এটা
সর্ববিদিত যে, মহর্ষি যাস্ককৃত নিরুক্ত নির্বচন শাস্ত্র । বেদের একটি
অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং " ব্যাকরণস্য কাৎস্ন্য " অর্থাৎ, ব্যাকরণ
শাস্ত্রের পূরক । যেখানে ব্যাকরণের প্রকৃতি প্রত্যয় বিভাগ শব্দ প্রধান
ব্যুৎপত্তি করা হয়, সেখানে নিরুক্ত শাস্ত্র অর্থপ্রধান ব্যুৎপত্তিসমূহ
দর্শিয়ে থাকে । ব্যাকরণ এবং নিরুক্তের সমন্ধয় বেদার্থে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তথা প্রভাব রাখে । বিদ্বানগণ এ বিষয়ে ভালোভাবেই জ্ঞাত
যে, সৃষ্টির আদিতে কোনো ব্যাকরণের অস্তিত্ব ছিলো না । শক্তি এবং
বুদ্ধি ক্রমান্বয়ে হ্রাস হতে থাকে বৈদিক পরম্পরার ঋষিগণ বেদাঙ্গের রচনা
করেন । বেদের শব্দ নিত্য, ঋষিগণ তাঁদের অতি উচ্চ তপ, সাধনার মাধ্যমে
প্রকৃতি প্রত্যয়ের মনোবল দ্বারা বেদের শব্দের অর্থসমূহ দর্শানোর প্রয়াস
করেছেন । ধাতুর স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে । তার মূল অর্থের নির্ধারণ
বেদের আধারে করা হয়েছে । একই সাথে বৈদিক-লৌকিক শব্দসমূহের ব্যবস্থাও
ঋষিগণ করেন । বৈদিক পরম্পরা থেকে বিচ্যুত অবৈদিক, মূর্খ, নির্বোধগণ ইদানিং
মহর্ষি যাস্ক এবং তাঁর নিরুক্ত নিয়ে সম্পূর্ণ বানোয়াট, ভিত্তিহীন
মিথ্যাচার করছে । যা তাদের কপোলকল্পিত ধারণা । সম্পূর্ণটাই অজ্ঞানতা
পরিচয় ।
যাস্কের পূর্বে দেবতাবাদ
মহর্ষি
যাস্কের পূর্বে দেবতাবাদ এর স্বরূপ সম্বন্ধে ব্রাহ্মণ তথা আরণ্যক
শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থলে বর্ণনা লক্ষ্য করা যায় । এর বাস্তবিক স্বরূপ
কেমন ছিলো, এ সম্বন্ধে বিশদ বিবেচনা করা আবশ্যক । বর্তমানে সার্বিক
বিবেচনায় এতটুকুই বলা যায়, যাস্কের সময়কালে " অধিযজ্ঞ " প্রক্রিয়ারও
প্রচলন ছিলো । এর স্বরূপ যেমনই হোক না কেনো এই বিষয় পৃথক্ বিবেচনার
যোগ্য । অথর্ববেদ সহ চার বেদেও যত্র-তত্র যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা
রয়েছে, এর স্বরূপ নিশ্চয়ই ভিন্ন এবং বিবেচনীয় ।
যাস্ককৃত দেবতাবাদের স্বরূপ
মহর্ষি
যাস্কের নিরুক্ত তিন কাণ্ডে বিভক্ত । নৈঘণ্টুক কাণ্ডের প্রতিপাদিত্য
বিষয় " সমাম্নায়ঃ সমাম্নাতঃ " বেদে প্রযুক্ত বিশিষ্ট অপ্রসিদ্ধ
শব্দসমূহের ব্যাখ্যা । নৈগম কাণ্ডের প্রতিপাদিত্য বিষয় অর্থের আধার
অর্থাৎ, প্রকরণানুসারে শব্দের অর্থ দর্শানো । দৈবতকাণ্ডে দেবতাবাচী
শব্দসমূহের নিরূপণ করা হয়েছে । নির্বচন শাস্ত্র হওয়ার দরূণ তিনটি
কাণ্ডেই মহর্ষি যাস্ক নির্বচন দ্বারা সমস্ত শব্দের অর্থ দর্শিয়েছেন ।
নির্বচন দ্বারা অর্থ দর্শানোর স্পষ্ট তাৎপর্য এই যে, বৈদিক শব্দকে
যেনো লোকবৎ রূঢ়ি অর্থে প্রয়োগ তথা গ্রহণ না করা হয়, বরং প্রকৃতি
প্রত্যয় বা ভিন্ন ধাত্বর্থের আধারে যৌগিক, অর্থাৎ সেই গুণসমূহের কারণ
ততু তদ্ অর্থবাচক নির্দেশ করছে তা সম্বন্ধে বিস্তারপূর্বক জ্ঞাত হওয়া
যায় । দৈবত কাণ্ডে নির্বচন দ্বারা যে অর্থ দর্শানো তথা নিরুক্তের
প্রথমাধ্যায়ে " নামান্যাখ্যাতজানি " শব্দের উল্লেখ রয়েছে । এ দ্বারা
স্পষ্ট যে, মহর্ষি যাস্ক সব শব্দকে আখতজ মেনেছেন ।
মহর্ষি যাস্ক দেবতার লক্ষণ বর্ণনা করেন –
" যৎকাম ঋষির্যস্যাং দেবতায়ামার্থপত্যমিচ্ছন্স্ততিং প্রযুক্তে তদ্দৈবতঃ স মন্ত্রো ভবতি । "
( নিরুক্ত. ৭/১ )
কামনাকারী ঋষিগণ যে দেবতায় পদার্থের বল, কর্ম চেয়ে স্তুতি প্রযুক্ত করেন, সেই মন্ত্র সেই দেবতারই হয়।
অর্থাৎ, মন্ত্ৰসমূহ যে পদার্থ বা দেবতার উপর প্রযুক্ত হয়ে স্তুত (আলোচিত) হয়, সেই পদার্থই বা দেবতাই সেই মন্ত্রের দেবতা হন।
সর্বানুক্রমণীকারও
" য়া তেনোচ্যতে সা দেবতা " বাক্য দ্বারা একই অর্থ ব্যক্ত করেছেন ।
দৈবতকাণ্ডে প্রধান স্তুতিকর্তা দেবতাগণের নিরূপণ করা হয়েছে, এমনটা
মহর্ষি যাস্ক এই কাণ্ডের প্রারম্ভেই বর্ণনা করেছেন । বৃহদ্দেবতাকার
শৌনকেরও একই বিচার ।
কল্পিত যজুঃসর্বানুক্রমণী
বাস্তবে
যজুর্বেদ সর্বানুক্রমণী যা কাত্যায়নকৃত নামে প্রসিদ্ধ তা আসলে অবৈদিক
উবটাদি ভাষ্যকারগণের পরবর্তীকালে রচিত হয়েছে । এর পক্ষে মুখ্য প্রমাণ
যে, উবট তার ভাষ্যসহ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনায় দেবতানির্ণয় বিষয়ে এই
গ্রন্থের মান্যতা তথা কোনোরূপ উদ্ধৃত দেয় নাই । উক্ত গ্রন্থের নাম
পর্যন্ত উল্লেখ করে নাই তার কোনো লেখায় তথা গ্রন্থে । দ্বিতীয় প্রমাণ,
যজুঃ সর্বানুক্রমণীর প্রথম মন্ত্রেই শাখাকেও দেবতা মানা হয়েছে ; যা
সর্বতোভাবে কপোলকল্পিত ভ্রান্ত, অবৈদিক বচন । কেননা, " শাখা "
ছেদনাদিতে উক্ত মন্ত্রের বিনিয়োগের উল্লেখ রয়েছে । পরন্তু সেই
মন্ত্রের দেবতা নয় ।
শতপথ ব্রাহ্মণে বর্ণন হয়েছে –
" য়স্যৈ হবির্দীয়তে সা দেবতা "
অর্থাৎ,
যাকে উদ্দেশ্য করে হবিঃ প্রদান করা হবে, তাকে দেবতা বলা হয় ।
শ্রৌতপ্রক্রিয়া আয়ত্তকারী বিদ্বান স্পষ্টভাবেই জানেন যে, " শাখা "-কে
হবিঃ প্রদান করা হয় না, বরং মন্ত্রের উক্ত অংশ উচ্চারণ পূর্বক শাখা
ছেদনাদি ক্রিয়া করা হয়ে থাকে ।
মহষি যাস্কের সিদ্ধান্ত –
"
ইতীমানি সপ্তবিংশতি দৈবতানামধেয়ান্যনুক্রান্তানি । সূক্তমাঞ্জি
হবির্ভাঞ্জি । তেষামেতান্যহবির্ভাঞ্জি বেনোऽসুনীতি ঋর্ত ইন্দুঃ ।। "
( নিরুক্ত: ১০/৪২ )
অর্থাৎ,
বেন-অসুনীতি ঋত-ইন্দু এসব বাদে দেবতা হবির্ভাক্ হয়ে থাকে । যাজ্ঞিক
প্রক্রিয়ায় হবির্ভাক্ দেবতাবাচক, এমনটা নিরুক্তকারগণ ভাসিত করেছেন ।
শতপথের উপর্যুক্ত বচন তো সর্বথা স্পষ্ট ।
নিরুক্তের মুখ্য দেবতা " আত্মা "
নিরুক্তের দৈবত কাণ্ড ( ৭/৪ ) মহর্ষি যাস্ক বর্ণনা। করেছেন –
" মহাভাগ্যাদ্ দেবতায়া এক আত্মা বহুধা স্তুয়তে । একস্যাত্মনোऽন্যে দেবাঃ প্রত্যঙ্গানি ভবন্তি " ।।
অর্থাৎ,
দেবতার পরম ঐশ্বর্যশালী হওয়ায় এক আত্মাকেই বিবিধ প্রকারে স্তুতি
করা হয় । অন্য [ সব ] দেবতা এক আত্মারই প্রত্যঙ্গ ( অবয়ব ভূত বা
অন্তর্ভূত ) ।।
মহর্ষি
যাস্ক মুখ্য দেবতা হিসেবে একমাত্র আত্মাকেই সর্বত্র দর্শিয়েছেন এবং
মেনেছেন । অগ্নি, বায়ু, সূর্য, মিত্র, বরুণ, রুদ্র আদি সমস্ত
দেবতাই এক আত্মার ভিন্ন-ভিন্ন বিভূতি ( শক্তি ) । মহর্ষি যাস্ক দেবতাবাদ
বিষয়ে কী ধারণা রাখতেন তা তাঁর নিরুক্তের সর্বত্র স্থলে এবং
পূর্বোক্ত বর্ণনা দ্বারা স্পষ্ট বিদিত হয় । এ দ্বারাও সিদ্ধ হয়ে যে,
এই উপর্যুক্ত শব্দ যেখানে প্রধানের বিবক্ষায় বিশেষ, সেখানে গৌণের
বিবক্ষায় বিশেষণবাচীও । কেননা, এর নির্বচন বরাবর উপলব্ধ ।
বেদের বিবিধ মন্ত্রেও এমন বিশেষণবাচী উপলব্ধ ।
"
উর্বী পৃথিবী " ( ঋগ্বেদ. ৬/৪৭/২০ ; ১/১৮৫/৭ ) , " য়েয়ং পৃথিবী
দাধার " ( ঋগ্বেদ. ১০/৬০/৯ ) , " অঘ্ন্যায়া ধেনোঃ " ( ঋগ্বেদ. ৪/১/৬ ) ,
" গাবো ধেনবঃ " ( ঋগ্বেদ. ৬/৪৫/২৮ ) এই মন্ত্র সমূহের মধ্যে " উর্বী
পৃথিবী " তথা " পৃথিবী মহী " মন্ত্রদ্বয় পৃথিবীর নাম নির্দেশ করছে । "
গৌ এবং ধেনু " এই দুটি গোনাম ।
উপর্যুক্ত
বেদ মন্ত্রে দুটির নাম প্রযুক্ত হওয়ার কোনোরূপ প্রয়োজন নাই,
মন্ত্রসমূহে নাম বিশেষ বিশেষণ রূপে অবস্থান করছে, নতুবা বেদ মন্ত্রে
পুনরুক্ত দোষে তুষ্ট হবে ।
বিশেষণ বিনা নির্বচন গঠন অসম্ভব ।
অতঃ উক্ত স্থলে বিশেষ বিশেষণ ভাব অনিবার্য ।
দৈবতকাণ্ড বিচার
নিরুক্তে
দেবতাশব্দের স্বরূপ পূর্বে দর্শানো হয়েছে । এটাও বর্ণনা করা হয়েছে
যে, নিরুক্তের তিনটি মহত্ত্ব একে অপরের থেকে পৃথক । দৈবতকাণ্ডে মহর্ষি
যাস্ক যদ্যপি প্রায়ঃ যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ান্তর্গত দেবতাবাচী শব্দের
বিবেচন করেছেন । তথাপি প্রারম্ভেই মহর্ষি যাস্ক " এক আত্মা বহুধা
স্তুয়তে " বচন উল্লেখ করে মুখ্য দেবতা " এক আত্মাই " অন্য দেবতা এর
অঙ্গস্বরূপ, এটাই স্পষ্ট প্রতিপাদন করেছেন । যাজ্ঞিক দেবতাগণকে মনুষ্যগণ
ভিন্ন অর্থে না গ্রহণ করে, এজন্য মহর্ষি যাস্ক দৈবতকাণ্ডের রচনা করেন ।
এ কাণ্ডে তিনি মুখ্য আধিদৈবিক প্রক্রিয়ার কারণ বর্ণনা করেছেন –
"
তিস্র এব দেবতা ইতি নৈরুক্তাঃ, অগ্নিঃ পৃথিবীস্থানো, বায়ুর্বেন্দ্রো
বান্তরিক্ষস্থানঃ সূর্যো দ্যুস্থানঃ । তাসাং মহাভাগ্যাদেকৈকস্যাং অপি
বহুনি নামধেয়ানি ভবন্তি, অপি বা কর্মপৃথবাদ্যথা
হোতাধ্বয়ুব্রহ্মোদ্গাতেত্যপ্যেকস্য সতঃ । "
নৈরুক্তো'র মতানুসারে তিনটি স্বত্তাই দেবতা, অগ্নি পৃথিবীস্থানী, বায়ু বা ইন্দ্র অন্তরিক্ষস্থানী এবং সূর্য দ্যুস্থানী ।
ত্রিবিধ
স্থানীর বিচার আধিদৈবিক পক্ষে । আধ্যাত্মিক পক্ষে এক আত্মাই সর্বা দেবতা
। আধিযাজ্ঞিক পক্ষেও দেবতা এক আত্মারই অবয়বভূত । আধিদৈবিক পক্ষে সব
তিনের ভিতরই ( অন্তর্ভূত ) এমনটা মহর্ষি যাস্ক প্রতিপালন করেছেন ।
নিরুক্ত এবং ঋক্ সর্বানুক্রমণীতে দেবতা ভেদ
এ
স্থলে এই বিষয় বিচার্য আবশ্যক যে, সর্বানুক্রমণী বৃহদ্দেবতায় উল্লেখিত
দেবতাগণ নিরুক্তে বর্ণিত হয়েছে নাকি হয় নাই । একইসাথে ব্রাহ্মণ
শাস্ত্রের সব দেবতা সর্বানুক্রমণী এবং বৃহদ্দেবতায় উল্লেখ আছে কি নাই ।
পরন্তু
এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নিরুক্তে প্রতিপাদিত দেবতাবাচী শব্দ
সর্বানুক্রমণী বৃহদ্দেবতায় প্রায়ঃ উপলব্ধ । আরও বলা যায় যে,
বৃহদ্দেবতায় উল্লেখিত প্রায়ঃ সমস্ত দেবতা নিরুক্তে উল্লেখ রয়েছে,
যদ্যপি কিছু ভেদ বিদ্যমান ।
নিরুক্ত এবং সর্বানুক্রমণী বৃহদ্দেবতায় যে যে স্থলে ভেদ বিদ্যমান, তা দর্শানো হল –
ঋগ্বেদ নিরুক্তের দেবতা সর্বানু. দেবতা
1. ১/৫০/৬৭ বরুণঃ (১২/২২) সূর্য
2. ৬/৪৯/৮ পূষা (১২/১৮) বিশ্বেদেবাঃ
3. ১১০/৮৫/২০ সূর্যঃ (১২/৭) আশীঃপ্রায়ঃ
4. ৫/৫৬/৮ রোদসী (১১/৫০) মরুতঃ
5. ৫/৪১/১৯,২০ ইলা (১১/৪৮) বিশ্বেদেবাঃ
6. ১/১৬৪/৪২ গৌরী (১১/৪০) বিশ্বেদেবাঃ
7. ১০/১১ ইন্দ্রাণী (১১/৩৭) ইন্দ্রঃ
8. ১০/১৪/৬ পিতরঃ ; অর্থবাণঃ (১১/১৯)
বশিষ্ঠপুত্র ইন্দ্রোবা
9. ৫/৫৭/১ রুদ্রাঃ (১১/১৫) মরুতঃ
(সর্বসূক্তস্য)
10. ১০/৬৭/৩ বিধাতা (১১/১২) সোমঃ ;
বরুণঃ ; বৃহস্পতিঃ আদি
11. ৭/১৭/১ ধাতা অগ্নি
12. ১০/১১৪/৩ সুপর্ণঃ (১০/৪৬)
বিশ্বেদেবাঃ (সূক্তস্য)
13. ৪/২৩/৮ ঋতঃ (১০/৪১) ইন্দ্র ঋতং বা
14. ১/৫৫/১৯ ত্বষ্টা (১০/৩৪) বিশ্বেদেবাঃ
(সূক্তস্য)
15. ৬/৩৭/৬ বায়ুঃ (১০/১) ইন্দ্রঃ
16. ১/২২/১২ অগ্নায়ী (৯/৩৪)
ইন্দ্রাণী-বরুণানী-অগ্নায়ী
17. ১/১৮৭/১ পিতুঃ (৯/২৪) অন্নং
18. ১০/১০২/৯ দ্রুধণঃ (৯/২৩) দ্রুধণ
ইন্দ্রো বা
19. ৬/৭৫/৬ অভীশবঃ (৯/২৬)
সারথী= পূর্বার্দ্ধস্য, রথঃ= উত্তরার্দ্ধস্য
20. ১/১২৬/১ নারাশংসঃ (৮/৬)
স্বনয়ো ভাবয়ব্যঃ
ঋক্ সর্বানুক্রমণী তথা বৃহদ্দেবতায় দেবতার ভেদ
সর্বানুক্রমণী তথা বৃহদ্দেবতায়ও দেবতা প্রকরণে পরস্পর ভেদ বিদ্যমান ।
তদ্যথা
– ঋগ্বেদ. ১/৫০ নং সূক্তের দেবতা সর্বানুক্রমণীতে সূর্য, অপরদিকে
বৃহদ্দেবতায় বরুণ । ঋগ্বেদ. ২/৩০/৮ নং মন্ত্রের দেবতা সর্বানুক্রমণীতে
সরস্বতী, বৃহদ্দেবতায় বাক্ । ঋগ্বেদ. ৪/৪/২ নং মন্ত্রের দেবতা
সর্বানুক্রমণীতে রুদ্র তথা বৃহদ্দেবতায় অগ্নিঃ । ঋগ্বেদ. ৫/৫৬/৮ নং
মন্ত্রের দেবতা সর্বানুক্রমণীতে মরুতঃ, বৃহদ্দেবতায় রোদসী । ঋগ্বেদ.
২/৩৩/১১ নং মন্ত্রের দেবতা ক্রমশঃ রুদ্র এবং মৃগ । ঋগ্বেদ. ২/৩৩/৬ নং
মন্ত্রের দেবতা ক্রমশঃ ইন্দ্র এবং বিশ্বামিত্র তথা ৭ নং মন্ত্রের দেবতা
ইন্দ্র এবং নদ্যঃ । ঋগ্বেদ. ৫/৫৭/১ নং মন্ত্রের দেবতা ক্রমশঃ মরুতঃ এবং
রুদ্রাঃ ।
দেবতাবাদে এটা অবশ্যই বিচারণীয় যে, সর্বানুক্রমণী এবং বৃহদ্দেবতাই এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ, তাই না ।
দৈবতকাণ্ডের কিছু বিশেষ শব্দ
নিরুক্ত
৭/১৪ থেকে ৮/২১ পর্যন্ত মহর্ষি যাস্ক পৃথিবীস্থানী দেবতার নিরুপণ করেছেন
। ৯ম অধ্যায়ের শেষ পর্যন্ত " পৃথিব্যায়তনানি " এর ১০/১ থেকে ১১/১২
পর্যন্ত মধ্যমস্থানী দেবতার প্রতিপাদন করেছেন । ১১তম অধ্যায়ের শেষ
পর্যন্ত মধ্যমস্থানী দেবগণ তথা দেব-স্ত্রীগণের বর্ণন উপলব্ধ । ১২ তম
অধ্যায়ে দ্যুস্থানী দেবতা তথা দেবগণ আদির নিরুপণ করেছেন ।
এর
মধ্যে পৃথিবী এবং ত্বষ্টা এই দুটি দেবতাবাচী শব্দের নিরুপণ পৃথিবী
স্থানী, অন্তরিক্ষ স্থানী তথা দ্যুস্থানী উক্ত তিন স্থানী দেবতায়
নিরুক্তকার দর্শিয়েছেন । এই দুটি অতিরিক্ত আরও চারটি দেবতাবাচী শব্দের
প্রতিপাদন ভিন্ন-ভিন্ন দুটি স্থানী দেবতায় দর্শানো হয়েছে ।
যেমন -
বরুণ — নিরুক্ত. ১০/৪-এ মধ্যমস্থানী, ১২/২২-এ দ্যুস্থানী দেবতা ।
যমঃ — নিরুক্ত. ১০/২০-এ মধ্যমস্থানী, ১২/২৯-এ দ্যুস্থানী দেবতা ।
সবিতা — নিরুক্ত. ১০/৩২-এ মধ্যমস্থানী, ১২/১৩-এ দ্যুস্থানী দেবতা ।
উষাঃ — নিরুক্ত. ১১/৪৭-এ মধ্যমস্থানী দেবগণ, ১২/৬-এ দ্যুস্থানী দেবতা ।
এখানে,
এই বিষয় বিশেষ বিচারণীয় যে, " বরুণ " যদি মধ্যমস্থানী বায়ু বা
বিদ্যুৎ হয় তাহলে দ্যুস্থানী দেবতাতেও তা বিদ্যুৎ বা বায়ুই, অথবা
আগ্নেয় বা অন্য কিছু ।
এই অবস্থায় মধ্যমস্থানী এবং দ্যুস্থানী উপর্যুক্ত সব বরুণ, যম, সবিতা, উষার স্বরূপে ভেদ থাকা আবশ্যক ।
একইসাথে
ত্বষ্টা এবং পৃথিবী তিনটি স্থানী । এই দুটির পরস্পর ভেদ কী ? পৃথিবী
দ্যুস্থানী কেনো ? এটাও বিচার্য বিষয় । যদি বলা হয় দ্যুস্থানী অধিক
আগ্নেয়, গৌণ পার্থিব, সেটাও নয় । কেননা, মহর্ষি যাস্ক দৈবত কাণ্ডের
প্রারম্ভে বর্ণনা করেছেন – " তদ্যানি নামানি প্রাধান্যস্ততীনাং দেবতানাং
তদ্দৈবতমিত্যাচক্ষতে " । দৈবতকাণ্ডে প্রধান দেবতা বাণী পদসমূহেরই নিরুপণ
করা হয়েছে ।
অন্তে
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নির্বচনের আধারে উক্ত শব্দ
পৃথিবী-স্থানী হয় তো, শেষ দুটি শব্দ বিশেষণ বাচী হওয়া আবশ্যক,
এমনটাই মধ্যস্থানী এবং দ্যুস্থানীতেও বোধগম্য আবশ্যক । মহর্ষি যাস্ক
একারণে উক্ত শব্দসমূহের নির্বচন করেছেন । নির্বচন করার ফলে এটাই সিদ্ধ
হয় যে, এই শব্দ বিশেষণবাচীও এবং বিশেষ্যবাচীও । ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে
এরূপ অনেক শব্দের অর্থ তথা নির্বচনের আধারেও উক্ত শব্দসমূহ বিশেষণ
বিশেষ্যভাবই নির্দেশ করছে । উক্ত দেবতাবাচী শব্দসমূহের সমন্বয় এই
প্রকারে খুব ভালোভাবেই যুক্তিযুক্ত অর্থ প্রদর্শন করে । পূর্বে দর্শানো
হয়েছে যে, " পৃথিবী " আদি শব্দও বিশেষণবাচী, কেননা বেদমন্ত্রে উর্বী
পৃথিবী দুটি একার্থক পৃথিবীবাচী শব্দ হওয়ায় সিদ্ধ হয় যে,
পৃথিবী-উর্বী, ত্বষ্টা-যমঃ আদি শব্দ কোথাও বিশেষ্য, কোথাও বিশেষণ পদ
নির্দেশ করছে ।
ত্বষ্টা শব্দের বিচার
পূর্বে
দর্শানো হয়েছে যে, " ত্বষ্টা " দেবতাবাচী শব্দ এবং তা পৃথিবী-স্থানী,
মধ্যম-স্থানী তথা দ্যুস্থানী এই তিন প্রকারে দেবতাবাচী শব্দে মহর্ষি
যাস্ক দর্শিয়েছেন । নিশ্চয়ই উক্ত তিনটি স্থানে " ত্বষ্টা " এর ভিন্ন
অর্থ তথা স্বরূপ উল্লেখ করা অনিবার্য । ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে এই শব্দের অনেক
অর্থ দর্শানো হয়েছে, যা নির্বচন শাস্ত্রের আধারেই বর্ণিত হয়েছে । বেদেও
ত্বষ্টা শব্দের বিবিধ অর্থ উপলব্ধ ।
যেমন
— ঐতরেয় ব্রাহ্মণ. ৬/১০ নং শ্লোকে " ইন্দ্রো বৈ ত্বষ্টা " বচনের
উল্লেখ রয়েছে, ঋগ্বেদ. ১/৩২/২ নং মন্ত্রে ত্বষ্টাকে ইন্দ্র অর্থে নির্দেশ
করছে ।
ত্বষ্টা —
1. অগ্নিঃ ( ঋগ্বেদ. ২/১/৫ )
2. মাতা-পিতা ( ঋগ্বেদ. ১০/৬৪/১০ )
3. বাণীপতিঃ ( ঋগ্বেদ. ১০/৬৬/৩ )
4. বিশ্বেদেবাঃ ( ৬/৪৫/১৯ )
5. সুদত্রঃ ( ৭/৩৪/২২ )
ত্বষ্টা
রূপাণি পিংশতু ( ঋগ্বেদ. ১০/১৮৪/১ ) ; ( অথর্ববেদ. ৫/২৫/৫ ) , ত্বষ্টা বৈ
পশুনাং রূপাণাং বিক্রেতা ( তাণ্ডব্য. ৯/১৯/৩ ), ত্বষ্টারমগ্রিং (
ঋগ্বেদ. ১/১৩/১০ ), ত্বষ্টারমগ্রজাং গোপাং ( ঋগ্বেদ. ৯/৫/৯ ), ত্বষ্টারং
হোতারং ( ঋগ্বেদ. ১০/১১০/৯ ), ত্বষ্টুর্জামাতরং বায়ুং ( ঋগ্বেদ.
৮/২৬/২২), ত্বষ্টা জবং দধাতু ( যজু. ৯/৮ ), ইন্দ্রায় ত্বষ্টা
দধদিন্দ্রিয়াণি ( যজু. ২১/৫৫ )
নির্বচনের
আধারেই উক্ত শব্দসমূহ প্রকরণানুসারে ভিন্ন-ভিন্ন অর্থের প্রদর্শন হচ্ছে ।
উপর্যুক্ত সব শব্দের নির্বচন এই প্রকারেই হওয়া আবশ্যক ।
নির্বচন শাস্ত্রের মহত্ত্ব
উপর্যুক্ত
সমস্ত শব্দ, প্রকরণ নির্বচন শাস্ত্রেরই মহত্ত্ব বলা যায় । অন্যথা
এসব শব্দের অর্থের সমন্বয় হওয়া অসম্ভব । এ কারণে মহর্ষি যাস্ক
নিরুক্তের তিনটি কাণ্ডেই সর্বত্র একের পর নির্বচন দর্শিয়েছেন । তাই
যৌগিকবাদের স্থাপনার মধ্যে প্রমুখ স্থান মহর্ষি যাস্ককৃত প্রসিদ্ধ
শাস্ত্র নিরুক্তই, যার আধারে বেদ মন্ত্রের অর্থ আধ্যাত্মিক,
আধিদৈবিক, আধিযাজ্ঞিক আদি সব প্রক্রিয়ার মন্ত্রের অর্থ দর্শানো হয় ।
অতঃ
নির্বচনের আধারে মহর্ষি যাস্ক দেবতাবাদ বিষয়ে যে তত্ত্ব প্রতিপাদন
করেছেন এবং " মহাভাগ্যাদ্ দেবতায়া এক আত্মা বহুধা স্তুয়তে " বচন
দ্বারা এক আত্মাকেই মুখ্য দেবতা মেনে তথা সর্বত্র প্রতিপাদন করে
পৃথিবীস্থানী, মধ্যমস্থানী এবং দ্যুস্থানী দেবতা নিরুপণ করেছেন । এসবের
সমন্বয় নির্বচনের আধারে হওয়া সম্ভব ।
এই যুগে এর পুনরুদ্ধারক একমাত্র মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী । যাঁর প্রতি সমগ্র সংসার কৃতজ্ঞ ।
– বিদুষাং বশংবদঃ
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)