বিগত পর্বে আমরা গোত্রা শব্দটির বিবিধ পদার্থ তুলনামূলক ভাষ্য আলোচনা সাপেক্ষে উপস্থাপনের মাধ্যমে মহর্ষির ভাষ্যের পদার্থচয়নে নৈঘণ্টুক বৈচিত্র্যতা এবং বেঙ্কটভাষ্য ও সায়ণভাষ্যের অর্থের ঘাটতিজনিত দোষ তুলে ধরছিলাম। এবারের পর্বে আমরা যে শব্দটিকে বিবিধ ভাষ্যকারের দৃষ্টিতে দেখার প্রয়াস গ্রহণ করেছি সেই শব্দটি হলো “শ্রদ্ধা”।
“শ্রদ্ধা ইতি সত্যনাম” [নিঘ০ ৩।১০]
দুঃখের বিষয়, সায়ণাচার্য এবং বেঙ্কটমাধবের মতো প্রমুখ প্রসিদ্ধ বেদভাষ্যকারদের কেউই তাদের স্বকৃত বেদভাষ্যে শ্রদ্ধা অর্থ “সত্য” হিসেবে গ্রহণ করেননি। যদিও নিঘণ্টু টীকাকার দেবরাজ যজ্বা এরূপ অর্থ গ্রহণের যথার্থতা নিশ্চয়নে করেছেন। যথা —
“ सत्यमद्वा नकिरन्यस्त्वावान् “ (ऋo सं० १, १, ४, १)”- इति निगमाः ॥
[ দেবরাজ যজ্বার নিঘণ্টুটীকা - ৩।১০ দ্র০]
সুতরাং, এস্থলে পৌরাণিক আচার্যদের ভাষ্য মান্যতাকারীদের উচিত এবিষয়টি গভীরভাবে বিচার করা।


(১)ঋগ০ ১।১০৮।৬
শ্রদ্ধাম্,

(অনুরূপ: স্কন্ধস্বামী,
আচার্য মুদ্গলের ভাষ্য।)
(২)ঋগ০ ২।২৬।৩
শ্রদ্ধানমন্সকঃ,

(৩)ঋগ০ ৬।২৬।৬
শ্রদ্ধাভি,

(৪)ঋগ০ ৭।৩২।১৪
শ্রদ্ধয়া,

(৫)ঋগ০ ৯।১১৩।৪
শ্রদ্ধাম্ যজনামানাম্,

(৬)ঋগ০ ১০।১৫১।১
শ্রদ্ধা,

(৭)ঋগ০ ১০।১৫১।৩
শ্রদ্ধা,

(৮)ঋগ০ ১০।১৫১।৪
শ্রদ্ধাম্,

(৯)ঋগ০ ১০।১৫১।৫
শ্রদ্ধা।

বেঙ্কটমাধবের ভাষ্যে শ্রদ্ধা শব্দটির অন্য কোনো পর্যায়বাচী অর্থই পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর ভাষ্যের এমন বৈচিত্র্যহীনতা ও একই অর্থের পুনরাবৃত্তি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং ভাষ্যপ্রক্রিয়ার দৃষ্টিতে দৃষ্টিকটু।

(১)ঋগ০ ১।১০৮।৬
শ্রদ্ধাং শ্রদ্ধয়াদশতিশায়েত কৃতামুক্তিম্ ।

(২)ঋগ০ ২।২৬।৩
শ্রদ্ধা মনসি ।

(৩)ঋগ০ ৬।২৬।৬
শ্রদ্ধাভি শ্রদ্ধাপুরঃ সরমা -দশতিশায়েনানুষ্ঠিনৈ কর্মভিঃ ।

(৪)ঋগ০ ৭।৩২।১৪
শ্রদ্ধয়াযুক্তঃ সন্।

(৫)ঋগ০ ৯।১১৩।৪
শ্রদ্ধাং যজমানানামাত্মনো -পেক্ষিতাং।

(৬)ঋগ০ ১০।১৫১।১
(ক) শ্রদ্ধয়া এব,

(খ) শ্রদ্ধাম উৎকলক্ষণারাঃ ,
(গ) শ্রদ্ধয়া অভিমানী দেবনাং।
(৭)ঋগ০ ১০।১৫১।৩
শ্রদ্ধাং।

(৮)ঋগ০ ১০।১৫১।৪
(ক) শ্রদ্ধাং দৈবীং,

(খ) শ্রদ্ধাম এব পরিচরন্তি সর্বেজনাঃ,
(গ) শ্রদ্ধয়া হেতভূতয়া।
(৯)ঋগ০ ১০।১৫১।৫
(ক) শ্রদ্ধাং দৈবীং,

(খ) শ্রদ্ধাম আহ্বায়ামহে,
(গ) শ্রদ্ধাং আহ্বায়ামহে,
(ঘ) শ্রদ্ধে,
(ঙ) শ্রদ্ধাপয় শ্রদ্ধাবনঃ করু ।
(১০)সাম০ ৯০
শ্রদ্ধা দৈবী।

(১১) সাম০ ২৮০
শ্রদ্ধয়াযুক্তঃ সন্ বাজী

হবিষ্মান যজমানী ভবেৎ।
(১২) সাম০ ১৬৮২
ঐ ।

অথর্ববেদের অধিকাংশ মন্ত্রের ভাষ্য সায়ণাচার্য করেননি বা করতে পারেননি বা করতে পারলেও অজ্ঞাত বিধায় তা পুনঃ উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে অথর্ববেদের যেসকল মন্ত্রে (১৮টি) “শ্রদ্ধা” শব্দটি এসেছে তার সন্ধান নিম্নে ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হলো যেন পাঠক তা অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন। উল্লেখ্য, এই মন্ত্রগুলোতে শ্রদ্ধা অর্থ সত্য হিসেবে সায়নাচার্য কর্তৃক গৃহীত হয়নি।
অথর্ববেদ- (কাণ্ড,সূক্ত,মন্ত্র) = ৫।৭।৫, ৬।১৩৩।৪, ৯।৫।২১, ১০।২।১৯, ১০।৬।৪, ১০।১৭।১, ১০।১৭।১১, ১১।৭।৯, ১১।৮।২২, ১২।২।৫১, ১৩।৪।২৩, ১৫।২।৫, ১৫।৭।২, ১৫।৭।৩, ১৫।৭।৪, ১৫।৭।৫, ১৫।১৬।৪, ১৯।৬৪।১ ।।



(১) ঋগ০ ৬।২৬।৬
সত্যস্য ধারণাভিঃ ।

(২) ঋগ০ ৭।৩২।১৪
সত্যে প্রীতিঃ ।

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের ৬১ নং সূক্ত পর্যন্ত এবং সম্পূর্ণ যজুর্বেদের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। বাকি বেদের ভাষ্য সমাপ্ত করার সুযোগ তিনি পাননি। যেখানে ঋগ্বেদে ৯ টি মন্ত্রে ১৮ বার শ্রদ্ধা শব্দটির অর্থচয়নের সুযোগ সায়ণাচার্য এবং বেঙ্কটমাধব পেয়েছিলেন সেখানে মহর্ষি কেবলমাত্র চারটি ঋক্ মন্ত্রে চারবার শ্রদ্ধা শব্দটির পদার্থকরণের সুযোগ পেয়েছিলেন।

সায়ণাচার্য তাঁর ভাষ্য রচনার সময় শ্রদ্ধা শব্দটি পেয়েছিলেন ৩০টি মন্ত্রের ৩৭টি স্থলে ।
বেঙ্কটমাধব তাঁর ভাষ্য রচনাকালে শ্রদ্ধা শব্দটি পেয়েছিলেন ৯টি ঋক মন্ত্রের ১৭টি স্থলে।
মহর্ষি শ্রদ্ধা শব্দটি পেয়েছিলেন মাত্র চারটি ঋচার ৪টি স্থলে। সবমিলিয়ে শ্রদ্ধা শব্দটির নিরুক্তসম্মত বিবিধ অর্থ গ্রহণে সায়ণাচার্য ও বেঙ্কটমাধব হতে যথাক্রমে ৯ গুণ এবং ৪ গুণ কম সুযোগ ছিল মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর। তারপরও তিনি তাঁর ভাষ্য বৈচিত্র্যময়তা সম্পূর্ণ নৈরুক্তপ্রণালী সম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন যেখানে কথিত মহান পৌরাণিক ভাষ্যকার সায়ণাচার্য এবং বেঙ্কটমাধব উভয়েই প্রায় একই অর্থকে কেন্দ্র করে তাদের পুনরাবৃত্তির চাকা তাদের স্ব স্ব বেদভাষ্যে ঘূর্ণায়মান রেখেছেন।

বেদভাষ্যসমূহের এরূপ তুলনামূলক পর্যালোচনা দ্বারা পাঠক যতো গভীরে প্রবেশ করবেন, ততোই পৌরাণিক ভাষ্যকারদের হতাশজনক ত্রুটি বা ঘাটতি তার চোখে পড়তে থাকবে আর ঋষি ভাষ্যের শ্রেষ্ঠত্বের উপলব্ধি হতে থাকবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা মহর্ষির থেকে সম্পূর্ণ চারবেদের ভাষ্য লাভ করতে পারিনি। কিন্তু যতটুকু পেয়েছি তা সর্বদাই এসকল দুর্বল-মানবীয় অভাব-ত্রুটির ঊর্ধ্বে থেকে স্বমহিমায় বিরাজিত থাকবে।
- ১ম পর্ব - ঋষি ভাষ্য বিজয়ম্ - ১ম পর্ব - গোত্রা




0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী