

উত্তর: শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১৮.৬৬ শ্লোকটি গীতার চূড়ান্ত উপদেশ ও সারসংগ্রহ ।
এই শ্লোকে 'সর্বধর্ম' পরিত্যাগের নির্দেশে কি শ্রীকৃষ্ণ গীতার পূর্ববর্তী
উপদেশকে নিজেই নাকচ করলেন ? না কি 'ধর্ম' শব্দটি এখানে ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত
হয়েছে ? আর 'আমি' এই আত্মসমর্পণের কেন্দ্রবিন্দু - তাঁর প্রকৃত স্বরূপ কী ?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতেই আমাদের প্রবেশ করতে হয় গীতার গূঢ় তত্ত্ব ,
ভাষা , দর্শন ও প্রসঙ্গের গভীরে । কারণ এ শ্লোক শুধুই একটি উপদেশ নয় , এটি
এক মৌলিক সিদ্ধান্ত এক চরম আত্মসমর্পণ , যেখানে মানুষ তার বিভ্রান্ত বুদ্ধি
ও মিথ্যা ধর্মবোধ ত্যাগ করে ঈশ্বরীয় সত্যের আশ্রয় গ্রহণ করে । এই আলোচনায়
আমরা দেখব , কীভাবে গীতার বাকি উপদেশগুলির সঙ্গে এই শ্লোকটি নিগূঢ়ভাবে
সংযুক্ত , এবং কেন এটিকে গীতার ❝সর্বগুহ্যতম বচন❞ বলা হয়েছে ।



সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৬৬অনুবাদ: সকল ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার স্মরণ লও , আমি তোমাকে সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত করবো তুমি শোক করো না ।
❝সকল ধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণ লও , আমি তোমাকে সকল প্রকার পাপ থেকে মুক্ত করব❞ ।
অধিকাংশ
গীতাভাষ্যকারগণ এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে , জগতের সকল ধর্ম বা
অনুশাসন ত্যাগ করে কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আশ্রয় নিলে , পত্র-পুষ্পাদি
দ্বারা তাঁর অর্চনা করলে তিনি সেই ভক্তকে পাপ থেকে মুক্ত করবেন । কিন্তু
এখানে এই ব্যাখ্যা সঙ্গত মনে হয় না । কেননা , এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে
সম্পূর্ণ গীতার ভাব এবং কুরুক্ষেত্রের ভাব প্রশ্নবিদ্ধ হয় । প্রথমত ,
মহাভারতে আছে , কুরুক্ষেত্রে গীতার জ্ঞান প্রাপ্তির পর অর্জুন যুদ্ধের জন্য
উত্থিত হয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণের চরণে পত্র-পুষ্পদি অর্পণ করে অর্চনা করেননি-
(ভীষ্মপর্ব: ৪৩।১)। দ্বিতীয়ত , এখানে সকল ধর্মের পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে ,
অথচ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৩য় অধ্যয়ের ৩৫শ শ্লোকে এবং ১৮.৪৭ এ বলেছেন-


শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বির্গুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাত্ ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৩.৩৫
অনুবাদ: উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা গুণরহিত স্বধর্ম শ্রেষ্ঠ । স্বধর্মে মৃত্যু শ্রেয় , পরধর্ম ভয়াবহ ।


শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৪৭
অনুবাদ: স্বধর্ম গুণহীন হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । স্বভাব-নির্দিষ্ট কর্ম করে মানুষ পাপ প্রাপ্ত হয় না ।


সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ । সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৪৮
অনুবাদ:
হে কৌন্তেয় (অর্জুন) ! সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করতে নেই । কেননা ,
ধোঁয়া দ্বারা আবৃত অগ্নির ন্যায় সমস্ত কর্মই দোষ দ্বারা আবৃত ।
❝শ্রেয়ান
স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ॥❞ অর্থাৎ উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত
পরধর্ম অপেক্ষা গুণরহিত স্বধর্ম শ্রেষ্ঠ । এই অধ্যায়েও বলেছেন- ❝সহজং কর্ম
কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ❞ স্বভাবজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও তা ত্যাগ করতে নেই
। অর্জুন ছিল ক্ষত্রিয় , আর ক্ষত্রিয়ের স্বাভাবিক কর্ম তথা ধর্ম দুষ্টদের
দণ্ড দেওয়া , ❝লোকসংরক্ষণে❞ অর্থাৎ প্রজাদের রক্ষা করা , অন্যায়ের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করা, ❝যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্❞ অর্থাৎ যুদ্ধ হতে পলায়ন না করা ।


শৌর্যং তেজো ধৃতিদাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্। দানমীশ্বরভাবশ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্ ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৪৩
অনুবাদ: শৌর্য , তেজ , ধৈর্য , দক্ষতা , যুদ্ধেও বিমুখ না হওয়া ও দান এবং ঈশ্বরভাব-এগুলো ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম ।


ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োঽন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ॥ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.৩১
অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নেই ।


অথ চেত্ত্বমিমং ধর্মং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
তত: স্বধর্মং কীর্তিং চ হিতা পাপমবাপ্স্যসি॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা২.৩৩
অনুবাদ: যদি তুমি ধর্মযুদ্ধ না কর , তবে স্বধর্ম ও কীর্তি ত্যাগ করে পাপ প্রাপ্ত হবে ।
এছাড়া
তিনি বারংবার স্বধর্ম পালনে নির্দেশ করেছেন , সন্তাপ মুক্ত হয়ে যুদ্ধ করার
নির্দেশ করেছেন-❝তম্মাদ যুধ্যস্ব ভারত।❞ গীতা ২।১৮ ; অর্থাৎ , হে অর্জুন
যুদ্ধ করো । ❝ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বর❞ ॥ গীতা ৩।৩০ অর্থাৎ , সন্তাপমুক্ত
হয়ে যুদ্ধ করো ।
যোগেশ্বর
শ্রীকৃষ্ণ নিজেই অর্জুনকে স্বধর্ম সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং স্বধর্ম
ত্যাগ করলে পাপ হবে তাই যেন স্বধর্ম ত্যাগ না করে পালন করে ন , তা দ্বারাই
উত্তম গতিপ্রাপ্ত হবে বলেছেন । আবার নিজেই ১৮।৬৬ শ্লোকে সকল ধর্ম ত্যাগ
করতে বলেছেন । এই শ্লোকটি মানলে শ্রীকৃষ্ণকে স্ববিরোধী মানতে হবে , নয়তো
শ্লোকটি স্ববিরোধী হবে । সুতরাং যদি পত্র পুষ্পাদী দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের চরণ
অর্চনা করা গীতার মূল বক্তব্য হয় তবে অর্জুন কেন গীতার জ্ঞান প্রাপ্তির পর
তাঁর অর্চনা করলেন না ? যদি সকল ধর্মের পরিত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা
করা শ্রেষ্ঠ ধর্ম হয় তবে স্বধর্ম পালন করাকে কেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলা হয়েছে ?
বস্তুত অর্জুন কর্মযোগী , যুদ্ধক্ষেত্রে এসে যুদ্ধ করাই তার স্বধর্ম ,
কিন্তু অর্জুন তা ভুলে গিয়েছিলেন , ঘোর তামসিকতা তাকে গ্রাস করেছিল । তার
মনে হয়েছিল এই যুদ্ধ করে কোনো লাভ , কোনো কল্যাণই হতে পারে না ; যে যুদ্ধের
পশ্চাতে আত্মীয়-স্বজনের বধ হবে , কুলক্ষয় হবে , কুলক্ষয়ের ফলে সনাতন
কুলধর্ম নষ্ট হবে , কুলে অধর্ম ছড়িয়ে গেলে কুলস্ত্রীগণও ব্যভিচারিণী হবে ,
বর্ণসংকর উৎপন্ন হবে , পিণ্ডোদক কর্ম থেকে বঞ্চিত হয়ে পিতৃগণ নিশ্চিতভাবে
পতিত হবে , নিশ্চিত নরক বাস হবে , সেই যুদ্ধ কখনোই ধর্মসঙ্গত হতে পারে না ।
অর্জুনের এরূপ জ্ঞান-ধারণকে লক্ষ্য করেই ভগবান্ তাকে অনার্য সম্বোধন করে
গীতার জ্ঞান প্রদান করতে আরম্ভ করেছিলেন


কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্ ।
অনার্যজুষ্ঠমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২.২
অনুবাদ:
শ্রীভগবান্ বললেন- হে অর্জুন ! অত্যন্ত কঠিন যুদ্ধের মুহূর্তে অনার্য
আচরণমূলক , স্বর্গহানিকর , কীর্তিনাশক এই মোহ কোথা থেকে তোমাকে আশ্রয় করল ?
অর্থাৎ
প্রথম অধ্যায়ে ভগবানকে উদ্দেশ্য করে অর্জুন যেসকল ধর্মের প্রভাবে উপযুক্ত
বিষয়গুলো বলেছিলেন সেগুলো স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ধর্মময় মনে হলেও গীতার
দৃষ্টিতে তা অধর্ম ছিল । সেই অধর্মযুক্ত জ্ঞানসমূহকেই বর্তমান শ্লোকে ❝সকল
ধর্ম❞ (সর্বধর্মান) বলা হয়েছে । যেমন: 'চোরের ধর্ম চুরি করা'-এই বাক্যে চোর
চুরি-বিদ্যা ধারণ করেছে বলে 'ধর্ম' শব্দের প্রয়োগ হয়েছে (ধর্ম ধারণ করা) ,
কিন্তু সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে চুরি করা ধর্ম নয় , অধর্ম । এরূপে বর্তমান
শ্লোকে অর্জুনকে উদ্দেশ্যে ভগবান্ যে বলেছেন- ❝সকল ধর্মের পরিত্যাগ করো❞
-এই বক্তব্যের মূল তাৎপর্য হলো, প্রথম অধ্যায়ে তুমি যেসকল জ্ঞান ধর্মযুক্ত
মনে করে ধারণ করেছিলে সেসব ধর্মের পরিত্যাগ করো । কেননা, এগুলো বেদবিরুদ্ধ
ধর্ম ; এগুলো উত্তম ধর্মের ন্যায় প্রতীত হয় , কিন্তু বাস্তবে অধর্ম । এখানে
'সর্বধর্ম' বলতে কোনো শাস্ত্রসম্মত স্বধর্ম বোঝানো হয়নি । বরং অর্জুন যে
প্রথম অধ্যায়ে যুদ্ধবিমুখ হয়ে ভ্রান্ত বুদ্ধি , মায়াপ্রসূত আবেগ ও কুলঘাতী
যুক্তিকে ধর্ম বলে আখ্যা দিয়েছিল গীতার ভাষায় যেগুলো অনার্য , অবৈদিক ও
অধর্মের ছদ্মবেশসেইসব ভ্রান্ত মত ও মানসিক অবস্থাকেই বোঝানো হয়েছে । তাই
এদের ত্যাগ মানেই প্রকৃত ধর্মে প্রতিষ্ঠা । মহর্ষি দয়ানন্দ থাকাকালীন ,
রামগোপাল নামক এক ব্যক্তিরও এই শ্লোকটি নিয়ে শঙ্কা হয়েছিল । তিনি গীতার
অনেক টীকা অধ্যয়ন করেছিলেন কিন্তু তাতেও তাহার শঙ্কা দূরীভূত হয়নি ।
তৎপশ্চাত তিনি মহর্ষি দয়ানন্দজীর নিকট গিয়ে গীতার ১৮।৬৬ শ্লোকের শঙ্কা
প্রকাশ করেছিলেন ।
তখন মহর্ষি দয়ানন্দ বলেছিলেন -

"ধর্মান্" শব্দকে এখানে "অধর্মান্" বুঝা উচিত । "শকন্ধাদিষু পররূপং বাচ্যম্" ব্যাকরণের নিয়মানুসারে
সর্বধর্মান্'-এর
'সর্ব' শব্দে ব-কারে যে অ- কার রয়েছে তা 'অধর্মান্'-এর অ-কারের সঙ্গে
যুক্ত হয়েছে । এজন্য সর্ব শব্দের সঙ্গে অধর্মান্ যুক্ত হওয়ায় 'অধর্মান্'
শব্দ 'ধর্মান্' শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে । এর দ্বারা রামগোপাল বৈশ্যের
শঙ্কা সমাধান হয়ে যায় এবং তিনি সন্তুষ্ট হন ।
[ মহর্ষি দয়ানন্দ জীবন চরিত্র দেবেন্দ্রনাথ- ১।১৯১, লেখরাম- ১৯৮ ]
সুতরাং
বলা যায় যে , ভগবানের উপদেশ হলো, সকল বেদবিরুদ্ধ ধর্মের (অর্থাৎ সকল
অধর্মের) পরিত্যাগ করে তুমি আমার শরণ লও । ভগবানের শরণ কীরূপে নেওয়া যায় ?
ভগবানের প্রদত্ত জ্ঞানের আশ্রয়ে কর্ম সম্পাদন করে জীবন পরিচালনা করাই তাঁর
শরণ নেওয়া । অর্জুনকে ২য় অধ্যায় থেকে ১৮শ অধ্যায় পর্যন্ত ভগবান যেসকল জ্ঞান
প্রদান করেছেন , যা বেদের দ্বারা , বিভিন্ন ঋষিদের দ্বারা এবং
ব্রহ্মসূত্রের পদসমূহ দ্বারা বলা হয়েছে , সেসব জ্ঞান অনুসরণ করে
কর্মানুষ্ঠান করলেই মানুষ ক্রমে ক্রমে চিত্ত-শুদ্ধির দিকে এগিয়ে যায় এবং
অন্তিমে সকল পাপ মুক্ত হয় । এরূপ কর্মকে বলা হয় নিয়ত কর্ম বা যজ্ঞার্থ কর্ম
(গীতা: ৩।৮-৯) । এরূপ কর্মের মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের কৃপা প্রাপ্ত হয়ে পাপ
থেকে মুক্ত হয় এবং অন্তিমে মোক্ষকে লাভ করে । তাই যোগস্থ ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে পূর্ণরূপে অভয় দিয়ে বললেন , আমার প্রদত্ত জ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে যদি
তুমি স্বধর্ম পালন করো , যদি তুমি যুদ্ধ থেকে বিচ্যুত না হও তবে অবশ্যই
পরমানন্দকে লাভ করবে, তাই শোক করো না ।
১৮তম
অধ্যায়ে ৬৩শ শ্লোকে অর্জুনকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলা হয়েছিল । কিন্তু ভগবান্
তাকে সময় না দিয়ে ৬৫শ-৬৬শ শ্লোকে সম্পূর্ণ গীতার মর্ম জানিয়ে দিলেন ।


সর্বগুহ্যতমং ভূযঃ শৃণু মে পরমং বচঃ। ইষ্টোঽসি মে দৃঢমিতি ততো বক্ষ্যামি তে হিতম্ ॥
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্-যাজী মাং নমস্কুরু ।
মামৈবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮.৬৪-৬৫
অনুবাদ:
পুনরায় সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম আমার শ্রেষ্ঠ বচন শ্রবণ করো ; তুমি আমার
অত্যন্ত প্রিয় হও , সেহেতু এই কল্যাণকর বাক্য তোমাকে বলব । আমাতে স্থির হও ,
আমার ভক্ত হও , আমার উপাসনা করো , আমাকে নমস্কার করো , তাহলে আমাকেই
প্রাপ্ত করবে । তোমার নিকট সত্য প্রতিজ্ঞা করছি । কারণ , তুমি আমার প্রিয়
হও ।
৬৪শ
শ্লোকের প্রথমেই বললেন,"তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় হও , সেজন্য এই কল্যাণকর
বাক্য তোমাকে বলব ।" কিন্তু আমরা ৯ম অধ্যায়ের ২৯শ শ্লোকে জেনেছি, ভগবান
বলেছেন -
❝সমোহহং
সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোৎস্তি ন প্রিয়ঃ॥❞ অর্থাৎ আমি সর্বভূতে সমরূপ,
আমার প্রিয় নেই, অপ্রিয় নেই । সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে ,
ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্যে এরূপ পরস্পরবিরোধী ভাব কেন ? বস্তুতঃ গীতার
ভাব সঠিকভাবে বুঝলে দেখা যাবে ভগবানের এরূপ পরস্পরবিরোধী উক্তিতে বাস্তবিক
জ্ঞানের মধ্যে কোনো অসংগতি হয় না । যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ❝ব্রহ্মাত্মবোধে❞
কথা বলছেন তখন তাঁর প্রিয় বা অপ্রিয় নেই বলেছেন , আর যখন তিনি অর্জুনের সখা
ও সমাজের হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি হিসেবে কথা বলেছেন তখন তাঁর উক্তিতে
পরপ্রীতির কথা এসেছে । আমরা 'উপদেষ্টা ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ' প্রবন্ধে
জেনেছিলাম , ❝যোগ দর্শন ১।৩ এ বলা হয়েছে অসম্প্রাজ্ঞত সমাধিতে❞ সাধক নিজ
স্বরূপে স্থিত হয়ে এবং পরমাত্মাকে নিজের মধ্যে ব্যক্ত করে উপদেশ প্রদান
করতে পারেন । অর্জুনের ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়ার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
সখারূপে অর্জুনকে প্রিয়তম বলেছেন । অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়
হওয়ার কারণে ভগবান্ এবার সম্পূর্ণ গীতার যে অন্তর্নিহিত কল্যাণকর বাক্য
রয়েছে তা উপস্থাপন করছেন । ব্রহ্মাত্মবোধে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বললেন , আমাতে
স্থির হও , আমার ভক্ত হও , আমার উপাসনা করো , আমাকে নমস্কার করো , তাহলে
আমাকেই প্রাপ্ত করবে । অনুরূপ বক্তব্য ৯ম অধ্যায়ে ৩৪শ শ্লোকে বলা হয়েছে -


মন্মনা ভব মন্ত্রক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু । মামেবৈভাসি যুক্তৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ॥
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৯.৩৪
অনুবাদ: আমাতে স্থির হও , আমার ভক্ত হও , আমার উপাসনা করো , আমাকে নমস্কার করো , তাহলে আমাকেই প্রাপ্ত করবে ।
প্রশ্ন
উঠতে পারে যে, ৯ম অধ্যায়ের উক্ত শ্লোক আর বর্তমান শ্লোকের তাৎপর্য যদি
একই হয় তবে ৯ম অধ্যায়ের বক্তব্য কেবল গুহ্যতম আর বর্তমান শ্লোকে তা
সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম কীভাবে হলো ? বস্তুত ৯ম অধ্যায়ে উক্ত জ্ঞান দেওয়া হলেও
সম্পর্ণ বাঁকায় (২।২-১৮।৬৩) আরো বহু আলোচনা করা হয়েছে । ফলে সেসব জ্ঞানকে
গুহ্যতম বলা হয়েছে , কিন্তু সেসব গুহ্যতম জ্ঞানের মধ্যে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান বুঝাতে ভগবান এটিকে সর্বাপেক্ষা গুহ্যতম বলেছেন । গীতার
জ্ঞানকে বলা হয় উপনিষদের সার কথা । এই জ্ঞান ❝পরম গুহা জ্ঞান❞ তা উপনিষদেও
বর্ণিত হয়েছে- ❝য ইমং পরম গুহ্যং❞ -(কন্ঠ: ১।৩ ১৭), ❝বেদান্ত পরমং গুহ্যং❞
-(শ্বেতাশ্বতর: ১।৩।৭) ইত্যাদি । আর আমাতে স্থির হও , আমার ভক্ত হও ,
আমার উপাসনা করো , আমাকে নমস্কার করো , তাহলে আমাকেই প্রাপ্ত করবে । এই
বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে , সর্বপ্রথম আমাদের অন্তকরণকে ঈশ্বরের প্রতি
সমর্পিত করতে হবে । সেই সমর্পণ বেদজ্ঞান প্রাপ্তিতে জ্ঞানযোগের মাধ্যমে
আসতে পারে , কর্মযোগের মাধ্যমে আসতে পারে , অথবা ভক্তিযোগের মাধ্যমে আসতে
পারে । যখন পূর্ণ-জ্ঞান বোধগম্য হবে , কিংবা কর্মের ভাব বুঝতে পারব , অথবা
ভক্তির তাৎপর্য জানব , তখন দেখা যাবে যে, এই তিনটিই মিলেমিশে একাকার ।
জ্ঞানে কর্মত্যাগ নেই , কর্মে অজ্ঞানতা নেই , ভক্তিতে বিশুদ্ধ জ্ঞান ও
নিষ্কাম কর্মের সন্নিবেশ হয়েছে-এরূপে বিশুদ্ধ চিত্তে ঈশ্বরের প্রতি
আত্মসমর্পণের শক্তিতে ত্রিগুণাত্মক মায়ার প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে
নির্গুণ আত্মমায়ার প্রকৃতি লাভ করতে পারব । এটিই জীবের মুক্তাবস্থা ।
অতঃ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১৮.৬৬ শ্লোক কেবল ধর্ম ত্যাগের নির্দেশ নয় এটি এক
অনন্য আত্মজাগরণের সর্বোচ্চ আহ্বান । এখানে 'সর্বধর্ম' বলতে বোঝানো হয়েছে
না কোনো শাস্ত্রসম্মত স্বধর্মকে , না কোনো নিষ্ঠাবান কর্তব্যকে ; বরং সেই
সব মনস্তাত্ত্বিক সংশয় , আবেগপ্রসূত মোহ এবং অবৈদিক-অনার্য ধ্যানধারণা ,
যেগুলো অর্জুনের মনে প্রথম অধ্যায়ে ধর্মরূপে প্রতীয়মান হয়েছিল , অথচ
প্রকৃতপক্ষে তা ছিল আত্মবিচ্যুতি ও কর্মবিমুখতার রূপ । এই শ্লোকে ভগবান সেই
মিথ্যা 'ধর্ম' গুলিকে পরিত্যাগ করতে বলছেন যেগুলো আত্মস্বরূপ উপলব্ধির পথে
অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । এখানে 'আমি'-র অর্থ কেবল ঐতিহাসিক শ্রীকৃষ্ণ নন বরং
সেই ব্রহ্মা , যিনি নিরাকার , অখণ্ড , জ্ঞানস্বরূপ এবং সর্বত্র বিরাজমান ।
যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তখন ছিলেন ❝অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিস্থ❞ ; সেই অবস্থায় তিনি
ব্রহ্মজ্ঞানের মুখপাত্র হিসেবে বলছেন - "আমাতে স্থির হও" , "আমারই শরণ হও"
এই আহ্বান, একদিকে যেমন আত্মার চরম নিষ্কলুষতায় প্রতিষ্ঠিত হবার ডাক ,
তেমনি অন্যদিকে অর্জুনের প্রতি ভগবানের গভীর স্নেহ ও মিত্রত্বের অভিব্যক্তি
। এই পরমাত্মনিবেদন এই আত্মসমর্পণ গীতার সারবত্তা , এর প্রকৃত মুক্তিবোধ ।
যখন ব্যক্তি নিজের বিভ্রান্তি , দ্বৈততা , কৃত্রিম কর্তব্যবোধ ও মোহ-আবৃত
চেতনা ত্যাগ করে ঈশ্বরীয় চেতনায় একাত্ম হয় তখনই সে পরম শান্তি ও অনন্ত
আনন্দের অধিকারী হয় । ১৮.৬৬ শ্লোকের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো আত্মস্বরূপে
প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত বিভ্রান্তিকর ধারণা ও স্বল্পচেতনার আবরণ ত্যাগ করে
পরম চৈতন্যের আশ্রয় গ্রহণ , যেখানে নিহিত রয়েছে প্রকৃত মুক্তির চূড়ান্ত ও
চিরন্তন রূপ ।

বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক ।
0 মন্তব্য(গুলি)