https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

'অধ্বর' ও 'মেধ' শব্দ মীমাংসা

Friday, July 12, 2024

 


💠'অধ্বর' ও 'মেধ' শব্দ মীমাংসা💠
অধ্বর ও মেধ উভয় পদদ্বয়ই যজ্ঞের সমার্থক [নিঘন্টু-৩।১৭] । এ নিয়ে কারো মতানৈক্য নেই। কিন্তু যজ্ঞের বেলায় 'অধ্বর', 'মেধ' এই শব্দগুলো পশুবধের সাথে সম্পর্কিত নাকি সম্পর্কযুক্ত নয় এ নিয়ে তর্কের অন্ত নেই।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, বৈদিক নামপদ মাত্রই সার্থক। বেদ এ একই বস্তু বা সত্তার ভিন্ন ভিন্ন নাম পাওয়া যায় কিংবা একই নামপদের দ্বারা পরস্পর হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তদ্বয়কে চিহ্নিত করা হয় - উভয়ক্ষেত্রেই শব্দ কখনো নিজের ধাতুগত অর্থ ত্যাগ করে না। বিষয়টি বোঝার জন্য একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিচার আরম্ভ করা যাক।
'পঙ্কজ' শব্দের অর্থ পদ্ম। এখন এই শব্দটি ভাঙলে আমরা পাই 'পঙ্ক' এবং 'জ' । 'পঙ্ক' অর্থ কাদা আর 'জ' অর্থ জন্ম বা জাত। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমরা পঙ্কজ অর্থ পাই - যা কাদায় জন্মে। এখন প্রশ্ন হলো আদৌ কি পদ্মফুল কাদায় জন্মে বা ফোটে? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে বৈদিক দৃষ্টিকোণ থেকে পদ্মকে 'পঙ্কজ' বলাটা ভুল। কারণ যে বস্তুর বৈশিষ্ট্য যা নয় তার দ্বারাই সেই বস্তুকে চিহ্নিত করাটা ত্রুটিপূর্ণ । আর এতে ঐ নামপদের সার্থকতাও থাকে না। যদিও আমরা প্রায়ই দেখতে পাই দৃষ্টিহীনার নাম 'সুনয়না', অপ্রিয়ভাষী নারীর নাম 'সুভাষিণী', অধীনস্থ চাকরের নাম 'জগন্নাথ' প্রভৃতি। কিন্তু বৈদিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ নামগুলো তখনই সার্থক হয় যখন দেখতে সক্ষম কিংবা সুন্দর চোখের অধিকারিণীর ক্ষেত্রে 'সুনয়না', প্রিয়ভাষী নারীর ক্ষেত্রে 'সুভাষিণী' এবং মুখ্যরূপে পরমাত্মা আর গৌণরূপে রাজার বেলায় 'জগন্নাথ' নাম প্রযুক্ত হয়।
🔰একই প্রক্রিয়ায় এবার যথাক্রমে অধ্বর ও মেধ শব্দ নিয়ে বিচার করা যাক -
'অধ্বর' শব্দের নিরুক্তি (derivation) এ নিরুক্তকার যাস্কমুনি লিখেছেন - 'অধ্বর ইতি যজ্ঞনাম। ধ্বরতিহিংসকর্মা তৎপ্রতিষেধঃ ।। [নিরুক্ত-১।৮]
🔰নিরুক্তকারের এই শব্দসমূহের ব্যাখ‌্যায় শ্রী দেবরাজ যজ্বা তাঁর নিঘন্টুভাষ্যে লিখেছেন -"ধ্বরতের্বধকর্মণঃ, 'পুংসি সংজ্ঞায়ং ঘঃ' [অষ্টাধ্যয়ী- ৩।৪।১১৮]
নঞ্পূর্বঃ। ধ্বরা হিংসা, তদভাবী যত্র।" [নিঘন্টু-১।১৭]
🟥এই ব্যাখ‌্যার অভিপ্রায় এই যে - 'অধ্বর' শব্দ ভাঙলে আমরা দুটি অংশ পাই। 'অ' এবং 'ধ্বর' । 'অ' অর্থ নিষেধবাচক আর 'ধ্বর' অর্থ হিংসা করা/হত্যা করা/বধ করা। অতএব অধ্বর শব্দের অর্থ হলো হিংসা বা বধ নিষিদ্ধ। এভাবে যজ্ঞের আরেক নাম 'অধ্বর' হওয়া এই মতেরই সমর্থন করে যে, যজ্ঞে কখনো হিংসা বা বধ করা উচিত নয়। অনেকে এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন - 'যেহেতু দেবতাদের যজ্ঞে অসুরেরা বা রাক্ষসেরা হিংসা করতে পারেনি তাই যজ্ঞের নাম অধ্বর' । আমরা এই ব্যাখ্যাটি অস্বীকার করছি না এবং একইসাথে এটাও বলছি যে '''এটিই অধ্বর এর একমাত্র সংজ্ঞা নয়।''' উল্লেখ্য ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কোথাও কিন্তু বলা হয়নি যে কেবলমাত্র এটিই অধ্বর শব্দের একমাত্র ব্যাখ্যা। এস্থলে হঠাকারীভাবে কিছু ভ্রাতা কেন ব্যাকরণগত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অস্বীকার করে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ গ্রন্থের ব্যাখ‌্যাকেই গ্রহণ করেন তা তারাই ভালো জানেন। যেখানে অধ্বর শব্দ নিজেই নিজের নির্বচন দ্বারা স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করছে যজ্ঞে পশুবলি নিষিদ্ধ। যদি যজ্ঞে পশুবধ করাই বেদ এর উদ্দেশ্য হতো তাহলে বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞের নাম 'অধ্বর' না হয়ে বরং 'ধ্বর' বা 'সধ্বর' হিসেবে থাকতো।
🔴এখন অনেকে এই দাবি তোলেন যে, যেহেতু যজ্ঞে বধ করা পশু স্বর্গে গমন করে তাই এটি হিংসা হয়েও হিংসা নয় । একইরকম কল্পনা দেবরাজ যজ্বাও করেছেন। নিরুক্তের গম্ভীর জ্ঞানের অধিকারী হয়েও তিনি কেন এমন কষ্ট কল্পনা করলেন? - এর একটিই উত্তর হলো - পরম্পরাগত পৌরাণিক সংস্কারের প্রতি প্রবল দুর্বলতা যা তিনি ত্যাগ করতে পারেননি বা অস্বীকার করতে চাননি । ফলে "অধ্বর" যজ্ঞ হয়ে গেলো পশুদের পরকালীন কল্যাণের নিমিত্তে আয়োজিত 'বৈদিকী হিংসার' অনুষ্ঠান। যাজ্ঞিকদের মধ্যে এই সংস্কার প্রচলিত হয়েছিল যে, যজ্ঞে পশুকে বধ করাই "অধ্বর" যজ্ঞের সার্থকতা বহন করে। কিন্তু এই ধারণাটি যে ভুল এবং দেবরাজ যজ্বার "বৈদিকী হিংসার" তত্ত্ব যে সরাসরি ঋষিবাক্য এবং বেদবিরুদ্ধ তা কেবলমাত্র একটি মন্ত্রের ব্যাকারণিক বিশ্লেষণ দ্বারাই এখন প্রমাণ করা হবে। উল্লেখ্য 'যজ্ঞ' বা 'অধ্বর' এর অপর নাম "মেধ" [নিঘন্টু ৩।১৭]
এবার অথর্ববেদ হতে একটি মন্ত্র দেখে নেওয়া যাক -
🕉️রাজসূয়ং বাজপেয়মগ্নিষ্টোমস্তদধ্বরঃ।
অর্কাশ্বমেধাবুচ্ছিষ্ট ""জীবর্বহিভমদিন্তম""।।
(অথর্ববেদ ১১।৭।৭)
--- "রাজসূয়, বাজপেয়, অগ্নিষ্টোম এইসব যজ্ঞ অধ্বর (অহিংস) । অর্ক এবং অশ্বমেধ যজ্ঞ প্রভূর মধ্যে স্থিত, যাহা জীবের বৃদ্ধিকারী এবং অত্যন্ত হর্ষদায়ক।"
🔵এখানে মন্ত্রের একাধিক কোটেশনযুক্ত শব্দটি দেখুন - ""জীবর্বহিভমদিন্তম""" - যার অর্থ জীবের বৃদ্ধিকারক।
🔰অথর্ববেদের প্রকাণ্ড বিদ্বান পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী পাণিনি সূত্র হতে এর অর্থ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে- ///জীব+বৃহি বৃদ্ধৌ-ইসি। জীবানাং বৃদ্ধিব্যবহারঃ (মদিন্তমঃ) অত ইনিঠনৈ। পা০ ৫।২।১১৫///
ব্যাকরণিক বিশ্লেষণ: "ইনি" প্রত্যয় (মদিন্তম্) এবং পদের শেষে বিবৃত অ হয় এমন পদ ঘটমান বর্তমান কাল তথা বর্তমান কাল নির্দেশ করে। [পাণিনি ০ ৫।২।১১৫]
অর্থাৎ , "জীবর্বহিভমদিন্তম"- জীবের বৃদ্ধিকারক - বর্তমান কাল নির্দেশ করে। সুতরাং ব্যাকারণিক দৃষ্টিকোণ অনুসারে এবং মন্ত্রের অর্থ অনুযায়ী, অশ্বমেধ,গোমেধ প্রভৃতি "মেধ" বা "যজ্ঞ বা "অধ্বর"" বর্তমান কালেই যজ্ঞের পশুসমূহের বর্ধনকারী বা কল্যাণকারী। পরকালের বা ভবিষ্যৎকালের জন্য বৃদ্ধিকারক এমন নয় !
📝সুতরাং পাঠক, একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, স্বর্গে পাঠানোর নাম করে যদি যজ্ঞে পশুকে হত্যাই করে ফেলা হয় তাহলে কি করে বর্তমানকালে তা পশুসমূহের বৃদ্ধিকারী হতে পারে?? শব্দবিচার তো দূরে থাক, পশুকে হত্যা করে ফেললে বর্তমান কালে বা ইহকালে তার বৃদ্ধি ঘটে এমন পাগলামো চিন্তা করলে মন্ত্র, ব্যাকরণ কোনোটারই সার্থকতা থাকে না ! আর পশু স্বর্গে গিয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে এমন চিন্তাও মন্ত্রের ব্যাকরণ নাকচ করে দিচ্ছে। পশুর বৃদ্ধি তথা কল্যাণ বর্তমানে বা ইহকালেই হবে। বধ করার পরে তথা ভবিষ্যতে নয়!
✅অতঃ 'যজ্ঞ তথা মেধ তথা অধ্বর বা অহিংসা মানে বৈদিকী হিংসা ( অশ্বাদি প্রাণীর পরকালে উত্তম গতি লাভের জন্য তাদের হত্যা করা ) যা হিংসা হয়েও হিংসা নয়' - এমন কপোলকল্পিত ও বেদবিরুদ্ধ ধারণা মন্ত্র এবং আর্ষ ব্যাকরণ দ্বারাই খণ্ডিত হয় ।
📒ভূমিকাংশ: 'বৈদিক পশুযজ্ঞ মীমাংসা'- প্রোফেসর বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার।
সংযোজন ও সম্পাদনা : রাহুল ধর ।
📚সহায়ক গ্রন্থাদি:
অথর্ববেদ -পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী, ঋগ্বেদাদি ভাষ্যভূমিকা, সামবেদ-পূর্ব ও মহানাম্নী আর্চিক (স্বাধ্যায় প্রকাশনী) ।