https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

অনধিকারীর শাস্ত্রচর্চা ও শাস্ত্রানুবাদ বিভ্রান্তি

Sunday, March 31, 2024


 ▪️অনধিকারীর শাস্ত্রচর্চা ও শাস্ত্রানুবাদ বিভ্রান্তি ✅


বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রানুবাদ একটি কঠিন বিষয়। আমাদের পূজ্য আচার্যগণ তাদের প্রজ্ঞাবলে বেদের ও অন্যাদি শাস্ত্রের অনুবাদ ও পর্যালোচনা করেছেন। মধ্যকালে বেদের যে অনর্থ করা হয়েছিলো তার যথোপযুক্ত প্রতিবাদ ও খণ্ডন করেছেন। অধুনা সময়ে স্বাধ্যায়তপহীন কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল বিমতালম্বীরা সামান্য কিছু পুস্তক তাও অনুবাদমাত্র অধ্যয়ন করে বেদের অর্থ করতে ও আর্য বিদ্বানদের নিন্দা করতে অগ্রসর হতে দেখা যাচ্ছে । বালচাপল্য ভেবে আমরা তা উপেক্ষা করলেও অনেক পাঠকই অনুরোধ করেন তাদের শাস্ত্রীয় জ্ঞানের পরিসীমা কত ক্ষুদ্র তা তুলে ধরতে। আমরা আজ সেটি নিয়েই আলোচনা করবো। 


🍁 বেদের অনুবাদ বা ভাষ্যে  নিরুক্ত একমাত্র সহায়ক নয় বরং বলা যায় মুখ্য সহায়ক । মুখ্য ও একমাত্রের মধ্যে অনেক বড় ব্যবধান বিদ্যমান। আমরা যখন  'নৈরুক্তিক প্রণালী' কথাটি ব্যবহার করি তার মানে কেবল এই নয় নিরুক্তই ব্যবহার করা হয়েছে । বরং তার তাৎপর্য যে নিরুক্ত ও নিরুক্তের শৈলীতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । বেদের সব শব্দের অর্থ নিরুক্তে নেই । আবার ব্রাহ্মণের অনেক নির্বচন সরাসরি নিরুক্তে গৃহীত হয়েছে। এভাবেই বেদের যোগরুঢ় শব্দগুলো নিরুক্ত, ব্রাহ্মণ, ব্যাকরণ দ্বারাও অর্থ বিশ্লেষণ ও অধ্যাহার সম্ভব।


🔰 একইভাবে অষ্টাধ্যায়ী শব্দের নির্বচন ও প্রয়োগ কৌশল নিয়েও আলোচনা করে । উণাদিকোষের মাধ্যমে শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে সেই অর্থ ব্যবহার করা যায় যা কিনা নিরুক্ত বা ব্রাহ্মণে নেই । এটিই বেদার্থ শৈলী । পূজ্য পণ্ডিত চন্দ্রমণি বিদ্যালংকার তার বেদার্থবিধিতে এই নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন । অষ্টাধ্যায়ীতে নানা শব্দ রয়েছে, একই শব্দ রয়েছে কল্পসূত্রসহ অন্যাদি গ্রন্থেও । আমি যদি উদাহরণ থেকে কেবল শব্দ গ্রহণ করি তা হবে আমার জন্য মূর্খের ন্যায় কর্ম । একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে - 


🌸 নিরুক্তে বৃত্র শব্দটি মৌলিকরূপে বৃত্রঃ  ও বৃত্রম্ রূপে নানা জায়গায় পাওয়া যায় । নিরুক্ত ২।১।১৬।১০ অনুযায়ী বৃত্র = মেঘ, ত্বাষ্ট্র অসুর । এখন যাদের সক্ষমতা একমাত্র অমরেশ্বর ঠাকুরের পদার্থ কিংবা  Reading মাত্র তাদের বেদ বিশ্লেষণ উপহাসজনক নয় কি ? ওখানে একটিবারেও বলা হয়নি নিরুক্তে যে অর্থ আছে সেটিই একমাত্র অর্থ ।  অষ্টাধ্যায়ীতে উদাহরণ দেওয়া বৃত্র শব্দ কিংবা গৃহ্যসূত্রে যেখানে বৃত্র শব্দের উল্লেখ ভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লেখ করে তাকে কী বুদ্ধিমান বলা যাবে ?  কেননা না অষ্টাধ্যায়ীতে সেটির অর্থ নিরূপণ করা হয়েছে না গৃহ্যসূত্রে সেই শব্দটি নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে । গৃহ্যসূত্র প্রায়োগিক বিধিবিধানমাত্র । 


এখন আর্যভাষ্য আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে বৃত্র = পাপ/পাপপ্রবৃত্তি করে থাকে । স্বাভাবিকরূপেই স্বাধ্যায়হীন ক্ষুদ্রমস্তিষ্কাধিকারীরা বলবে নিরুক্তে তো এই অর্থ নেই। অথচ শতপথ ব্রাহ্মণ ১১।১।৫।৭ স্পষ্টভাবেই 'পাপ্মা বৈ বৃত্রঃ' বলে আমাদের সমর্থন করেছেন । নিরুক্ত যেমন বৃত্র শব্দের অর্থ মেঘ প্রদর্শন করে তার ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন ' 'বৃত্রো বৃণোতেঃ.... য়দবৃণোৎ তদ্ বৃত্রস্য বৃত্রত্বমিতি বিজ্ঞায়তে' নিরু০ ২।১৭ ' এখানে মূলে আছে অবৃৃণোৎ = আচ্ছাদিত করাই বৃত্রের বৃত্রত্ব । দুর্গাচার্য তার টীকাতে এটাকে আবার লিখেছেন 'বিজ্ঞায়তে ব্রাহ্মণেঽপি' = ব্রাহ্মণগ্রন্থেও জানা যায়। অথচ কিছু মূর্খ যাদের যোগ্যতা অনুবাদ অব্দি তারা দেখা যায় এখানে আধিদৈবিক বা অনুবাদকের অর্থ নিয়েই উচ্ছ্বসিত ! কি নিদারুণ পরিহাস !


🔴আরেকটি উদাহরণ দেখি । ঋগ্বেদ ১০।২৭।১৭তে মন্ত্রে বীরা শব্দটি আছে । পদপাঠে এর স্বরূপ আমরা 'বীরাঃ' বহুবচনে পাই । নিরুক্তে (১.৩) বীরঃ শব্দটি দিয়ে সুবীরাঃ অর্থাৎ একবচন উল্লেখ করে বহুবচনের ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু অনধ্যায়ের ফলে অনেকেই একবচনের বা বহুবচনের উল্লেখ দেখে আর্ষভাষ্যকার যদি ভিন্ন বিচনে একই ব্যুৎপত্তি নিয়ে ব্যাখ্যা করেন তবে তার প্রতি প্রশ্ন তোলে। এটিই স্বাধ্যায় না করার ফল । নিরুক্তে উক্তস্থলে ঋগ্বেদ ১।১১।২১ বা ২।১৬।৯ ব্যাখ্যাত হচ্ছে সুবীরাঃ পদ প্রসঙ্গক্রমে এসেছে। নিরুক্ত এখানে উনবিংশপাদে অমিত্র ও  বীর‍য়তি=কম্পিত করা উল্লেখ করেছেন । বিংশ ও একবিংশ পদে গত্যার্থক ও বীর্ ধাতুর উল্লেখ করেছেন যেখানে ধাতুজ অর্থ হবে বিক্রমশালী । শতপথ ব্রাহ্মণ ১২।৮।১।২২ বীরাঃ অর্থাৎ বহুবচনে ১০ প্রাণকে নির্দেশ করেছে, এই অর্থ কী নিরুক্ত বিরুদ্ধ ?  বিরুদ্ধ হলে বিরুদ্ধতার প্রমাণে আদেশ প্রয়োজন । না এটি প্রসঙ্গ বিরোধ করে না প্রমাণ বিরোধ । 


🍁একই মন্ত্রে অক্ষাঃ অর্থ নিরুক্ত ৫।৩ অমরেশ্বর ঠাকুরের অনুবাদ অনুযায়ী ব্যাপ্ত করা ও ক্ষরিত হওয়া লেখা হয়েছে। আবার নিরুক্তেই ৩।১৬ অক্ষান্ = কিতব করেছে । অর্থাৎ নিরুক্ত নিজেই একটি অর্থই গৃহীত হবে কখনোই বলে দেয়নি। 


এই সামান্য তত্ত্ব বুঝতে অক্ষম ব্যক্তি যদি অষ্টাধ্যায়ী, বৃহদ্দেবতা কেন সমগ্র ভাষ্য থেকেও বৃত্রকে কেবল মেঘ বা অসুর কিংবা মেষ, বৃষভ ইত্যাদি কেবল পশুবাচক স্থান ও মন্ত্রসমূহ গ্রহণ করে তাকে একদেশী পণ্ডিতাভিমানী মূর্খ ব্যতীত আর কী বলা যাবে ? 


▫️একইভাবে দেব শব্দের অর্থ গোপথ ব্রাহ্মণে ( ১।২।১০) চোখ, মন ও বাণীও আছে, জৈমিনীয় উপনিষদ্ ব্রাহ্মণে (৩।৪।৮) বায়ু ও শতপথ ব্রাহ্মণে (২।১।৪।৯) যশ ও শ্রী দেব বলে [ মূর্খাদিরা প্রচলিত বঙ্গানুবাদ পড়ে অবশ্য এটার বিরোধ করবে, অশিক্ষিতের বহুদোষ ] অর্থ বিদ্যমান, তা কী নিরুক্তে অনুপস্থিত বলে অসিদ্ধ ?  


🔹নিরুক্তে মাধ্যমিক দেব অগ্নি হলেও শতপথ ব্রাহ্মণে (৬।৩।৩।২১) আমরা যজমানকেও অগ্নি সংজ্ঞা পাই, একই ব্রাহ্মণে মৃত্যু (১৪।৩।২।১০), মন (১০।১।২।৩), প্রাণ (৯।৫।১।৬৮), গায়ত্রী (৬।৬।২।৭) এমনকি ব্রহ্মকেও ( কৌ০ ব্রা০ ৯।১।৫)  অগ্নি বলা হয়েছে । যাদের জ্ঞান সীমিত তারা নিরুক্তের ব্যুৎপত্তির ভাব না বুঝে কেবল আধিদৈবিক কিংবা যাজ্ঞিক ক্রিয়ার বিধান থেকে লৌকিক অর্থ অথবা বৃহদ্দেবতাদির ন্যায় অপ্রামাণিক গ্রন্থ থেকে অগ্নিকে কেবল একার্থক দেখানোর বৃথা চেষ্টা করবে। 


🔸ঋতম্ বা ঋত শব্দ নিঘণ্টু ১।১২তে জল ও ৩।১০তে সত্যের পর্যায়বাচী হিসেবে উল্লেখিত । এখন কোথায় কোন অর্থ হবে তা অবশ্যই প্রকরণ অনুযায়ী হবে । অমরেশ্বর ঠাকুর নিরুক্ত ১০।৪১।১ ঋতস্য অর্থ করেছেন ঋত দেবতা বা ঋতস্য দেবতা । অথচ ঋত+অস্য = ঋত+এর [ অস্য = এর ] বাদ দিয়ে দেবতা শব্দ কোথা থেকে এলো ?  এই বিষয়ে অনধ্যায়ীগণ নীরব । অন্যদিকে ঋত অর্থ অগ্নি (তৈ০ ২।১।১১।১), চোখ (ঐ০ ২।৪০), মন (জৈ০ উ০ ৩।৩৬।৫),  ব্রহ্ম (শ০ ৪।১।৪।১০), ওম্ (জৈ০ উ০ ৩।৩৬।৫) ইত্যাদি হয় । ঋত শব্দের মূল ধাতু ঋ যা গত্যার্থক । গতির ৩ অর্থ - জ্ঞান, গমন, প্রাপ্তি। 


🔺একইভাবে 'গো' শব্দের অর্থ নিঘণ্টু পৃথিবী (১।১), রশ্মি (১।৫), বাক্ (১।১১), স্তোতা (৩।১৬) এবং পদনামে (১।৪) উল্লেখিত। নিরুক্ত ২।১৩ অনুযায়ী আদিত্য ও দ্যৌ-ও গোবাচক। নিরুক্ত ১১।৪২ গো পদের অর্থ মাধ্যমিক বাণী, ঘর্ম্মধুক্ করে। নিরুক্ত ৪।১ অনেকার্থক বলে সংকলিত করে। এভাবে প্রায় ১৪টি অর্থ নিরুক্তেই আমরা পাচ্ছি। নিরুক্তকার ১২।৭ 'গাবো গমনাৎ' লিখে গৌ এর প্রবৃত্তি ও ব্যুৎপত্তি নিমিত্ত প্রদর্শন করেছেন। শতপথ ব্রাহ্মণে লোক (৬।১।২।৩৪), অন্ন (৭।৫।২।১৯), যজ্ঞ (৩।৯।৮।৩), প্রাণ (৪।৩।৪।২৫), ইন্দ্রিয় (৫।৪।৩।১০) ইত্যাদি অর্থ গো শব্দের রয়েছে। অমরকোষের ন্যায় লৌকিক অভিধানেও (৩।নানার্থবর্গ।৩০) তীর, স্বর্গ, বজ্র, দিক, চোখ, জল পাওয়া যায় । তারানাথ তর্কবাচস্পতি তার 'বাচস্পত্যাভিধান'-এ ২২টি অর্থ দেখিয়েছেন। কিন্তু যে মূর্খ সে চিরকালই কেবল পশু অর্থই নেবে । 


🔻আর শেষে থাকলো অধ্যাহার আর পূর্ব অনুবৃত্তি । যস্য বা সঃ এসবে ঈশ্বর বা বিশেষণ যুক্ত থাকলেও স্বাধ্যায়হীনরা তা বোঝে না বরং বলে এখানে বিশেষণ বা উল্লেখ কীভাবে এলো । তাদের প্রিয় অমরেশ্বর ঠাকুর যস্য = ‌যে বৃষাকপি (১০।৩৯), পৃথিবি = হে মাধ্যমিকদেবতে পৃথিবি (১০।৩৭) কিংবা আদুরে = হে যজ্ঞসমাদরকারী যজময়ান (৬।৩১) লিখেছে সেভাবেই এখানেও এসেছে । ভাষ্যকারের আশয় ও ভাষ্য প্রণালী না বুঝলে এহেন আক্ষেপ অস্বাভাবিক নয় । 



তাই কেবলমাত্র অভিধান বা প্রমাণাদি প্রদর্শন করে যত্রতত্র ভ্রান্তিময় অনুবাদ করলেই তা যথাযথ হয় না বরং পূর্বাচার্য, প্রকরণানুকূল ও প্রমাণাদি একত্রেই অর্থ প্রকাশক হয়। যদি আমি আমার অর্থ যা ইচ্ছা করে তা পরস্পরবিরোধীরূপে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কেবল একার্থক সমস্ত শব্দ গ্রহণ করি তবে তা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, তাতে আমি যতই প্রমাণ বা তথ্যসূত্র প্রদর্শন করিনা কেন ।  এভাবে বেদভাষ্য কদর্থকারী, তাদের পুরাতন ও নব্য সমর্থক সকলের অপদাবি নস্যাৎ করা হলো । বেদভাষ্যের অপূর্বতা জ্ঞাত না হওয়ায় ও সম্যক ধারণা না থাকায় তাদের কোনবিধ বক্তব্যই গৃহীত হবে না ।