https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

পৌরাণিক উপাসকের উপাস্যের স্বরূপ বিভ্রান্তি

Friday, November 19, 2021


বেদাদি শাস্ত্র সমূহে প্রতিমা বা মূর্তির কথা নেই তা সুধী ও স্বাধ্যায়ী পাঠকগণ মাত্রেই অবগত। তবে পৌরাণিক ভ্রাতাগণ তা মানতে অপারগ ও খুবই স্বাভাবিক। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো তারা বলে , " আমরা গর্বিত আমি মূর্তি পূজারী হিন্দু ।" আবার সেই মুখেই বলে , " আমরা মূর্তি পূজা করি না , মূর্তির অবলম্বনে পূজা করি ।" মায়াবাদীসহ তথাকথিত পরম্পরাবাদীগণ সবাই মানে যে তারা মূর্তির নয় মূর্তিতে পূজা করে । তাহলে আমরা যদি মূর্তিকে ঈশ্বর জ্ঞানে উপাসনা করতে নিষেধ করি তাহলে তাদের জ্বলুনির কারণ কি ? অবশ্য কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক প্রসূত কুচক্রী স্ববিভ্রান্তিতে পরা লোকজন সাকারবাদের ভ্রান্তিতে পরে সেই ভ্রান্তিকে সত্য প্রমাণের জন্য ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে এবং নানা প্রকার হাস্যকর যুক্তি দিয়ে থাকে । আবার যখন তাদেরই প্রিয় পরম্পরাবাদী ভাষ্যকারগণকে টেক্কা দিয়ে [ যারা কিনা নিজেরাই বেদের কদর্থ করেছেন ] পূর্বাপর বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব স্বার্থে আরো বিকৃত অর্থ করে এবং প্রতিমা পূজা বেদে অনুমোদন সেটা দেখানোর নির্বোধ শিশুর ন্যায় প্রয়াস করে । প্রকৃতপক্ষে ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে , যবন , জাকির, পেট্রোডলার এসব কিছু নির্দিষ্ট শব্দগুচ্ছ প্রয়োগ ব্যতীত তাদের কাজই নেই । কী করে তা এরা নিজেরাই জানে না । অবশ্য শাস্ত্রজ্ঞানহীন ও অসংস্কৃতজ্ঞ এমন বহুচারী মানুষ আসলে কি চায় সেটা খুব সহজেই অনুমেয় -


  • প্রথমতঃ তারা নিজেরাই বলেন মূর্তির নয় মূর্তিতে পূজা করে । তাহলে মূর্তির পূজা নিষেধ করলে এতো জ্বলে কেন ? নাকি আমাদের বক্তব্যই ঠিক যে তারা মূর্তিরই উপাসক ?

  • দ্বিতীয়তঃ সাকারবাদী পৌরাণিকদের নিজস্ব গ্রন্থ পুরাণাদিসহ তন্ত্রের অসংখ্য স্থানে লেখা আছে যে মূর্খরাই মূর্তিতে ঈশ্বরবুদ্ধি করে । অর্থাৎ তাতে মূর্তিতে উপাসনা অনুমোদিত হলেও মূর্তিই ঈশ্বর এমনটা বলেনি । তাহলে যদি অনুবাদে মূর্তিকে ঈশ্বর জ্ঞানে উপাসনা করতে নিষেধ থাকে তাহলে তাদের জ্বলুনির কারণ কি ?
যদি জ্বলে থাকেন তো তারা জানাক ডাক্তার ও বার্নল দুটোই পৌঁছে দেওয়া হবে ।

  • তৃতীয়তঃ যজুর্বেদের যেখানে সম্ভূতি ও অসম্ভূতি বা বিদ্যা ও অবিদ্যার উপাসনার নিষিদ্ধতা তাহলে করেন কেনো ? অবশ্য আধ্যাত্মিকতার নামে জড় বস্তুবাদ ও বস্তুর উপাসকদের তা বোধগম্য হবে না ।


  • চতুর্থতঃ প্রতিমা কখনোই ঈশ্বর নয় [ যেটা আপনার ইদানীং দাবি করেন । এতোদিন ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা একটা মাধ্যম বলে শুধুমাত্র বিরোধীতার নিমিত্তে কারা এসব প্রচার করে তাদের মানসিক অবস্থা ও জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে বৈকি । কারণ প্রতিমা কখনোই ঈশ্বরের সরাসরি স্বরূপ নয় । সচ্চিদানন্দ তো নয়ই ।
▶️ পুরাণাদিসহ তন্ত্রে মূর্তি পূজার অবশ্যই হাজার হাজার বিধান আছে তবে আদতেই সেখানে প্রতিমাই ঈশ্বর এমন প্রায় নেইই। বরং প্রতিমা সম্বন্ধে কী বলা হয়েছে তা পর্যালোচনা করা যাক -

অহং সর্ব্বেষু ভূতেষু ভূতাত্মামস্থিতঃ সদা॥
তমবজ্ঞায় মাং মর্ত্ত্যঃ কুরুতেহর্চ্চাবিড়ম্বন্ম॥
ভাগবতম্ ৩|২৯|২১
অন্বয়ঃ- অহং সর্ব্বেষু ভূতেষু সদা অবস্থিতঃ ভূতাত্মা (তেষাং ভূতানাম্ আত্মা চ অস্মি) । তং (মাম্) অবজ্ঞায় ( তত্র মম দৃষ্টকম্ অকৃত্বা) মর্ত্ত্যঃ (মরণধর্ম্মশীলঃ দেহাত্মাভিমানী) অর্চ্চাবিড়ম্বনং (অর্চ্চা এব বিড়ম্বনং অনুকরণং) কুরুতে (অর্চ্চায়াম্ এব মাম্ অর্চ্চিত) ॥  
অনুবাদ- (সর্ব্বভূতে কৃষ্ণ ও কার্ষ্ণ-দর্শন দ্বারাই চিত্তের প্রসন্নতা লাভ হয় । প্রকৃত ভক্তের কেবল প্রতিমাদি নিষ্ঠা নিন্দা করিয়া বলিতেছেন-) মাতঃ , আমি অন্তর্য্যামিরূপে নিখিল জীবের অন্তরে অবস্থিত ; যে মর্ত্ত্যজীবসমূহ আমার অধিষ্ঠানভূত প্রাণিসমূহে কার্ষ্ণবুদ্ধি না করিয়া বস্তুতঃ আমারই অবমাননা করেন , তাঁহারা প্রাকৃতবুদ্ধিতে যে প্রতিমাদি পূজা করিয়া থাকেন , তাহার দ্বারা শ্রী অর্চ্চার অবজ্ঞাই করা হয় । 


যো মাং সর্ব্বেষু ভূতেষু সন্তমাত্মানমীশ্বরম॥
হিত্বার্চ্চাং ভজতে মৌঢ্যাদ্ভস্মন্যেব জুহোতি সঃ॥
ভাগবতম্ ৩|২৯|২২

অন্বয়ঃ- সর্ব্বেষু ভূতেষু আত্মানং (পরমাত্মানং) ঈশ্বরম্ (অন্তর্য্যামিনং) সন্তং (বিদ্যমানং) মাং হিত্বা (উপক্ষ্য) যঃ মৌঢ্যাৎ (মৌর্খ্যাৎ) অর্চ্চাং (প্রতিমাং) ভজতে (সেবতে) সঃ ভস্মনি এব জুহোতি (তৎক্বতা পূজা ভস্মানি হোমবৎ নিষ্ফলা) l
অনুবাদ- যে ব্যাক্তি সর্ব্বভূতে বর্ত্তমান পরমাত্মা স্বরূপ আমাকে উপেক্ষা করিয়া মূঢ়তাবশতঃ কেবল লৌকিক রীতি অনুসারে প্রাকৃতবুদ্ধিতে অর্চ্চা-মূর্ত্তির পূজা করে , সে ব্যাক্তি ভস্মে আহুতি প্রদান করিয়া থাকে ।


মনস৷ কল্পিতা মূৰ্ত্তিনৃৰ্ণাং চেন্মোক্ষসাধনীঃ l
স্বপ্নলব্ধেন রাজ্যেন রাজানো মানবাস্তদা॥ ( মহানির্বাণ ১৪।১১৭ )
মৃচ্ছিলাধাতুদাৰ্ব্বাদিমুৰ্ত্তাবীশ্বরবুদ্ধয়ঃ l
ক্নিশ্যন্তস্তপসা জ্ঞানং বিনা মোক্ষং ন যান্তি তে॥ (মহানির্বাণ ১৪/১১৮)
অনুবাদঃ মনঃকল্পিত মূর্ত্তি যদি মনুষ্যগণের, মোক্ষ সাধিকা হয় , তাহা হইলে মানবগণ স্বপ্নলব্ধ রাজ্য দ্বারাও প্রকৃত রাজা হইতে পারে ।
মৃন্ময় , প্রস্তরময় , ধাতুময় বা কাষ্ঠদিময় মূর্ত্তি কে ঈশ্বর বোধ করতো তপস্যা দ্বারা ক্লেশ পায় ; কেননা , তত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত মুক্তি লাভ করিতে পারা যায় না ।


গৌড়ীয় টীকা ব্যাখ্যায় ভাগবতে শ্লোকে নানা প্রসঙ্গ যেমন এখানে প্রাকৃত ভক্ত= যারা অগ্নি, গো, ব্রাহ্মণ পূজা করে না ইত্যাদি করা হলেও শ্রীধর টীকায় কেবল মূল অনুযায়ীই ব্যাখ্যা করা হয়েছে । এখানে মূল তাৎপর্য যে মূর্তি মাত্রেই ঈশ্বর না তা গীতাপ্রেসের অনুবাদে আরো স্পষ্ট । 

মহানির্বাণের শ্লোক নিয়েও ' মনঃকল্পিত' শব্দটা নিয়ে অনেকে বলেন এখানে অশাস্ত্রীয় মূর্তির কথা বলা। যদিও যে এটা তা নয় সেটা ১১৮ নং শ্লোকেই বোঝা যাচ্ছে । 

যস্যাত্মবুদ্ধিঃ কুণপে ত্রিধাতুকে 
স্বধীঃ কলত্রাদিষু ভৌম ইজ্যধীঃ ।
যত্তীর্থবুদ্ধিঃ সলিলে ন কর্হিচি 
জ্জনেশষ্বভিজ্ঞেষু স এব গোখরঃ ৷৷ 
ভাগবত ১০.৮৪.১৩
 অন্বয়ঃ  যস্য ( জনস্য ) ত্রিধাতুকে ( বাতপিত্ত কফময়ে ) কুণপে ( শবতুল্যে দেহে ) আত্মবুদ্ধিঃ ( আত্মা প্রেমাস্পদং তদ্‌বুদ্ধির্বৰ্ত্ততে ) কলত্রাদিষু স্বধীঃ ( স্বীয়া ইমে ইতি বুদ্ধিবর্ৰ্ত্ততে ) ভৌমে ( পার্থিবপ্রতি মাদৌ ) ইজ্যধীঃ ( পূজ্যোহয়মিতি বুদ্ধির্বৰ্ত্ততে ) সলিলে ( নদ্য দিজলে ) যৎ তীর্থবুদ্ধিঃ ( যস্য তীর্থমিদমিতি বুদ্ধিবৰ্ত্ততে ) বহিচিৎ ( কদাচিদপি ) অভিষুে ( ভগ-বত্তত্ত্বজ্ঞেষু ) জনেষু ন ( তা বুদ্ধয়ো ন ভবন্তি ) সঃ ( তাদৃশো জনঃ ) গোখরঃ এব ( গৌশ্চাসৌ খরো গদ্দভশ্চেতি সঃ , উভয়সাধৰ্ম্মাদুভয়শব্দবাচ্যো ভবতি , কিম্বা গবামপি তৃণাদিভারবাহকো গৰ্দ্দভো ভবতি ) ৷৷ 

অনুবাদঃ যাঁহারা বাতপিত্ত কফময় এই শবতুল্য দেহকে পরমপ্রেমাস্পদ আত্মা , স্ত্রীপুত্রাদিকে আত্মীয় , পার্থিব প্রতিমাদিকে পূজনীয় দেবতা এবং নদ্যাদিস্থিত জলকে তীর্থ বলিয়া মনে করেন , কিন্তু ভগবত্তত্ত্বজ্ঞ সাধুগণকে তাদৃশ মনে করেন না , তাঁহারা গো এবং গৰ্দ্দভ উভয় সাধৰ্ম্মহেতু গো এবং গৰ্দ্দভ - পদবাচ্য অথবা গরুর তৃণাদি ভারবাহী গৰ্দ্দভ ৷৷ ১৩ ৷৷



প্রতিমাপূজারী সাকার তথা ভ্রান্তবাদীরা বলেন , " ঈশ্বর সমগ্র বিশ্বে ব্যাপ্ত । এসব সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয় । তাই তারা মূর্তি পূজা করে । তাতেই তারা উত্তম ফল লাভ করে । " 

  • আমরা অগ্রিম পাঠকগণকে জানিয়ে রাখি, পৌরাণিকগণ এর প্রত্যুত্তরে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা ও পুরাণে মূর্তি তৈরীর বিধান আছে এর বাইরে কিছুই দেখাতে পারবে না । যদিও আমরা পূর্বেই স্পষ্ট করেছি পুরাণের এসব বাক্য কেন আমরা ও কোন প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছি।

এদিকে তাদের পরম্পরাগত শঙ্করাচার্য তার শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৮/২২ এর ভাষ্যে লিখেছেন - 

" সমস্তবৎ সৰ্ব্ববিষয়সিব একস্মিন্ কাৰ্য্যে দেহে বহির্ব্বা প্রতিমাদৌ সক্তম্ ‘এতাবান্ এব আত্মা ঈশ্বরো বা নাতঃ অতত্বার্থবৎ , অহেতুকত্বাদেব অল্পং চ অল্পবিষত্বাদরফলত্বাদ্ বা তৎ তাসমুদাহৃতম্ ॥ তামসানাং হি প্রাণিনাম্ অবিবেকিনাম্ ঈদৃশৎ জ্ঞানং দৃশ্যতে ॥ 
অনুবাদঃ যে জ্ঞান একটি কাৰ্য্যে অর্থাৎ দেহে বা বাহু প্রতিমা প্রভৃতিতে ‘কৃৎস্নবৎ" সমস্তবৎ অর্থাৎ ইহাই আত্মা বা ইহাই ঈশ্বর , ইহা ছাড়া আর কিছু আত্মা বা ঈশ্বর হইতেই পারে না , এই ভাবে যেন সৰ্ব্ববিষয়ক হইয়া সক্ত হয় । যেমন নগ্ন ক্ষপণক জৈন ও বৌদ্ধ দার্শনিক প্রভৃতির মতে , জীব দেহপরিমাণ বা শরীরকে অনুবর্তন করে কিংবা ঈশ্বর কাঠাদিপরিমাণ মাত্র , সেইরূপ যে জ্ঞান একটি কোন কার্য্যে আসক্ত অথচ সর্ব্ববিষয়কবৎ প্রতীয়মান ; "অহেতুক" যাহার হেতু নাই অর্থাৎ যে জ্ঞান নিযুর্ক্তিক (যুক্তিহীন ) ; "অতত্বার্থবৎ" তত্বার্থ শব্দের অর্থ সত্য বস্তু , যে জ্ঞান সত্য বস্তুকে প্রকাশ করে , তাহা তত্ত্বার্থবৎ যে জ্ঞান তত্ত্বার্থবৎ নহে , তাহাই অতত্ত্বার্থবৎ ;’ অহেতুক বলিয়াই "অল্প" যাহার বিষয় অল্প বা যাহার ফল তুচ্ছ । এই প্রকার যে জ্ঞান তাহাই শাস্ত্রে তামস বলিয়া উদাহৃত হয় । তামস অর্থাৎ অবিবেকী প্রাণিগণেরই ঈদৃশ জ্ঞান হইয়া থাকে । "


এখানে শঙ্করাচার্য মূল শ্লোকের ভাষ্যে স্পষ্টই বলেছেন " ঈশ্বর সর্বব্যাপী অথচ যারা মৃত্তিকা প্রতিমাকে ঈশ্বর মনে করেন এবং তদতিরিক্ত ঈশ্বরের সত্তার ধারণা যাদের নেই তারা অবিবেকী ।" সুতরাং নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনায় অপারগ হওয়ার কারণে মূর্তি পূজার যুক্তিও অবিবেকী তা দেখা গেল ।

তাহলে বিজ্ঞ পৌরাণিক মহল কিভাবে মূর্তি , প্রতীক এগুলোর মাধ্যমে ঈশ্বরকে কল্পনা করতে চান বা তার গুণ কর্ম অনুসরণ করতে চান ?

ঈশ্বর সম্পূর্ণ নিরাকার আর তাকে নিরাকারভাবেই বেদমন্ত্রের দ্বারা ও আমাদের বেদোক্ত কর্মের মাধ্যমেই উপাসনা করতে হবে ।

ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে - 

💢 তদৈজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বান্তিকে..

অর্থাৎ ঈশ্বর মূঢ় ব্যক্তিদের নিকট থেকে দূরে আর জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিকটে । এটা ঔপচারিক । ঈশ্বর সর্বব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও মূঢ় ব্যক্তি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে না বলে ঈশ্বর থেকে দূরে সরে যায় । অন্যদিকে জ্ঞানী ব্যক্তি তার জ্ঞান , কর্ম , চিন্তা চেতনা দ্বারা ধীরে ধীরে সর্বব্যাপক ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন । তখন তার মনে হয় , ঈশ্বর তো আমাদের সবার মাঝেই আছেন । যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়েও বলেছেন অর্জুনকে । এই যে নিজ অন্তরে থাকা ঈশ্বরকে উপলব্ধি , এর দ্বারাই জ্ঞানী ব্যক্তি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেন । ঈশ্বরের সান্নিধ্য বাইরে লাভ করা যায় না , কারণ জীবাত্মা তো সীমিত একদেশী । সান্নিধ্য এমন স্থানেই লাভ করা যায় , যেখানে দুটো সত্ত্বার অবস্থান থাকে‌ ; জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলিত অবস্থান একমাত্র দেহের অভ্যন্তরেই । 

মন নিরাকার - অবয়বহীন । এখন এই মন‌ , বুদ্ধি, প্রাণ , জীবাত্মা প্রভৃতি অবয়বহীন বিষয় নিয়ে কাউকে বোঝাতে গেলে পৌরাণিক ভ্রাতাগণ কি ছবি আঁকবেন ? শক্তির বিষয়ে কোন বিজ্ঞানের ছাত্রকে পড়াতে গেলে কি ছবি আঁকব ? ফোটন যার ভর শূন্য তাকে কি ছবি এঁকে প্রকাশ করব ? 

ঐতরেয় উপনিষদ ৩/১/১০ এ বলা হয়েছে "প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম" অর্থাৎ জ্ঞানই ব্রহ্ম বা ব্রহ্ম জ্ঞানময় । আবার ব্রহ্ম তথা পরমাত্মা হলেন সর্বব্যাপক চেতন সত্তা যার ভিতরেই এই জগৎ অবস্থিত । এর খুব সুন্দর উদাহরণ হলো,একটি জলভর্তি গ্লাসে একটা কাগজের টুকরা ডুবালে যেমন জলের ভিতরে কগজের টুকরা ও কাগজের বাহিরে জল পূর্ণ থাকে তেমনি পরমাত্মার ভিতরেই এই জগৎ তথা এই জগতের সর্বস্থানেই পরমাত্মা রয়েছেন ঈ্শা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগতাৎ জগৎ । তাই তিনি আলাদাভাবে কখনোই আকার ধারণ করেন না বা তার আকার ধারণ করার কোনো যৌক্তিক আবশ্যকতা নেই । আকার ধারণ করতে দৃশ্যমান উপাদান লাগে অর্থাৎ একমাত্র জড় উপাদানই আকার ধারণ করে । পরমাত্মা হলেন জ্ঞানময় চেতন সত্তা আর চেতন সত্তার কোনো আকার নেই‌ । চেতন সত্তার আকার ধারণ করতে উপাদান লাগে (উদাহরণ হলো জীব) আর জড় উপাদানের সংস্পর্শে আসলে জড় বন্ধন ও জড়ত্বের দোষ প্রাপ্তি ঘটে । পরমাত্মা সকল প্রকার বন্ধনরহিত ও দোষ বিবর্জিত ।

যার রূপ নেই তাকে কল্পণা করবে কিভাবে ? তাহলে সেটা কাল্পনিক হয়ে গেলো বাস্তবিক না । ঈশ্বরের উপসনার বিধান বেদ-উপনিষদ মতে নিজের হৃদয়ে জড় পদার্থে না । কারণ আমরা চেতন, জড় পদার্থ না । জড় পদার্থের ভেতর জীবাত্মা থাকে না, আমাদের ভেততর জীবাত্মা থাকে । আর জীবআত্মা দ্বারাই পরমাত্মাকে দর্শন করতে হয় এটাই বেদ-বেদান্ত তথা উপাঙ্গে বলা আছে । সেই পরমেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে অপৌরষেয় জ্ঞানে বর্ণিত হচ্ছে যে - 


ঋগ্বেদ ১/৬৭/৩) অনুসারে পরমাত্মা অজর,
অজন্মা,সমস্ত কিছুর ধারণকর্তা (ঋগ্বেদ ৬/৫০/১৪) পরমেশ্বর সমস্ত জগতের একমাত্র রক্ষক এবং অজন্মা । (ঋগ্বেদ ১/১৭৪/৩ পরমৈশ্বর্যশালী পরমাত্মা অজন্মা । (ঋগ্বেদ ১/১০২/৮) পরমাত্মা সর্বদা বিদ্যমান , অনুপম , ঐশ্বর্যশালী । (ঋগ্বেদ ২/১৬/১) পরমাত্মা অজর,কখনো বার্ধক্য বা অন্য কোনো অবস্থা প্রাপ্ত হননা । (ঋগ্বেদ ১/৬৬/১,ঋগ্বেদ ১/১৪০/৭,ঋগ্বেদ ১/১৪১/২,ঋগ্বেদ ৩/২৫/৫) অনু ঈশ্বর নিত্য । .(যজুর্বেদ ৪০/৮) অনুসারে ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ সদা নিজের স্বরুপে বর্তমান । (অথর্ববেদ ১০/৮/১২) ঈশ্বর অনন্ত অর্থাৎ সর্বব্যাপক ।
যজুর্বেদ ৩২/৮) ঈশ্বর সর্বব্যাপক , বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা । তিনিই সমস্তকিছুর ভিতরে , সমস্তকিছুর বাহিরেও তিনিই বিদ্যমান(যজু ৪০/৫) । 
কোন সীমা যেই পরমেশ্বরকে বাঁধতে পারে নি , কোন অন্ত যেই পরমেশ্বরের অসীম ব্যাপ্তিকে সমাপ্ত করতে পারে নি এমন কোন শরীর, কোন আকার রয়েছে যা সেই অসীম স্বরূপকে ধারণ করবে ? বরং পরমাত্মা জগতের সমস্ত আকার - আকৃতি ও শরীরকে পূর্ণরূপে ব্যাপ্ত করে তা অতিক্রম করেও অনন্ত ব্যাপ্তিতে বিদ্যমান । তাই তিনি সমস্ত আকারের ঊর্ধ্বে , নিরাকারস্বরূপ । 

সাংখ্যসূত্রঃ
নিত্যমুক্তত্বম্।।১.১৬২।। 
সরলার্থঃ- পরমাতা সর্বজ্ঞ ও এক রস বলিয়া স্বতন্ত্র ও সদামুক্ত ।

ঔদাসীন্য চৈতি।।১.১৬৩।।
সরলার্থঃ- পরমাত্মা নির্লিপ্ত, প্রবৃত্তি রহিত, অভােক্তা ও পর্যাপ্ত কাম বলিয়া সদামুক্ত ও স্বতন্ত্র ।


এমন কোন মনুষ্য কি রয়েছে যে পরমেশ্বরের সেই অসীম স্বরূপকে কোন এক ছোট মূর্তিতে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ? এই পৃথিবী ও আকাশ যার ব্যাপ্তির অন্তকে প্রাপ্ত হতে পারে না (ঋক্ ১/৫২/১৪) সেই অসীম স্বরূপকে কে একটা ছোট্ট মূর্তির দ্বারা প্রকাশ করতে পারে? তাছাড়া কোনকিছুই যার সদৃশ হতে পারে না (ঋক্ ১/৫২/১৩) আপনি একটি মূর্তি বানিয়ে কিকরে বললেন যে এই মূর্তিটি সেই পরমাত্মার সদৃশ ? উপরন্তু কোন শরীর , কোন আকার যাকে পারেনা বাঁধতে সেই অসীম নিরাকার স্বরূপের মূর্তি কীসের ?

ঈশ্বর কেনো শুধুমাত্র আমাদের সাধারণ কল্পনা ও দৃষ্টিসীমায় থাকা বস্তু/প্রাণী/জিনিসের মতো ? 
উনার আকার কেনো জীবাণু বা বা মহাকাশের কোনো কিছুর মতো নয় যেটা পুরাণ রচনার পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে/হচ্ছে । পুরাণের ঈশ্বরের যত রূপই দেখতে পাই সবই মানুষ বা আমাদের কল্পনা/দৃষ্টিগোচর পৃথিবীর কোনো পশু , পাখি বা প্রাণীর মতো । এই মহাবিশ্ব তো শুধু এই পৃথিবী নিয়েই না । এর চেয়েও কল্পনাতীত জায়গা রয়েছে যেখানে আমাদের দেখা মানুষ , গরু , ছাগল , বরাহ ছাড়াও অনেক কিছু রয়েছে । কৈলাস ছাড়াও কত লক্ষ কোটি পাহাড় পর্বত , চন্দ্র-সূর্য এর চেয়েও হাজার গুণ বড় গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে । 

তবে দেবতা শুধু চাঁদ সূর্য হয় কেনো ? দেবতার আকার শুধু কোনো মানুষ/প্রাণী/হাফ-মানুষ/পশু/পাখির মতো কেনো ? যেটা আমরা শুধু খালি চোখের দ্বারা দেখতে পাই এই পৃথিবীর মধ্যেই শুধু!

সাকারবাদীরা দাবি করে প্রতিমা অর্থ উপমা এবং প্রতিমাই নাকি ঈশ্বর । অথচ তাদেরই বহুল প্রচারিত ড. দূর্গাদাস বসু সরস্বতীর ' হিন্দুধর্মের সারতত্ত্ব' বইতে ১০০ পৃষ্ঠায় বলেছেন -


হিন্দুশাস্ত্র কুত্রাপি মৃত্তিকা বা প্রস্তর নির্মিত প্রতিমাকে ঈশ্বর বলে নাই । বরং বলিয়াছে যে , ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে তাঁহার উপমা বা সাদৃশ্য বস্তু নাই- 
 ন তস্য প্রতিমা অস্তি ।





একই কথা আছে পৃষ্ঠা ৯০ তেও - 



আবার যারা কিনা মূর্তি বা প্রতিমা না মানলেই হিন্দু না [ যদিও তাদের নিজেদের পূর্ব আচার্যরাই কাউকেই কেউ মানেননি ও কোন ছাড়ও দেন । বিস্তারিত লেখা পাবেন এই ব্লগেই  ] তাদের সম্পর্কেই সেই বইতে আছে পৃষ্ঠা ৯৫ এ - 

এই কারণেই আৰ্য্যসমাজী বা ব্রাহ্মগণ প্রতিমাপূজা না করিলেও প্রণবালম্বনে বিশ্বাসী বলিয়া , তাঁহাদিগকে হিন্দুত্বের সংজ্ঞা হইতে বাদ দেওয়া হয় না ।



▶️ এবার আমরা দেখি ভ্রান্ত সাকারবাদী ঈশ্বরের যে সাকার রূপ কল্পনা করে তা কতটা ভ্রান্তঃ 

👉ব্রহ্ম শুধু অরূপ নহেন ,তিনি অচিন্তনীয় এবং অনির্বচনীয় কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সহিত তাহার তুলনা করা যায় না ,সুতরাং তাহার কোনো প্রতিমা হয় না । 

[ যজু (৩২।৩) ন তস্য প্রতিমা অস্তি..... সর্বতোমুখঃ...নিহিতং..গুহা বিভুঃ... ]

যজুর্বেদ ৪০/৮-->পরমাত্মা শুদ্ধ,জন্ম রহিত, অকায়ম(শরীর রহিত) , সর্বব্যাপী ।

👉 কেন উপনিষদ ১/৬-->
"য়চ্চক্ষুষা ন পশ্যতি য়েন চক্ষুংষি পশ্যতি।
তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং য়দিদমুপাসতে।।"

অনুবাদ: চোখ দিয়ে যাঁকে দেখা যায় না , কিন্তু লোকে দৃশ্যমান বিষয়গুলো যাঁর দ্বারা দেখে থাকে, তাঁকেই তুমি ব্রহ্ম বলে যেন। লোকে যেসব দৃশ্যমান বস্তুর(#মূর্তি বা #প্রতীক) উপাসনা করে তা ব্রহ্ম নয় ।

👉কঠ উপনিষদেও ১/২/২২-->পরমব্রহ্ম প্রাণীগণের শরীরে থেকেও শরীর রহিত ।

👉কঠ উপনিষদের ১/৩/১৫--> পরমাত্মা অরূপম বা রূপহীন , কেবল সেই পরমাত্মাকে উপলব্ধি করতে পারলেই মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে ।

👉শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/৯-->ঈশ্বরের কোন লিঙ্গ(চিহ্নবিশেষ) পর্যন্ত নেই ।

👉তৈত্তিরীয় উপনিষদের ব্রহ্মানন্দবল্লীর ৭ম অনুবাক-->ঈশ্বর দৃষ্টির অগোচর এবং শরীর রহিত ।

👉শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৩/১০-->পরমেশ্বর হচ্ছেন অরূপম(রূপ রহিত) ।

👉মুণ্ডক উপনিষদ ২/১/২-->সেই দিব্য পরম পুরুষ অমূর্ত বা মূর্তিহীন ।

👉 মুণ্ডক উপনিষদ ১/১/৬-->পরমাত্মা হলেন বর্ণহীন , গোত্রহীন , চক্ষু-কর্ণ রহিত এবং হস্ত-পদ শূন্য
 ।


চোখে‌র সামনে ঈশ্বরের এতো বৃহৎ‌ জটিল‌ সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্ত । ঈশ্বরের এসব সৃষ্টি দেখে ঈশ্বরকে স্মরণ করা যায় না ?

ঈশ্বরকে স্মরণ করার‌ জন্য সামান্য কয়েক ইঞ্চির কল্পিত গড়িয়ে‌ তারই মধ্যে ঈশ্বরকে‌ স্মরণ করতে হবে !!! এমন বাধ্যবাধকতার এসব কি মূর্খামি ? প্রকৃতপক্ষে অন্ধ যেমন কাউকে পথ দেখাতে পারে না পৌরাণিকরাও তাই । আবার এদের কাঁকড়া প্রবৃত্তিও আছে ; নিজেও উপরে উঠবে না কাউকে উঠতেও দেবে না  । কেউ নিরাকার সর্বব্যাপীর উপাসনায় নিয়োজিত হয়ে ভ্রান্তি ত্যাগ করতে চাইলে ও সবাইকে উপরে নিয়ে উঠতে চাইলেও  তারা নিচেই টেনে আনবে কর্দমাক্ত নর্দমায় ।  
ঈশ্বর সর্বব্যাপী । এটা তো পৌরাণিকরা‌ও মানে । সর্বব্যাপী হ‌ওয়ার‌ কারণে‌ ঈশ্বর‌ মূর্তিতেও থাকবেন । কিন্তু পৌরাণিকরা ঈশ্বরকে‌ সম্পূর্ণভাবে মূর্তির‌ মধ্যে কল্পনা করে স্মরণ করে । এখানে ঈশ্বর‌ একদেষী হয়ে যান । যেটা‌ সম্পূর্ণ বেদ বিরুদ্ধ ।

🔥অতঃ পৌরাণিকগণ তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যে মিথ্যাচার করে তা প্রমাণিত । চুনের জলে দুধের ভাবনা আরোপ করে তা থেকে মাখন পাওয়া সম্ভব না । ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ , নিরাকার , সর্বশক্তিমান , ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা , অনন্ত , নির্বিকার , অনাদি , অনুপম , সর্বাধার , সর্বেশ্বর সর্বব্যাপক , সর্বান্তর্যামী, অজর , অমর , অভয় , নিত্য , পবিত্র ও সৃষ্টিকর্তা , একমাত্র তারই উপসনা করা উচিত ।

- নমস্কার