মূর্খ হলেও ব্রাহ্মণ পূজ্য ? মনুস্মৃতি ৯।৩১৭ পর্যালোচনা
অবিদ্বাংশ্চৈব বিদ্বাংশ্চ ব্রাহ্মণো দৈবতং মহৎ ।
প্রণীতশ্চাপ্রণীতশ্চ যথাঽগ্নির্দৈবতং মহৎ ॥
মনুস্মৃতি ৯।৩১৭; অনুরূপ শ্লোক বামনপুরাণ ৯৫।৯
অর্থাৎ, যেমন অগ্নি প্রণীত বা অপ্রণীত হউক তা মহাদেবতা, তেমন ব্রাহ্মণ বিদ্বান্ বা অবিদ্বান্ হোন তিনি মহাদেবতা।
এই শ্লোকটি প্রক্ষিপ্ত। শুধু এই শ্লোকটি নয় বরং ৩১৩-৩২৩ এই ১১টি শ্লোকই একসাথে প্রক্ষিপ্ত। কেননা,
১. অন্তর্বিরোধ:
এই শ্লোকগুলোর সমগ্র প্রসঙ্গ অন্তর্বিরোধের ভিত্তিতে প্রক্ষিপ্ত।
(ক) ৩১৩-এ ব্রাহ্মণকে অত্যন্ত ক্রোধী বলা হয়েছে,
পরামপ্যাপদং প্রাপ্তো ব্রাহ্মণান্ন প্রকোপয়েৎ ।
তে হ্যেনং কুপিতা হন্যুঃ সদ্যঃ সবলবাহনম্ ॥
অথচ ৬.৯৩এ ব্রাহ্মণের জন্য ক্রোধ সর্বতোভাবে ত্যাজ্য বলা হয়েছে।
দশ লক্ষণানি ধর্মস্য যে বিপ্রাঃ সমধীয়তে ।
অধীত্য চানুবর্তন্তে তে যান্তি পরমাং গতিম্ ॥
(খ) ৩১৪–৩১৬-এ সমুদ্র, লোকপাল ইত্যাদির নির্মাতা ব্রাহ্মণদের মনে করা হয়েছে, অথচ মনুস্মৃতিতেই বস্তুগুলোর নির্মাতা হিসেবে পরমাত্মাকেই উল্লেখ করা হয়েছে।
তেষাং ত্ববয়বান্ সূক্ষ্মান্ ষণ্ণামপ্যমিতৌজসাম্ ।
সংনিবেশ্যাত্মমাত্রাসু সর্বভূতানি নির্মমে ॥ ১.১৬
কর্মাত্মনাং চ দেবানাং সোঽসৃজৎ প্রাণিনাং প্রভুঃ ।
সাধ্যানাং চ গণং সূক্ষ্মং যজ্ঞং চৈব সনাতনম্ ॥ ১.২২
তেষামিদং তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।
সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সম্ভবত্যব্যযাদ্ ব্যযম্ ॥ ১.১৯
অণ্ব্যো মাত্রা বিনাশিন্যো দশার্ধানাং তু যাঃ স্মৃতাঃ ।
তাভিঃ সার্ধমিদং সর্বং সম্ভবত্যনুপূর্বশঃ ॥ ১.২৭
পাশাপাশি চন্দ্রকলার হ্রাস, সমুদ্রের লবণাক্ততা ভৌত সৃষ্টিবিদ্যার বিষয়। বৈদিক শাস্ত্রে পরিভ্রমণ বা গ্রহণকালে চন্দ্রকলার হ্রাস, জোয়ারভাটার বৈজ্ঞানিক কারণ উল্লেখিত রয়েছে। আর পরমেশ্বর যে গুণ যাতে বলেছেন তার ব্যতিক্রম কখনোই সম্ভব না। পাশাপাশি কোনো মানুষ এই বস্তুগুলোর নির্মাতা - এ কথা হাস্যকর, মূর্খতাপূর্ণ ও সৃষ্টিক্রমবিরোধী উক্তি।
যৈঃ কৃতঃ সর্বভক্ষ্যোঽগ্নিরপেয়শ্চ মহোদধিঃ।
ক্ষয়ী চাপ্যায়িতঃ সোমঃ কো ন নশ্যেৎপ্রকোপ্য তান্॥
লোকানন্যান্সৃজেয়ুর্যে লোকপালাংশ্চ কোপিতাঃ ।
দেবান্কুর্যুরদেবাংশ্চ কঃ ক্ষিণ্বংস্তান্সমৃধ্নুয়াৎ॥
যানুপাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি লোকা দেবাশ্চ সর্বদা।
ব্রহ্ম চৈব ধনং যেষাং কো হিংস্যাত্তাঞ্ জিজীবিষুঃ॥৯.৩১৪-৩১৬
শ্লোক ৩২০-এ ক্ষত্রিয়ের উৎপত্তি ব্রাহ্মণ থেকে, ৩১৬-এ সর্বলোকের আশ্রয় ব্রাহ্মণে এবং ৩২১-এ জল থেকে অগ্নির উৎপত্তি সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ, শ্রুতি বিরুদ্ধ [ 'বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ। অদ্ভ্যঃ পৃথিবী।' তৈত্তিরীয় উপনিষদ্ ২।১।২] ও কখনোই মনুসম্মত না।
(গ) ৩১৭-৩১৯-এ অবিদ্বান ও নিন্দনীয় কর্মকারীদেরও ব্রাহ্মণ ও পূজ্য বলে মনে করা হয়েছে—এটি মনুর মৌলিক ব্যবস্থার পরিপন্থী। মনু কর্ম অনুযায়ী বর্ণব্যবস্থা মানেন,দ্রষ্টব্য ১.১০৭-
অস্মিন্ ধর্মেঽখিলেনোক্তৌ গুণদোষৌ চ কর্মণাম্ ।
চতুর্ণামপি বর্ণানামাচারশ্চৈব শাশ্বতঃ ॥
পাশাপাশি, নিন্দনীয় কর্ম ও স্বকর্মত্যাগের ফলে শূদ্রত্বপ্রাপ্তি মানেন। উদাহরণ-
ন তিষ্ঠতি তু যঃ পূর্বাং নৌপাস্তে যশ্চ পশ্চিমাম্ ।
স শূদ্রবদ্বহিষ্কার্যঃ সর্বস্মাদ্ দ্বিজকর্মণঃ ॥২.১০৩;
উত্তমানুত্তমানেব গচ্ছন্ হীনাংস্তু বর্জয়ন্ ।
ব্রাহ্মণঃ শ্রেষ্ঠতামেতি প্রত্যবায়েন শূদ্রতাম্ ॥৪.২৪৫;
শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চৈতি শূদ্রতাম্ ।
ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবং তু বিদ্যাদ্বৈশ্যাৎ তথৈব চ ॥১০.৬৫
(ঘ) ৯.৩২৩-এ জরিমানার অর্থ ব্রাহ্মণদের দেওয়ার কথা বলা হয়েছে,
দত্ত্বা ধনং তু বিপ্রেভ্যঃ সর্বদণ্ডসমুত্থিতম্ ।
পুত্রে রাজ্যং সমাসৃজ্য কুর্বীত প্রায়ণং রণে ॥
অথচ ৭–৯ এই তিনটি অধ্যায়ে প্রত্যেক জরিমানার দণ্ড রাজাকে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এইভাবে এই শ্লোকগুলো এবং এদের সংশ্লিষ্ট এই প্রসঙ্গের অন্যান্য শ্লোক প্রক্ষিপ্ত। এই সমস্ত শ্লোক জন্মগত জাতিভেদের প্রচলনের পর রচনা করে সংযোজিত করা হয়েছে।
২. বিষয়বিরোধ:
বিষয়সংকেতকারী শ্লোক ৯.২৫২–২৫৩ থেকে এখানে ‘লোককণ্টকসমূহ নিবারণ’-এর বিষয় রয়েছে।
সম্যঙ্নিবিষ্টদেশস্তু কৃতদুর্গশ্চ শাস্ত্রতঃ।
কণ্টকোদ্ধরণে নিত্যং আতিষ্ঠেদ্যত্নং উত্তমম্॥
রক্ষনাদার্যবৃত্তানাং কণ্টকানাং চ শোধনাৎ।
নরেন্দ্রাস্ত্রিদিবং যান্তি প্রজাপালনতৎপরাঃ॥
এই শ্লোকগুলো প্রচলিত বিষয়ের পরিপন্থী, অতএব প্রক্ষিপ্ত।
৩. শৈলীগত ভিত্তি:
এই সকল শ্লোকের শৈলী অমূলক, অযুক্তিসম্পন্ন, পক্ষপাতদুষ্ট ও অতিশয়োক্তিপূর্ণ। মনুর শৈলীতে এই ধরনের ত্রুটি নেই। এই কারণেও এগুলো প্রক্ষিপ্ত।
সূত্র: বিশুদ্ধ মনুস্মৃতি - পণ্ডিত রাজবীর শাস্ত্রী কৃত সমীক্ষা।
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্য(গুলি)