https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্বাধ্যায় [১] - ভগবান কে ? ভগবান ও ঈশ্বর কি এক ?

Thursday, October 27, 2022


প্রশ্নঃ– শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে সম্বোধন করেছেন , আর্যসমাজ কি শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে স্বীকার করে ? 

উত্তরঃ– অবশ্যই আর্য সমাজ আর্ষ সিদ্ধান্ত ও পরম্পরা অনুযায়ী ভগবান বলে স্বীকার করে । তবে তার আগে ভগবান শব্দটির অর্থ সম্পর্কে সম্যকরূপে জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক । মূখ্য ও গৌণ দুইভাবে সম্বোধন হতে পারে । উদাহরণস্বরূপ আমরা জড়জগতে আমাদের জৈবিক জন্মদাতা দম্পতিকে মাতা-পিতা বলে সম্বোধন করি , মিত্রকে বন্ধু - সখা ইত্যাদি শব্দে আখ্যায়িত করি । বেদেও পরমাত্মাকে একইভাবে সম্বোধন করা হয়েছে । উদাহরণস্বরূপ - 


স নঃ পিতা জনিতা স উত বন্ধুর্ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা ।

যো দেবানাং নামধ এক এব তং সংপ্রশ্নং ভুবনা যন্তি সর্বা॥

অথর্ববেদ ২।১।৩ 

পদার্থঃ (সঃ) তিনিই [ঈশ্বর] (নঃ) আমাদের (পিতা) পালক ও (জনিতা) জনক (উন) এবং (সঃ) তিনিই বন্ধু, তিনিই (বিশ্বা=বিশ্বানি) সব (ধামানি) পদসমূহ [অবস্থাসমূহকে] ও (ভুবনানি) লোককে (বেদ) জানেন। (যঃ) যেই [পরমেশ্বর] (একঃ) একা (এব) ই (দেবানাম) দিব্যগুণযুক্ত পদার্থের (নামধঃ) নামকরণকারী (সপ্রশ্নম) যথাবিধি প্রশ্নের যোগ্য (তম) তাকেই (সর্বা=সর্বাণি) সব (ভুবনা) ভুবন (যন্তি) প্রাপ্ত হয়৷

বঙ্গানুবাদঃ- তিনিই [ঈশ্বর] আমাদের পালক ও জনক এবং তিনিই বন্ধু, তিনিই সব পদসমূহ [অবস্থাসমূহকে] ও লোকসমূহকে জানেন। সেই যথাবিধি প্রশ্নের যোগ্য, দিব্যগুণযুক্ত পদার্থের নামকরণকারী এক [পরমেশ্বর] -কেই সব ভুবন প্রাপ্ত হয়৷ 


অগ্নিং মন্যে পিতরমগ্নিমাপিমগ্নিং ভ্রাতরং সদমিত্সখায়ম্ । 

অগ্নেরনীকং বৃহতঃ সপর্য দিবি শুক্রং যজতং সূর্যস্য॥ 

ঋগবেদ ১০।৭।৩

পদার্থঃ (অগ্নিম্) জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাকে (পিতরম্ মন্যে) আমি পিতা মান্য করছি (অগ্নিম্ আপিম্) জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাকে বন্ধু (অগ্নিম্ ভ্রাতরম্) জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাকে ভ্রাতা এবং (সদম্ ইত্ সখায়ম্) সদাই মিত্র মান্য করছি (বৃহতঃ অগ্নেঃ) এই বৃহৎ জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মার (অনীকম্) বলকে (সপর্যম্) আমি পূজন করছি । এই জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মার প্রভাব দ্বারা (দিবি) দ্যুলোকে (সূর্যস্য) সূর্যের (যজতম্) মহা পবিত্রকারী (শুক্রম্) তেজ উজ্জ্বল করছে।

বঙ্গানুবাদঃ- জ্ঞানস্বরূপ পরমাত্মাকে আমি পিতা, বন্ধু, ভ্রাতা এবং সর্বদাই মিত্র মান্য করছি। এই বৃহৎ পরমাত্মার বলকে আমি পূজন করছি। তাঁর প্রভাব দ্বারা সূর্যের মহা পবিত্রকারী তেজ দ্যুলোককে উজ্জ্বল করছে।


ত্বং হি নঃ পিতা বসো ত্বং মাতা শতক্রতো বভূবিথ । 

অধা তে সুম্নমীমহে ॥

ঋগ্বেদ ৮।৯৮।১১

= হে নিবাসপ্রদাতা পরমেশ্বর ! তুমিই আমাদের পিতা [ পালক ], বিবিধ প্রজ্ঞা ও কর্মবিশিষ্ট প্রভু তুমিই আমাদের মাতা [ নির্মাণকর্ত্রী ] । এজন্য তোমার থেকে সুখ যাচনা করি ।

এখানে শাব্দিক অর্থের চেয়েও আভ্যন্তরীণ অর্থ ব্যাপক । যেমন পরমেশ্বর লালন-পালন করেন বলে তিনি মাতা , রক্ষা করেন বলে তিনি পিতা আবার সদুপদেশ প্রদান করেন বিধায় আচার্য ও সর্বহিতকামী বিধান তিনিই মিত্র । 

অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি জাগতিক ও পারমার্থিক ক্ষেত্রে একই শব্দ দ্বিস্থানে দ্বিবিধ ও বিস্তৃত অর্থ প্রকাশ করছে ।

নিঘণ্টুতে [ ২.১০ ] 'ভগ' শব্দটি ধনবাচক । 

 


জগতে পিতা-মাতা-আচার্য গুরুদেব জ্ঞান রূপ ঐশ্বর্যযুক্ত বলে তাদের ভগবান বলে ঔপচারিকরূপে সম্বোধন করা হয় । বেদে বিবিধস্থলে আচার্যের নিকট বিদ্যা-শিক্ষারূপ ধনের যাচনা করা হয়েছে - 

অভীষতস্তদা ভরেন্দ্র জ্যায়ঃ কনীয়সঃ।
পুরূবসুর্হি মঘবন্বভূবিথ ভরেভরে চ হব্যঃ ॥ 

সামবেদ ৩০৯ 

পদার্থঃ হে (ইন্দ্র) দোষবিদারক উপদেশ প্রদানকারী আচার্যবর ! (কনীয়সঃ সতঃ) আয়ু এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে কনিষ্ঠ আপনার এই শিষ্যকে আপনি (তৎ) আপনার মাঝে বিদ্যমান (জ্যায়ঃ) প্রভূত তথা মহান বিশাল বিদ্যারূপ ভাণ্ডারকে (অভি আ ভর) প্রদান করুন। (হি) কেননা, হে (মঘবন্) সচ্চরিত্ররূপ সম্পদের অধিপতি ! আপনি (পুরূবসুঃ বভূবিথ) বহু বিদ্যা বিশারদ (ভরে ভরে চ) এবং প্রত্যেক শিষ্যকে বিদ্যা প্রদানের জন্য (হব্যঃ) আহ্বানের যোগ্য ॥৭॥
সরলার্থঃ হে দোষবিদারক উপদেশ প্রদানকারী আচার্যবর ! আয়ু এবং জ্ঞানের দিক দিয়ে কনিষ্ঠ আপনার এই শিষ্যকে আপনি আপনার মাঝে বিদ্যমান প্রভূত তথা মহান বিশাল বিদ্যারূপ ভাণ্ডারকে প্রদান করুন। কেননা, হে সচ্চরিত্ররূপ সম্পদের অধিপতি! আপনি বহু বিদ্যা বিশারদ এবং প্রত্যেক শিষ্যকে বিদ্যা প্রদানের জন্য আহ্বানের যোগ্য ॥৭॥



আ পবস্ব সহস্রিণং রয়িং সোম সুবীর্য়ম্।
অস্মে শ্রবাংসি ধারয় ॥

সামবেদ ৫০১
পদার্থঃ হে (সোম) সর্বৈশ্বর্যবান্ জগদীশ্বর অথবা বিদ্বান্ আচার্য! আপনি আমাদের জন্য (সহস্রিণম্) সহস্র সংখ্যাযুক্ত অথবা প্রচুর বা পরম ['পরমং সহস্রম্' তা০ ব্রা০ ১৬।৯।২] (সুবীর্য়ম্) শুভ বলযুক্ত (রয়িম্) মোক্ষ রূপ ঐশ্বর্যকে অথবা বিদ্যাধনকে (আ পবস্ব) প্রবাহিত করুন ও (অস্মে) আমাদের [‘সুপাং সুলুক্।’ অষ্টা০ ৭।১।৩৯] (শ্রবাংসি) যশকে (ধারয়) স্থাপিত [প্রতিষ্ঠিত] করুন ॥৫॥
সরলার্থঃ হে সর্বৈশ্বর্যবান্ জগদীশ্বর অথবা বিদ্বান্ আচার্য! আপনি আমাদের জন্য সহস্র সংখ্যাযুক্ত অথবা প্রচুর, শুভ বলযুক্ত মোক্ষ রূপ ঐশ্বর্যকে অথবা বিদ্যাধনকে প্রবাহিত করুন ও আমাদের যশকে স্থাপিত [প্রতিষ্ঠিত] করুন ॥



ভ্রাজন্ত্যগ্নে সমিধান দীদিবো জিহ্বা চরত্যন্তরাসনি।
স ত্বং নো অগ্নে পয়সা বসুবিদ্রয়িং বর্চো দৃশেঽদাঃ ॥

সামবেদ ৬১৫


পদার্থঃ 
আচার্য রূপ অগ্নিতে নিজেকে আহুতি দেবার জন্য সমিধ হাতে গুরুকুলে আগত শিষ্য বলছেন—হে (সমিধান) স্বয়ং জ্ঞানদীপ্ত, তথা (দীদিবঃ) শিষ্যদের জ্ঞান দ্বারা প্রদীপ্তকারী, (অগ্নে) বিদ্বান আচার্যদেব! আপনার (আসনি অন্তঃ) মুখের ভেতর (ভ্রাজন্তী) শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা উপদেশ প্রদানের ফলে যশ দ্বারা দীপ্তিমান (জিহ্বা) জিহ্বা (চরতি) শব্দসমূহের উচ্চারণের জন্য তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থানে বিচরণ করে। (সঃ) সেই মহিমান্বিত, (বসুবিৎ) বিবিধ বিদ্যা রূপ ধনের দাতা (ত্বম্) আপনি, হে (অগ্নে) আচার্যদেব! (নঃ) আমাদের (দৃশে) কর্তব্য-দর্শনের জন্য (পয়সা) বেদজ্ঞান রূপ দুধের সাথে (রয়িম্) সদাচারের সম্পদ এবং (বর্চঃ) ব্রহ্মবর্চস তথা ব্রহ্মতেজ (দাঃ) আমাদেরকে প্রদান করুন ॥১॥
সরলার্থঃ আচার্য রূপ অগ্নিতে নিজেকে আহুতি দেবার জন্য সমিধ হাতে গুরুকুলে আগত শিষ্য আচার্যের উদ্দেশ্যে বলছেন—হে স্বয়ং জ্ঞানদীপ্ত, তথা শিষ্যদের জ্ঞান দ্বারা প্রদীপ্তকারী, বিদ্বান আচার্যদেব! আপনার মুখের ভেতর, শাস্ত্রজ্ঞান দ্বারা উপদেশ প্রদানের ফলে প্রাপ্ত যশ দ্বারা দীপ্তিমান জিহ্বা, শব্দসমূহের উচ্চারণের জন্য তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থানে বিচরণ করে। সেই মহিমান্বিত, বিবিধ বিদ্যা রূপ ধনের দাতা, হে আচার্য্যদেব! আপনি আমাদের কর্তব্য-দর্শনের জন্য বেদজ্ঞান রূপ দুধের সাথে সদাচারের সম্পদ এবং ব্রহ্মবর্চস তথা ব্রহ্মতেজ আমাদেরকে প্রদান করুন ॥১॥

আবার পরমাত্মাই জগদাধিপতি, সর্ব ঐশ্বর্যের একচ্ছত্র অধিপতি , জগতের সম্রাট , অদ্বিতীয় - সর্বশক্তিমান বিধান তাঁর ঐশ্বর্যহেতু তাকেও ভগবান বলা হয় । বেদে অনেকত্রই ব্রহ্মের নিকট সদ্গুণ তথা আধ্যাত্মিক ও ভৌতিক ধন-সম্পদের প্রার্থনা করা হয়েছে । যেমন -

অগ্নিং দূতং বৃণীমহে হোতারং বিশ্ববেদসম্। 

অস্য য়জ্ঞস্য সুক্রতুম্ ॥

সামবেদ ৩ 


পদার্থঃ
আমরা (হোতারম্) দিব্য গুণের আহ্বানকারী, ['হোতারং হ্বাতার' নিরু০ ৭।১৫, 'বহুলং ছন্দসি' অষ্টা০ ৬।১।৩৪] (বিশ্ববেদসম্) বিশ্বের জ্ঞাতা, বিশ্বে পূর্ণভাবে বিদ্যমান তথা সকল আধ্যাত্মিক এবং ভৌতিক ধনের ['বেদ ইতি ধননাম' নিঘ০ ২।১০] স্রোত, (অস্য) এই অনুষ্ঠিত (য়জ্ঞস্য) অধ্যাত্ম-যজ্ঞের (সুক্রতুম্) সুকর্তা, সুপ্রজ্ঞাবান ['ক্রতুরিতি কর্মনাম' নিঘ০ ২।১, 'ক্রতুঃ প্রজ্ঞানাম' নিঘ০ ৩।৯, 'ক্রত্বাদয়শ্চ' অষ্টা০ ৬।২।১১৮] সুসঞ্চালক ঋত্বিকরূপ (অগ্নিম্) পরমাত্মাকে (দূতং বৃণীমহে) দিব্য গুণ [‘দূতো দেবানামসি’ নিরু০ ৫।১] অবতরণের জন্য দূতরূপে বরণ করছি ॥৩॥


সরলার্থঃ দিব্যগুণের আহ্বানকারী, বিশ্বের জ্ঞাতা, বিশ্বে পরিপূর্ণ ভাবে বিদ্যমান তথা সমস্ত আধ্যাত্মিক ও ভৌতিক ধনের স্রোত, এই অনুষ্ঠিত অধ্যাত্ম যজ্ঞের সুকর্তা, সুপ্রজ্ঞাবান, সুসঞ্চালক, যজ্ঞের ঋত্বিকরূপ পরমাত্মাকে আমরা দিব্য গুণ অবতরণের জন্য দূতরূপে বরণ করছি ॥৩॥


পরি বাজপতিঃ কবিরগ্নির্হব্যান্যক্রমীৎ।
দধদ্রত্নানি দাশুষে ॥

সামবেদ ৩০


পদার্থঃ
 (বাজপতিঃ) আত্মিক বলের অধীশ্বর, মোক্ষানন্দের অধিপতি ['অমৃতোঽন্নং বৈ বাজঃ' জৈ০ ব্রা০ ২।১৯৩] (কবিঃ) মেধাবী, দূরদর্শী ['কবিরিতি মেধাবিনাম' নিঘ০ ৩।১৫, 'কবিঃ ক্রান্তদর্শনো ভবতি কবতের্বা' নিরু০ ১২।১৩] (অগ্নিঃ) প্রকাশস্বরূপ পরমেশ্বর (দাশুষে) নিজের আত্মাকে হবি বানিয়ে ঈশ্বরে অর্পণকারী, আত্মদানকারী স্তোতার জন্য ['দাশ্বান্ সাহ্বান্ মীঢ্বাঁশ্চ' অষ্টা০ ৬।১।১২] (রত্নানি) রমণীয় সদ্গুণরূপ ধন ['রত্নানাং রমণীয়ানাং ধনানাম' নিরু০ ৭।৫] (দধৎ) প্রদান করতে করতে স্তোতার (হব্যানি) আত্মসমর্পণরূপ হবিকে (পরি অক্রমীৎ) সব দিকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ গ্রহণ করেন ['ছন্দসি লুঙ্লঙ্লিটঃ' অষ্টা০ ৩।৪।৬] ॥
সরলার্থঃ নিজের আত্মাকে হবি বানিয়ে ঈশ্বরে অর্পণকারী, আত্মদানকারী স্তোতার জন্য আত্মিক বলের অধীশ্বর, মেধাবী, দূরদর্শী, প্রকাশস্বরূপ পরমেশ্বর রমণীয় সদ্গুণরূপ ধন প্রদান করতে করতে স্তোতার আত্মসমর্পণরূপ হবিকে সব দিকে প্রাপ্ত হন অর্থাৎ গ্রহণ করেন ॥

অনেকেই ভাবেন বেদে ভগবান শব্দটি নেই । মূলতঃ তারা প্রকৃতভাবে বেদ অধ্যয়ন করেননি বলে এহেন অজ্ঞতা প্রদর্শন করেন । বেদে রয়েছে - 

 

ভগ এব ভগবাং অস্তু দেবাস্তেন বয়ং ভগবন্তঃ স্যাম। 

তং ত্বা ভগ সর্ব ইজ্জোহবীতি স নো ভগ পুরএতা ভবেহ ॥

ঋগ্‌বেদ ৭।৪১।৫

= হে (ভগঃ) সর্বৈশ্বর্য প্রদাতা ! তুমি (ভগঃ) অতি ভজনীয় (ভগবান্) সকলৈশ্বর্য্যসম্পন্ন (অস্তু) রূপে বিদ্যমান ;(তেনৈব) সেই ভগবানের সাথে (বয়ম্) আমরা (দেবাঃ) বিদ্বানরা (ভগবন্তঃ) সর্বৈশ্বর্যযুক্ত (স্যাম) হবো, হে সকলৈশ্বর্য্য প্রদাতা ! যে (সর্বঃ) সর্ব মানব (তম্) সেই (ত্বা) তোমাকে (জোহবীতি) নিরন্তর প্রশংসা করে (সঃ) সে (ইহ) এখন (নঃ) আমাদের (পুরএতা) অগ্রগামী হোক এবং হে (ভগ) ভজনীয় বস্তুপ্রদাতা ! তুমিই আমাদের অর্থকে অগ্রগামীকারী (ভব) হও ॥

 

ভগ এব ভগবাং অস্তু দেবাস্তেন বয়ং ভগবন্তঃ স্যাম। 

তং ত্বা ভগ সর্ব ইজ্জোহবীতি স নো ভগ পুরএতা ভবেহ ॥

যজুর্বেদ ৩৪।৩৮ 

পদার্থঃ- হে (দেবাঃ) বিদ্বান্ গণ ! যিনি (ভগ, এব) সেবনীয় (ভগবান্) প্রশস্ত ঐশ্বর্য্যযুক্ত (অস্তু) হইবেন (তেন) সেই ঐশ্বর্য্যরূপ ঐশ্বর্য্যসম্পন্ন পরমেশ্বর সহ (বয়ম্) আমরা (ভগবন্তঃ) সমগ্র শোভাযুক্ত (স্যাম) হইব। হে (ভগ) সম্পূর্ণ শোভাযুক্ত ঈশ্বর ! (তম্ ত্বা) সেই আপনাকে (সর্বঃ, ইৎ) সমস্তই ব্যক্তি (জোহবীতি) শীঘ্র আহ্বান করে। হে (ভগ) সকল ঐশ্বর্য্য প্রদাতা (সঃ) সুতরাং আপনি (ইহ) এই জগতে (নঃ) আমাদের (পুর এতা) অগ্রগামী (ভব) হউন॥
ভাবার্থঃ- হে মনুষ্যগণ ! তোমরা যে সমস্ত ঐশ্বর্য্য দ্বারা যুক্ত পরমেশ্বর, তাঁহার এবং যাহারা তাঁহার উপাসক বিদ্বান্, তাহাদের সহ সিদ্ধ ও শ্রীমান্ হও, যে জগদীশ্বর মাতা-পিতার সমান আমাদের উপর কৃপা করেন, তাঁহার ভক্তিপূর্বক এই সংসারে মনুষ্যদিগকে ঐশ্বর্য্য সম্পন্ন নিরন্তর করিতে থাকিবে॥

অর্জুন যেরূপ শ্রীকৃষ্ণকে গুরুরূপে ভগবান মেনেছিলেন আমরাও ঐরূপ মান্য করি। কেননা আমরা দেখি শ্রীকৃষ্ণের গীতোপদেশ শুরুর আগেই অর্জুন তার কাছে শিষ্য হিসেবে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন–

“শিষ্যস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্” [ গীতা ২।৪৭] 

অর্থাৎ, আমি তোমার শিষ্য ও শরণাগত আমাকে শিক্ষা দাও।

অর্জুনের মতোই অভিপ্রায় নিয়ে মনুস্মৃতিতে, মনু মহারাজকে ঋষিগণ ভগবান বলে সম্বোধন করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন–

ভগবন্ সর্ববর্ণানাং যথাবদনুপূর্বশঃ।

অন্তরপ্রভবাণাঞ্চ ধর্মান্ নো বক্তুমর্হসি॥ [ মনু০ ১।২]

অনুবাদঃ হে ভগবান, আপনি সকল বর্ণ এবং তদনন্তর আশ্রমে পালনীয় সকল কর্তব্য ক্রমানুসারে যথাযথভাবে আমাদের উপদেশ দিন।

আবার প্রাচীনকালে গুরুদেরকে যে তাদের শিষ্যরা ভগবান বলে সম্বোধন করতেন তার অসংখ্য প্রমাণ বিভিন্ন উপনিষদ থেকে দেখানো যেতে পারে। এরকম প্রমাণ লিখে শেষ করা যাবে না তাও নিচে তার কয়েকটি দেখাচ্ছি, দেখুন–

প্রশ্ন উপনিষদ্ ১।১ এ ভরদ্বাজের পুত্র সুকেশা, শিবির পুত্র সত্যকাম, গর্গগোত্রীয় সৌর্যায়ণী, অশ্বল পুত্র কৌসল্য, ভৃগুবংশীয় বৈদর্ভি ও কত্য তনয় কবন্ধী এদের সকলেরই গুরুদেব ঋষি পিপ্পলাদকে ভগবান হিসেবে সম্বোধন করতে দেখা যায় –

“ভগবন্তং পিপ্পলাদমুপসন্নাঃ”

অর্থাৎ, তারা ভগবন্ পিপ্পলাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।

এছাড়াও প্রশ্ন উপনিষদ ২।১, ৩।১, ৪।১, ৫।১ ও ৬।১ শ্রুতিগুলোতেও শিষ্যরা স্বয়ং তাদের গুরুদেবকে ভগবান বলে সম্বোধন করছেন–

১। “অথ হৈনং ভার্গবো বৈদর্ভিঃ পপ্রচ্ছ – ভগবন্.....” [২।১]

অর্থাৎ, অতঃপর ভৃগুগোত্রীয় বৈদর্ভি সেই পিপ্পলাদ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্, ....।

২। “অথ হৈনং কৌসল্যশ্চাশ্বলায়নঃ পপ্রচ্ছ – ভগবন্.....” [৩।১]

অর্থাৎ, অতঃপর  অশ্বলপুত্র কৌসল্য সেই পিপ্পলাদ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্, ....।

৩। অথ হৈনং সৌর্যায়ণী গার্গ্যঃ পপ্রচ্ছ – ভগবন্.....” [৪।১]

অর্থাৎ, অতঃপর সৌর্যপুত্র গার্গ্য পিপ্পলাদ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্, ....।

৪। অথ হৈনং শৈব্যঃ সত্যকামঃ পপ্রচ্ছ – ...... ভগবন্.....” [৫।১]

অর্থাৎ, অতঃপর শিবিপুত্র সত্যকাম পিপ্পলাদ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ..... ভগবন্, ....।

৫। অথ হৈনং সুকেশা ভারদ্বাজঃ পপ্রচ্ছ – ভগবন্.....” [৬।১]

অর্থাৎ, অতঃপর ভরদ্বাজপুত্র সুকেশা পিপ্পলাদ ঋষিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্, ....। 


মুণ্ডক উপনিষদ্ ১।১।৩ নং শ্রুতিতে গৃহস্থাগ্রণী শৌনক, ঋষি অঙ্গিরাকে ভগবান বলে সম্বোধন করেছেন –

“শৌনকো হ বৈ মহাশালোঽঙ্গিরসং বিধিবদুপসন্নঃ পপ্রচ্ছ – .... ভগবো ....।”

অর্থাৎ, গৃহস্থশ্রেষ্ঠ শৌনক যথাবিধি অঙ্গিরা ঋষির নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্.....।

 

তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ৩।১-৫ নং শ্রুতির প্রতিটাতেই ভৃগু নামে প্রসিদ্ধ বরুণপুত্র, পিতা বরুণের সামনে উপস্থিত হয়ে তার পিতাকে ভগবান বলে ডেকেছেন এবং বলেছেন যে–

“অধীহি ভগবো ব্রহ্মেতি” অর্থাৎ, “হে ভগবান, আমায় ব্রহ্মোপদেশ করুন।” 


ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ও  বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ এর দিকে তাকলে তো ভগবানের হিড়িক খুজে পাওয়া যায়! ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে কিছু নমুনা তুলে ধরা হলো – 

ছান্দোগ্য উপনিষদ ১।১১।৩, ৪, ৬ ও ৮, ১।১২।২,  ৪।১।৮, ৪।২।২,  ৪।৪।৪, ৪।৫।১ ও ২, ৪।৬।২ ও ৩ , ৪।৭।২ ও ৩, ৪।৮।২ ও ৩, ৪।৯।১ এভাবে ৪।১৪।২, ৬।৫।৪, ৬।৮।৭, ৬।৯।৪, ৬।১০।৩, ৬।১১।৩, ৬।১২। ১ ও ৩ এবং ৭।১।১ থেকে ৭।২৬।২ নং পর্যন্ত সকল শ্রুতিতেই শিষ্যরা তাদের গুরুদেবকে ভগবান বলেছেন। আর গুরুদেবরাও তার প্রেক্ষিতে উত্তর দিয়েছেন –

১। “ভগবাংস্ত্বেব মে সর্বৈরার্ত্বিজ্যৈরিতি...” [১।১১।৩]

অর্থাৎ, হে ভগবান, আপনিই আমার সকল ঋত্বিক - কার্যের ভার গ্রহণ করুন।

২। “....ইতি মা ভগবানবোচৎ...” [১।১১।৪, ৬, ৮]

অর্থাৎ, ভগবান এই কথা আপনি আমাকে বলিয়াছিলেন।

৩। “...নো ভগবানাগায়তু...” [১।১২।২]

অর্থাৎ, ভগবান আমাদের জন্য গান করুন।

৪। “...তং হাভ্যূবাদ ত্বং নু ভগবঃ সযুগ্বা রৈক্ব?” [৪।১।৮]

অর্থাৎ, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল – ভগবন্ আপনিই কি শকটবান্ রৈক্ব?

৫। “....অনু ম এতাং ভগবো দেবতাং শাধি যাং দেবতামুপাসস ইতি” [৪।২।২]

অর্থাৎ, হে ভগবন্, যে দেবতাকে আপনি উপাসনা করেন ঐ দেবতা বিষয়ে আমাকে উপদেশ দিন।

৬। “....অনু এব মা ভগবঃ শাধীতি” [৪।৪।৩]

অর্থাৎ, হে ভগবন্, আপনি আমায় উপদেশ দিন।

৭। “...ভগব ইতি হ প্রতিশুশ্রাব...” [৪।৫।১, ৪।৬।২, ৪।৭।২, ৪।৮।২, ৪।৯।১, ৪।১৪।২]

অর্থাৎ, হে ভগবন্ বলিয়া প্রত্যুত্তর দিলেন।

 

নিম্নোক্ত ভিডিওটি দেখতে পারেন - 


 

অতঃ গুরুও ভগবান পদবাচ্য হতে পারেন ঔপচারিকরূপে । ভগবান সম্বোধন মাত্রেই কারো ঈশ্বরত্ব সংস্থাপিত হয় না ।