প্রাজ্ঞজন বলেন মূর্খের অশেষ দোষ, তার থেকেও বেশী দোষ মূর্খের সাথে যে বাদানুবাদে লিপ্ত হয় । সম্প্রতি বেদের প্রচার ও প্রসারের উত্তাপে কিছু মানুষের প্রসব বেদনা শোনা যাচ্ছে । ত্রাহি মাম্ রবে বৎসহারা গাভীর ন্যায় উন্মত্ত আচরণে ব্যস্ত । মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ও আর্যসমাজের যেন-তেন প্রচারে নিন্দাই যেন একমাত্র ধ্যানজ্ঞান । দিনে ঈশ্বরের চেয়ে মহর্ষি দয়ানন্দের নাম নেওয়া কিংবা নিজের পিতার নামের থেকে অগ্নিবীরের নাম মুখে নেওয়া এদের প্রধানতম একটি বৈশিষ্ট্য ।
এই বিশেষ খামারটিতে যেসব গৃহপালিত জন্তু ও অবৈতনিক শ্রমিক রয়েছে তাদের নিকৃষ্ট কিছু শাবকের জঘন্য একটি বিষয় হলো ' বৈদিক ' শব্দটিকে বিকৃতভাবে 'বৌদিক' বলা । আশ্চর্যজনক এটিই যে মতভেদ থাকাটা স্বাভাবিক হলেও এভাবে শব্দকে বিকৃত করতে তাদের হৃদয় কম্পিত হয় না কিংবা বিবেকবোধও জাগ্রত হয় না । বরং যুক্তিগ্রাহ্য না হলেই কিছু বর্বর এই শব্দটির ক্রমাগত প্রয়োগ করে শালীনতা ও সভ্যতার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে । তাই আমরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে যদিও কুকুর কামড়ালে কুকুরকে কামড়ানো মানুষের জন্য শোভনীয় নয়, তারপরেও মুগুরপেটা করা আবশ্যক ।
অতি প্রিয় পৌরাণিক ভ্রাতৃগণের পঞ্চমবেদ বলে মান্য বস্তু আছে ২টি৷ একটি মহাভারত আরেকটি ১৮ পুরাণ । মহাভারতের প্রক্ষিপ্ততা নিয়ে তারা অতীব আস্ফালন করে অমুকটা BORIতে থাকলেও আর্যসমাজীরা ইচ্ছেমত প্রক্ষিপ্ত বলে বিধায় এরা প্রক্ষিপ্তসমাজী । বেশ ভালো কথা । কালীপ্রসন্ন সিংহের সংস্করণে মহাভারতের আদিপর্বের ১০৪ অধ্যায়ে দেবগুরু বৃহস্পতি ও তার বৌদি মমতাকে নিয়ে অত্যন্ত সুন্দর একটি গল্প আছে -
পূর্বে উতথ্য নামে এক সুবিখ্যাত মহর্ষি ছিলেন। তাঁর মমতা নামে এক সহধর্মিণী ছিলেন। একদা মহর্ষি উতথ্যের ছোট ভাই দেবপুরোহিত মহাতেজাঃ বৃহস্পতি কামাতুর হয়ে মমতার নিকট উপস্থিত হলেন। মমতা দেবরকে সম্মোধন করে বললেন, "হে মহাভাগ ! আমি তোমার বড়ভাইয়ের সহযোগে আন্তৰ্ব্বত্নী [গর্ভিণী] হয়েছি, অতএব রমণেচ্ছা সংবরণ কর। আমার গর্ভস্থ উতথ্য কুমার কুক্ষিমধ্যেই ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করেছেন। তুমিও অমোঘরেতাঃ; এক গর্ভে দুই জনের সম্ভব নিতান্ত অসম্ভব। অতএব অদ্য এই দুর্ব্যবসায় [নিন্দিত চেষ্টা] হতে নিবৃত্ত হও।' বৃহস্পতি মদনবাণে নিতান্ত আহত ও সাতীশয় অধীর হয়েছিলেন, সুতরাং স্বীয় চঞ্চলচিত্তকে কোনক্রমেই স্থির করতে না পেরে মমতার অসম্মতি থাকলেও তিনি বলপূর্বক তাঁর আসক্ত হলেন ! অনন্তর গর্ভস্থ ঋষিকুমার বৃহস্পতিকে কামক্রীড়ায় আসক্ত দেখে বললেন “ভগবান ! মদনবেগ সংবরণ করুন । স্বল্পপরিসর কুক্ষিতে উভয়ের সম্ভব অত্যন্ত অসম্ভব । আমি পূর্ব্বে এই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছি অতএব অমোঘরেতঃপাত দ্বারা আমাকে পীড়িত করা আপনার নিতান্ত অযোগ্য কৰ্ম্ম হচ্ছে , সন্দেহ নাই ।' বৃহস্পতি বালকবাক্যে কর্ণপাতও না করে স্বীয় নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে লাগলেন । গর্ভস্থ মুনিকুমার বৃহস্পতির এইরূপ অসাধুব্যবহার দর্শনে অসহিষ্ণু হয়ে পাদ দ্বারা তদীয় শুক্রের পথরোধ করলেন । রেতঃ প্রবেশমার্গ না পেয়ে প্রতিহত হয়ে সহসা ভূতলে পতিত হলো । তন্নিরীক্ষণে ভগবান্ বৃহস্পতি রোষপরবশ হয়ে গর্ভস্থ উতথ্যনন্দনকে ভর্ৎসনাপূর্ব্বক অভিসম্পাত করলেন , ‘যেহেতু, সর্ব্বভূতের অভিলষিত ঈদৃশ সময়ে আমাকে এমন কথা বললে , এই অপরাধে তুমি যাবজ্জীবন অন্ধত্ব প্রাপ্ত হবে ।' বৃহস্পতি-শাপপ্রভাবে উতথ্যতনয় অন্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন , তাতেই তার নাম দীর্ঘতমা হলো সেই জন্মান্ধ বেদবিৎ প্রাজ্ঞ ঋষি ।
অথোতথ্য ইতি খ্যাত আসীদ্ধীমানৃষিঃ পুরা।
মমতা নাম তস্যাসীদ্ভার্যা পরমসংমতা।
উতথ্যস্য যবীয়াংস্তু পুরোধাস্ত্রিদিবৌকসাম্।
বৃহস্পতির্বৃহত্তেজা মমতাং সোঽন্বপদ্যত।
উবাচ মমতা তং তু দেবরং বদতাং বরম্।
অন্তর্বত্নী অহং ভ্রাত্রা জ্যেষ্ঠেনারম্যতামিতি।
অয়ং চ মে মহাভাগ কুক্ষাবেব বৃহস্পতে |
ঔতথ্যো বেদমত্রৈব ষড়ঙ্গং প্রত্যধীয়ত।
অমোঘরেতাস্ত্বং চাপি নূনং ভবিতুমর্হসি।
তস্মাদেবঙ্গতেঽদ্য ত্বমুপারমিতুমর্হসি।
এবমুক্তস্তয়া সম্যগ্বৃহত্তেজা বৃহস্পতিঃ।
কামাত্মানং তদাত্মানং ন শশাক নিয়চ্ছিতুম্।
সম্বভূব ততঃ কামী তয়া সার্ধমকাময়া।
উৎসৃজন্তং তু তং রেতঃ স গর্ভস্থোঽভ্যভাষত।
আহা ! কি অপ্রাকৃত কাহিনী । পাঠক ! বৃহস্পতি কিনা নিজের বড় ভাইয়ের স্ত্রী অর্থাৎ বৌদির গর্ভাধান করেছে দেবর যে কিনা আবার দেবতাদের গুরুও বটে । এই যে ছেলের জন্ম হয়েছে নাম দীর্ঘতমা এই নামে কিন্তু ঋগ্বেদের ১ম মণ্ডলের ১৪০ ও ১৬৪তম সূক্তের দ্রষ্টাও । অর্থাৎ ঋষিদের নাম ব্যবহাএ করে কি অবস্থা করেছে প্রক্ষিপ্তকারীরা ও পুরাণবাদীরা ।
আর মহাশয়গণ ! আপনাদের এই কাহিনী প্রবক্তা কিন্তু ভীষ্মই যার বাণী আপনারা আবার যত্রতত্র শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর তা প্রমাণে উদ্ধৃত করে । ক্রিটিক্যাল এডিশনেও ৯৮তম অধ্যায়ে এই কাহিনী বিদ্যমান । আবার মৎস্য পুরাণের ৪৮তম অধ্যায়েও এই কাহিনী আছে । সেখানে পরের কাহিনীটা আরো বিচিত্র -
দীর্ঘতমা এক গোরু কাছে গোধর্ম শিখেন এবং কামের তাড়নায় নিজের ছোট ভাই গৌতমের স্ত্রীর কাছে যান । গৌতমের স্ত্রী তাকে ধরে যাচ্ছেতাই গালাগাল আর নিজের কন্যাস্থানীয় মেয়েকে প্রার্থনাকারী বলে নিন্দা করেন
তারপর একটা কাঠের বাক্সে বন্দি করে জলে ফেলে দেন । বলি রাজা পুত্রোৎপাদনে অক্ষম ছিলেন তাই দীর্ঘতমার দ্বারা নিজের স্ত্রী সুদেষ্ণাকে নিয়োগ করে পাঠান । সুদেষ্ণা নিজে না গিয়ে দাসীকে পাঠান । রাজা জানতে পেরে স্ত্রীকে নিন্দা করে আবার পাঠান । এবার দীর্ঘতমা সুদেষ্ণাকে বলেন লবণ - দই - ঘি মাখা তার সারা শরীর চেটে দিতে । সুদেষ্ণা তার গুহ্যস্থান অর্থাৎ মলদ্বার ব্যতীত চেটে দেন । দীর্ঘতমা বলেন যেহেতু তুমি এই স্থান চাটোনি তাই তোমার এক পুত্র হবে তারও গুহ্যস্থান থাকবে না । পরে সুদেষ্ণা ক্ষমা চাইলে বাকি স্থান চেটে দিয়েছে এই বিবেচনায় একপুত্র যার নাম অঙ্গ সে মলদ্বারবিহীন হয় আর কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, সূক্ষ্ম ও বঙ্গ নামে আরো ৪ ছেলে মোট ৫ ছেলে জন্মায় ।
প্রসাদিতে গতে তস্মিন্ গোধর্মং ভক্তিতস্তু সঃ।
মনসৈব সমাদধ্যৌ তন্নিষ্ঠস্তৎপরো হি সঃ॥৫২ ॥
ততো যবীয়সঃ পত্নীং গৌতমস্যাভ্যপদ্যত।
কৃতাবলোপান্তাং মত্বা সোঽনড্বানিব ন ক্ষমে॥৫৩ ॥
দধ্না লবণমিশ্রেণ স্বসক্তং মধুকেন তু।
লিহমাম জুগুপ্সন্তী আপাদতলমস্তকম্॥
ততস্ত্বং প্রাপ্স্যসে দেবি! পুত্রান্ বৈ মনসেপ্সিতান্॥৬৯ ॥
তস্য সা তদ্বচো দেবী সর্বং কৃতবতী তদা।
তস্য সা পানমাসাদ্য দেবী পরিহরত্তদা॥
তামুবাচ ততঃ সোঽথ যত্তে পরিহৃতং শুভে।
বিনা পানং কুমারন্তু জনয়িষ্যসি পূর্বজম্॥৭০-৭১॥
এই একই কাহিনী বায়ুপুরাণের অধ্যায় ৯৯তে পাবেন । আর শিবপুরাণের উমাসংহিতার অধ্যায় ৪ শ্লোক ৩৮ এই কাহিনীর স্পষ্ট স্বীকৃতি দিয়ে বলছে -
বৃহস্পতির্মুনিবরো মোহিতঃ শিবমায়য়া॥
ভ্রাতৃপত্ন্যা বশী রেমে ভরদ্বাজস্ততোঽভবৎ ॥
অর্থাৎ, শিবের মায়ায় বিমোহিত হয়ে জিতেন্দ্রিয় মুনিবর বৃহস্পতি নিজের ভাইয়ের পত্নীর সাথে রমণ করে ও তার ফলস্বরূপ মহর্ষি ভরদ্বাজের জন্ম হয় ।
আবার স্কন্দপুরাণের আবন্ত্যখণ্ডের রেবাখণ্ডে [ ৫।৩।৪২।৮-২৪ ] মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য ও তার বোনকে নিয়ে যে কাহিনী করেছে তা বর্ণনার অযোগ্য । কিন্তু পৌরাণিকদের সীমাহীন ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার এই তথাকথিত পঞ্চমবেদের রহস্য প্রকাশ করতে আমাদের বাধ্য করেছে । এখানে আছে -
একরাতে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের স্বপ্নদোষ হয় ও বীর্য তার কৌপীনে থাকা অবস্থাতেই খুলে রেখে শুয়ে পড়েন । তার বোন এসে সেই কৌপীন দিয়ে নিজের যোনীপথ [ পুরাণের ভাষায় ভগাবরণ ] আবৃত করেন । পরে সকালে যাজ্ঞবল্ক্য জিজ্ঞাসা করে জানেন যে ঋতুস্নানান্তে তার বোন এই কাপড় অন্তর্বাস হিসেবে ব্যবহার করেছে । এই শুনে যাজ্ঞবল্ক্য হাহাকার করেন ও পরে বলেন এর মাধ্যমে এক সন্তান জন্ম নেবে ও তার খেয়াল রাখতে বললেন । তার বোন নিজের ভাইয়ের বীর্যে গর্ভবতী হয়ে সেই সন্তান জন্ম দেয় এবং সাথে সাথে সেই সন্তানকে এক গাছের ছায়া ত্যাগ করে ।
স্বপ্নং দৃষ্ট্বাত্যজচ্ছুক্রং কৌপীনে রক্তবিন্দুবৎ ।
বিরাজিতেন তপসা সিদ্ধং তদনলপ্রভম্ ॥ ৪২.১০ ॥
নিষিদ্ধং তু নিশি স্নানমিতি সুষ্বাপ স দ্বিজঃ ।
নিশীথে সাপি তদ্বস্ত্রং ভগস্যাবরণং ব্যধাৎ ॥ ৪২.১২ ॥
নাত্র দোষোঽস্তি তে কশ্চিন্মম চৈব শুভব্রতে ।
তবোদরে তু গর্ভো যস্তত্র দৈবং পরায়ণম্ ॥ ৪২.২০ ॥
তস্য তত্ত্বেন রক্ষা চ ত্বয়া কার্যা সদৈব হি ।
বিনাশী নৈব কর্তব্যো যাবৎকালস্য পর্যযঃ ॥ ৪২.২১ ॥
তথেতি ব্রীডিতা সাধ্বী দূয়মানেন চেতসা ।
অপালয়চ্চ তং গর্ভং যাবৎপুত্রো হ্যজায়ত ॥ ৪২.২২ ॥
জাতমাত্রং চ তং গর্ভং গৃহীত্বা ব্রাহ্মণী চ সা ।
অশ্বত্থচ্ছায়ামাশ্রিত্য তমুৎসৃজ্য বচোঽব্রবীৎ ॥ ৪২.২৩ ॥
ধিক্ ধিক্ পাষণ্ড পামর পৌরাণিক ধিক্ ৷ এই তোমাদের পঞ্চমবেদ ? এই তোমাদের শিক্ষা ? এর জন্যই তোমাদের প্রতি বক্তব্যে থাকে অপরের চরিত্র নিয়ে কথা কেননা তোমাদের শাস্ত্রের শিক্ষাই এমন । তোমরাও যে তারই অনুসারী হবে সেটাই তো স্বাভাবিক ।
অতঃ বৈদিকদের কটাক্ষ করা জন্মপরিচয়হীন সংস্কারের নামে কুসংস্কারের প্রতিপালক ও নির্বোধ - অপদার্থরাই যে অধুনা বৌদিবাজির প্রবর্তক এবং 'বৌদিক' নাম যে এদের জন্যই যথাযথ তা প্রমাণিত ।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী