🕉️ ঐতরেয় আরণ্যকে 'বঙ্গ' রহস্য উদ্ঘাটন 🕉️

 

আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা , চাকরির পরীক্ষা কিংবা বিসিএসের জন্য একটি অতি পরিচিত প্রশ্ন ' বঙ্গ শব্দের প্রাচীনতম উল্লেখ কোথায় পাওয়া যায় ' । ইতোমধ্যে যারা পরীক্ষার্থী তারা নিঃসন্দেহে উত্তর দিয়ে ফেলেছেন ' ঐতরেয় আরণ্যকে ' । হ্যাঁ, আপাততঃ সিলেবাস বা গবেষকদের মতে তা ঠিক আছে ও আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ১ নম্বর পেলেন বটে তবে শাস্ত্র অনধ্যায়ের কারণে কত যে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই । কেন বললাম ভাবছেন তাও তো ? কেননা উক্ত ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ বলতে কোন স্থানকেই বোঝানো হয়নি । সম্পূর্ণটাই পাশ্চাত্য গবেষকদের মস্তিষ্কপ্রসূত কষ্টকল্পনা ও তাঁদের পদাঙ্কে অন্ধবিশ্বাসে গমনকারী গবেষকদের বিশাল অবদান বিশেষ । চলুন আগে ঝটপট উক্ত আরণ্যকের মূল পাঠ ও তাৎপর্য পড়ে নেই গবেষকদের অতি প্রিয় সায়ণভাষ্য সহ -

এষ পন্থা এতৎকর্মৈতদ্ব্রহ্মৈতৎসত্যম্, ইতি । তস্মান্ন প্রমাদ্যেত্তন্নাতীয়াৎ, ইতি । ন হ্যত্যায়ন্পূর্বে যেঽত্যায়ংস্তে পরা বভূবুঃ,ইতি । তদুক্তমৃষিণা প্রজা হ তিস্রো অত্যায়মীয়ুর্ন্যন্যা অর্কমভিতো বিবিশ্রে । বৃহদ্ধ তস্থৌ ভুবনেষ্বন্তঃ পবমানো হরিত আ বিবেশেতি, ইতি । প্রজা হ তিস্রো অত্যায়মীয়ুরিতি যা বৈ তা ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায়মায়ংস্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ, ইতি । ন্যন্যা অর্কমভিতো বিবিশ্র ইতি তা ইমাঃ প্রজা অর্কমভিতো নিবিষ্টা ইমমেবাগ্নিম্, ইতি । বৃহদ্ধ তস্থৌ ভুবনেষ্বন্তরিত্যদ উ এব বৃহদ্ভুবনেষ্বন্তরসাবাঽদিত্যঃ, ইতি । পবমানো হরিত আ বিবেশেতি বায়ুরেব পবমানো দিশো হরিত আবিষ্টঃ ॥

ঐতরেয় আরণ্যক ২।১।১

অনুবাদঃ

[পরম পুরুষার্থ প্রাপ্তির জন্য সাধনমার্গের উপদেশ]

এই হল পথ, এই হল (যজ্ঞ)কর্ম, এই ব্রহ্ম, এই হল সত্য। তার (সেই পথ) থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়, তাকে অতিক্রমণ করা উচিত নয়, কারণ পূর্ববর্তীরা (সেই কর্ম এবং জ্ঞানের পথকে) অতিক্ৰমণ করেন নি। যাঁরা অতিক্রমণ করেছেন তাঁরা পরাজিত হয়েছেন। এই বিষয়ে ঋষি বলেছেন -

‘প্রজা হ তিস্রো অত্যায়মীয়ূন্যন্যা অর্কমভিতো বিবিশ্বে।

বৃহদ্ধ তস্থৌ ভুবনেন্তঃ পবমানো হরিত আ বিবেশ।।

(ঋসং ৮.১০১.১৪)

‘প্রজা হ তিস্রো অত্যায়মীয়ুঃ” (ঋসং ৮.১০১.১৪ক)—তিন শ্রেণীর প্রজারা, যারা (এই পথকে) অতিক্রমণ করেছে তারা হল এই পক্ষীকুল, বৃক্ষসমূহ, ওষুধি (এবং) সরীসৃপকুল'। 'নান্যা অর্কমভিতো বিবিশ্ৰে' (ঋসং ৮.১০১.১৪খ)—এই প্রজারা সূর্যের মত (আহবনীয়রূপ) অগ্নির চতুর্দিকে নিজেদের স্থাপন করেন (অর্থাৎ অৰ্চনা করেন)। 'বৃহদ্ধ তস্থৌ ভুবনেধন্তঃ' (ঋসং ৮.১০১.১৪গ)—পৃথিবীর মধ্যস্থলে (বিরাজমান) বৃহৎ হলেন এই আদিত্য। ‘পবমানো হরিত আ বিবেশ” (ঋসং ৮.১০১.১৪ঘ) – বায়ু পবমান (তিনি) হরিত' দিক্‌সমূহে প্রবেশ করছেন৷৷১৷৷

 

 

সায়ণভাষ্যঃ তাঃ পূর্বমন্ত্রোক্তা ইমা অস্মাভির্ দৃশ্যমানাঃ শ্রদ্ধারহিতাস্ত্রিবিধাঃ প্রজা যাঃ কাশ্চিদ্বৈদিকস্যাতিক্রমং প্রাপ্তাস্তানি তথাবিধপ্রজানাং শরীরাণি তদ্দোষফলং ভোক্তুং প্রবৃত্তানীমান্যস্মাভির্ দৃশ্যন্তে। সামান্যতঃ প্রোক্তানাং পুনর্ব্যাংসীত্যাদিনা বিশেষনির্দেশঃ। বয়াংসি পক্ষিণঃ কাকগৃধ্রাদয় আকাশে দৃশ্যন্তে। সোহযং পক্ষিসংঘস্ত্রিবিধানাং প্রজানাম্ একো ভাগঃ। বঙ্গা বনগতা বৃক্ষা অবগধা অবন্তি মনুষ্যাদীন্ রক্ষন্তি তৈঃ গৃধ্যন্তেঽভিকাঙ্ক্ষ্যন্ত ইতি ব্রীহিয়বাদ্যা ওষুধয়োহবগধাঃ। ‘গৃধু অভিকাঙ্ক্ষায়াম্’ ইতি ধাতোৰ্গৰ্ধশৰ্দনিষ্পত্তিঃ। সোহ্যমোষধিবনস্পতিরূপঃ প্রজানাং দ্বিতীয়ো রাশির্ভূমৌ বর্ততে। ইরপাদা উরঃপাদাঃ সর্পা ভূৰিলবাসিনঃ সোহয়ং তৃতীয়ো রাশিঃ।

 

 

 

পথ হল দুপ্রকার – কর্মের পথ এবং জ্ঞানের পথ। 'কর্ম' শব্দের দ্বারা বেদবিহিত যজ্ঞানুষ্ঠানকে এবং ‘ব্রহ্ম’ শব্দের দ্বারা ব্রহ্মসম্বন্ধীয় জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে। কর্মের কথা সংহিতা, ব্রাহ্মণ এবং ঐতরেয় আরণ্যকের প্রথম আরণ্যকে বলা হয়েছে এবং ব্রহ্মজ্ঞানের বিষয়কে ঐতরেয় আরণ্যকের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আরণ্যকে বলা হয়েছে। এই জ্ঞানের পথই হল অভ্রান্ত পথ।

 

‘বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ’—এই অংশের মন্তব্যে Keith বলেছেন—

 

“ Vayā üsi gives us a people like the Matsyas, Ajas &c., in whose names we may, if we like, see totemism. The Vangavagadhaḥ are a composite tribe or group of tribes like the Kuru-Pañcalas, whose name reminds us of the later Vanga ... in conjunction with Anga, as a part of what is now Bengal. The Cerapādāḥ are a third tribe, whose name points to the later ceras of Southern India.' 

 

সায়ণ ‘চেরপাদাঃ’ শব্দকে ‘চ ইরপাদাঃ' এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, 'বঙ্গ' অর্থ বনগত বৃক্ষ, 'অবগধ' ওষধি এবং 'ইরপাদ' সর্প। 

 

 

 

আধুনিককালে ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার ' বাঙ্গালার ইতিহাস ' ১ম খণ্ডে বলেছেন -

 

" ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ শব্দের সর্ব্বপ্রাচীন উল্লেখ পাওয়া গিয়াছে। ঐতরেয় আরণ্যক রচনাকালে বঙ্গ, বগধ ও চেরদেশবাসিগণকে আর্য্যগণ পক্ষিবৎ জ্ঞান করিতেন। বঙ্গ, বঙ্গদেশের নাম; বগধ, হয় মগধের প্রাচীন নাম অথবা লিপিকরপ্রমাদের ফল; এবং চের, জাতি অথবা দেশবিশেষের নাম। "

 

 

 

বস্তুত রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সবারই বক্তব্য কীথের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে নেওয়া । আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে - 

 

১। অযাচিতভাবে লিপিকর প্রমাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ প্রমাণহীন ও বিনা কারণে দোষ উত্থাপন করা হয়েছে । অন্যত্র এই গবেষকরাই নিরুক্তের ' প্রমগন্দ ' থেকে মগধ নাম এসেছে বলে থাকেন । বগধ যে মগধেরই প্রাচীন নাম তার কি প্রমাণ ? প্রকৃতপক্ষে জোর করে ইতিহাস তৈরী করা বা চাপানোর ফলেই এই অবস্থা । 

 

অর্থাৎ মূলে পেলাম আমরা 'অবগধ' । রাখালদাস বা সমস্ত ঐতিহাসিক নিলেন বগধ । তারপরেও মিলাতে না পেরে তারা মন্তব্য করলেন এটা প্রাচীন নাম নয়তো লিপিকর প্রমাদ । শাস্ত্রের যথেচ্ছাচার অর্থের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ।

 

২। অধিকন্তু, সায়ণাচার্যের সময় পর্যন্তও যে এই ধরনের কোন অর্থ প্রচলিত ছিলো না তা সুনিশ্চিত । যেখানে সায়ণ যত্রতত্র ভ্রান্তিবশতও বেদে ইতিহাস প্রদর্শন করেছেন তিনি ঐতরেয় আরণ্যকের এই খণ্ডে এতোটা তথাকথিত সুস্পষ্ট অঞ্চলের নাম ছিলো কিন্তু বিন্দুমাত্র উল্লেখ করলেন না এটা কিভাবে সম্ভব ?

 

৩। এই স্থলে মূলতঃ উক্ত ঋকে বিদ্যমান জ্ঞান ও কর্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত কেউ ইতিহাস প্রদর্শন করেননি । এখানে বলার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের মধ্যে তিন চতুর্থাংশ মানুষ বেদবিহিত কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেননা, তারা অধোগতি অর্থাৎ পক্ষী, অন্নাদি বনস্পতি এবং সর্পযোনি প্রাপ্ত হয়। কেবলমাত্র এক চতুর্থাংশ মানুষ শ্রদ্ধা পূর্বক কর্ম করেন এবং তাঁদের অভ্যুদয় হয়। 

 

৪। ‘বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ’ এখানে উক্ত বেদ মন্ত্রের ৩ প্রকার প্রজার কথা উল্লেখিত হয়েছে । বয়, বঙ্গ -অবগধ ও ইরপাদাঃ । রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় কথিত মগধ [ যদিও তিনি লিখেছেন বগধ প্রাচীন নাম । কোন তথ্যসূত্র অজানা ] এখানে নেই । আর সায়ণ ভাষ্যেও আমরা দেখি এখানে -

 

(১) পক্ষীকুল

(২) বনগত বৃক্ষ ও ওষধি

(৩) সর্প

এই ৩ প্রকার প্রজারই উল্লেখ আছে । কোন জনপদ না । 

 

৫। মন্ত্রের ৩ প্রকার প্রজার মধ্যে যদি বঙ্গকে পক্ষীবৎ জ্ঞান করতেন এই ইঙ্গিত সম্পূর্ণ কপোলকল্পিত । কেননা এখানে বয়=পক্ষী ও বঙ্গ=বনস্পতি আলাদা । তাই কোনভাবেই " বঙ্গ, বগধ ও চেরদেশবাসিগণকে আর্য্যগণ পক্ষিবৎ জ্ঞান করিতেন" এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা । মস্তিষ্কে বঙ্গদের অবদমিত করে রাখা হত কিংবা এটি বর্জিত অঞ্চল এই জাতীয় পূর্বাগ্রহ না থাকে তবে এই প্রকার সিদ্ধান্ত আসা কোনভাবেই সম্ভবপর নয় । 

 

প্রসঙ্গত অনেকেই এখানে বঙ্গাদি অঞ্চলকে পাণ্ডববিবর্জিত , এখানে আগমন করলে পুনঃসংস্কার বাধ্যতামূলক [ নির্ণয়সিন্ধু কিংবা সমুদ্রযাত্রা বিরোধী শ্রী করপাত্রীর মত অনুযায়ী ] এই মতের সাথে উক্ত আরণ্যককে মেলাতে চেষ্টা করেন । বিষয়টি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত । মনুস্মৃতির বর্তমান কলেবরের ১০।৪৩-৪৪ শ্লোকে আমরা দেখি - 

 

শনকৈস্তু ক্ৰিয়ালোপাদিমাঃ ক্ষত্রিয়জাতয়ঃ।

বৃষলত্বং গতা লোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ৷৷ ৪৩৷৷

অনুবাদ : [পরবর্তী শ্লোকে বর্ণিত] সমস্ত ক্ষত্রিয়জাতিগণ পুরুষানুক্রমে উপনয়নাদি, নিত্যাগ্নিহোত্র ও সন্ধ্যাবন্দনা প্রভৃতি ক্রিয়ার অনুষ্ঠান না করায় এবং ব্রাহ্মণে বিহিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করায় ক্রমে ক্রমে বৃষলত্ব অর্থাৎ শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।। ৪৩।।

কুল্লূকভট্টকৃতাটীকা : শনকৈরিতি। ইমা বক্ষ্যমাণাঃ ক্ষত্রিয়জাতয় উপনয়নাদিক্রিয়ালোপেন ব্রাহ্মণানাঞ্চ যাজনাধ্যাপন-প্রায়শ্চিত্তাদ্যর্থদর্শনাভাবেন শনৈঃশনৈলোকে শূদ্রতাং প্ৰাপ্তাঃ।। ৪৩।।

পৌণ্ড্রকাশ্চৌড্রদ্রবিড়াঃ কাম্বোজা যবনাঃ শকাঃ।

পারদা পহ্নবাশ্মীনাঃ কিরাতা দরদাঃ খশাঃ।। ৪৪।।

অনুবাদ : পৌণ্ড্রক, উড্র, দ্রাবিড়, কাম্বোজ, যবন, শাক, পারদ, পহ্লব, চীন, কিরাত, দরদ ও খশ —এই সব দেশোদ্ভব ক্ষত্রিয়গণ পূর্বশ্লোকোক্ত কর্মদোষে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। [এখানে এ কথাও বোঝনো হ’ল যে, অন্য দেশোৎপন্ন ক্ষত্রিয়াদির যদি ক্রিয়ালোপ-দোষ ঘটে, তবে তারাও শূদ্র হয়।]৷৷৪৪৷৷

কুল্লূকভট্টকৃতাটীকা : পৌণ্ড্রকা ইতি। পৌণ্ড্রাদিদেশোদ্ভবাঃ ক্ষত্রিয়াঃ সন্তঃ ক্রিয়ালোপাদিনা শূদ্রত্বমাপন্নাঃ।।৪৪।।

 

 

 

বলা বাহুল্য পৌণ্ড্রক বলতে বাংলার প্রাচীন পুণ্ড্র নগরকে বোঝায় । নিঃসন্দেহে এই শ্লোকটি মনুস্মৃতিতে পরবর্তীকালে সংযোজিত কেননা এই রাজ্যসমূহ পরবর্তী সময়ে অতি আধুনিক নগরী । তবুও এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বর্ণাশ্রম ভঙ্গের কারণে এই অঞ্চলসমূহ শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে এবং সেই কারণেই পরবর্তীতে বিবর্জিত অঞ্চলের তালিকায় চলে এসেছে । 

 

অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ শব্দ কোন জনপদ বিশেষ নয় এবং সেখানে বঙ্গদেশনিবাসীগণিকে হেয় দৃষ্টিতে দেখা হতো এমন দাবি সম্পূর্ণ অমূলক ও মিথ্যা । 

 

অলমিতি । 

 

বাংলাদেশ অগ্নিবীর