বর্তমানে একদল পৌরাণিক কুসংস্কারবাদী উঠে পড়ে লেগেছে পৌষ মাসে যে বিবাহ নিষিদ্ধ তা প্রমাণ করতে। কিন্তু প্রমাণ করতে গিয়ে সরাসরি শাস্ত্র বচন না দেখিয়ে উল্টো গোরুর রচনা লিখে বসেছে। অথচ কোনো বৈদিক শাস্ত্র বলছে না পৌষ মাসে বিবাহ নিষিদ্ধ।
তবে এ বিষয়ে যে গৃহ্যসূত্রের কথাকে তারা তুলে ধরছে তা হচ্ছে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের ১।৪।১ বচন। সেখানে বলা হচ্ছে -
উদগয়ন আপূর্যমাণপক্ষে কল্যাণে নক্ষত্রে চৌলকর্মোপনয়নগোদানবিবাহাঃ। (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১।৪।২)
অর্থাৎ, সূর্যের উত্তরায়ণের সময় শুক্লপক্ষে কল্যাণময় নক্ষত্র বা সময়ে চৌলকর্ম, উপনয়ন, গোদান ও বিবাহ অনুষ্ঠান করবে।
এখানে বলা হচ্ছে এই সময়ে করার জন্য। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এই সময়গুলোই কেবল পবিত্র আর বাকি সময় অপবিত্র বা নিষিদ্ধ। যদি তাই হতো তবে পরবর্তী শ্লোকে আচার্য আশ্বলায়ন বলতেন না -
সার্বকালম্ একে বিবাহম্।
অর্থাৎ অন্য আচার্যের মতে বিবাহ সবসময়ই অনুষ্ঠিত হতে পারে। (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১।৪।২)
পূর্বপক্ষঃ দ্বিতীয় সূত্রটি আপদকালের জন্য। সাধারক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়।
উত্তরপক্ষঃ এই দাবি নিতান্তই অসঙ্গত। যদি দ্বিতীয় সূত্র আপদকালীন অবস্থা প্রকাশ করতো তবে সূত্র আপদকাল নির্দেশক শব্দ অবশ্যই থাকতো। বরং সূত্রে যে শব্দগুলো রয়েছে তা হচ্ছে -
সার্বকালম্ - সর্বকালেই
একে - অন্য আচার্যের মতে
বিবাহম্ - বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে পারে
অর্থাৎ সূত্রের শব্দগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় অন্য আচার্যের মতে সবসময়ই বিবাহ সম্ভব। যদি উত্তরায়ণ ভিন্ন অন্য সময়ে বিবাহ নিষিদ্ধ হতো তবে এই সূত্র উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।
সিদ্ধান্তঃ আচার্য আশ্বলায়ন উত্তরায়ণে বিবাহ করতে বললেও অন্য আচার্যের মত রয়েছে যেকোনো সময়ে বিবাহ অনুষ্ঠানের। এখানে শুভ বা অশুভের কিছু নেই। উত্তরায়ণে শীতকাল শেষ হওয়া শুরু করে এবং শুক্লপক্ষে চন্দ্রালোকের প্রাচুর্যের কারণেই আচার্য আশ্বলায়ন উত্তরায়ণ ও শুক্লপক্ষকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তারমানে এই না অন্যসময় বিবাহ নিষিদ্ধ।
এবার চলুন দেখে নিই আরো কিছু গৃহ্যসূত্রের বচন যা দেখলে আপনাদের নিকট পরিষ্কার হবে বিবাহ বিষয়ে এমন কোনো নির্দিষ্ট পুণ্যতিথি নেই যেখানে বিবাহ কর্তব্য বা কোনো নির্দিষ্ট অশুভ তিথি নেই যা পরিহার্য।
আপস্তম্ভ গৃহ্যসূত্রের ১।২।১২ সূত্রে বলা হচ্ছে -
সর্ব ঋতবো বিবাহস্য শৈশিরৌ মাসৌ পরিহাপ্যোত্তমং চ নৈদাঘম্।
অর্থাৎ শিশির ঋতুর দুইমাস এবং নিদাঘ ঋতুর শেষ মাসকে পরিহার করে সকল সময়ই বিবাহের জন্য উপযুক্ত।
এখানে দুটো ঋতুর কথা বলা হয়েছে এবং দুটোই বৈদিক ঋতু। একটি শিশির ও অন্যটি নিদাঘ। আপস্তম্ভ বলছেন শিশিরের দুইমাস ও নিদাঘের শেষ মাস ত্যাগ করতে।
শিশিরের দুইমাস কোনগুলো?
আপস্তম্ভ গৃহ্যসূত্রের ভাষ্যকার সুদর্শনাচার্য বলছেন -
"শিশিরস্যর্তোঃ যৌ দ্বৌ মাসৌ মাঘফাল্গুনৌ" অর্থাৎ শিশির ঋতুর সেই দুই মাস হচ্ছে মাঘ ও ফাল্গুন।
আর নিদাঘের সর্বশেষ মাস?
সুদর্শনাচার্য বলছেন -
"নিদাঘস্য গ্রীষ্মস্য যশ্চোত্তমোন্ত্য আষাঢ়ঃ" অর্থাৎ নিদাঘ বা গ্রীষ্ম ঋতুর সেই দ্বিতীয় মাস হচ্ছে আষাঢ়।
অর্থাৎ আপস্তম্ভ আচার্যের মতে মাঘ, ফাল্গুন ও আষাঢ় মাস ব্যতীত অন্য সময়ে বিবাহ করা যাবে। উল্লেখ্য তিনটি মাসই কিন্তু উত্তরায়ণের। আপস্তম্ভ গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী পৌষ মাসে বিবাহ করা যাবে।
এবার আসি বোধায়ন গৃহ্যসূত্রের দিকে। বোধায়ন গৃহ্যসূত্র ১।১।১৮-১৯ বলছে -
সর্বে মাসা বিবাহস্য।।১৮
অর্থাৎ সকল মাসেই বিবাহ করা যাবে।
শুচিতপস্তপস্যবর্জামিত্যেকে।।১৯
অর্থাৎ অন্য আচার্যের মতে শুচি, তপ, তপস্য এই তিন মাস বর্জন করে।
এখানে উল্লেখ্য আচার্য বোধায়নের মতে সকল মাসেই বিবাহ করা যাবে যা ১৮নং সূত্রে উল্লিখিত হয়েছে। তিনি নিজের মত প্রকাশ করে পরবর্তী সূত্র অন্য আচার্যের মত উল্লেখ করেছেন, যার মতে তিন মাস বর্জনযোগ্য। সেই মাসগুলোর বৈদিক নাম উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে -
শুচি - আষাঢ়
তপ - মাঘ
তপস্য - ফাল্গুন
অর্থাৎ আচার্য বোধায়ন অপর আচার্য বলতে মূলত আপস্তম্ভের মতকেই উল্লেখ করেছেন। যদিও তাঁর নিজের মতে সকল মাসই বিবাহযোগ্য।
এবার চলুন কৌশিক গৃহ্যসূত্রের মত দেখে নিই। কৌশিক গৃহ্যসূত্রের ১০।১।২-৩ সূত্রে বলা হচ্ছে -
ঊর্ধ্বং কার্তিক্যা আ বৈশাখ্যাঃ।।২।।
অর্থাৎ কার্তিক থেকে বৈশাখ হচ্ছে বিবাহের সময়।
যথাকামী বা।।৩।।
অথবা যখন চাইবে তখনই বিবাহ করবে।
অর্থাৎ দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ এই সাত মাস বিবাহের সময়। এখানে প্রথম তিনটি মাসই কিন্তু দক্ষিণায়নের অন্তর্ভুক্ত। তবে এরমানে এই নয় বাকি পাঁচ মাস নিষিদ্ধ। আচার্য কৌশিক তৃতীয় সূত্রে উল্লেখ করেছেন কেউ যখন চাইবে তখনই বিবাহ করতে পারবে। যদি অন্য মাসগুলো নিষিদ্ধ হতো তবে এই সূত্রের অবতারণা করতেন না আচার্য কৌশিক।
অর্থাৎ গৃহ্যসূত্রের কোনো আচার্যই বলছেন না পৌষ মাসে বিবাহ নিষিদ্ধ। অথবা কেবল উত্তরায়ণেই বিবাহ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
বরং আমরা আচার্য বোধায়নের মতানুসারেই বলি সকল মাসই বিবাহের জন্য যোগ্য বা আচার্য কৌশিকের সূত্র অনুযায়ী বলি যে যখন চাইবে তখনই বিবাহ করতে পারবে। তাই পৌরাণিক মিথ্যা প্রলাপে বিভ্রান্ত হবেন না যে পৌষ মাসে বিবাহ নিষিদ্ধ। এমন কোনো বচন বৈদিক শাস্ত্রে নেই।
0 মন্তব্য(গুলি)