ঋগ্বেদের
দশম মণ্ডলের অন্তর্গত রাত্রি সূক্ত (১০.১২৭) একটি অনন্য কাব্যিক ও
দার্শনিক বর্ণনা , যেখানে রাত্রিকে কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয় , বরং এক
চেতন-সত্ত্বা , দেবী , রক্ষাকর্ত্রী ও স্নেহময়ী মাতৃরূপে চিত্রিত করা হয়েছে
। এই সূক্তে রাত্রি আলোবিমুখ অন্ধকার নয় , বরং অন্ধকারের অন্তরালে থাকা
গভীর শান্তি , সুরক্ষা ও নবজীবনের প্রতীক ।
ঋষি
কুশিক এই সূক্তে রাত্রিকে 'দেবী ' রূপে আহ্বান করেন । যিনি সর্বত্র
বিস্তৃত, নক্ষত্ররূপ নয়নের দ্বারা আমাদের পর্যবেক্ষণ করেন, আমাদের নিদ্রায়
নিমগ্ন করে ক্লান্ত শরীরে প্রাণসঞ্চার করেন। এ যেন এক দৈনন্দিন পুনর্জন্মের
অনুপম স্তোত্র । ঋগ্বেদের ১০.১২৭ সূক্তে রাত্রিকে একটি জীবন্ত সত্তা
হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে । তিনি শুধু অন্ধকার নন, বরং মমতাময়ী জননীরূপে
অভিভাবিকা । তিনি আমাদের ঘুমে নিমজ্জিত করেন , তত্ত্বাবধান করেন এবং রক্ষা
করেন। এখানে 'নিদ্রা' দার্শনিকভাবে একটি অস্তিত্বগত পুনর্গঠনের প্রতীকবি ।
যেমন মৃত্যু ও পুনর্জন্ম একটি চক্রও , তেমনি প্রতিদিনের ঘুম এক ক্ষুদ্র
মৃত্যু , আর জাগরণ এক নতুন জন্ম । রাত্রি এখানে অন্ধকারের প্রতীক হয়েও
নেতিবাচক নয় । তিনি আলোর বিরোধী নন , বরং আলোর পথ প্রস্তুতকারী । রাত্রি
মানেই অন্তর্মুখীনতা , চিন্তন , রাত্রির 'নয়ন' হিসেবে নক্ষত্রের উল্লেখ এটি
"বিশ্ববুদ্ধি" বা "চেতনা-সত্তার সর্বব্যাপী দৃষ্টি"র রূপক । রাত্রি যেন
সর্বত্র চেতনা ছড়িয়ে একটি সচেতন নিরীক্ষিকা , আমাদের কাজ ও অস্তিত্বকে
নিরবধি পর্যবেক্ষণ করছেন ।

উদু ত্যং জাতবেদসং দেবং বহন্তি কেতবঃ।
দৃশে বিশ্বায় সূর্যম্॥
[১] এই রাত্রি– আমাদের প্রশান্তিদায়িনী , আনন্দদায়িনী ।
(পুরুত্রা) যিনি সর্বত্র উপস্থিত থেকে পালন করেন , পূর্ণতা প্রদান করেন এবং সুরক্ষা করেন ।
(দেবী)
(‘দিব্’ ধাতু থেকে নির্গত- ঘুম , আলোক) যিনি আমাদের নিদ্রার কারণ , আমাদের
নিদ্রায় নিমগ্ন করেন । (আয়তী)যিনি সমাগত , উপস্থিত হচ্ছেন ।
(অক্ষভিঃ ব্যবখ্যত) যিনি নক্ষত্রস্বরূপ নয়নের দ্বারা আমাদের দিকে চেয়ে আছেন ।
যেমন
মাতা শিশুকে স্নেহ ও যত্নের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন , তেমনই এই দেবী
রাত্রি আমাদের প্রতি দৃষ্টি রাখেন । নক্ষত্রসমূহই তাঁর নয়ন , যেগুলোর
মাধ্যমে তিনি আমাদের নিরবিচারে রক্ষা ও তত্ত্বাবধান করেন ।
[২] এই রাত্রি আমাদের নিদ্রামগ্ন করে
(বিশ্বা শ্রিয়ঃ) — সমস্ত শক্তি , সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য
অধি অধিক — আমাদের দেহে প্রাচুর্যে ধারণ করান ।
রাত্রির
নিদ্রার মাঝে ক্লান্ত দেহে পুনরায় সতেজতা ও প্রাণসঞ্চার ঘটে । নিঃশেষিত
প্রাণশক্তি নতুন করে পূর্ণতা পায় । এইভাবে রাত্রি প্রকৃতপক্ষে আমাদের জন্য
পালনকর্ত্রী
, পুনরুজ্জীবনদাত্রী ও রক্ষাকর্ত্রীরূপে আবির্ভূত হন । ঘুমান্ত ব্যক্তি
জেগে উঠে নিজেকে যেন নবপ্রাণবন্তরূপে অনুভব করে ।
ভাবার্থঃ
রাত্রির নিদ্রা কেবল বিশ্রাম নয় , তা এক নবজীবনের উপহার । যার পরশে
ক্লান্ত জীবন আবার প্রস্ফুটিত হয় , চেতনার পুষ্পপুঞ্জ আবার বিকশিত হয়ে ওঠে ।


অপ ত্যে তার্থম্ উদগাৎ নার্তুর্দধাতি পৃষ্ঠতঃ।
অত্যং জুষ্টং চ দেবাঃ॥
পদার্থ:
[১] এই রাত্রি (অমর্ত্যা) = অদ্বিতীয় , অবিনাশী । এটি কখনো নষ্ট হয় না ।
দিন শেষ হলে আবার ফিরে আসে । রাত্রি দিন শেষে ঘুমিয়ে পড়ে , তারপর দিন শেষ
হলে আবার জেগে ওঠে । এটি কখনো ধ্বংস হয় না । এটি (দেবী) = সবার স্বপ্নের
কারণ [দিব্- স্বপনে] । যখন এটি আসে , তখন এটি (নিবত:) = পৃথিবীর নীচু
স্থানগুলো , (উদ্বত:) = উচ্চ স্থানগুলো, গুহা, গর্ত ও পর্বতশিখরগুলোকে (আ) =
চারপাশে , (উরু) = ব্যাপকভাবে বিস্তৃত আকাশকে পূর্ণ করে ফেলে । চারপাশে
রাত্রির অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে ।
[২]
এই রাত্রি এখন (জ্যোতিষা) = নক্ষত্রের আলো দিয়ে (তমঃ) = অন্ধকারকে কিছুটা
তাড়িত করে। নক্ষত্রের আলো দ্বারা সেই অন্ধকার এত ভয়ানক হয়ে ওঠে না ।
ভাবার্থ
- রাত্রির আগমন হয় এবং পুরো পৃথিবী অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে । এই
অন্ধকার নক্ষত্রের আলো দ্বারা কিছুটা তাড়িত হয় , তবে এটি পুরোপুরি ভয়াবহ
হয়ে উঠতে পারে না ।

যাবয়া বসুপত্নীব যথা দেবা ন দুচ্ছুনাঃ।
রাত্রি স্তবস্যা বয়ম্॥
পদার্থ:
[১] এই (দেবী) = আমাদের স্বপ্নের কারণ রাত্রি [দিব্-স্বপনে] (আয়তী) =
সর্বত্র চলমান , ক্রমশ এগিয়ে চলা , (স্বসারং উষসম্) = নিজের বোন উষার মতো
লক্ষ্য রেখে (উ) = নির্দিষ্টভাবে (নিঃঅস্কৃত) = স্থান ছেড়ে দিয়ে রাত্রি শেষ
হয় এবং উষা আসেন ।
[২]
এই উষার আগমনে (ইৎ উ) = নির্দিষ্টভাবে (তমঃ অবহাসতে) = অন্ধকার ধ্বংস হয়ে
যায় । বাস্তবে জীবনধারায় যে বিভ্রান্তি বা উত্তেজনার অভাব ছিল তা রাত্রির
ঘুমের পর শক্তি অর্জনের মাধ্যমে পুনরায় ফিরে আসে । প্রভাববেলায় আমরা উঠি
এবং নিজের মধ্যে সেই উদ্দীপনা পুনরায় অনুভব করি । এটাই অন্ধকারের ধ্বংসের
অনুভূতি ।
ভাবার্থ:
রাত্রি ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে উষার জন্য স্থান খালি করে দেয় , অন্ধকার
ধ্বংস হয়ে যায় । ঠিক তেমনি , আমাদের জীবনে অনুৎসাহের অন্ধকারও নিঃশেষিত হয়ে
, নতুন উদ্দীপনার আলোকিত প্রকাশ পুনরায় উজ্জ্বল হয় ।


নহি ত্বদ্রাত্রি দুচ্ছুনা ন রজ্যন্তি দেবীঃ।
বয়ং ত্বা স্তুবন্তঃ॥
পদার্থ:[১]
হে রাত্রি! (সে) = তুমি (আজ) = আজ (আমাদের জন্য) হও , (যার মাধ্যমে) তোমার
(আগতিতে) = আমরা (নির্দিষ্টভাবে) আমাদের গৃহে প্রবেশ করি । ঠিক যেমন
(পক্ষী) = পাখিরা (গাছের) = বৃক্ষের (উপরে) = তাদের বাসায় প্রবেশ করে ।
[২]
রাত্রি আসে , এবং আমাদের কাজের মাঝে বিশ্রাম প্রদান করে । যদি রাত্রির
নিয়মিত আগমন না হতো , তবে আমরা ক্রমাগত কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম ।
তাই রাত্রি সত্যিই আমাদের জন্য এক নীরব প্রশান্তি , আমাদের পুনঃপ্রাণিত করে
।
ভাবার্থ:
রাত্রি আসে এবং আমাদের জীবনে বিশ্রামের সুযোগ সৃষ্টি করে , যাতে আমরা
পুনরায় শক্তি ফিরে পেতে পারি । রাত্রির আগমন , ঠিক যেমন পাখিরা গাছের ডালে
ফিরে আসে , আমাদের জন্য এক শান্তি ও পুনঃপ্রাণের অভ্যর্থনা ।


শরদঃ শতং হি ত্বং রাত্রি বিভর্ষি রোদসী।
বিষ্টম্ভতেম ধীরাঃ॥
পদার্থ: [১] রাত্রি সমাগত হলে
গ্রামাসঃ নিঅবিক্ষত: এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম , সমস্ত জনপদ ধীরে ধীরে নিজ নিজ গৃহে প্রবেশ করে , রাত্রির নিঃশব্দতায় নিমগ্ন হয় ।
পদ্বন্তঃ: দুই পায়ে গমনকারী মানবসমাজ হোক বা
চতুষ্পদঃ: চতুষ্পদ প্রাণীরা
সকলেই (নি) বিশ্রামের উদ্দেশ্যে নিজেদের আশ্রয়ে স্থিত হয় ।
পক্ষিণঃ: আকাশচারী পক্ষীরাও নিজেদের নীড়ে ফিরে যায় , নিদ্রার পরশে নিবিষ্ট হয় ।
[২]
শ্যেনাসঃ: অতি দ্রুতগামী , চঞ্চল , ধনলাভে প্রতিনিয়ত ছুটে চলা
অর্থিনঃ: ধনান্বেষী বণিকগণও ,
যারা
চতুর্দিকে ছুটে বেড়ায় , এক স্থান হতে অপর স্থানে গমন করে , তর্পিত জীবনের
উদ্দেশ্যে পরিশ্রমে লিপ্ত থাকে, তাঁরাও (চিত্) অবশেষে ক্লান্ত হয়ে নিজেদের
আশ্রয়ে ফিরে আসে এবং নিদ্রায় নিমগ্ন হয় ।
ভাবার্থঃ রাত্রি— বিশ্রামের মহামন্ত্রণা।
সে
জীবজগতের ক্লান্ত গাঁথা মোচনের এক অলৌকিক অধ্যায় । দিন যেমন কর্মের অবধি ,
তেমনি রাত্রি বিশ্রামের অবলম্বন । মানব , জন্তু , পক্ষী
ধনলোভী বহমান বণিক হোক বা নির্বাক পশু
সকল জীব এক সুরে নিদ্রার মন্ত্রে বাঁধা পড়ে ।
রাত্রি তাদের মাঝে এক মহামায়ার মতো নেমে আসে
শান্তি , পুনর্জীবন ও পুনরাবিষ্কারের প্রতীক হয়ে ।


অন্নাপূর্ণা চ যাসি ত্বং সূনৃতাভিঃ সুভগাম্।
রাত্রি প্র শংসমীয়ম্॥
[১]
পূর্ববর্তী মন্ত্র অনুযায়ী রাত্রি বিশ্রামের সময় হলেও, যদি সে সময় হিংস্র
পশুদের ভয় বা চোরদের ভয় থাকে, তবে সঠিকভাবে নিদ্রা নেওয়া সম্ভব নয় । তাই
বলা হয়েছে , হে (উর্ম্যে) = রাত্রি! তুমি যে সমস্ত পৃথিবীকে অন্ধকারে
আচ্ছাদিত করে দাও! [উর্ণুঞ্জ আচ্ছাদনে] (বৃক্যং বৃকম্) = শিয়াল ও
বাঘ-ভেড়িদের (যাবয়া) = আমাদের থেকে দূরে রাখো। রাজা এভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ
করুক যাতে জনপদের কাছে এই হিংস্র পশুরা না আসতে পারে । একইভাবে (স্তেনম্) =
চোরকে (যবয়া) = আমাদের থেকে পৃথক করে দাও । রাত্রির রক্ষাকর্মীদের সঠিক
ব্যবস্থার কারণে চোরদের ভয়ও দূর হয়ে যায় ।
[২]
এইভাবে হিংস্র পশু ও চোরদের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে, তুমি (নঃ) = আমাদের জন্য
(সুতরাভব) = শরীরের রোগ ও মানসিক ঈর্ষা , দ্বেষ , ক্রোধ ইত্যাদি
অসুখ-ব্যাধি থেকে আমাদের সুস্থ করে তোলো । রোগী যদি ঘুমায় , তবে তার অর্ধেক
রোগ দূর হয়ে যায় এবং যে ব্যক্তি ক্রোধে অস্থির হয়ে থাকে , সে যদি ঘুমায় ,
তবে পরবর্তী দিন সে পুরোপুরি ক্রোধ মুক্ত হয়ে ওঠে । এই রাত্রি আমাদের
শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি থেকে মুক্তি দেয় ।
ভাবার্থঃ হিংস্র পশু ও চোরদের ভয় থেকে মুক্ত হয়ে , আমরা সঠিকভাবে ঘুমাতে সক্ষম হই এবং শরীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার উপরে উঠে আসি ।


শুচিঃ পাবক ঊর্জস্বতী যামায়ুষং বিভর্ষি নঃ।
রাত্রি ত্বং ন সূনৃতাঃ॥
[১]
রাত্রে ঘুমিয়ে উষাকাল প্রভাতে যিনি জাগ্রত হন, তিনি উষাকে বলেন যে , এই
(পেপিশৎ) = আমাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা , আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে
(কৃষ্ণম্) = গভীর কালো (ব্যক্তম্) = চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া (তমঃ) = অন্ধকার ,
(মা উপ অস্থিত) = আমাকে এমনভাবে আচ্ছাদিত করেছে যে , এ যেন আমার উপর পূর্ণ
আধিপত্য স্থাপন করেছে ।
[২]
হে (উষঃ) = উষা দেবী ! তুমি এই অন্ধকারকে এইভাবে (যাতয়) = আমার থেকে দূর
করে দাও , (ইব) = যেমন ঋণদাতারা ঋণ পরিশোধ করে । উষাকালে উঠেও একজন মানুষ
পিতৃ ঋণ পরিশোধের জন্য বড়দের প্রণাম , দেবযজ্ঞের মাধ্যমে দেব ঋণ মিটিয়ে এবং
স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে ঋষি ঋণ মুক্ত হয় । একইভাবে উষা আমাদের সকল ঋণ থেকে
মুক্তি দেয় । বলা হয় , তেমনই তুমি আমাদের এই রাত্রির অন্ধকার থেকেও মুক্তি
দাও ।
ভাবার্থঃ
যেমন উষা আমাদের ঋণ থেকে মুক্তি দেয় বড়দের প্রণাম , দেবযজ্ঞ ও স্বাধ্যায়ের
মাধ্যমে ঠিক তেমনি উষার মতো রাত্রির অন্ধকার থেকেও আমাদের মুক্তি প্রদান
করো ।

উপ মা পেপিশদ্গবাং সংবিশন্তীব নিলিলীঃ।
রাত্রি যা দুচ্ছুনা॥
[১]
হে (রাত্রি) = আমার প্রিয় রাত্রি ! (তেতপ) = তোমার কাছে পৌঁছে (গাঃ ইব) =
এই রশ্মির মতো [গাঃ] (অকরম) = জ্ঞানের বাণীকে নিজের মধ্যে ধারণ করি ।
রাত্রির শেষ সীমা উষাকাল । এই উষাকালে যেমন আলোর রশ্মির শুরু হয় , তেমনই
আমি এই মুহূর্তে নিদ্রার অবসান ঘটিয়ে জ্ঞানের বাণী গ্রহণ করতে প্রস্তুত ।
[২]
হে (দ্বিহঃ দুঘিতঃ) = [দু পূরণকারী] আলোর পূর্ণতার সঞ্চারিকা! আমরা তোমার
জন্য (স্তোমম্) = স্তুতির সমূহ উচ্চারণ করি । তেমনই উচ্চারণ করি (ন) = যেমন
(জিগ্যুষে) = এক বিজয়ী পুরুষের জন্য স্তোত্র উচ্চারণ করা হয়। তুমি
(বৃণীষ্) = সেই স্তোত্রের সঞ্চারিকা হবে । এই প্রভাতে আমরা স্তুতি উচ্চারণ
করবো ।
ভাবার্থঃ
রাত্রির সমাপ্তির পর , জ্ঞানে প্রবুদ্ধ হয়ে আমরা স্তোত্রের উচ্চারণ করতে
থাকব এবং জ্ঞানের বাণী অধ্যয়ন করব । এই সুচক থেকে বুঝা যায় যে , দিনের
সমস্ত ক্লান্তি থেকে যদি আমরা ঘরেই নিরাপদ নিদ্রা উপভোগ করি , তবে আমাদের
সব ইন্দ্রিয় আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে , এবং প্রভাতে জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হয়ে
আমরা স্বাধ্যায়ে এবং স্তোত্রে দিন শুরু করতে পারব । যদি আমাদের দিন এভাবেই
শুরু হয় , তবে আমরা 'বিহব্য'—বিশিষ্ট পূজা ও বিশেষ আহ্বানকারী—হই, এবং এই
'বিহব্য' এর পরবর্তী সুচক সেই বিশেষ প্রার্থনা করতে থাকে ।

ঋগ্বেদের
রাত্রিসূক্তম্ মানব অস্তিত্বের এক অনবদ্য দার্শনিক অন্বেষণ । এখানে রাত্রি
কেবল দৈহিক ক্লান্তির পর বিশ্রামের সময় নয় , বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক
বাস্তবতা যার আঁধারে লুকিয়ে থাকে প্রজ্ঞা , অনন্ততা ও আত্মপরিচয়ের আহ্বান ।
রাত্রি যেমন প্রতিদিন আমাদের চেতনার অন্তরালে ডুবিয়ে দিয়ে এক
অন্তঃপ্রবাহের দিকে নিয়ে যায় , তেমনি ঋষি কুশিকও এই সূক্তম্-এর মাধ্যমে
আমাদের মনে করিয়ে দেন যে সত্যের অন্বেষণ সবসময় আলোয় হয় না ; কখনো কখনো তা
ঘটে নিস্তব্ধ , রহস্যঘেরা , নক্ষত্রবিন্দুতে উজ্জ্বল অন্ধকারের ভিতরেই । এই
অন্ধকার ভয়ংকর নয় , কারণ রাত্রি নিজেই এক রক্ষা এক প্রশ্রয়–যেখানে আত্মা
পুনর্প্রতিষ্ঠা পায় । এই উপলব্ধি আমাদের আহ্বান জানায় দৈনন্দিন জীবনেও
রাত্রির মতো হয়ে উঠতে বিস্তৃত , গ্রহণশীল , ও আশ্রয়দাত্রী ।
0 মন্তব্য(গুলি)
Author
সত্যান্বেষী