ঋগ্বেদ
অষ্টম মণ্ডলের ৪৯ থেকে ৫৯ পর্যন্ত ১১টি সূক্তের প্রচারক ঋষি " বালখিল্য
" হওয়ার জন্য এ সূক্তগুলোকে বালখিল্য সূক্ত নামে সম্বোধন করা হয় ।
এই
সূক্তের বিষয়ে অনেক পাশ্চাত্য গবেষক এবং তাদের মতানুসারে কিছু বিদ্বান
যার মধ্যে " বৈদিক এজ " এর লেখকও সম্মিলিত রয়েছে ; তাদের কল্পিত
ভিত্তিহীন মত এই যে, বালখিল্য সূক্ত পরবর্তীকালে অষ্টম মণ্ডলে কেউ
যুক্ত করে দিয়েছে । শুধু এতটুকু নয়, বৈদিক এজ এর লেখক এই অষ্টম মণ্ডল
সম্বন্ধে পরস্পর স্ববিরোধী অনেক কথা বলেছে । বৈদিক এজ পৃষ্ঠা ২২৯-এ অন্য
মণ্ডল থেকে অষ্টম মণ্ডল সম্পর্কে কিছু বিশেষতা বর্ণনা করতে যেয়ে লিখেছে
--
This peculiarity of the eighth Mandala does suggest-but by no means proves, hat the eighth Mandala was subjoined at a later date to the kernel constituted by the Family Mandalas. But there is positive reason to believe that there was a time when the eighth Mandala was actually considered to be the last in the Samhita, for why else should the Balakhilya hymns be thrust into the eighth Mandala and not added after the tenth.
-Vedic Age, P. 229
অর্থাৎ, অষ্টম মণ্ডলের বিশেষতা থেকে এমন কিছু সংকেত পাওয়া যায় - কিন্তু এটা সর্বথা সিদ্ধ হয় না যে, অষ্টম মণ্ডলকে পরবর্তী মণ্ডলের ( দ্বিতীয় থেকে সপ্তম পর্যন্ত ) সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু এটা মানার স্পষ্ট কারণ হলো, এক সময় এমন ছিলো যখন অষ্টম মণ্ডলকে ঋগ্বেদ সংহিতার শেষ মণ্ডল হিসেবে মানা হতো । যদি এমন না হতো তাহলে বালখিল্য সূক্তকে অষ্টম মণ্ডলেই কেনো যুক্ত করা হলো ? দশম মণ্ডলের শেষে কেনো যুক্ত করা হলো না ? পর্যবেক্ষণ করার পর এসব কুযুক্তি অসঙ্গত প্রতীত হয় । প্রথম তো লেখক স্বয়ং মেনেছে এখানে একটি মাত্র নির্দেশ মিলে, কিন্তু সর্বথা সিদ্ধ হয় না যে, অষ্টম মণ্ডল মূল সংহিতায় পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছে, তাহলে এরকম অনিশ্চিত মূলক কথা কেন একটি তথ্য হিসেবে লিখিত হবে ? এটা বুঝাতে চাচ্ছে যে, নিশ্চিত রূপে কোনো না কোনো সময় অষ্টম মণ্ডলে ঋগ্বেদ সংহিতার সমাপ্তি হয়, একেতো এই বক্তব্য অষ্টম মণ্ডলের প্রক্ষিপ্ত হওয়াকে নাকচ করে দেয় এবং বালখিল্য সূক্ত প্রক্ষিপ্ত হওয়ার বক্তব্যও স্বয়ং সাধ্য সিদ্ধ মেনে চলে । যা সর্বথা অসমীচীন যেটা পরবর্তীতে প্রমাণ সহ দেখানো হবে ।
বালখিল্য
সূক্ত প্রক্ষিপ্ত বলার পিছনে যুক্তি দেওয়া হয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ২৮.৮-এ
উল্লেখ রয়েছে " বজ্রেণ বালখিল্যাভির্বায়ঃ কুটেন " এর ব্যাখ্যা
সায়ণাচার্য করেছেন --
" বালখিল্যনামকাঃ কেচন মহর্ষয়ঃ তেষাং সম্বন্ধীন্যষ্টৌ সূক্তানি বিদ্যন্তে তানি বালখিল্যনামকে গ্রন্থে সমাম্নায়ন্তে ।।
অর্থাৎ - বালখিল্য নামে কোনো মহর্ষি ছিলেন । তাঁর ৮টি সূক্ত বালখিল্যং নামক গ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে । সায়ণাচার্যের এই উক্তির মাধ্যমে জ্ঞাত হওয়া যায় বালখিল্য নামক কোনো মহর্ষির বিষয়ে তিনি কোথাও থেকে শুনেছেন বা জেনেছেন, কিন্তু কোনো নিশ্চিত জ্ঞান ছিলো না এবং বালখিল্য নামক গ্রন্থও কোথাও পাওয়া যায় নাই ।
সম্ভব যে, ঋগ্বেদ থেকেই বালখিল্য মহর্ষি দ্বারা প্রচারিত কিছু সূক্ত, যার মধ্যে -- য়ো নো দাতা বসুনামিন্দ্রং তং হূমহে
বয়ম্।। - ঋগ্বেদ (৮/৫১/৫)
যস্মৈ ত্বং বসো দানায় শিক্ষসি স
রায়স্পোষমশ্নুতে। তং ত্বা বয়ং মঘবন্নিন্দ্র
গির্বণঃ সুতাবন্তো হবামহে।। - ঋগ্বেদ
(৮/৫১/৬) কদাচত স্তরীরসি তেন্দ্র সশ্চসি দাশুষে।
উপোপেন্নু মঘবন্ ভূয় ইন্নু তে দানং
দেবস্য পৃচ্যতে।। - ঋগ্বেদ (৮/৫১/৭) যো নো দাতা স নঃ পিতা মহাং উগ্র
ঈশানকৃত্। - ঋগ্বেদ (৮/৫২/৫)
বিশ্বা দ্বেষাংসি জহি চাব চা কৃধি বিশ্বে
সন্বন্ত্বা বসু।। - ঋগ্বেদ (৮/৫৩/৪)
যদিন্দ্র রাধো অস্তি তে মাঘোনং
মঘবত্তম। তেন নো বোধি সধমাদ্যো বৃধে
মঘো দানায় বৃত্রহন।। - ঋগ্বেদ (৮/৫৪/৫) যমৃত্বিজো বহুধা কল্পয়ন্তঃ সচেতসো
যজ্ঞমিমং বহন্তি। যো অনূচানো ব্রাহ্মণো
যুক্ত আসীক্তো স্বিত্তত্র যজমানস্য
সংবিত্।। - ঋগ্বেদ (৮/৫৮/১) এক এবাগ্নির্বহুধা সমিদ্ধ একঃ সূর্যো
বিশ্বমনু প্রভূতঃ। একৈবোষোঃ সর্বমিদং
বিভাত্যেকং বা ইদং বি বভূব সর্বম্।। -
ঋগ্বেদ (৮/৫৮/২)
ইন্দ্রাবরুণা সৌমনসমদৃপ্তং রায়স্পোষং
যজমানেষু ধত্তম্। প্রজাং পুষ্টিং
ভূতিমস্মাসু ধত্তং দীর্ঘায়ুত্বায় প্রতিরতং ন
আয়ুঃ।। - ঋগ্বেদ (৮/৫৯/৭)
ইত্যাদি
সরলার্থক এবং অত্যন্ত উপযোগী মন্ত্র রয়েছে । সম্ভব হতে পারে ইনি পৃথক
গ্রন্থে ব্যাখ্যা সহিত সংকলিত করেছিলেন ; যেমন বেদপ্রেমী সংগঠন সূক্ত
ঋগ্বেদ: ১০/১৯১, স্বরাজ্য সূক্ত ঋগ্বেদ: ১/৮০, শিব সংকল্প মন্ত্র যজু:
৩৪/১-৬ ইত্যাদি করা হয়েছে । শুধু এই জন্য এই সূক্তের প্রক্ষিপ্ততা সিদ্ধ
হয় না, কিন্তু সরলতার জন্য অধিক প্রসিদ্ধতা বা লোকপ্রিয়তাই সিদ্ধ হয় ।
এখানে
এই উক্তিও উল্লেখনীয় যে, ঐতরেয় ব্রাহ্মণের যে বচনের ওপর ভিত্তি করে
কিছু তথাকথিত গবেষক ( যার মধ্যে পাশ্চাত্য ব্যতীত স্বামী হরিপ্রসাদ জী,
পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মাদিও ) বালখিল্য সূক্তকে প্রক্ষিপ্ত মানে, তা স্বয়ং
ঐতরেয় ব্রাহ্মণের বিদ্বানের বিচারানুসারে প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় হিসেবে
বিবেচিত হয়েছে । যেমন -- Encyclopedia Britanica এর Ancient Sanskrit
Literature বিষয়ক লেখায় সিদ্ধ করা হয়েছে । এই অবস্থায় স্বয়ং
প্রক্ষিপ্তমূলক বাক্য দ্বারা কিছু সূক্তের প্রক্ষিপ্ততা কখনই সিদ্ধ করা
সম্ভব নয় । এই সূক্ত প্রথম থেকেই ঋগ্বেদ সংহিতায় রয়েছে । হতে পারে
কোনো না কোনো শাখায় থাকতে না পারে । শাখা সমূহে এমন ভেদ বিদ্যমানই
থাকে, কেননা শাখার সংকলন বিশেষ উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে ।
এই সূক্তের ভাষা এবং ভাব ঋগ্বেদের অন্য সূক্তের ভাবের সাথে সম্পূর্ণ মিল রয়েছে । কোনো
রকম ভেদ পরিলক্ষিত হয় না । প্র. ম্যাক্সমূলার ঋগ্বেদের যে শুদ্ধ
সংস্করণ ইউরোপে প্রকাশিত করেছেন সেই সংস্করণেও এই সূক্তও বিদ্যমান ।
জার্মানের সুপ্রসিদ্ধ গবেষক Dr. Winternitz এই সূক্তের প্রাচীনতা বিষয়ে " ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস " বিষয়ক পুস্তকের লিখেছেন --
The word khila means, 'supplement' and this name in itself indicates that they are texts which were collected and added to the Samhita only after the latter had already been conducted. This does not exclude the possibility that some of these khilas are of no less antiquity than the hymns of the Rigveda Samhita, but for some reason unknown to us were not included in the collection.
--- A History of Indian Literature by Dr. Winternitz, P. 59-60
এর ভাবার্থ এই যে, খিলের অর্থ পরিশিষ্ট এবং এই নামে সূচিত হয় যে, যেসব মন্ত্র সংগ্রহ করা হয়েছে এবং সেগুলোকে সংহিতায় যুক্ত করা হয়েছে ; কিন্তু এর মাধ্যমে এই সম্ভাবনার নিষেধ হয় না যে এদের মধ্যে কিছু ঋগ্বেদ সংহিতার অন্য সূক্তসমূহ থেকে প্রাচীন নয়৷ কিন্তু এরূপ কারণে, যা আমাদের জ্ঞাত নয়, তাদের সংহিতার মধ্যে স্থান প্রাপ্ত হয়নি।
Dr. Winternitz এর এরূপ মন্তব্যও সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য নয় । কেননা, ৪৯তম সূক্ত থেকে ৫৯তম সূক্তের ভাষা এবং ভাবসহ কোনো দিক ঋগ্বেদের অন্য সূক্ত থেকে পৃথক এটা লক্ষ্য করা যায় না, তবুও তিনি এর প্রাচীনতা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা বিবেচ্য ।
Dr. Winternitz স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন ঐ ১১টি সূক্তের সমস্ত হস্তলিখিত লিপি পাওয়া যায় --
The eleven Bal-Khilya hymns... in all manuscript are found at the end of the book. -- VIII, P.60
গ্রিফিথ খুবই অনুচিত কাজ করেছে ; সে ৮ম মণ্ডলকে সংহিতার মাঝখান থেকে বের করে শেষে যুক্ত করে দিয়েছে । এমনটা করার অধিকার তার কখনও নেই । শুধুমাত্র এমনটা এজন্য করেছে যে, এই সূক্তের প্রারম্ভে " অথ " এবং শেষে " ইতি " শব্দ রয়েছে, তো এটার ভিত্তিতে এরূপ মন্তব্য করা একদমই অনুচিত । প্রতীত হয় যে, অধিক প্রচারের জন্য যখন পৃথক ভাবে সংকলিত হয়েছে তখন অথ এবং ইতি এই সূক্তের প্রারম্ভে এবং শেষে যুক্ত করা হয়েছে । এজন্য এই সূক্তের অর্বাচীনতা বা প্রক্ষিপ্ততা সিদ্ধ কখনই হয় না ।
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)