দ্বারা উত্তম এবং নিকৃষ্ট কথাকে সহ্য করতে হয়, তাতে স্থিত হয়ে  (বিশ্বদর্শতম্) যে বিদ্বানগণের জ্ঞানদৃষ্টিতে দর্শনযোগ্য পরমেশ্বর রয়েছেন, তাঁকে (দর্শম্) বারংবার দেখা (রথম্) বিমান আদি যানসমূহকে- (নু) -ও  (দর্শম্) পুনঃ-পুনঃ দেখে সিদ্ধ করার জন্য (মে) আমার (গিরঃ) বাণীসমূহকে (জুষত) সদা সেবন করো ।
মন্ত্রের ভাবার্থ হল - ক্ষমাদি গুণসমূহে  যুক্ত মনুষ্যগণের জানা উচিৎ যে  প্রশ্ন এবং উত্তরের ব্যবিহার ব্যতীত পরমেশ্বরকে জানা এবং শিল্পবিদ্যা সিদ্ধ বিমানাদি রথসমূহ  তৈরী সম্ভব নয় এবং  তাতে যা গুণাদি রয়েছে, তা বিজ্ঞান তথা বিশেষ রূপে জ্ঞাত হওয়ার জন্য সদা প্রচেষ্টা করা উচিৎ । 

[ ভাষ্যকারঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ]


আধ্যাত্মিক পক্ষে -
(নু) নিশ্চিতরূপে (অধিক্ষমি)ক্ষমাদি সদগুণযুক্ত আমি (বিশ্বদর্শতম্) সমগ্র দৃশ্যমান জগতের প্রভুকে (রথম্) নিজের শরীরের অভ্যন্তরে (দর্শম্) হৃদয়দেশে দর্শন করি৷ এই প্রভু (মে) আমার (এতাঃ) এই (গিরঃ) স্তুতিকে (জুষত) প্রীতিপূর্বক গ্রহণ করেছেন ।

[ ভাষ্যকারঃ পণ্ডিত শিবশঙ্কর শর্ম্মা ]


🚩 প্রসঙ্গতঃ এখানে রথ= শরীর
১.
'যদনো বা রথং বা শরীরম্'  [মৈত্রেয়ানী সংহিতা০ ৪।৮।৩]


২. 
আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং  রথমেব তু ৷
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ ৷৷
কঠোপনিষদ ১.৩.৩ 
পদার্থঃ হে নচিকেতা! (আত্মানম্) জীবাত্মাকে (রথিনম্) রথী (বিদ্ধি) জানবে (তু) এবং (শরীরম্) শরীরকে (এব) নিশ্চিতরূপে (রথম্) রথ জানবে (তু) এবং (বুদ্ধি) বুদ্ধিকে (সারথি) সারথি (বিদ্ধি) জানবে (চ) এবং (এব) নিশ্চিতরূপে (মনঃ) মনকে (প্রগ্রহম্) লাগাম জানবে।।৩।।

সরলার্থঃ হে নচিকেতা! জীবাত্মাকে রথী এবং শরীরকে নিশ্চয়রূপে রথ জানবে, বুদ্ধিকে সারথি এবং মনকে লাগাম বলে জানবে।।৩।।



৩.
এখানে শরীরকে রথের উপমা বিশেষ প্রয়োজনে দেওয়া হয়েছে। কারণ সমস্ত প্রাণিদের মধ্যে মানব শরীরই জ্ঞানপ্রাপ্তি তথা সুখ ভোগের উত্তম অদ্বিতীয় সাধন। নিরুক্তে রথের অর্থ স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে - "রথঃ রহতের্গতিকর্মণঃ স্থিরতের্বা স্যাদ্ বিপরীতস্য রমমাণোহস্মিংস্তিষ্ঠতীতি বা রয়তের্বা রসতের্বা।" (নিরুক্ত ৯.১১)।


আর সাকাররূপ ধারণের কথাই যদি আসে তাহলে বৈষ্ণবদের পঞ্চমবেদ বা মহাপ্রামাণ্য এক লক্ষ(?) শ্লোকের প্রামাণিক (?) মহাভারতের আমরা তো দেখি বরুণ পরপত্নী হরণে ব্যস্ত । বেদে কি এই বরুণের আমরা দর্শন(?) পাই ?  আগ্রহী পাঠক অনুশাসন পর্বের ১৫৪তম অধ্যায় পড়ে দেখতে পারেন  -