কিছুদিন আগে একটি হাস্যকর ও বালকসুলভ কথা প্রচার করা হয়। তখন বলা হয়েছিল যে, মহর্ষি সত্যার্থপ্রকাশের ৮ম সমুল্লাসে মনুসংহিতার শ্লোকের একটি শব্দ পরিবর্তন করেছেন। আর এটি নিয়ে এক মূর্খের সে কি আস্ফালন। ছোট্ট একটি শ্লোক দেখাতে গিয়ে ৩০ মিনিট ধরে দম্ভোক্তি করে বলা হলো, শাস্ত্র হলো ভগবানের শরীর, তাই শাস্ত্রের শব্দ পরিবর্তনের অর্থ হলো ভগবানের দেহে আঘাত করা। মনুর শ্লোক চেঞ্জ করে দয়ানন্দ সরস্বতী এখানে মনুর শ্লোকের বিকৃতি করেছেন।
এবার আসি উক্ত অবোধের আস্ফালন নিবারণ পর্বে।
- প্রথমত সকলের কাছে প্রশ্ন, কেউ কোনো গ্রন্থের শ্লোক বা পাঠ পরিবর্তন করলে তার পেছনে কোনো না কোনো স্বার্থ থাকার কথা৷ কিন্তু মহর্ষি যদি সত্যই এখানে পাঠ পরিবর্তন করেন, তবে এর পেছনে মহর্ষির স্বার্থ কী? ব্রহ্মবর্তের জায়গায় আর্যাবর্ত পাঠ বসিয়ে দিয়ে মহর্ষির কী লাভ? এটি করে কি নিজেকে তিনি ঈশ্বর বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন? এরকম কিছু তো নয়৷ তাহলে বিনা স্বার্থে তিনি শাস্ত্রের শব্দ পরিবর্তন করবেন কেন?
- আর দ্বিতীয়ত, আমরা যদি বিভিন্ন স্মৃতি শাস্ত্র ও ইতিহাস গ্রন্থ গুলোর বিভিন্ন সংস্করণ দেখি তাহলে সেখানে অসংখ্য পাঠভেদ দৃষ্ট হয়। তাহলে প্রাচীনকাল থেকেই কি পুঁথি লেখকগণ ইচ্ছাকৃতভাবে শাস্ত্রের শ্লোক পরিবর্তন করে ভগবানের দেহে আঘাত করে আসছেন?
এসব স্মৃতিশাস্ত্র শ্রুতি বা বেদের তুল্য প্রামাণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ নয় । ফলে বেদকে যেভাবে সংহিতাপাঠ, পদপাঠ, ক্রমপাঠ, জটপাঠ, ঘনপাঠ প্রভৃতি উপায়ে মুখস্থ করে রাখা হত, স্মৃতিশাস্ত্রগুলোকে ওভাবে মুখস্থ করে রাখা হত না। ফলে সহজেই স্মৃতিশাস্ত্রের শ্লোকের বা শব্দের পরিবর্তন ঘটে যেত পারে। আর এই কারণেই স্মৃতি গ্রন্থের অসংখ্য পাঠভেদ দৃষ্ট হয়। এই বিষয়গুলো ন্যূনতম শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিরই জানার কথা। তবুও এই বিষয়গুলোকে পুরোপুরি ইগনোর করে মহর্ষির উপর মনুসংহিতার শ্লোক বিকৃতির অভিযোগ আনা নিজের দুরভিসন্ধিকে সিদ্ধ করা বা স্বার্থসিদ্ধি করা ছাড়া কিছুই নয়।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে৷ সত্যার্থপ্রকাশের ৮ম সমুল্লাসে 'আর্যবর্ত' এর সীমার প্রমাণ দিতে গিয়ে মহর্ষি মনুস্মৃতির দুইটি (২।২২ ও ২।১৭) শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। তার মধ্যে তিনি ২।১৭ শ্লোকটি এভাবে লিখেছেন—
❝সরস্বতীদৃশদ্বত্যোর্দেবনদ্যোর্যদন্তরম্।
তং দেবনির্মিতং দেশমার্যাবর্তং প্রচক্ষতে।।❞
তবে বর্তমানে মনুস্মৃতির যে সংস্করণ পাওয়া যায় তাতে শ্লোকটি এভাবে আছে—
❝সরস্বতীদৃশদ্বত্যো র্দেবনদ্যো র্যদন্তরম্।
তং দেবনির্মিতং দেশং ব্রহ্মাবর্তং প্রচক্ষতে।।❞
অর্থাৎ মহর্ষি সত্যার্থপ্রকাশের এই স্থানে 'দেশমার্যাবর্তং' পাঠ উদ্ধৃত করলেও মনুস্মৃতির বর্তমান সংস্করণের এই স্থানে 'দেশং ব্রহ্মাবর্তং' পাঠ পাওয়া যায়।
এটিকে দেখিয়েই সেই মূর্খ অজ্ঞানী দাবি করেছে, মহর্ষি এখানে শ্লোক বিকৃতি করেছেন। মনুর কথাকে অমান্য করেছেন।
এবার আসা যাক এটির সমাধান পর্বে। পূর্বেই বলেছি স্মৃতি শাস্ত্রের বহুবিধ পাঠভেদ পাওয়া যায়৷ ফলে বহু সংস্করণ ও হস্তলিখিত পুঁথি দেখে অনেক স্মৃতিশাস্ত্রেরই ক্রিটিক্যাল এডিশন প্রকাশিত হয়েছে। তেমনি মনুসংহিতার শতাধিক হস্তলিখিত পুঁথি ও সংস্করণ তুলনা ২০০৫ সালে Oxford University Press থেকে 'Manu's Code of Law' নামের একটি ক্রিটিক্যাল এডিশন প্রকাশিত হয়েছে। এই ক্রিটিক্যাল এডিশনের ৪০৬ পৃষ্ঠায় মনুসংহিতার ২।১৭ শ্লোকটি ও তার পাঠভেদের টীকাগুলো রয়েছে। সেখানে দেখা যায় এই 'দেশং ব্রহ্মাবর্তং' অংশটুকুরই প্রায় ৫টি পাঠভেদ বিভিন্ন পুঁথি ও সংস্করণে পাওয়া যায়৷ এদের মধ্যে 'Jm' নাম দ্বারা চিহ্নিত পুঁথিতে 'দেশমার্যাবর্তং' পাঠটিও রয়েছে, যা মহর্ষির দ্বারা সত্যার্থপ্রকাশেও উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। এই ক্রিটিক্যাল এডিশনের ৩৫৫–৩৫৬ পৃষ্ঠা ভূমিকা অংশে 'Jm' চিহ্নিত পুঁথিটির পরিচয় দেওয়া আছে৷ সেখানে এটিকে ❝শ্রী রণবীর রিসার্চ ইনস্টিটিউট❞, জম্মু এর ৬৩৬ নং হস্তলিখিত পুঁথি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থাৎ এসব দেখে সহজে বোঝা যায়, মহর্ষির কাছে এমন একটি সংস্করণ অথবা পুঁথি ছিল যেটির ২। ১৭ শ্লোকে 'দেশমার্যাবর্তং' বিদ্যমান ছিল। ফলে তিনি সত্যার্থপ্রকাশের ৮ম সমুল্লাসে আর্যবর্তের সীমার প্রমাণ দিতে গিয়ে মনুর ২।২২ ও ২। ১৭ শ্লোকদ্বয় উদ্ধৃত করেছেন। আর আমরা উপরে ক্রিটিক্যাল এডিশনের প্রমাণ দ্বারা দেখতে পেলাম, মনুর ২। ১৭ শ্লোকে মহর্ষি ব্যবহৃত 'দেশমার্যাবর্তং' পাঠটি প্রাচীন পুঁথি ও সংস্করণে বিদ্যমান ছিল। ফলে মহর্ষির উপর নির্বোধের মতো শাস্ত্র বিকৃতির অভিযোগ আনা নিতান্তই মূর্খতা ভিন্ন কিছু নয়।
ভিডিও আকারে দেখুন -
0 মন্তব্য(গুলি)