https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

সামবেদ কি ঋগ্বেদেরই অংশ বা সংকলন ?

Sunday, September 24, 2023


কিছু ভারতীয় ও পাশ্চাত্য বিদ্বানগণের ধারণা হলো সামবেদের কোনো স্বতন্ত্র সত্তা বা মৌলিকত্ব নেই, বরং এটি গানের উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদ থেকে সংগৃহীত ঋকের সংকলনমাত্র৷ এটি মূলত তাঁদের ভ্রান্ত ধারণা। কারণ–

(১) সামবেদ যদি শুধু গানের জন্যই ঋগ্বেদ থেকে সংকলন করা হত, তবে এতে কেবল সামগানের জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্রগুলোই থাকত৷ অথচ সামবেদে এমনটি দেখা যায় না৷ সামবেদে ৪৫০টি এমন মন্ত্র আছে, যেগুলোর উপর সামগান আরোপিত হয় না। শুধু গানের জন্য সামবেদ সংকলিত হলে সামবেদে এমন মন্ত্রের সংগ্রহ থাকত না ৷
(২) সামবেদে প্রাপ্ত অধিকাংশ ঋগ্বেদীয় ঋকগুলোর মধ্যে আংশিক সাম্যতা আছে৷ কিছু ঋকে পাঠভেদ আছে, কিছু কিছু ঋকে পাদ-ব্যত্যয় আছে, কিছু ঋক আবার অপূর্ণ। যদি ঋগ্বেদ থেকে এই ঋকসমূহ নেয়া হত তাহলে এতে পাঠভেদ থাকত না এবং ঋকসমূহ আংশিক ভাবে না নিয়ে পূর্ণরূপেই নেয়া হত। যেমন– ঋগ্বেদে "অপো মহি ব্যয়তি" (ঋ০ ৭।৮১।১) পাঠ আছে, কিন্তু সামবেদে "অপো মহী বৃণুতে" (সাম০ ৩০৩) পাঠ রয়েছে। ঋগ্বেদে "অরং বহন্তি মন্যবে" (ঋ০ ৬।১৬।৪৩) এবং সামবেদে "অরং বহন্ত্যাশবঃ" (সাম০ ২৫) পাঠ রয়েছে। একই ভাবে শব্দের বানানেও ঋগ্বেদে ও সামবেদে পার্থক্য আছে৷ যেমন– ঋগ্বেদে "ইদং বিষ্ণুঃ...পাংসুরে" (ঋ০ ১।২২।১৭) মন্ত্রে 'পাংসুরে' পাঠ থাকলেও সামবেদে 'পাংসুলে' (সাম০ ১৬৬৯) পাঠ আছে। আবার ঋগ্বেদের "পরি ত্যং হর্য়তং হরিম্" (ঋ০ ৯।৯৮।৭) মন্ত্রের শুধু একটি পাদই সামবেদে "পরি ত্যং হর্য়তং হরিম্" (সাম০ ১৬৮১) রূপে রয়েছে, শেষ তিনটি পাদ এখানে নেই৷ এগুলো আংশিক সাম্য৷ এরকম উদাহরণ অনেক রয়েছে। আমাদের সামবেদ ভাষ্যের টিপ্পনীতে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই পাঠভেদ বা শব্দভেদগুলো কোনো বিকৃতি বা কোন অপপাঠ নয়, বরং সামবেদেরই স্বতন্ত্র সত্তা, মৌলিকত্ব ও গভীর তাৎপর্য নির্দেশ করে ।

(৩) সামবেদের মন্ত্রগুলো যদি ঋগ্বেদ থেকে সংকলন করা হত তবে সামবেদের এই মন্ত্রগুলোর ঋষি ও দেবতাও ঋগ্বেদের ঋষি ও দেবতার সাথে অভিন্ন হত৷ কিন্তু সামবেদের অনেক মন্ত্রের ঋষি ও দেবতার সাথে ঋগ্বেদের ঋষি ও দেবতার ভিন্নতা দেখা যায়৷ এই ভিন্নতাগুলো আমাদের বেদভাষ্যের টিপ্পনীতে দ্রষ্টব্য।
(৪) যদি সামবেদের মন্ত্র ঋগ্বেদ থেকেই নেয়া হত তাহলে সামবেদের মন্ত্রগুলো সাজানোর ক্ষেত্রে সার্বিক দিক দিয়ে বা অংশত ঋগ্বেদের ক্রমকেই অনুসার করা হত৷ কিন্তু সামে এমনটি হয়নি ৷

(৫) ঋগ্বেদ ও সামবেদের স্বরাঙ্কন পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা৷ ঋগ্বেদে উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিতের জন্য পৃথক চিহ্ন রয়েছে। অপর দিকে, 'নারদীয় শিক্ষা' অনুসারে সামবেদে ১, ২, ৩ অংকগুলো দ্বারা যথাক্রমে মধ্যম (ম), গান্ধার (গ) ও ঋষভ (রে) স্বর বোঝানো হয়৷ এছাড়াও ঋগ্বেদ ও সামবেদের মন্ত্রের উচ্চারণেও পূর্ণ ভিন্নতা আছে৷ ঋগ্বেদের মন্ত্র দ্রুতগতিতে পাঠ করা হয়, অথচ সামবেদের মন্ত্র ধীরগতিতে পাঠ করা হয়৷
(৬) ঋগ্বেদে স্বয়ং সামবেদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত শব্দ ৩৭ বার এসেছে৷ যেমন– 'সাম' শব্দটি ১৩ বার, 'সামান্যঃ সামভিঃ' ও 'সামানি' শব্দগুলো ৪ বার, 'সামন্' শব্দটি ৩ বার, 'সাম্নে' শব্দটি ২ বার এবং 'সামগা ইব', 'সামগাম্', 'সাম্নাম্', 'সামনৌ', 'সাম্নঃ', 'সাম্না' প্রভৃতি শব্দগুলো ১ বার করে ঋগ্বেদে উল্লেখিত হয়েছে। এই 'সাম' (ঋ০ ১।৬২।২, ২।৪৩।২), 'সামগাঃ' (ঋ০ ২।৪৩।১২), 'সামভিঃ' (ঋ০ ১।১০৭।২), 'সামানি' (ঋ০ ৫।৪৪।১৪, ১৫), 'সাম্নঃ' (ঋ০ ২।২৩।১৬), 'সাম্না' (ঋ০ ৮।৯৫।৭), 'সাম্নে' (ঋ০ ৮।৪।১৭) শব্দগুলো ঋগ্বেদের এসব সন্দর্ভে উল্লেখ থাকায় এটি সিদ্ধ হয় যে সামবেদ ঋগ্বেদ থেকে অর্বাচীন ও ঋগ্বেদ থেকে সংকলিত নয় বরং সামবেদ একটি মৌলিক বেদ৷

(৭) ঋগ্বেদের "ঋচাং ত্বঃ" (ঋ০ ১০।৭১।১১) মন্ত্রে শক্বরী ছন্দে গানের বর্ণনা আছে, যা মূলত সামবেদের ঋত্বিক 'উদ্গাথা' এর কর্মকাণ্ডকে নির্দেশ করে। এছাড়া বৃহৎ সাম, রথন্তর সাম ইত্যাদির উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে৷ ফলে ঋগ্বেদের মাধ্যমে সামবেদের মৌলিক সত্তা জ্ঞাত হওয়া যায়৷
(৮) স্বয়ং ঋগ্বেদে "তস্মাদ্ যজ্ঞাৎ....ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে" (ঋ০ ১০।৯০।৯) মন্ত্রে পরমাত্মা হতে একসাথে ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব–এই চার বেদের উৎপত্তি বর্ণনা করা হয়েছে৷ ফলে স্বতঃপ্রমাণ বেদ বচনের মাধ্যমেই সামবেদের মৌলিকত্ব ও পৃথকত্ব প্রমাণ হয়।

(৯) মধ্যকালীন সায়ণ, উব্বট প্রমুখ বেদভাষ্যকারগণসামবেদের স্বতন্ত্র সত্তা মানতেন। যেমন– সায়ণাচার্য ঋগ্বেদের পর সামবেদের উপর ভাষ্য লিখেছিলেন৷
(১০) যে ৭৫টি মন্ত্রকে বিপক্ষগণ সামবেদের মৌলিক মন্ত্র দাবি করেন, সেগুলোই যদি শুধুমাত্র সামবেদের মৌলিক মন্ত্র হত তবে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য কিংবা পুঁথিতে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই এগুলোকে সামবেদের মৌলিক মন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা থাকত। অথবা শুধুমাত্র এই ৭৫টি মন্ত্রের সমন্বয়ে সামবেদের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যেত। কিন্তু তা পাওয়া না যাওয়ায় সিদ্ধ হয় শুধু এই ৭৫টি নয়, বরং সামবেদের পুরো ১৮৭৫টি মন্ত্রই মৌলিক মন্ত্র। এজন্য রাণায়নী বা কৌথুমীয় কোনো শাখাতেই এই মন্ত্র সংখ্যার কোনো ভেদ নেই।

(১১) সামবেদের মধ্যে ঋগ্বেদ থেকে মৌলিক পার্থক্য আছে৷ দুইয়ের বিভাজন পদ্ধতি আলাদা৷ ঋগ্বেদ মণ্ডল, সূক্ত ও ঋকে বিভক্ত। অপরদিক্র সামবেদে কাণ্ড, অধ্যায়, দশাতি ইত্যাদিতে বিভক্ত৷ দুইয়ের বিষয়বস্তু আলাদা ৷ দুইয়ের কার্য আলাদা৷ ঋগ্বেদ পরমাত্মা স্তুতি, জাগতিক ও পারমার্থিক জ্ঞান ও সামবেদ সেই পরমাত্মারই সঙ্গীতময় উপাসনা তথা মোক্ষ লাভের পথ নির্দেশক৷

উক্ত বিবরণ হতে জানা যায়, সামবেদের স্বতন্ত্র সত্তা আছে ৷ এটি ঋগ্বেদের উপর আশ্রিত নয়, বরং স্বতন্ত্র ৷


বাংলাদেশ অগ্নিবীর