https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

আধ্যাত্মিক‌-প্রক্রিয়ানুসারী‌ বেদার্থ‌

Tuesday, August 30, 2022

 

ओ३म्

মহর্ষি যাস্কের সিদ্ধান্তনুসারে আধিদৈবিক বেদার্থ পুষ্পস্থানীয় এবং আধ্যাত্মিক বেদার্থ ফল-স্থানীয় । [1] অর্থাৎ, যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ থেকে আধিদৈবিক বেদার্থ শ্রেষ্ঠ, এবং আধিদৈবিক বেদার্থ থেকে আধ্যাত্মিক বেদার্থ সর্বশ্রেষ্ঠ ।

অন্যভাবে‌ তাৎপর্য, আধ্যাত্ম‌ জ্ঞানের উপলব্ধি বেদের মুখ্য অর্থাৎ অন্তিম প্রয়োজন ।

বেদার্থের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার বাস্তবিক তাৎপর্য উপলব্ধি করার‌ জন্য সর্বপ্রথম 'আধ্যাত্ম' শব্দের স্বরূপ‌ বোধগম্য হ‌ওয়া আবশ্যক ।

আত্মা শব্দের অর্থ - শরীর [2] জীব‌ এবং ঈশ্বর । আত্মার বিষয়ে যা‌ বর্ণন করা হয়, তা 'আধ্যাত্ম' [3] । এই প্রকারে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থে শরীর, জীব এবং ঈশ্বর সম্বন্ধী সমস্ত বিজ্ঞানের অন্তর্ভাব হয়ে থাকে । বেদের সমগ্র‌ জ্ঞান‌ই জীবের নিঃশ্রেয়স্ এবং অভ্যুদয়ের জন্য । অতঃ বেদের সহিত জীবের সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরা দ্বারা‌ সম্বন্ধ হ‌ওয়া অবশ্যম্ভাবী । র‌ইল ঈশ্বর সম্বন্ধ, সুতরাং যেই প্রকারে বেদে সমগ্র সংসারের বিবিধ পদার্থের বিশেষ জ্ঞান দর্শানো হয়েছে, তদ্রূপ বেদে ঈশ্বর সম্বন্ধী বিশেষ জ্ঞানের নির্দেশ থাকাও আবশ্যক ।

এই নয়, প্রাচীন ভারতীয় সম্প্রদায় অনুসারে বৈদিক বিজ্ঞানকে ঈশ্বরপ্রদত্ত মানা হয়েছে । [4] অতঃ বেদের সহিত ঈশ্বরের সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । এ কারণে অনেক আচার্যের সিদ্ধান্ত‌, বেদের কোন মন্ত্রেই ঈশ্বরকে সর্বথা ত্যাগ কদাপি অসম্ভব । [5] এই প্রকারে বেদের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারী অর্থের অভিপ্রায় শরীর,জীব তথা ঈশ্বর সম্বন্ধী যেকোন বিশেষ জ্ঞান প্রতিপাদন করা । [6]

অতি প্রাচীন কালে বেদের আধ্যাত্মিক অর্থ কীরূপ শৈলীতে‌ ব্যাখ্যা করা হতো তা‌ বর্তমান সময়ে নিশ্চয়াত্মক রীতিতে ব্যক্ত‌ করা অসম্ভব । কেননা বর্তমানে য‌ত‌ই বৈদিক বাঙ্ময় উপলব্ধ হোক‌ না কেনো, তা সব ভারতযুদ্ধকালের‌ আশপাশ সময়ের ।

পরন্ত উপলভ্যমান আর্ষ বাঙময়ে আধ্যাত্মিক অর্থের বিবিধ‌ সংকেত উপলব্ধ, বিশেষতঃ আরণ্যক শাস্ত্রে ।

নিরুক্ত ৭/৪ নং শ্লোকে‌ বর্ণিত হয়েছে ---

'মহাভাগ্যাদ্দেবতায়া এক আত্মা বহুধা স্তূয়তে ।'

অর্থাৎ, দেবতার অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী হ‌ওয়ার‌ দরুন এক‌ই দেবতার বিবিধ প্রকারে স্তুতি হয়ে থাকে‌।

এখন প্রশ্ন সেই এক দেবতা কে ? এর ব্যাখ্যা নিরুক্ত পরিশিষ্টে ( যেখানে মুখ্যতয়া বেদার্থের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া দর্শানো হয়েছে [7] ) দেওয়া হয়েছে –

'অথৈষ মহানাত্মা সত্ত্বলক্ষণঃ, তৎপরং তদ্ ব্রহ্ম'

অর্থাৎ, সেই মহানাত্মা পর (পরমাত্মা), তিনি ব্রহ্ম ।

কাত্যায়নের সিদ্ধান্তনুসারে উক্ত মহানাত্মা'র নাম 'সূর্য' । [8] বেদে উক্ত‌ মহনাত্মা'র নাম 'অগ্নি' --

"অগ্নিরস্মি জন্মনা জাতবেদাঃ ।"

[ঋগ্বেদ. ৩/২৬/৭]

এই এক অগ্নিরূপী মহানাত্মা অত্যন্ত ঐশ্বর্যযুক্ত হ‌‌ওয়ায় [8] আধ্যাত্মচিন্তক তাঁকে অনেক নামে‌ স্মরণ‌ করে থাকে । এর নির্দেশ ভগবতী শ্রুতিতে‌ও উপলব্ধ‌ –

ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নিমাহুরথো দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্ ।

একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্ত্যগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ ॥ [9]

[ ঋগ্বেদ. ১/১৬৪/৪৬ ]

তদেবাগ্নিস্তদাদিত্যস্তদ্ বায়ুস্তদু চন্দ্রমাঃ । তদেব শুক্রং তদ্ ব্রহ্ম তা আপঃ স প্রজাপতিঃ ।।

[ যজুর্বেদ. ৩২/১ ]

উক্ত‌ শ্রুতি‌র প্রমাণ অনুসারে বেদে ইন্দ্র, বরুণ আদি যত‌ নাম প্রযুক্ত হয়েছে, তা সব আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারে এক‌ই মহানাত্মা বাচক । [10]

এ কারণে বেদে যত‌ দেবতাবাচক পদ বিদ্যমান, আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারে‌ সেসবের‌ অর্থ ব্রহ্ম‌ই হবে ।

যাজ্ঞিকপ্রক্রিয়ানুসারী বেদার্থ দ্বারা পরাহত ব্যক্তিগণ‌ শুধু এটাই মেনে‌ থাকে‌ যে‌, বেদের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় শুধুমাত্র‌ যজ্ঞ‌ই (কর্মকাণ্ড) প্রতিপাদন‌ করা‌ , আধ্যাত্মের প্রতিপাদ্য‌ বিষয়‌ তো‌ উপনিষদের‌ [11] (যজুর্বেদের ৪০তম‌ অধ্যায়, অর্থাৎ ঈশাবাস্য অধ্যায়‌‌ও উপনিষদ্ সংজ্ঞার অন্তর্গত হ‌ওয়ার‌ দরুন‌ একেও উপনিষদে‌র‌ মধ্যে‌ গণনা‌ করে থাকে) ।

উক্ত‌ ধারণা সর্বথা মিথ্যা । আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ানুসারে সমগ্র‌ বেদের প্রতিপাদ্য বিষয় একমাত্র ব্রহ্ম ।

এই‌ বিষয়ে কতিপয় প্রমাণ এস্থলে‌ দর্শানো হলো‌ –

সর্বে বেদা য়ৎ পদমামনন্তি তপাংসি চ সর্বাণি য়দ্বদন্তি ।

য়দিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীম্যোমিত্যেতৎ ।।

[ কঠ উপনিষদ্‌. ১/১৫ ]

এই শ্রুতি দ্বারা‌ স্পষ্ট হয় যে‌, সমগ্র‌ বেদের একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় 'ওম্' । উক্ত‌ কঠ শ্রুতির প্রতিধ্বনি গীতাতেও ব্যক্ত‌ করা হয়েছে –

য়দক্ষরং ব্রহ্মবিদো বদন্তি বিশন্তি য়দ্যতয়ো বীতরাগাঃ ।

য়দিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্য়ং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ প্রবক্ষ্যে ।।

[ গীতা. ৮/১১]

এক‌ই তত্ত্ব গীতায় অন্যত্র‌ও প্রকট হয়েছে --

বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যঃ ।

[ গীতা. ১৫।১৫ ]

ভগবান্ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস তাঁর পুত্র শুকদেবকে আধ্যাত্মবিদ্যার উপদেশ প্রদানের‌ সময় অন্তে ব্যক্ত‌ করেছেন‌ –

দশেদমৃক্সহস্রাণি নির্মথ্যামৃতমদ্ভুতম্ নবনীতং য়থা দধ্নঃ কাষ্ঠাদগ্নির্য়থৈব চ । তথৈব বিদুষাং জ্ঞানং পুত্রহেতোঃ সমুদ্ধৃতম্ ॥

[ মহাভারত. শান্তি পর্ব. অধ্যায়. ২৪৬ ]

অর্থাৎ যেমন দই মন্থন করে মাখন বের করা হয়, অথবা দুটি কাষ্ঠ খণ্ডকে ঘর্ষণ করে অগ্নিকে প্রকট করা হয়, ওইপ্রকার দশ সহস্র ঋচাসমূহকে মন্থন করে আমি এই আধ্যাত্মজ্ঞান খুঁজে বের করেছি।

মহর্ষি ব্যাস তাঁর স্বীয়‌ বচনে‌ যে‌ উপমা‌ প্রদান‌ করেছেন, তা‌ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য । এই উপমাসমূহ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, যেমন দইয়ের প্রত্যেক মার্গে নবনীত সূক্ষ্ম রূপে বিদ্যমান থাকে এবং যেমন কাষ্ঠের প্রত্যেক অবয়বে অগ্নি সূক্ষ্ম রূপে বিদ্যমান থাকে, অনুরূপভাবে দশ সহস্র ঋচার (সমূহ ঋগ্বেদ) প্রত্যেক ঋচাতে সূক্ষ্মরূপে আধ্যাত্মজ্ঞান নিহিত আছে।

এই তত্ত্বকে স্বীকার বিনা উভয় উপমাই ব্যর্থ হয়ে যায় –

মহাভারতের শান্তিপর্ব ২৬৩ তম‌ অধ্যায়ে‌ উক্ত‌ তত্ত্বের উপদেশ এই‌ প্রকারে‌ বর্ণনা করা হয়েছে –

ব্রাহ্মং বেদমধীয়ন্তস্তোষয়ন্ত্যপরানপি । অখিলং দৈবতং সর্বং ব্রহ্ম ব্রহ্মণি শ্রিতম্।।

ঋকসর্বানুক্রমণীকার মহর্ষি‌ কাত্যায়ন‌ও বলেছেন‌ –

ওঙ্কারঃ সর্বদেবত্যঃ পারমেষ্ঠ্যো বা ব্রাহ্মো দৈব আধ্যাত্মিকঃ ।

অর্থাৎ, আধ্যাত্মে সমগ্র ঋচার ওঙ্কার দেবতা ; অথবা পরমেষ্ঠী বা‌ ব্রহ্ম ।

এই বিবেচনা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, প্রাচীন আচার্যগণের সিদ্ধান্তনুসারে বেদের প্রতিটি মন্ত্র আধ্যাত্মিক অর্থের প্রতিপোষণ করে ।

এই‌ ভাবার্থকে স্কন্দস্বামী তাঁর স্বীয় প্রণীত‌ নিরুক্তটীকায় মহর্ষি যাস্ককৃত‌ সিদ্ধান্তের‌ প্রমাণ‌ দিয়ে‌ এই‌ প্রকারে দর্শিয়েছেন -

সর্বদর্শনেষু চ সর্বে মন্ত্রা য়োজনীয়াঃ । কুতঃ ? স্বয়মেব ভাষ্যকারেণ সর্বমন্ত্রাণাং ত্রিপ্রকারস্য বিষয়স্য প্রদর্শনায় 'অর্থ বাচঃ পুষ্পফলমাহ' ইতি য়জ্ঞাদীনাং পুষ্পফলত্বেন প্রতিজ্ঞানাৎ ।

[ নিরুক্ত টীকা. ৭/৫ ]

অর্থাৎ - আধ্যাত্ম, নৈরুক্ত তথা যাজ্ঞিক এই‌ তিনটি প্রক্রিয়ায় সব মন্ত্রের যোজনা করা‌ আবশ্যক, কেননা ভাষ্যকার (যাস্ক) স্বয়ং সব মন্ত্রের বিষয় তিন প্রকারের, তা‌ দর্শানোর জন্য যজ্ঞ, দৈবত এবং আধ্যাত্মকে বেদবাণীর পুষ্প এবং ফল বলেছেন ।

আচার্য‌ হরিস্বামী শতপথ ব্রাহ্মণের ভাষ্যের প্রথম কাণ্ডের প্রারম্ভে লিখেছেন –

মন্ত্রা আধিয়াজ্ঞিকা ইষে ত্বাদয়ঃ, ত এব দেবতাপদত্বেনাধিদৈবিকাঃ, ত এবাত্মানমধিকৃতা আধ্যাত্মিকা: । ইষে ত্বাদয়স্ত্বাধ্যাত্মিকা এব ।

আচার্য ভর্তৃহরি‌ও মহাভাষ্যের ব্যাখ্যায় প্রসঙ্গবশ প্রকরণে‌ লিখেছেন -

য়থা ইদং বিষ্ণুর্বিচক্রমে ইত্যত্র এক এব বিষ্ণুশব্দোঽনেকশক্তিঃ সন্ অধিদৈবতমধ্যাত্মমধিয়জ্ঞং চাত্মনি নারায়ণে চষালে চ তয়া শক্ত্যা প্রবর্ততে ।

[ মহাভাষ্যদীপিকা ]

অর্থাৎ, ইদং বিষ্ণুর্বিচক্রমে এই মন্ত্রে এক বিষ্ণু শব্দ‌‌ই অনেক অর্থবাচক হ‌ওয়ায় অধিদৈবতপ্রক্রিয়ায় আত্মা (সূর্য, 'সূর্য আত্মা জগতস্তস্থুষশ্চ' ) আধ্যাত্মে নারায়ণ এবং অধিযজ্ঞে চষাল অর্থে‌ ব্যাখ্যা‌ করা‌ হয়ে থাকে ।

এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে‌, বেদের সমস্ত দেবতাবাচক পদ বিবিধ প্রক্রিয়ায় অর্থ ব্যক্ত‌ করায় পূর্ণ সমর্থ ।

অতঃ বেদের প্রত্যেক দেবতাবাচক পদের আধ্যাত্ম প্রক্রিয়াপরক অর্থ সর্বদা সম্ভব ।

শুধু এই নয়, বেদের অনেক মন্ত্রে অগ্নি আদি কতিপয় এমন বিশিষ্ট বিশেষণ প্রযুক্ত, যা‌ অভিধাবৃত্তি দ্বারা কেবল আধ্যাত্ম প্রক্রিয়াতেই‌ উপপন্ন হ‌ওয়া সম্ভব ।

যথা – 'কবিমগ্নিমুপস্তুহি' ( ঋগ্বেদ.১/১২/৭) শ্রুতিতে‌ অগ্নি পদ‌ কবির বিশেষণ । ভৌতিক অগ্নির কবি বিশেষণ বিনা লক্ষণায় কদাপি উপপন্ন হ‌ওয়া অসম্ভব ।

অনেক আধ্যাত্মদর্শনবিহীন তথাকথিত পণ্ডিতম্মন্য আশঙ্কা করে থাকে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় বিনিয়োগ কৃত মন্ত্রসমূহের আধ্যাত্মিক অর্থ কীরূপে সম্ভব ? ঔষধি আদি ভৌতিক পদার্থবাচক পদ আধ্যাত্মপ্রক্রিয়ার পক্ষে কীরূপে সঙ্গত হতে পারে ?

উক্ত প্রসঙ্গে এটুকু কথন‌ই আবশ্যক যে‌, এমন শঙ্কাকারী‌ ব্যক্তিগণ‌ আধ্যাত্ম শব্দের বাস্তবিক স্বরূপ সমন্ধে সম্পূর্ণভাবে‌ই অজ্ঞাত । এই অজ্ঞাত ব্যাক্তিগণ আধ্যাত্মের‌ অর্থ কেবল ব্রহ্মের প্রতিপাদন এরূপ ধারণা পোষণ করে থাকে । এই লেখ‌ এর প্রারম্ভেই সবিস্তারে দর্শানো‌ হয়েছে‌ আধ্যাত্ম শব্দের অর্থ - শরীর, জীব এবং ঈশ্বর সম্বন্ধী বিশেষ জ্ঞানের প্রতিপাদন ।

এই অন্তর্দৃষ্টি নির্ণয়ের পর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় প্রযুক্ত‌ মন্ত্রসমূহে শরীর এবং জীবের সাক্ষাৎ বর্ণন হ‌ওয়ার‌ দরুন উক্ত‌ ক্রিয়ার প্রতিপাদ্য বিষয় আধ্যাত্ম অতিরিক্ত এ স্থলে‌ অন্য‌ কোন কিছু হ‌ওয়া অসম্ভব ।

সংসারের সমস্ত পদার্থ জীবের আনন্দ‌ প্রাপ্তি‌র‌ জন্য সৃষ্টি হয়েছে, অতঃ সাংসারিক পদার্থের গুণবর্ণন দ্বারা তার সদুপয়োগের বিধান করাও আত্মকল্যাণার্থ ।

ঔষধিসমূহ তো শরীরের সহিত‌ সাক্ষাৎ সম্বন্ধ, এর সেবন দ্বারা শরীর নিরোগ হয়ে থাকে এবং সেই‌ নৈরোগ্য দ্বারা আত্মার‌ আনন্দ‌ প্রাপ্তি হয়ে থাকে । একারণে ঔষধি বিজ্ঞানের মন্ত্রসমূহ শরীরের‌ সহিত‌ সাক্ষাৎ এবং আত্মার‌ সহিত‌ পরম্পরা দ্বারা‌ সম্বন্ধ বিস্পষ্ট ।

এই প্রকারে বেদের সমস্ত‌ মন্ত্র শরীর, আত্মা এবং পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরা দ্বারা সম্বন্ধ হ‌ওয়ার‌ দরুন এর‌ আধ্যাত্মিক অর্থ হ‌ওয়ার‌ পক্ষে‌ বিষয়টি‌ বাস্তবিকভাবে কোনরূপ দুর্বোধ্য নয় ।

দুর্বোধ্য তো তখন‌ই লক্ষ্যণীয় যখন আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় অর্থ কেবল পরমাত্মা সম্বন্ধী এমনটা ধারণা করা হবে ।

শুধু এই‌ নয়‌, যে‌ মন্ত্রসমূহের‌ বিনিয়োগ যজ্ঞ‌ প্রক্রিয়ায় তার‌ তো আধ্যাত্মিক অর্থ অবশ্য‌ই স্বীকার করা‌ অতি‌ আবশ্যক, কেননা‌, বৈদিক পরম্পরা অনুসারে যজ্ঞ ব্রহ্মাণ্ড এবং পিণ্ডের প্রতিনিধি ।

শতপথকার মহর্ষি‌ যাজ্ঞবল্ক্য‌ও দর্শপৌর্ণমাসের‌ বিস্তারিত‌ আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার‌ অন্তে‌ লিখেছেন -

তদাহু: – আত্ময়াজী শ্রেয়া৩ন্ দেবয়াজী ৩ ইতি‌ । আত্ময়াজীতি ব্রূয়াৎ । স হ বা আত্ময়াজী য়ো বেদেদং মেঽনেনাঙ্গ সংস্ক্রিয়তে, ইদং মেঽনেনাঙ্গমুপধীয়ত ইতি ।

[ শতপথ ব্রাহ্মণ. ১১/২/৬/১৩ ]

অর্থাৎ দেবযাজী এবং আত্মযাজীর মধ্যে আত্মযাজী শ্রেষ্ঠ । আত্মযাজী তাঁকেই বলা হয়, যিনি যজ্ঞ সম্বন্ধে পারঙ্গত‌ বিদ্বান‌, যিনি‌ জানেন‌ যজ্ঞের কোন ক্রিয়া দ্বারা আমার শরীরের কোন‌ অঙ্গের সংস্কৃত হবে বা বৃদ্ধিকে প্রাপ্ত হবে ।

এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে‌, যজ্ঞে বিনিয়োগকৃত তত্তন্মন্ত্রের সম্বন্ধ আধ্যাত্ম প্রক্রিয়ায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সহিত‌ ।

এ কারণে‌ যখন‌ যজ্ঞক্রিয়া‌ই আধ্যাত্মে পর্যবসান হয়ে থাকে, তখন যজ্ঞে বিনিয়োগকৃত মন্ত্রসমূহ'র অর্থের আধ্যাত্ম প্রক্রিয়ায় পর্যবসান হ‌ওয়া অবশ্যম্ভাবী ।

এই‌ বিবেচনা দ্বারা‌ এটাও‌ ব্যক্ত হয়ে যে‌, যে বা যারা বেদ কেবল যজ্ঞ কর্মের নিমিত্ত‌ মেনে‌ থাকে‌, তারা বস্তুতঃ যজ্ঞ কর্মের মূল‌ মর্ম সম্বন্ধে পরিপূর্ণভাবে অজ্ঞাত‌ ।


 আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন

যেই প্রকার যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ায় উত্তরোত্তর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সেই প্রকারে বেদার্থের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায়‌ও মহান্ পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় ।

সর্বপ্রথম আধ্যাত্ম প্রক্রিয়ার‌ সহিত‌ শরীর বিজ্ঞানের সম্বন্ধ ক্ষুণ্ণ হলো, তদনন্তর আত্মবিজ্ঞানের সম্বন্ধ চূর্ণীত হলো এবং আধ্যাত্ম শব্দ কেবল পরমাত্মচিন্তন অর্থে প্রযুক্ত‌ হ‌‌ওয়ার‌ প্রচলন‌ হলো‌ ।

এই পরিবর্তনের প্রভাব উপনিষদে‌ও স্পষ্ট লক্ষিত । ঈশ, কঠ আদি উপনিষদে শরীর, আত্মা এবং পরমাত্মা এই তিন‌ তত্ত্বের বর্ণন বিদ্যমান, মুণ্ডকে আত্মা এবং পরমাত্মা উভয়ের‌ই উল্লেখ রয়েছে এবং মাণ্ডূক্যে শুধুমাত্র ব্রহ্ম তত্ত্বের‌ই প্রতিপাদন হয়েছে । এই একাঙ্গী ব্রহ্মবিচার‌ই উত্তরকালে অদ্বৈতবাদরূপে পরিণত হয়েছে ।

এই পরিবর্তনের প্রভাব দ্বারা বেদার্থের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া‌ও প্রভাবিত । উত্তরকালে 'মন্ত্রার্থে‌ যেন-তেন প্রকারে ঈশ্বর সম্বন্ধ যুক্ত‌ করে' আধ্যাত্মিক অর্থ হিসেবে গ্রহণ‌ হতে‌ থাকে ।

মধ্বাচার্য তথা তাঁর সম্প্রদায়ের বিদ্বানগণকৃত বেদভাষ্য উক্ত‌ প্রসঙ্গের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।

বেদের‌ কর্মকাণ্ডের সহিত‌ বিশেষ সম্বন্ধ হ‌ওয়ার‌ দরুন অথবা 'বেদ কেবল যজ্ঞের জন্য প্রবৃত্ত হয়েছে' এমন‌ কপোলকল্পিত মিথ্যা ধারণা পোষণ করায় শনৈঃ শনৈঃ বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ‌ বিদ্যা‌ আধ্যাত্ম বিদ্যার সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এবং যেমনভাবে শুধু যাজ্ঞিক প্রক্রিয়া প্রাধান্য‌ দেওয়ার দরুন শনৈঃ শনৈঃ বেদের মুখ্যতা বিনষ্ট‌ হয়ে ব্রাহ্মণ গ্রন্থ মুখ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা‌ পেলো, তদ্রূপ আধ্যাত্ম বিদ্যার‌ সহিত বেদের সম্বন্ধ ক্ষুণ্ণ হ‌ওয়ার‌ পর‌ উপনিষদ‌ই আধ্যাত্ম বিদ্যার মুখ্য গ্রন্থ হিসেবে মান্যতা পেলো ।

এ কারণে উত্তরকালে (দ্বাপর যুগের‌ চতুর্থ চরণ) বেদ অপরা বিদ্যা হিসেবে পরিগণিত হলো । [12] তদনন্তর উপনিষদের প্রধানতা দ্বারা ফায়দা‌ লুটে উপনিষদের নামে এমন অনেক পুস্তক স্বীয় সার্থ হাসিলের‌ জন্য রচনা করা হয়েছে, যে‌সবে‌ আধ্যাত্ম বিদ্যার লেশমাত্র অনুপস্থিত ।

রামতাপিনী আদি শতশঃ নামধারী উপনিষদ্‌ এর‌ অন্তর্গত । এমনকি যবন, ম্লেচ্ছ‌ সম্প্রদায়ের সহিত সম্বন্ধকারী অল্লোপনিষদ্ নামে এক‌ গ্রন্থের‌‌ও রচনা হয়েছে ।

যে‌ই প্রকারে‌ যাজ্ঞিক প্রক্রিয়ায় শনৈঃ শনৈঃ বেদ মন্ত্র অনর্থক = অর্থ রহিত হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে‌, তদ্রূপ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায়‌ও মন্ত্র অনর্থক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এই কারণে মন্ত্রের জপমাত্রকে প্রধানতা দেওয়া হতে থাকে অর্থাৎ, মন্ত্রের মূল‌ স্বরূপ উপলব্ধি হোক বা না হোক, কেবল জপের মাধ্যমেই কল্যাণ হ‌বে, এমন ভাবনার উদয় হয় ।

উত্তরকালে বৈদিক মন্ত্রের জপের প্রাধান্য‌ হ্রাস‌ পায় এবং সে‌ স্থলে‌ ‘রাধাকৃষ্ণাভ্যাং নমঃ' 'সীতারামাভ্যাং নমঃ' আদি সাম্প্রদায়িক জপের‌ প্রাধান্য‌ বৃদ্ধি পেতে থাকে । অন্তে জপের মাহাত্ম্য এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে‌, উল্টা ক্রমে‌ নাম জপেও কল্যাণ হয়ে থাকে এমন ধারণা‌ হতে থাকে । [13] । এই প্রকারে বেদের 'দ্বা সুপর্ণা সয়ুজা সখায়া' আদি মন্ত্রে জীব এবং ব্রহ্মের যে‌ নাম সাম্যরূপী 'সমান-খ্যানত্ব" [14] এর উল্লেখ হয়েছে, এর‌ মূল‌ ভাবের বোধগম্য‌ না‌ হ‌ওয়ায় বল্লভ আদি সম্প্রদায়ে গোপী-কৃষ্ণ আদি রাসলীলার উদয় হয় ।

এই প্রকারে‌ বেদার্থে‌র‌ সর্বশ্রেষ্ঠ‌ প্রক্রিয়া‌ আধ্যাত্মিকতার‌ মূল‌ স্বরূপ‌ বর্ণনা করা হলো ।

– বিদুষাং বশংবদঃ


                     তথ্যসূত্র

1. অর্থ বাচঃ পুষ্পফলমাহ, য়াজ্ঞদৈবতে পুষ্পফলে, দেবতাধ্যাত্মে বা ।

                                                           [ নিরুক্ত. ১/২০ ]


2. 'দ্বাবাত্মানৌ – অন্তরাত্মা শরীরাত্মা চ ।' [ মহাভাষ্য ১/৩/৬৭ ]

অথর্ববেদ. ১০/২/৩২ তথা ১০/৮/৪৩ মন্ত্রদ্বয়ে যক্ষ=জীবের জন্য প্রযুক্ত 'আত্মন্বৎ' বিশেষণে আত্মা শব্দের অর্থ শরীর ।


3. আত্মানমধিকৃত্য ইত্যধ্যাত্মম্, বিভক্ত্যর্থেঽব্যয়ীভাবঃ ।


4. 'শাস্ত্রয়োনিত্বাৎ' । [ বেদান্ত. ১/১/৩ ]

'অরেঽস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতমেতদ্ ঋগ্বেদো য়জুর্বেদঃ সামবেদোঽথর্বাঙ্গিরসঃ ।' [ শতপথ ব্রাহ্মণ. ১৪/৫/৪/৬ ]


5. 'নৈবেশ্বরস্যৈকস্মিন্নপি মন্ত্রার্থেত্যন্তং ত্যাগো ভবতি ।'

                   [ ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা ]


6. মহর্ষি‌ যাস্ক নিরুক্ত ৭/১,২ শ্লোকদ্বয়ে ঋচাসমূহের ত্রিবিধত্বের প্রতিপাদনে পরোক্ষকৃত এবং প্রত্যক্ষকৃতের সাথে যে আধ্যাত্মিকের নির্দেশ করেছেন, তা উক্ত আধ্যাত্মিক থেকে সর্বথা ভিন্ন ।


7. ব্যাখ্যাতং দৈবতং য়জ্ঞাঙ্গ চ । অথাত ঊর্ধ্বগতিং ব্যাখ্যাস্যামঃ ।

                                                         [ নিরুক্ত ১৪/ ১॥ ]


8. একৈব হ মহানাত্মা দেবতা, স সূর্য় ইত্যাচক্ষতে, স হি সর্বভূতাত্মা ।

                                                  [ ঋকসর্বানুক্রমণী ]


৯. এ কারণে ঋগ্বেদের প্রারম্ভে 'অগ্নি' পদের‌ই নির্দেশ করা হয়েছে ।


10. এই মন্ত্রে উল্লেখিত ইন্দ্র, মিত্র আদি পদ কেবল একবার প্রযুক্ত হয়েছে, এবং 'অগ্নি' পদ দুইবার । এ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে‌, অগ্নি পদে উদ্দেশ্যতা বিদ্যমান‌, এবং ইন্দ্র, মিত্র আদিতে বিধেয়তা ।

কাত্যায়ন এক মহানাত্মার নাম 'সূর্য' বর্ণনা করে তাঁর বিভূতিসমূহ অন্য দেব, এর প্রতিপাদনের জন্য উক্ত‌ মন্ত্র‌ই উদ্ধৃত করেছেন । এটা সঠিক নয়‌, কেননা এই মন্ত্রে সাক্ষাৎ সূর্যের‌ই নির্দেশ অনুপলব্ধ । যদি 'সুপর্ণকে' সূর্যবাচক মানাও‌ হয়, তবুও তাতে মন্ত্র নির্দেশানুসার উদ্দেশ্যতা অনুপলব্ধ, বিধেয়তা ।

আধুনিক সদৈক্যবাদী এই মন্ত্রের 'সৎ' শব্দে উদ্দেশ্যতা এবং ইন্দ্র আদির সমান অগ্নিতেও বিদেয়তা মেনে থাকে, তাও‌ সঠিক নয় । অগ্নি পদের দুইবার প্রয়োগ হ‌ওয়ায় তাতে‌ বিধেয়তা কোনভাবেই মানা অসম্ভব । অতঃ 'একং সদ্ অগ্নি বিপ্রা বহুধা বদন্তি' এই‌ অন্বয়‌ই সর্বদা সঠিক ।


11. মনু. ১২/১২৩


12. তস্মিশ্চ বেদে দ্বৌ কাণ্ডৌ – কর্মকাণ্ডো ব্রহ্মকাণ্ডশ্চ । বৃহদারণ্যাখ্যো গ্রন্থো ব্রহ্মকাণ্ডঃ, তদ্ব্যতিরিক্তং শতপথব্রাহ্মণং সংহিতা চেত্যনয়োর্গ্রন্থয়োঃ কর্মকাণ্ডত্বম্ । তত্রোভয়ত্রাগ্নিহোত্রদর্শপৌর্ণমাসাদিকর্মণ এব প্রতিপাদিতত্বাৎ ।' কাণ্বসংহিতা সায়ণভাষ্যোপক্রমণিকা (কাশী সংস্করণ ) । এই লেখ-এ সায়ণ সম্পূর্ণ যজুর্বেদে কর্মকাণ্ডের প্রতিপাদন মেনেছে ।


13. মুণ্ডক ১।১।৫॥


14. উলটে নাম জপত জগ জানা, বাল্মীকী ভয়ে ব্রহ্মসমানা


15. ঋগ্বেদ ১/১৬৪/২০॥


16. সখা শব্দের অর্থ সমান-খ্যান (নিরুক্ত. ৭/৩০) অর্থাৎ, সমনামী ।

আত্মা, ব্রহ্ম, যক্ষ, হংস আদি অনেক নাম জীব এবং ঈশ্বর উভয়ের‌ই সমান । এ কারণে জীব থেকে ঈশ্বরকে‌ পৃথক্‌ করার‌ জন্য এসবে পরম বৃহৎ, মহৎ, খ, ব্যোমন্ আদি বিশেষণ যুক্ত‌ হয়ে থাকে ।