

॥ ১ম পর্ব - গোত্রা ॥
কারণ দেবরাজ যজ্বা তাঁর নিঘণ্টু-টীকায় ‘গোত্রা’ শব্দটি সম্বন্ধে লিখেছেন- “ইহার বেদমন্ত্র অন্বেষণীয়”।
তাঁর এই বক্তব্যের তাৎপর্য হিসেবে অনেকে এরূপ মতও পোষণ করতে পারেন যে, নিরুক্তে ‘গোত্রা’ শব্দযুক্ত কোনো বেদমন্ত্রের উদাহরণ মহর্ষি যাস্ক কর্তৃক দর্শানো হয়নি কিংবা ‘গোত্রা’ শব্দযুক্ত কোনো বেদমন্ত্রের অস্তিত্ব দেবরাজ যজ্বা খুঁজে পাননি বিধায় এরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এমন বক্তব্য সর্বথা অযৌক্তিক। কারণ —
(১) নিঘণ্টুতে এমন অনেক শব্দ বিদ্যমান যার সবগুলোর মন্ত্র-উদাহরণ যাস্ক প্রদর্শন করেননি কিন্তু এর মানে এই নয় যে তিনি সেগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তাঁর নির্দিষ্ট নির্বচনের বাইরে অন্য অর্থ সম্ভব নয় — এমন কথাও তিনি নিরুক্তের কোথাও বলেননি। প্রমাণ স্বরূপ নিঘণ্টুর প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লিখিত পঞ্চদশ হিরণ্যনামের সবগুলোর স্বতন্ত্র উল্লেখপূর্বক বেদমন্ত্র সংবলিত উদাহরণ নিরুক্তকার প্রদর্শন না করলেও নৈঘণ্টুক কাণ্ডের দশম খণ্ডে তিনি পঞ্চদশ হিরণ্য নামের প্রসঙ্গ এনেছেন।
(২) দেবরাজ যজ্বা বেদে ‘গোত্রা’ শব্দ খুঁজে না পেয়ে একে অন্বেষণীয় বলে মন্তব্য করেছেন এরূপ মনে করা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। অপিতু বিভক্তিসহ, ঋগ্বেদে ৮ বার, সামবেদে ১ বার এবং অথর্ববেদে ২ বার ‘গোত্রা’ শব্দের অস্তিত্ব থাকা এরূপ ভ্রমপূর্ণ বিচারকে স্বতঃ খণ্ডন করে। প্রসঙ্গত, পুনরায় পাঠককে এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো যে ‘গোত্রা’ শব্দটি হলো পৃথিবীবাচক।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মধ্যযুগ হতে আজ পর্যন্ত কোনো পৌরাণিক বেদভাষ্যকারই গোত্রা অর্থ পৃথিবীরূপে গ্রহণ করেননি। বেঙ্কটমাধব, উবট, মহীধর, মুদ্গল, সায়ণ কেউই নয়। আর একারণেই দেবরাজ যজ্বার দ্বারা উক্ত বক্তব্যের অবতারণা করা হয়েছে। এস্থলে মধ্যযুগীয় বেদভাষ্যকার সায়ণাচার্যের ভাষ্যকেই মুখ্য রূপে তুলে ধরে তাঁর এরূপ অর্থ নির্বচন না করার অক্ষমতা চার বেদের ১১টি স্থল হতে ক্রমশ উপস্থিত করা হলো —
(১) ঋগ০ ২।১৭।১ - (সা০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(২) ঋগ০ ৩।৩০।২১- (সা০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৩) ঋগ০ ৩।৩৯।৪ - (সা০) গোত্রা অর্থ গো।
(৪) ঋগ০ ৩।৪৩।৭ - (সা০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৫) ঋগ০ ৪।১৬।৮ - (সা০) গোত্রা অর্থ গোত্র।
(৬) ঋগ০ ৬।৬৫।৫ - (সা০) গোত্রা অর্থ সংঘ।
(৭) ঋগ০ ১০।৪৮।২ - (সা০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৮) ঋগ০ ১০।১০৩।৭ - (সা০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৯) সাম০ ১৮৫৫- (সা০) গোত্রা অর্থ সৈন্যদল ।
[পরিতোষ ঠাকুর এস্থলেও মেঘ অর্থই গ্রহণ করেছেন । দুর্গাদাস লাহিড়ী এস্থলে পর্বত অর্থ গ্রহণ করেছেন! ]
(১০) অথর্ববেদ-১৯।১৩।৭- (সা০) - গোত্রা অর্থ উদক,গো, মেঘ আদি অর্থ গ্রহণ করেছেন।
(১১) অথর্ববেদ - ২০।৭৭।৮- (সা০) - ঐ
সায়ণাচার্য একটি স্থলেও গোত্রা অর্থ পৃথিবীবাচী রূপে গ্রহণ করেননি। এস্থলে কেউ যেন এই আপত্তি উত্থাপন না করে যে, “সায়ণাচার্য বেদার্থের সীমা লঙ্ঘন করতে বা তাঁর ভাষ্য অতি ভারবহ করতে চাননি।”, কারণ ঋগ্বেদের একটি মাত্র মন্ত্র - “চত্বারি শৃঙ্গা ত্রয়ো….” [ঋগ০ ৪।৫৮।৩] এর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আচার্য সায়ণ স্বভাষ্যে দর্শিয়েছেন।
সুতরাং, যেস্থলে ১১টি মন্ত্রে গোত্রা শব্দের অনেকার্থতা দর্শানোর পূর্ণ সুযোগ বিদ্যমান ছিল সেস্থলে আচার্য সায়ণ প্রায় সর্বত্র “মেঘে মেঘে”-ই ভেসে বেড়িয়েছেন !
এবার যদি আমরা সায়ণাচার্য হতে পূর্ববর্তী আচার্য বেঙ্কটমাধবকৃত ঋগ্বেদভাষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে স্পষ্ট হবে যে তিনিও এই অক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতে পারেননি। যথা -
(১) ঋগ০ ২।১৭।১ - (বে০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(২) ঋগ০ ৩।৩০।২১- (বে০) গোত্রা অর্থ উদক,মেঘ।
(৩) ঋগ০ ৩।৩৯।৪ - (বে০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৪) ঋগ০ ৩।৪৩।৭ - (বে০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৫) ঋগ০ ৪।১৬।৮ - (বে০) গোত্রা অর্থ মেঘ।
(৬) ঋগ০ ৬।৬৫।৫ - (বে০) গোত্রা অর্থ গো ।
(৭) ঋগ০ ১০।৪৮।২ - (বে০) গোত্রা অর্থ ঐ ।
(৮) ঋগ০ ১০।১০৩।৭ - (বে০) গোত্রা অর্থ ঐ ।
অত্যাশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঋগ্বেদের কেবলমাত্র সপ্তম মণ্ডল পর্যন্ত যিনি ভাষ্য করেছিলেন সেই স্বামী দয়ানন্দের বেদভাষ্যেই (ঋগ০ ৩।৪৩।৭) সর্বপ্রথম গোত্রা শব্দের অর্থ পৃথিবীবাচক রূপে বিদ্যমান। যদি মহর্ষি সম্পূর্ণ চতুর্বেদের ভাষ্য করে যেতে পারতেন তাহলে আমরা বেদবাঙ্ময়ের কতো অভূতপূর্ব অমৃতেরই না সন্ধান পেতাম!
সুতরাং, এস্থলে অর্থের ঘাটতিজনিত দোষ যা সায়ণাচার্য এবং আচার্য বেঙ্কটমাধবের ভাষ্যে পাওয়া যায় তা হতে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর ভাষ্য সম্পূর্ণ মুক্ত। এটি ছাড়াও সায়ণভাষ্যে এমন ত্রুটি আরো বহু স্থলে বিদ্যমান যা পরবর্তী পর্বেও উপস্থাপন করা হবে।
'আর্ষসিদ্ধান্তম্ সদা সর্বত্র বিজয়তে'
0 মন্তব্য(গুলি)