https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

উপনিষদ্ রহস্য (পর্ব ২)- অদৃশ্যই সত্য (সদেব সোম্যেদমগ্র আসীৎ)

Wednesday, June 12, 2024

সংসারের পদার্থকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়— দৃশ্য ও অদৃশ্য। যা কিছু দৃশ্য সেসব আমরা দেখতে পাই আর যা কিছু অদৃশ্য, তা আমরা দেখতে পাই না। এমন অনেক পদার্থ আছে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। দেখতে না পাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত সেসব এতই সূক্ষ্ম যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সেগুলো দেখার শক্তি নেই। দ্বিতীয়ত সেসব এতটাই দূরে যে, আমরা সেগুলো দেখতে পাই না। অর্থাৎ দূরত্বের কারণে আমাদের ইন্দ্রিয় সেখানে পৌঁছাতে পারে না। যদি সেসব বস্তু আমাদের নিকটে হতো, তাহলে আমরা দেখতে পেতাম। তৃতীয় কারণ হতে পারে, সেগুলো আমাদের এতটাই কাছে যে, আমরা তাদের দেখতে পাই না। এর পরিণামস্বরূপ আমরা দৃশ্যকেই সত্য বলে মনে করি, বাস্তব মনে করি; অদৃশ্যকে সত্য ও বাস্তব মনে করি না। শুধু তাই নয়, আমরা অদৃশ্যকে মিথ্যা ও অবাস্তব বলতে শুরু করি। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দৈনন্দিন আচরণে অদৃশ্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে শুরু করি। কিন্তু যদি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, অদৃশ্যই সত্য, এটিই বাস্তব। দৃশ্যমান কেবল অদৃশ্যের উপর নির্ভর করে থাকে। যদি অদৃশ্য না থাকে, তবে দৃশ্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দৃশ্যের অস্তিত্ব অদৃশ্যের স্রোত থেকে প্রবাহিত হয়।
ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৬ষ্ঠ প্রপাঠকে আরুণি ও শ্বেতকেতুর সংবাদ পাওয়া যায়। পিতা শ্বেতকেতুকে বললেন— পুত্র! গুরুর কাছে গিয়ে বিদ্যা অধ্যয়ন কর। পিতার আদেশ অনুসারে শ্বেতকেতু ১২ বছর গুরুকুলে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করলেন। যখন শ্বেতকেতু পিতার কাছে ফিরে আসলেন, তখন তিনি নিজেকে খুব পণ্ডিত মনে করলেন এবং ভেবেছিলেন যে, তিনি সবকিছু শিখে ফেলেছেন। পিতা তখন পুত্রকে বললেন— তুমি কি সেই আদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলে, যার দ্বারা অশ্রুত বিষয় শোনা যায়, অচিন্তিত বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়?' শ্বেতকেতু বললেন, এটি কেমন বিদ্যা? এরপর পিতা বললেন— পুত্র যাও, সামনে দাড়িয়ে থাকা বট বৃক্ষের ফল নিয়ে এসো। পুত্র তখন বৃক্ষ থেকে ফল নিয়ে আসলেন। পিতা বললেন এটি ভেঙ্গে ফেল। পুত্র ভেঙে ফেললেন। পিতা বললেন, এখানে কি দেখতে পাচ্ছ? পুত্র বললেন, কিছু বীজ দেখতে পাচ্ছি। পিতা বললেন, এদের একটি ভেঙে ফেল। পুত্র বললেন, ভেঙেছি। পিতা বললেন কী দেখতে পাচ্ছ? পুত্র বললেন, কিছুই না। পিতা বললেন, যাকে তুমি কিছুই না বলছো, আসলে সেখানে সবকিছু রয়েছে। এই ছোট ছোট অসংখ্য বীজের মধ্যেই অসংখ্য বিশাল বটবৃক্ষ অদৃশ্যরূপে বিদ্যমান। এরপরের কাহিনিতে পিতা পুত্রকে বললেন, তোমাকে এই লবণখণ্ড দিলাম। তুমি এই লবণখণ্ড জলে রেখে পরদিন সকালে আমার কাছে নিয়ে আসবে। শ্বেতকেতু পিতার কথানুসারে তাই করলেন। পরেরদিন সকালে পিতা পুত্রকে বললেন, রাতে জলে যে লবণখণ্ডটি রেখেছিলে সেটি নিয়ে এসো। কিন্তু শ্বেতকেতু কোনো লবণখণ্ড খুঁজে পেলেন না, কারণ তা জলে মিশে গেছে। পিতা বললেন, এই জল থেকে একটুখানি পান করো। পুত্র পান করে বললেন, এটি তো লবণাক্ত। পিতা বললেন, একটু মাঝখানে ও নিচের দিকে থেকে পান করো। পুত্র বললেন, সর্বত্রই তো লবণাক্ত। পিতা বললেন, লবণ দেখা যাচ্ছে না কারণ এটি জলের সর্বত্রই ব্যাপ্ত হয়ে আছে। 
 
অদৃশ্য সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, চল ও অচল সম্পর্কে প্রায় একই কথা বলা যায়। যে বস্তুটি চলমান, 'গতিশীল' সেটিই আমাদের কাছে দৃশ্যমান এবং আমরা তাকেই সত্য বলে মনে করি। আমরা বুঝতে পারি যে চাকাটি চলছে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না যে চাকাটি চলার পেছনে যদি স্থির কোনো বস্তু না থাকে তবে চাকাটি চলতে পারে না। দৃশ্য ও অদৃশ্যের বিষয়ে আমরা বলেছিলাম যে, দৃশ্য অদৃশ্যের উপর টিকে আছে। সমস্ত দৃশ্য প্রথমে অদৃশ্যরূপে থাকে, এজন্য যথার্থ সত্তা অদৃশ্যরই। অদৃশ্য থেকে প্রবাহিত হয়েই সমস্ত দৃশ্য তৈরি হয়। চল ও অচল সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা যে চলমান বস্তু দেখি, তা বস্তুত অচল কিছুর সাহায্যে চলে। উদাহরণস্বরূপ চাকাটি চলছে, কিন্তু এটি একটি অচল কীলকের সাহায্যে চলছে। যদি কীলক না থাকতো, তবে চাকাটি চলতে পারতো না। রথ, যান এবং ট্রেনগুলো স্থির কীলকের সাহায্যে চলাচল করে। যদি স্থিরতা না থাকতো, অচল না থাকতো, তাহলে অস্থিরের সত্তা থাকতো না, চলমানের সত্তা থাকতো না। আমরা যদি চলমান বস্তুর অস্তিত্বকে মেনে নিই, তাহলে প্রথমে আমাদেরকে অচল বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। আমরা দৃশ্যকে, চলমানকে সত্য বলে মনে করি, কিন্তু সত্য এটিই যে, অদৃশ্য ও অচলই সত্য। যা কিছু সচরাচর আমরা বুঝে থাকি বাস্তবতা আসলে তার চেয়েও এগিয়ে। এই ক্রমাগত পরিবর্তনের পুঁতিতে যে অপরিবর্তনীয়তার সুতোটি গেঁথে আছে তা অপরিবর্তিত থাকে, কারণ পরিবর্তন তার মধ্যেই দৃশ্যমান। অপরিবর্তনে কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। আমরা আগেই বলেছি যে, যতক্ষণ কোনো অপরিবর্তনশীল বস্তু না থাকছে, ততক্ষণ কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটা সম্ভব নয়।
 
অদৃশ্যতা এবং অপরিবর্তনশীলতার এই গুণ যেখানে পাওয়া যায়, তাকে এই শরীরে 'আত্মা' বলা হয়। মানুষের শরীরের পরে এই উভয় গুণাবলি প্রকৃতি দ্বারা সৃষ্ট সংসারেও পাওয়া যায়। মানুষের শরীর দৃশ্যমান, প্রকৃতির সৃষ্ট জগৎও দৃশ্যমান। শরীরে পরিবর্তন ঘটতে থাকে— শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য এইসব শরীরের গুণাবলি, সংসারের প্রতিটি কণাতেও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পরিবর্তনের এই কারণেই একে সংসার বলা হয় (সংসরতি ইতি সংসারঃ)। এই দৃশ্যমান শরীর যে অদৃশ্য সত্তার ওপর টিকে আছে, তাকে যেমন 'আত্মা' বলা হয়, তেমনি এই দৃশ্যমান সংসারও যে অদৃশ্য সত্তার ওপর টিকে আছে, তাকে 'পরমাত্মা' বলা হয়। আমরা দৃশ্যমানতা সম্পর্কে যা-ই বলি না কেন, পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে। শরীরে পরিবর্তন হচ্ছে, তার মধ্যে অবিরাম গতিশীলতার প্রবাহ রয়েছে, তাই দেহের এই অবিরাম চলমান চাকার মধ্যে এমন কিছু স্থির কীলক থাকতে হবে, যার চারপাশে এই চাকাটি চলতে পারে। এই কীলকের নাম ‘আত্মা’। একইভাবে পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে যে পরিবর্তন ঘটতে থাকে, এই পরিবর্তন, এই নিরন্তর গতি যে গতিহীন সত্তার আধারে টিকে আছে, তাঁর নাম ‘পরমাত্মা’।
 
আমরা দেখেছি দৃশ্যমান সত্তাকে মানলে আমাদের অদৃশ্য সত্তাকে মেনে নিতে হয়। পরিবর্তন ও গতিশীলতার সত্তা মেনে নিলে এমন একটি সত্তাকে মেনে নিতে হবে যার কোনো পরিবর্তন নেই, যা গতিহীন, স্থির, কেননা দৃশ্যের আধার অদৃশ্য, গতিশীলতা ও পরিবর্তনের আধার হলো গতিহীনতা তথা স্থিরতা। এ দুটি বিষয় ছাড়াও তৃতীয় একটি বিষয় আছে যা বাধ্য হয়েও আমাদের মেনে নিতে হয়। ওই বস্তুটি কী? কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, আমরা যা দেখি, যা কিছু সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, সেটি তখনই ঘটে, যখন সেটি আমাদের থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে। যদি কোনো বস্তু আমাদের খুব কাছে থাকে, এত কাছে যে তার এবং আমাদের মধ্যে এক অণু পরিমাণ দূরত্বও থাকে না, তাহলে আমাদের সে সম্পর্কে দৃশ্য-জ্ঞান হয় না। চোখের মণি চোখের সবচেয়ে কাছে, তাই চোখ সেটিকে দেখতে পারে না। যদি কোনো সত্তা সর্বব্যাপী হয়, তাহলে আমরা যেখানে আছি সেখানেও তিনি বিদ্যমান। তিনি আমাদের থেকে দূরে থাকলেই আমরা তাঁকে দেখতে পেতাম। যেখানে তিনি আছেন সেখানে আমরা আছি, যেখানে আমরা আছি সেখানে তিনিও আছেন—তাহলে তাকে কে দেখবে এবং কীভাবে দেখবে? প্রথমত তিনি অদৃশ্য, দ্বিতীয়ত তিনি সর্বত্র বিরাজমান। দেখতে হলে দূরত্ব প্রয়োজন, যা উভয়ের মাঝে নেই।
এখন শঙ্কা হতে পারে, যদি অদৃশ্য আত্মার সত্তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে তাহলে তার অনুভব কেন হয় না? অদৃশ্য পরমাত্মার সত্তাও যদি সন্দেহের ঊর্ধ্বে হয়, তবে তাঁর প্রতীতি কেন হয় না? এর উত্তর হচ্ছে, যে বস্তুটি সর্বগত অর্থাৎ সর্বব্যাপী তার প্রতীতি সম্ভব নয়। তিনি সর্বত্র রয়েছে, তাই তাঁকে কোথাও অনুসন্ধান করা যায় না। তাঁর অনুসন্ধান তখনই করা যেত, যখন তিনি একটি জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেন। হ্যাঁ, তাঁর উপলব্ধি একভাবে করা যায়। সুস্থ অবস্থায় একজন মানুষ যেমন তার অঙ্গের প্রতি ধ্যান দেয় না, অসুস্থ হলেই তার প্রতি ধ্যান চলে যায়। এভাবে যখন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন তার খেয়াল হয় যে, এমন কেউ আছে যে তাকে সুস্থ, নীরোগ এবং মানসিক শান্তি দিতে পারে। সংসার একটি অদ্ভুত খেলা। এটি দৃশ্যমান, তাই অদৃশ্যকে বিশ্বাস করতে হবে। এটি বিনাশশীল, তাই অবিনশ্বরকে স্বীকার করতে হবে; এটি গতিশীল এবং পরিবর্তশীল, তাই গতিহীন এবং অপরিবর্তনীয় কাউকে মানতে হবে; এটি দুঃখময়, তাই আনন্দময় কাউকে মেনে নিতে হবে; এটি অপূর্ণ, তাই পূর্ণকে গ্রহণ করতে হবে। এজন্য শ্রুতি বলছে— “স পর্য়গাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিꣳ শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্। কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্য়াথাতথ্যতোঽর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ॥ (ঈশ০ ৮)”
 
সন্দর্ভ গ্রন্থ— (সত্য কী খোঁজ; ডা০ সত্যব্রত সিদ্ধান্তলংকার)
ভাষান্তর— বিপ্লব আর্য