https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

পুরুষসূক্তে উল্লেখিত পুরুষের যথার্থ স্বরূপ

Wednesday, December 30, 2020


সম্প্রতি ফেসবুকে একদল নব্য বেদ ব্যাখ্যাকারের আবির্ভাব হয়েছে৷ তারা বেদের মূল ভাবগত অর্থ বিশ্লেষণ করতে না পেরে বেদ মন্ত্রের আক্ষরিক অনুবাদ প্রচার করে নিজেদের বেদ জ্ঞানী ভাবতে শুরু করেছে৷ কিন্তু তারা যে এভাবে বেদাঙ্গ অনুসরণ না করে বেদকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টার মাধ্যকে বেদের অপব্যাখ্যা করছে সেটি তুলে ধরার জন্যই আজকের এই লেখা৷

আজকে আমরা পুরুষ সূক্তে আলোকপাত করব। পুরুষ সূক্ত বেদের একটি বিখ্যাত সূক্ত৷ এই সূক্তে ১৬টি মন্ত্র রয়েছে৷ এই সূক্তটি ঋগ্বেদে, যজুর্বেদে, অথর্ববেদে পাওয়া যায়৷ এছাড়া সামবেদ, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, শতপথ ব্রাহ্মণ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদসহ প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থে পুরুষ সূক্তের কিছু মন্ত্র পাওয়া যায়। তবে পুরো পুরুষ সূক্ত নিয়ে কথা বলে সময় ও আলোচনা উভয়ই দীর্ঘায়িত না করে শুধু এর প্রথম মন্ত্রটি নিয়ে আলোচনা করে সেইসব বেদ অপব্যাখ্যাকারীদের মূর্খতা সকলের সামনে তুলে ধরা হবে।
পুরুষ সূক্তের প্রথম মন্ত্রটি হলো—

সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ । 
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ।।

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ এই মন্ত্রে 'ইহা স্বয়ং পুরুষেরই রূপ, কাল্পনিক বা রূপক জাতীয় কিছু না।'

দাবী খণ্ডনঃ

আপনাদের এই দাবী যথেষ্ট হাস্যকর এবং অজ্ঞানতামূলক। এই মন্ত্রে 'পুরুষ' শব্দটি দেখে আপনারা খুশিতে ঈশ্বরকে একজন পুরুষ (পুং) হিসেবে দাবী করছেন৷ এতে আপনাদের ব্যাকরণগত, নিরুক্তগত এবং বৈদিক গ্রন্থগত জ্ঞানহীনতা স্পষ্ট হয়। কারণ–

১. 'পুরুষ' শব্দটির ব্যাকরণগত বিশ্লেষণে দেখা যায় এটি 'পৃ' ধাতু দ্বারা গঠিত৷ পাণিনিয় ধাতুপাঠেদের 'চুরাদি' গণে এই ধাতুটির অর্থ লেখা 'পৃ পুরণে'। অর্থাৎ 'পৃ' ধাতুর অর্থ হলো 'পূর্ণ'। এর সাথে উণাদি (৪।৭৪) 'পুরঃ কুষন্' সূত্র অনুসারে 'কুষন্' প্রত্যয়যোগে 'পুরুষ' শব্দটি গঠিত হয়। অর্থাৎ পুরুষ শব্দটির ধাত্বার্থক অর্থই হলো 'পূর্ণ'।



২. নিরুক্তে (২।৩) পুরুষ শব্দের ব্যাখ্যায় যাস্কাচার্য এভাবে বলেছেন,
"পুরুষঃ পুরিষাদঃ পুরিশয়ঃ পূরতর্তর্বা। পূরয়ত্যন্তরিত্যন্তঃ পুরুষমভিপ্রেত্য। 'যস্মাৎ পরং নাপরমস্তি কিঞ্চিদ্ যস্মান্নাণীয়ো ন জ্যায়োহস্তি কিঞ্চিদ্। বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকস্তেনেদং পুর্ণং পুরুষেণ সর্বম্' ইতি নিগমো ভবতি।" 

অর্থাৎ পুরিতে (ব্রহ্মাণ্ডে) বসার কারণে অথবা পুরিতে (ব্রহ্মাণ্ডে) শয়ন করার কারণে পুরুষ বলা হয়। অথবা এটি বৃদ্ধয়র্থক পুরী ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়। অন্তঃপুরুষ পরমাত্মাকে পুরুষ এজন্য বলা হয় যে, তিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে নিজের সত্তা দ্বারা পূর্ণ করে আছেন। এই বিষয়ে বলা হয়েছে 'যস্মাৎ পরং....পুরুষেণ সর্বম্'। 

এখানে নিরুক্তে পুরুষ শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে উদাহরণ স্বরূপ যাস্কাচার্য তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০।১০।২৩ তথা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৩।৯ মন্ত্রটি উল্লেখ করে প্রমাণ দেখিয়েছেন যে 'পুরুষ হলেন সর্বব্যাপী পরমেশ্বর'।




আপনাদের সুবিধার্থে মন্ত্রটির অনুবাদ দেওয়া হলো–

য়স্মাৎ পরং নাপরমস্তি কিঞ্চিদ্ য়স্মান্নাণীয়ো ন জ্যায়োऽস্তি কশ্চিৎ।
বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকস্তেনেদং পূর্ণং পুরুষেণ সর্বম্।।

সরলার্থঃ যাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কিছুই নেই, যাঁর থেকে সূক্ষ্ম ও মহান্ কেউ নেই, যিনি প্রকাশময় স্বরূপে বৃক্ষের ন্যায় নিশ্চলভাবে বিরাজমান, সেই এক ও অদ্বিতীয় পূর্ণ পরমাত্মা দ্বারা এই সম্পূর্ণ জগৎ পরিব্যাপ্ত।



৩. বেদের ব্যাখ্যানরূপ যে ব্রাহ্মণগ্রন্থ লিখিত হয়েছে সেখানেও পুরুষ শব্দের ব্যাখ্যা এরূপে করা হয়েছে– 

"ইমে বৈ লোকাঃ পূরয়মেব পুরুষো যোহয়ং পবতে সোহস্যাং পুরি শেতে তস্মাৎপুরুষঃ" 
(শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩।৬।২।১) 

অর্থাৎ এই লোক (বিশ্বব্রহ্মাণ্ড) হলো পুর। এবং পুরুষ হচ্ছেন তিনি, যিনি বাহিত হন। তিনি এই পুরে ব্যাপকরূপে শয়ন করেন জন্য তিনি পুরুষ।



উপর্যুক্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণের সাহায্যে বোঝা যাচ্ছে, এখানে পুরুষ কোনো পুং ব্যক্তি বিশেষ নয়৷ বরং সর্বব্যাপী পরমাত্মাকেই এখানে পুরুষ বলা হচ্ছে৷ তাই এই মন্ত্রে উল্লেখিত পুরুষের বর্ণনা যে রূপক তা এখানে স্পষ্ট৷ 

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ আপনাদের এসব ব্যাখ্যা ভুল। এসব আমরা মানি না৷ আপনারা মিথ্যাচার করছেন......।

দাবী খণ্ডনঃ বাহ্ ভাই, বাহ্ ! এসব ব্যাখ্যা তো আমাদের নিজস্ব নয়৷ বরং আর্ষ ঋষিগণ এসব ব্যাখ্যা করে গেছেন। এসব না মানার কোনো উপায় নাই আপনাদের৷

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ এসব ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ আমরা মানি না। আমাদের দাবী হলো 'এই পুরুষের বর্ণনা যে রূপক বা কাল্পনিক' তা কোথাও থেকে সরাসরি দেখান।

দাবী খণ্ডনঃ একটু ধৈর্য ধরুন মশাই৷ এত তাড়া কেন? নাকি অন্য কোনো বিষয়ে আবার অপব্যাখ্যা করতে দৌড় দিবেন জন্য তাড়ায় আছেন। আচ্ছা, যা হোক, এবার প্রমাণ দেখাচ্ছি। 
ঋগ্বেদের এই সূক্তের ১১নং মন্ত্রের প্রথমাংশে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে– 

"যৎপুরু॑ষং॒ ব্যদ॑ধুঃ কতি॒ধা ব্য॑কল্পয়ন্।  
মুখং॒ কিম॑স্য॒ কৌ বা॒হূ কা ঊ॒রূ পাদা॑ উচ্যেতে॥" 
এই মন্ত্রে দেখুন স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, যখন পুরুষকে সংকল্পরূপ উৎপাদন করা হলো, তারপর পুরুষকে কতভাবে 'কল্পনা' করা হলো (ব্যকল্পয়ন্ = বি + অকল্পয়ন্) ? মুখ কি হলো, বাহু কি হলো, উরু এবং পাদকে কি বলা হলো? 



তাই এই মন্ত্রের মাধ্যমেই প্রমাণ হয় যে, সেই পূর্ণ পরমাত্মার যে মুখ, হাত, পা ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে সেগুলো মূলত কল্পনাকৃত, বাস্তব নয়। 

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ এসব আপনাদের ভুল ব্যাখ্যা। আপনারা বেদের ভুল ব্যাখ্যাকারী। আর্যসমাজীরা ছাড়া এভাবে এই মন্ত্রে কেউ এভাবে এই পুরুষকে কল্পনা করার কথা বলে নাই। 

দাবী খণ্ডনঃ তাই নাকি ! রমেশচন্দ্রের অনুবাদ পড়েই নিজেকে বড় পণ্ডিত ভাবছেন ? আপনাদের ভাবপিতা সায়ণাচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে যা বলেছেন, সেটারই অনুবাদ করে উপরে দিয়েছি। বিশ্বাস না হলে নিজেই সায়ণভাষ্য দেখে নিন– 

"প্রশ্নোত্তররূপেণ ব্রাহ্মণাদিসৃষ্টিং বক্তুং ব্রহ্মবাদিনাং প্রশ্না উচ্যন্তে। প্রজাপতেঃ প্রাণরূপা দেবাঃ 'যৎ' যদা 'পুরুষং' বিরাড্রূপং 'ব্যদধুঃ' সংকল্পেনোৎপাদিতবন্তঃ তদানীং 'কতিধা' কতিভিঃ প্রকারৈঃ 'ব্যকল্পয়ন্' বিবিধং কল্পিতবন্তঃ। 'অস্য' পুরুষস্য 'মুখং' 'কিম্' আসীৎ। 'কৌ' 'বাহূ' অভূতাম্ 'কা' 'ঊরূ'। কৌ চ 'পাদাবুচ্যেতে'। প্রথমং সামান্যরূপঃ প্রশ্নঃ পশ্চাৎ মুখং কিমিত্যাদিনা বিশেষ বিষয়াঃ প্রশ্নাঃ॥"




অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ তাহলে যে এই মন্ত্রে 'সহস্র শীর্ষ, সহস্র চক্ষু, সহস্র পাদ' এসবের উল্লেখ আছে তার কী হবে? এগুলো তো সরাসরি ঈশ্বরের হাজার মাথা, চোখ, পা এসব নির্দেশ করছে। 

দাবী খণ্ডনঃ প্রথমত আমরা পূর্বেই প্রমাণ করে এসেছি যে এখানে পুরুষ শব্দ দ্বারা সর্বব্যাপী, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পূর্ণ পরমাত্মাকে বোঝাচ্ছে, কোনো পুং পুরুষকে বোঝাচ্ছে না৷ আবার এটিও দেখানো হয়েছে যে এই পুরুষের মাথা, পায়ের বর্ণনা বাস্তব নয়, কল্পনা করে নেওয়া৷ তাই এই স্থানে যে শীর্ষ, চক্ষু, পাদ শব্দগুলো রয়েছে এগুলো উপলক্ষণ মাত্র। কিসের উপলক্ষণ ? এখানে 'সহস্র' শব্দের অর্থ হলো 'বহু'। নিঘণ্টু ৩।১ এ উল্লেখ আছে 'সহস্র ইতি বহুনাম'। 



এখানে 'শীর্ষ' দ্বারা সেই পরমাত্মার মাথা বোঝাচ্ছে না। বরং পরমাত্মা সর্বব্যাপী হওয়ায় পরমাত্মার মধ্যেই সকল প্রাণীর মস্তিষ্ক তথা দেহ অবস্থিত৷ তাই এখানে সেই পরমাত্মাকে সহস্রশীর্ষ বলা হয়। আবার এখানে চক্ষু শব্দ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের উপলক্ষণ৷ অর্থাৎ পরমাত্মা সর্বপ্রকারের জ্ঞানযুক্ত। আর পাদ শব্দটি একই ভাবে কর্মেন্দ্রিয়ের উপলক্ষণ৷ 

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ এসব অনুবাদ ভুল। এসব আর্যসমাজীদের ভুল ভাষ্য। এরকম ব্যাখ্যা আর্যসমাজ ছাড়া কেউ স্বীকার করে না। তাই আমরা এসব মানব না। আপনারা অপপ্রচারকারী....ব্লা ব্লা ব্লা। 

দাবী খণ্ডনঃ হে হে। জানতাম আপনারা এটাই বলবেন। তাই আমি উপরে যে ব্যাখ্যাগুলো দিলাম সেগুলো কোনো আর্যসমাজী বেদভাষ্যকারের ব্যাখ্যা থেকে দেইনি৷ বরং আপনারা শুতে ও বসতে যাদের নাম জপ করেন, যাদেরকে নিজেদের ভাব পিতা হিসেবে স্বীকার করেন সেই সায়ণের ঋগ্বেদ ১০।৯০।১ এর ভাষ্য ও মহীধরের যজুর্বেদ ভাষ্যের ৩১।১ থেকে দিয়েছি৷ বিশ্বাস না হলে নিজেই দেখে নিন। সায়ণ বলেছেন– 
"সর্বপ্রাণিসমষ্টিরূপো ব্রহ্মাণ্ডদেহো বিরাডাখ্যো যঃ পুরুষঃ সোঽয়ং সহস্রশীর্ষা। সহস্রশব্দস্যোপলক্ষণৎবদনন্তৈঃ শিরোভির্যুক্ত ইত্যর্থঃ। যানি সর্বপ্রাণিনাং শিরাংসি তানি সর্বাণি তদ্দেহান্তঃপাতিত্বাত্তদীয়ান্যেবেতি সহস্রশীর্ষত্বম্ । এবং সহস্রাক্ষিত্বং সহস্রপাদত্বং চ। 'সঃ' পুরুষঃ 'ভূমিং' ব্রহ্মাণ্ডগোলকরূপাং 'বিশ্বতঃ' সর্বতঃ 'বৃত্বা' পরিবেষ্ট্য 'দশাঙ্গুলং' দশাঙ্গুলপরিমিতং দেশম্ 'অত্যতিষ্ঠৎ' অতিক্রম্য ব্যবস্থিতঃ। দশাঙ্গুলমিত্যুপলক্ষণম্। ব্রহ্মাণ্ডাদ্বহিরপি সর্বতো ব্যাপ্যাবস্থিত ইত্যর্থঃ॥"


আর মহীধর বলেছেন– 

"অব্যক্তমহদাদিবিলক্ষণশ্চেতনো যঃ পুরুষঃ 'পুরুষান পরং কিংচি'দিত্যাদিশ্রুতিষু প্রসিদ্ধঃ সর্বপ্রাণিসমষ্টিরূপো ব্রহ্মাণ্ডদেহো বিরাজাখ্যোঽস্তি। কীদৃশঃ। সহস্রশীর্ষা সহস্রশব্দো বহুলবাচী। সংখ্যাবাচকবে সহস্রাক্ষ ইতি বিরোধঃ স্যাৎ নেত্রসহস্রদ্বয়েন চ ভাব্যম্। ততঃ সহস্রমসংখ্যানি শীর্ষাণি শিরাংসি যস্য সঃ 'শীর্ষশ্ছন্দসি' (পা০ ৬।১।৬০) ইতি শিরঃশব্দস্য শীর্ষন্নাদেশঃ। শিরোগ্রহণং সর্বাবয়বোপলক্ষণম্। যানি সর্বপ্রাণিনাং শিরাংসি তানি সর্বাণি তদেহান্তঃপাতিবাৎ তস্যৈবেতি সহস্রশীর্ষবম্। এবমগ্রেঽপি। সহস্রাক্ষঃ সহস্রমক্ষীণি যস্য সঃ। অক্ষিগ্রহণং সর্বজ্ঞানেন্দ্রিয়োপলক্ষকম্। সহস্রপাৎ সহস্রং পাদা যস্য 'সংখ্যাসুপূর্বস্য' (পা০ ৫।৪।১৪০) ইতি পাদস্যান্ত্যলোপঃ। পাদগ্রহণং কর্মেন্দ্রিয়োপলক্ষণম্। সঃ পুরুষো ভূমি ব্রহ্মাণ্ডলোকরূপাং সর্বতঃ তির্যক্ ঊর্ধ্বমধশ্চ স্পৃৎবা ব্যাপ্য। স্পৃণোতির্ব্যাপ্তিকর্মা। যদ্বা ভূমিশব্দো ভূতোপলক্ষকঃ। পঞ্চ ভূতানি ব্যাপ্য দশাঙ্গুলপরিমিতং দেশমধ্যতিষ্ঠৎ অতিক্রম্যাবস্থিতঃ। দশাঙ্গুলমিত্যুপলক্ষণম্। ব্রহ্মাণ্ডাদ্বহিরপি সর্বতো ব্যাপ্যাবস্থিত ইত্যর্থঃ। যদ্বা নাভেঃ সকাশাদ্দশাঙ্গু। লমতিক্রম্য হৃদি স্থিতঃ।।"







অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ যাই হোক না কেন। আমরা আমাদের বাপের কথাও মানবো না৷ কারণ 'সর্বপ্রাণীর শির তাঁর মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় তিনি সহস্রশীর্ষ' এটির বিষয়ে কোনো প্রমাণ নাই। যারা এটি দাবী করে তারা "শঠ, বাটপার"। 

দাবী খণ্ডনঃ একটি প্রবাদ আছে 'মূর্খের অশেষ দোষ'। আপনাদের হয়েছে সেই অবস্থা৷ আপনারা নিজে শাস্ত্র না পড়ে এসেছেন নিজেদের শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত দাবী করতে! শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়টি একটু দেখে আসুন। সেখানে এই 'সহস্রাশীর্ষ পুরুষঃ' মন্ত্রের ব্যাখ্যায় আমাদের উপরের ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করছে৷ নিজেই দেখে নিন। এখন নিশ্চয় উপনিষদকার ঋষিদের গালাগাল করে নিজেদের অভ্রতার পরিচয় দিবেন না।

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ আমাদের আক্ষরিক অনুবাদই ঠিক৷ এরকম ব্যাখ্যা যৌক্তিক নয়। আপনারা 'ঈশ্বরকে নিরাকার বলার মাধ্যমে মূলত ঈশ্বরকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে ফেলছেন। ঈশ্বরকে অসম্পূর্ণ হিসেবে প্রচার করছেন।'

দাবী খণ্ডনঃ নিরাকারের মাধ্যমে কখনো ঈশ্বরকে প্রতিবন্ধী (পাঠক মণ্ডলী এদের শব্দচয়ন কতটা জঘন্য সেটা লক্ষ করুন৷ ঈশ্বরকে 'প্রতিবন্ধী' বলার মতো ধৃষ্টতা এরা দেখাচ্ছে) হিসেবে তুলে ধরা হয় না। কারণ আমরা তাঁকে পূর্ণ হিসেবে মানি। আর যিনি পূর্ণ তিনি কখন হীন হন না৷ বরং আপনাদের অক্ষর টু অক্ষর অনুবাদ যথেষ্ট সমস্যা যুক্ত। কারণ এই অনুবাদের কারণেই ঈশ্বরকে আপনারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক হিসেবে তুলে ধরতে পারছেন না (আমরা কখনই ঈশ্বরের জন্য 'প্রতিবন্ধী' জাতীয় অপশব্দ ব্যবহার করতে চাই না)। কেননা আপনাদের অক্ষর টু অক্ষর অনুবাদ অনুসারে ''পুরুষ নামক ঈশ্বর হলেন হাজার মাথা বিশিষ্ট, হাজার চোখ বিশিষ্ট, হাজার পা বিশিষ্ট।" এখন এখানে সকলে মনোযোগ দিন। যদি এটিই ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ হতো তবে হাজার মাথা বিশিষ্ট পুরুষের চোখ হওয়া উচিত দুই হাজার আবার পাদও হওয়া উচিত দুই হাজার। সেই হিসেবে মন্ত্রটা হওয়া উচিত ছিলো 'সহস্রাশীর্ষা পুরুষঃ দ্বিসহস্রাক্ষঃ দ্বিসহস্রাপাৎ'। আবার এই মন্ত্রে পুরুষের হাতের উল্লেখ নাই। তার মানে কি ঈশ্বর হস্তহীন ? আবার এই সূক্তের ৩য় মন্ত্রেই বলা হচ্ছে সেই পুরুষ চতুষ্পাদ৷ তাঁর একপাদে এই বিশ্বজগত প্রতিষ্ঠিত আর বাকি তিনপাদ প্রকাশময় অমৃতে অবস্থিত। দেখুন– "পাদো॑ঽস্য॒ বিশ্বা॑ ভূ॒তানি॑ ত্রি॒পাদ॑স্যা॒মৃতং॑ দি॒বি॥" 
তাই পূর্বোক্ত মন্ত্রের সহস্রপাদ রূপক না হয়ে বাস্তব হলে আবার এই মন্ত্রে সহস্র পাদকে বাদ দিয়ে চতুষ্পাদের উল্লেখ থাকতো না৷ ফলে আপনাদের আক্ষরিক অনুবাদই অযৌক্তিক ও ভুল। এখানে মূলত ঈশ্বরের সর্বব্যাপিতা ও মহিমা বোঝায়।

অপব্যাখ্যাকারীদের দাবীঃ না, মানে না৷ ইয়ে, ইয়ে। (মনে মনে– আসলে কি যে বলি। এদের এখন দুই চারটা গালি দিই। তারপর এরা গালির প্রত্যুত্তরে গালি দিলে এদের গালির স্ক্রিনশট নিয়ে এদের বিরুদ্ধে সাধারণ হিন্দুদের কাছে অপপ্রচার করতে হবে) আপনারা সাধারণ হিন্দুদের শত্রু, আপনারা মূর্খ, আপনারা মূর্তিপূজা মানেন না, আপনারা হিন্দু না। আপনারা ব্লা ব্লা ব্লা....


বি.দ্র. উক্ত মন্ত্রটির যথার্থ অনুবাদ নিচে পাঠকদের সুবিধার্থে দেওয়া হলো—

সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ । 
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ।।

পদার্থঃ (পুরুষঃ) সমগ্র জগতে পূর্ণ পরমাত্মা (সহস্রশীর্ষা) অনন্ত জ্ঞানবান অথবা তাঁর মধ্যে অসংখ্য প্রাণীর শীর্ষ অবস্থিত, তিনি (সহস্রাক্ষঃ) সর্বদ্রষ্টা অথবা তাঁর মধ্যে অসংখ্য প্রাণীর চক্ষু অবস্থিত, তিনি (সহস্রপাৎ) সর্বত্র গতিবান অথবা তাঁর মধ্যে অসংখ্য প্রাণীর পাদ অবস্থিত। (সঃ) তিনি (ভূমিম্) বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে (বিশ্বতঃ) সব দিক থেকে (বৃত্বা) ব্যাপ্ত করে (দশাঙ্গুলম্) দশ আঙুল পরিমাণ স্থূল ও সূক্ষ্ম দশভূত যুক্ত জগকেও (অত্যতিষ্ঠৎ) অতিক্রম করে বর্তমান রয়েছেন।

সমাপ্ত