বর্তমান সময়ে দূর্গা পূজা ও কালি পূজার সময় বিভিন্ন ডিজে পার্টি দেখে আমরা ভাবি “মন্দিরে চণ্ডি পাঠ ছাড়লে কি ক্ষতি হয়?” বিসর্জনের সময় মদ্যপদের ভণ্ডামী দেখে আমরা লজ্জায় মুখ লুকাই। কিন্তু আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি দশমীর বিসর্জনের ক্ষেত্রে পুরাণ সমূহ কি বলে ?
ভবেশ রায় সম্পাদিত “মূর্তিপূজা কী ও কেন” বইটি পড়ছিলাম। সেখানে পেলাম পুরাণে বর্ণিত আছে শবরোৎসব সহযোগে বিসর্জন করতে হয়। আসুন দেখে নেই শবরোৎসব সম্পর্কে পুরাণ কি বলে-
কালিকা পুরাণ, ৬১তম অধ্যায়-
বিসর্জ্জয়োশম্যানন্তু শ্রবণে শবরোৎসবৈঃ।।১৭
অন্তপাদো দিবাভাগে শ্রবণাস্য সদা ভবেৎ।
তদা সম্প্রেষণং দেব্যা দশম্যাং কারয়েদ্ ভবেৎ।।১৮
শঙ্খতুর্য্যনিচু নাদৈশ্চ মৃদঙ্গৈঃ পটহৈমন্তমা।।১৯
ধ্বজৈর্বস্তৈর্বহুবিধৈর্লাজ পুষ্প প্রকীর্ণকৈঃ।
ধুলিকর্দ্দমবিথেপৈঃ ক্রীড়াকৌতুক মঙ্গলৈঃ।২০
ভগলিঙ্গপভিধানৈশ্চ ভগলিঙ্গষ্প্রগীতকৈঃ।
ভগলিঙ্গপদি শব্দৈশ্চ ক্রীড়য়েসুরলং জনাঃ।।২১
পরৈর্নাক্ষিপ্যাতে সম্ভ স’পরান্নক্ষিপেদ যদি।
ক্রুদ্ধা ভগবতী অন্য শাপং যদ্যাৎ সুদারুণম্।।২২
মহাষ্টমীর দিন পূজা করিয়া নবমির দিন বহুবিধ বলিপ্রদানপূর্বক পূজা করিয়া দশমীর দিন শ্রবণা নক্ষত্রে শবরোৎসব সহিত দেবীর বিসর্জন করিবে। যে দশমী তিথির দিবাভাগে শ্রবণার শেষ পাদ হইবে, সেই দশমী তিথিতেই দেবীর বিসর্জন করিবে। রাগনিপুণ কুমারী ও বেশ্যা এবং নর্তকগণ সঙ্গে লইয়া শঙ্খ, তুরী, মৃদঙ্গ এবং পটহের শব্দ করিতে করিতে নানাবিধ বস্ত্রের ধ্বজা উড়াইয়া খই ও ধুলি-কর্দম নিক্ষেপ করত, ক্রীড়া কৌতুক ও মঙ্গলাচরণ পূর্বক ভগলিঙ্গপাদি বাচক গ্রাম্যশব্দ উচ্চারণ ও তাদৃশ শব্দবহুল গান এবং তাদৃশ অশ্লীল বাক্যালাপ করিয়া বিসর্জন সময়ে ক্রীড়া করিবে। সেই দিবস যদি কোন মানুষ, নিজের উপর অপর কর্তৃক অশ্লীল ব্যবহার করা না ভালবাসে এবং অপরের উপর অশ্লীল ব্যবহার করিতে না চাহে, তবে ভগবতী ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে শাপ প্রদান করিয়া গমন করে।
কি বুঝলেন ? অশ্লীলতা পচ্ছন্দ না করলে ভগবতী শাপ দেবেন । অতএব সাবধান, পৌরাণিকগণ ডিজে পার্টি করুক আর মদ খাইয়া মরুক। কী দরকার তাদেরকে বুঝাইয়া ভগবতীর শাপের ভাগিদার হওয়ার ?
বিষ্ণুপুরাণের একটি শ্লোক দেখানো হয়-
সুরামাংসপোহারৈশ্চ ভক্ষ্যভোজৈশ্চ পূজিতা
[বিষ্ণুপুরাণ ৫.১.৮৪]
অর্থাৎ সুরা(মদ) ও মাংস,ভক্ষ্য ও ভোজ্য দ্বারা দেবীকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে বিষ্ণু পুরাণে।
সুরামাংসপোহারৈশ্চ ভক্ষ্যভোজৈশ্চ পূজিতা
[বিষ্ণুপুরাণ ৫.১.৮৪]
অর্থাৎ সুরা(মদ) ও মাংস,ভক্ষ্য ও ভোজ্য দ্বারা দেবীকে পূজা করার কথা বলা হয়েছে বিষ্ণু পুরাণে।
বিষ্ণুপুরাণে [৫.২৫] আমাদের পরম সম্মানীয় শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রী বলরামের মদপান করার কাল্পনিক গল্প বলা আছে।
স্কন্দ পুরাণেও আমরা দেখতে পাই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রী
বলরাম এবং তাদের স্ত্রীদের মদপানই নয় বরং মদপান করে মাতাল হয়ে যাবার উদ্ভট
কাল্পনিক ও অশ্লীল পৌরাণিক গল্প পাওয়া যায়। প্রায় সব পুরাণেই এরকম অবাস্তব
সব গল্প পাওয়া যায়। এইসব মিথোলজির গল্পের সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক এবং
বাস্তব আইনের উপর এদের তেমন কোন প্রভাব নেই।
একইভাবে তন্ত্রশাস্ত্রে প্রচুর পরিমাণে মদের ব্যবহার পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই তন্ত্রশাস্ত্র বৈদিক পরম্পরার সাথে মিলবেনা।এজন্যই এটি তন্ত্র। যেমন কূলার্ণবতন্ত্রে দেখা যায় ৫ম উল্লাসের ৩২,৩৩,৩৪ নং শ্লোকগুলোতে ৩ ধরনের মদ তৈরীর প্রক্রিয়া সহ বর্ণিত আছে-
একইভাবে তন্ত্রশাস্ত্রে প্রচুর পরিমাণে মদের ব্যবহার পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই তন্ত্রশাস্ত্র বৈদিক পরম্পরার সাথে মিলবেনা।এজন্যই এটি তন্ত্র। যেমন কূলার্ণবতন্ত্রে দেখা যায় ৫ম উল্লাসের ৩২,৩৩,৩৪ নং শ্লোকগুলোতে ৩ ধরনের মদ তৈরীর প্রক্রিয়া সহ বর্ণিত আছে-
পৈষ্টী, গৌড়ী ও মাধ্বী সুরা।এছাড়াও আছে তালজা সুরা,মৈরেয়ী সুরা ইত্যাদির বর্ণনাও। এই মদগুলো কী কী উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করা হবে তারও বর্ণনা করা আছে।
এগুলো দিয়ে পূজা করার কথা রয়েছে সেখানে।
আবার কুলার্ণব তন্ত্রের পঞ্চম উল্লাসের ৪২ নং শ্লোকে
মদ ,মাংস ও ভাং অষ্টগন্ধের সাথে মিশিয়ে বটিকা (ট্যাবলেট) তৈরী করে তা সংরক্ষণ করার কথাও বলা হয়েছে। কোন কারণে মদ শেষ হয়ে গেলে বা না থাকলে এগুলো দিয়ে পূজা করতে বলা হয়েছে তন্ত্রে ।
তন্ত্রশাস্ত্রে এরকম মহিষরক্ত, মেষ রক্ত, ছাগরক্ত,মদ প্রভৃতি দ্বারা পূজার কথা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় নরবলি, গোবধ, গোরক্ত দিয়ে পূজা করা সহ নানা উপাচার। স্বাভাবিক ভাবেই বৈদিক জীবনপ্রণালীতে এগুলো প্রযোজ্য হবেনা । মুণ্ডমালা তন্ত্রের ৫ম পটলের ৫১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে-
মদ্যপান ন কর্তব্যং ন কর্তব্যং কলৌ যুগে।
শাক্তানাং চৈব শৈবানাং কর্তব্যং সর্ব সিদ্ধিদম্।।
অর্থাৎ কলিযুগে সাধারাণ মানুষের জন্য মদ্যপান উচিত না হলেও শৈব ও শাক্তদের মদ্যপান অবশ্য কর্তব্য ও মদ্যপান তাদের জন্য সর্বসিদ্ধিদায়ক !
মুণ্ডমালা তন্ত্র ৫.৫৪- মহিষ ও মেষের রক্ত দ্বারা দেবীর (কালী) পূজা করবে।
মুণ্ডমালা তন্ত্র ৫.৫৫- ছাগ ও ছাগের রক্ত দ্বারা দেবীর (কালী) পূজা করবে।
.মদ্যপানে কেন শাক্ত শৈবদেরই অধিকার ? মদ্যপান কি বেদানুকূল ? বেদানুকূল হলে তার প্রমাণ কি ও কেন অন্য মতালম্বীদের অধিকার নেই ? বেদানুকূল না হলে পঞ্চমতীদের "তন্ত্র বৈদিক " বলে ঢোল পেটানো হয় কেন ?
আর এভাবেই বিভিন্ন সময়ে সমাজে এই অপপ্রথাগুলো প্রবেশ করেছে ধীরে ধীরে যার ফলাফল এখন আমরা আমাদের সমাজে দেখতে পাচ্ছি বিশেষত বিভিন্ন পূজার মৌসুম আসলেই।
আমাদের জীবনাচরণের ও সনাতন আইনের মূল আধার বেদ। জগতে সৃষ্ট জীবের বিধি বিধান তথা জীবনাচরণ নিশ্চিত করা ঈশ্বরেরই কর্তব্য। সৃষ্ট জীবের মধ্যে মনুষ্যের জ্ঞান প্রজ্ঞা অনান্য জীবের অপেক্ষা অধিক উৎকৃষ্ট। সেহেতু ঈশ্বর মনুষ্যের কর্তব্য কর্ম, তথা বিধি নিষেধাদিরূপ জ্ঞানের সমষ্টি বেদ এই মনুষ্যকুলের জন্য প্রকট করেছেন।
0 মন্তব্য(গুলি)