

নমস্কার,
বর্তমান সময়ে সনাতন ধর্মে নারীদের অধিকার বা তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কথা বললেই একদল নামধারী পণ্ডিত বলে উঠে, ″নারীরা নরকের দ্বার″, একথা আমার নয়, একথা বলেছেন শঙ্করাচার্য নিজেই; [রেঃ প্রশ্নোত্তরী ৩]। শুধু তাই নয় সেই পণ্ডিতদের চোখের মণি শ্রীমদ্ভাগবতে বলা রয়েছে ″স্ত্রীশূদ্রদ্বিজবন্ধূনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরা″ [রেঃ ভাগবত-১/৪/২৫] অর্থাৎ, স্ত্রী, শূদ্র, পতিত দ্বিজাতি—এরা তিন শ্রেণীই বেদ শ্রবণে অনধিকারী। তাই তারা নারীদের সর্বদা অবহেলার নজরে দেখে। আর তাদের মুখেই যদি শোনেন যে, নারীর রজঃস্বলা অবস্থায় যজ্ঞাদি কর্মের অধিকার নেই। তো এ আর এমন কি? যারা সাধারণ ভাবেই এতটা নারী বিরোধী, তারা তো রজঃস্বলা অবস্থায় নারীদের অপবিত্র বলবেই।
তবে এখানে বেশ মজার বিষয় হচ্ছে, সেইসব নামধারী কিছু পণ্ডিত বেশকিছু শাস্ত্রীয় রেফারেন্স দিয়ে ″নারীরা রজঃস্বলা অবস্থায় যজ্ঞাদি কর্মে অনধিকারী″ প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আজকের এই পর্বে, সেগুলোর খণ্ডন ও বেদাদি শাস্ত্রের বিবিধ রেফারেন্স দিয়ে নারীর রজঃস্বলা বিষয়ে বিস্তারিত লিখবো।
ভাগবত পুরাণেই বলা রয়েছে যে, ″বেদপ্রণিহিতো ধর্মো হ্যধর্মস্তদ্বিপর্যয়″ [রেঃ শ্রীমদ্ভাগবত- ৬/১/৪০] অর্থাৎ, একমাত্র বেদে যা বলা আছে তাই ধর্ম; পক্ষান্তরে যা বেদনিষিদ্ধ তা সকলই অধর্ম এবং বিপর্যয়ের পথ।
কেন এইরকমটা বলা হলো জানেন কি? কারণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ″তস্মাৎ শাস্ত্রং প্রমাণং তে কার্য অকার্য ব্যবস্থিতৌ″ [গীতা ১৬/২৪] অর্থাৎ, হে অর্জুন কোনটা তোমার কর্তব্য ও কোনটা তোমার অকর্তব্য; উভয়ের নির্ণয়ে বেদ হলো প্রমাণ। এখন আপনারা বলতেই পারেন যে, উক্ত শ্লোকে তো ″শাস্ত্র″ শব্দ রয়েছে, তাহলে আপনি বেদ পেলেন কোথায়? দেখুন ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্ত দর্শনের [রেঃ ১/১/৩] মধ্যে শাঙ্করভাষ্যে শঙ্করাচার্য নিজেই শাস্ত্র শব্দের অর্থ বেদ করেছেন। এখন তবুও আপনার সংশয় নিবারন হলো না, এবার তাহলে আমরা দেখে নেই মহর্ষি আপস্তম্ব কী বলেছেন বেদ সম্পর্কে - ″বেদাশ্চ“ = 'বেদ এব মূলং প্রমাণম্ ধর্ম অধর্মঃ' [রেঃ আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১/১/১/৩] অর্থাৎ, ধর্ম-অধর্ম নির্ণয়ে মূল প্রমাণ হচ্ছে পবিত্র বেদ। শুধু এতটুকুই নয়, এই বিষয়ে মহর্ষি মনু বলেছেন ″বেদোঽখিলো ধর্মমূলং″ [রেঃ মনুস্মৃতি ২/৬] অর্থাৎ, বেদ হলো সনাতন ধর্মের মূল। মহর্ষি মনু আরও বলেছেন ″ধর্ম জিজ্ঞাস মানানাং প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ″ [রেঃ মনুস্মৃতি ২/১৩] অর্থাৎ, কেউ যদি ধর্ম-অধর্ম সম্পর্কে জানতে চায় তাঁর জন্য পরম প্রমাণ হচ্ছে পবিত্র বেদ। এছাড়াও মীমাংসা দর্শনে মহর্ষি জৈমিনি বলেছেন 'বেদ হচ্ছে স্বতঃ প্রমাণ' [রেঃ মীমাংসা দর্শন ১/১/৫]।
এখন একটু বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করুন —
য়া বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো য়াশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ।
সর্বাত্মা নিষ্ফলা প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাঃ স্মৃতা॥
[মনুস্মৃতি ১২/৯৫]
অর্থঃ (য়া বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ঃ) সংসারে যে বেদোক্ত ধর্মের প্রতিকূল স্মৃতি তৈরি হবে বা রয়েছে (চ) এবং (য়া কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ) যে সমস্ত বেদবিরোধী বিচার রয়েছে বা তৈরি হবে (তাঃ সর্বাঃ নিষ্ফলাঃ) সেই সব নিষ্ফল। (তাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠাঃ হি স্মৃতাঃ) সেগুলো পরলোকে নিশ্চিত রূপে তমোগুণী দুঃখময় জন্মকে প্রাপ্ত করায়।
পরবর্তী শ্লোকের সরলার্থে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বলেছেন – "যে সমস্ত গ্রন্থ এই বেদের সহিত বিরুদ্ধ হবে বা রয়েছে, সেগুলো আধুনিক হওয়ায়; সেগুলোর মান্যতা নিষ্ফল ও মিথ্যা।" [মনুস্মৃতি ১২/৯৬]
এবার আসি সেই নামধারী পণ্ডিতদের দাবিতে ~~
★ আপস্তম্ব সংহিতা ৭/৩ মধ্যে নারীদের রজঃস্বলা কালে নারীকে অপবিত্র বা অসূচী বলা হয়েছে।
মীমাংসা – তাদের এই উল্লেখিত সূত্রটি [আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১/১/১/৩] এর সহিত সাংঘর্ষিক; কারণ এখানে ধর্মের মূখ্য প্রমাণ হচ্ছে বেদ, আর বেদমন্ত্রে বলা রয়েছে যে, নারীরা সর্বদা পবিত্র বা শুভ্রময়ী। [রেঃ অথর্ববেদ ১১/১/১৭]।
☞ এই দাবিটি মনুস্মৃতি [১২/৯৫] তথা আপস্তম্ব ধর্মসূত্র [১/১/১/৩] এর আলোকে বেদমন্ত্রের সহিত সাংঘর্ষিক হওয়ায় পরিত্যাজ্য।
★ অঙ্গিরঃ সংহিতা ১/৩৫ ও ১/৩৭ মধ্যে বলা হয়েছে যে, "যে পর্যন্ত রজঃপ্রবৃত্তি হয়, (অর্থাৎ তিন দিন) তাবৎ (ততদিন) স্ত্রীলোক সদাচার (পবিত্র) নহে।"
এই সূত্রে বর্ণিত বিষয় [যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ১/৭১] এর সহিত সাংঘর্ষিক। সেখানে বলা রয়েছে, "নারীজাতি সোম থেকে শুদ্ধতাপ্রাপ্ত, গন্ধর্বদের থেকে সুমিষ্ট বাক্য প্রাপ্ত, অগ্নির কাছ থেকে শুদ্ধতাপ্রাপ্ত; তাই নারীরা [সর্বদা] শুদ্ধ।"
☞ এখানে তাদের উল্লেখিত স্মৃতিবাক্য অন্য স্মৃতির সহিত মিলছে না। এরূপ অবস্থায় একটিকেই মান্যতা প্রদান করতে হবে, এবং যেই স্মৃতিবাক্য বেদমন্ত্রের অনুরূপ বা বেদের অনুকূল হবে, তাই গ্রহণযোগ্য। অথর্ববেদ [১৪/২/২৮] এ বলা রয়েছে "এই বধু মঙ্গলময়ী, সকলে মিলিয়া ইহাকে দেখো, ইহাকে সৌভাগ্য দান করিয়া দূর্ভাগ্য বিদারিত করো।" যেখানে বেদমন্ত্রে নারীকে মঙ্গলময়ী বলা হয়েছে, সেখানে স্মৃতিতে নারীকে অপবিত্র বলা হলে তা আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না।
★ তাদের অপযুক্তি তৈত্তিরীয় সংহিতা (কৃষ্ণ যজুর্বেদ) [২/৫/১/৫-৬] মধ্যে, "নারীরা রজঃস্বলা কালীন অপবিত্র, এবং তাঁদের স্পর্শ করা অন্ন কারোর গ্রহণ করা উচিত নয়"। প্রথমত, এই কৃষ্ণ যজুর্বেদ প্রকৃতপক্ষে বিশুদ্ধ নয়। তাই এর কোনো প্রমাণ আমরা মান্য করবো না। কেন কৃষ্ণ যজুর্বেদ প্রমাণ্য নয় বা কেন এর প্রমাণ আমরা মানি না, এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের ওয়েবসাইটের এই লেখাটি পড়ুন ~~
★ তাদের দাবী মীমাংসা দর্শন [৩/৪/১৮] তে স্ত্রীদের রজঃস্বলা অবস্থায় তাঁদের সহিত কথাবার্তা নিষেধ।
আদৌ কি তাই লেখা রয়েছে ? চলুন দেখে নেই—
"প্রাগপরোধান্মলবদ্বাসসঃ॥"
অর্থ- (প্রাক্) দর্শ-পূর্ণমাস কর্মানুষ্ঠান প্রারম্ভ করার পূর্বে উপবাসের দিন (মলবদ্বাসসঃ) রজঃস্বলা স্ত্রীর (অপরোধাৎ) অপরোধ-অবরোধ হওয়ায়। ঔপবসথ্য বা দীক্ষার দিনেই যদি যজমান-পত্নী রজঃস্বলা হয়ে যায়, তো যজ্ঞে তাঁর উপস্থিতি বর্জিত করা হয়েছে। তখন দর্শ-পূর্ণমাস কর্মানুষ্ঠানের সময়ে রজঃস্বলা স্ত্রীর অনুপস্থিত হওয়ায় তাঁর সাথে সংবাদ আদির সম্ভাবনাই নেই।
☞ পাঠকগণ, এখানে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। প্রথমত দর্শ-পূর্ণমাস কোনো নৈমিত্তিক যজ্ঞকর্ম নয়। এটি বিশেষ সময়ে পালনীয়। তো এই কর্মের কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে যে, এই কর্মের পূর্বে ঔপবসথ্য [এর একটি অংশ উপবাস] থাকতে হয়। এখন উপরোক্ত নিয়ম অনুসারে যদি ঔপবসথ্য না করা হয়, তো তাঁকে সেই যজ্ঞ কর্ম থেকে বিশ্রাম প্রদান করা হয় এবং সে যজ্ঞ স্থানে উপস্থিত থাকে না [অন্যান্য নৈমিত্তিক যজ্ঞ, তাঁরা করতে পারে]। আর স্বভাবতই যেখানে উক্ত ব্যক্তি উপস্থিতই থাকে না, সেখানে তাঁর সাথে সংবাদ (বার্তালাপ) হওয়া অসম্ভব কিছুই নয়। এখানে আরেকটি শঙ্কা উঠতে পারে যে, রজঃস্বলা হলে ঔপবসথ্য কেন হয় না? দেখুন ঔপবসথ্যের একটি অংশ হলো উপবাস। যেহেতু রজঃস্বলা অবস্থায় নারীদের শরীর দুর্বল হয়ে থাকে, তাই তৎকালে তাঁদের ঔপবসথ্য করার সামর্থ বা শারীরিক শক্তি থাকে না।
[আর এইসব বিষয়ে বিস্তারিত না জেনেই নামধারী পণ্ডিতগণ বলে বেড়ায়, রজঃস্বলা অবস্থায় নারীদের যজ্ঞে অধিকার নেই]
★ তাদের আরও একটি যুক্তি হলো যে, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর অমর গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশের একাদশ সমুল্লাসে "রজঃস্বলা নারীদের স্পর্শ করা নিষিদ্ধ" বলেছে।
তো চলুন আমরা সত্যার্থ প্রকাশ থেকেই দেখে নেই—
❝এই সকল গণ্ডমূর্খ পোপের লীলা দেখ! এই বামমার্গীগণ বেদবিরুদ্ধ মহাপাপজনক কার্যগুলোকে উৎকৃষ্ট বলে মনে করলো। তারা মদ্য, মাংস, মীন অর্থাৎ মৎস, মুদ্রা, পুরী, কচুরী, বৃহৎ রুটি প্রভৃতি চর্বণ; যোনি, পাত্রাধার মুদ্রা এবং পঞ্চম মৈথুন অর্থাৎ সকল পুরুষ শিব এবং সকল স্ত্রীকে পার্বতী তুল্য মনে করে-
"অহং ভৈরবস্ত্বং ভৈরবী হ্যাবয়োরস্তু সঙ্গমঃ॥" কু০ ত০
যে কোনো স্ত্রী বা পুরুষ হোক না কেন, এই নিরর্থক অকথ্য বচন পাঠ করে সমাগম করা বামমার্গীগণ দোষজনক মনে করে না। অর্থ্যাৎ যে সকল হীনচরিত্রা স্ত্রীলোককে স্পর্শ করতে নাই, তাহাদিগকে ইহারা অতি পবিত্র মনে করে। শাস্ত্রে রজঃস্বলা স্ত্রীলোকের স্পর্শ নিষিদ্ধ। বামমার্গীগণ তাকেও অতি পবিত্র মনে করে।❞ [সত্যার্থ প্রকাশ, একাদশ সমুল্লাস]
☞ বিশেষ রূপে বিশ্লেষণ — কতবড় কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে তারা মহর্ষির কথাকে ভুলভাবে প্রচার করে, দেখুন। মহর্ষিজী এখানে প্রথমে বলেছেন যে বামমার্গীগণ সকল নর-নারীকে শিব-পার্বতী ভেবে উপরোক্ত মন্ত্র জপ করে সমাগম করাকে উচিত মনে করে, এমনকি সেই নারী যদি চরিত্র হীনও হয় তবুও তারা তাকে পবিত্র মনে করে। তৎপশ্চাৎ তিনি বলেছেন "শাস্ত্রে রজঃস্বলা স্ত্রীলোকের স্পর্শ নিষিদ্ধ" কেন বলেছেন? কারণ তাঁরা সেই সময় দুবর্ল হয়ে থাকে, তো সেই সময় তাঁরা সাধারণ কার্য থেকেই দূরে থাকবে। তো, তাঁদের সহিত শারীরিক সম্পর্কের কথা তো বাদই। কিন্তু বামমার্গীগণ তাঁদেরকেও অতি পবিত্র মনে করে সম্ভোগের জন্য। এইজন্যই মহর্ষি জী বলেছেন যে, রজঃস্বলা নারীগণ স্পর্শের যোগ্য নয়, তা কোন উদ্দেশ্যে? কামে (যৌনতার) এর উদ্দেশ্যে। কেন তিনি এই প্রকরণে এই কথা বললেন? কারণ বামমার্গীগণ সর্বদা নারীদের ভোগ্য বস্তু মনে করে। তাই মহর্ষি উপরোক্ত কথাটি বলেছেন। কিন্তু বর্তমানে তার উল্টো অর্থ বের করে অনেকেই প্রচার করতেছে যে, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী রজঃস্বলা স্ত্রীদের স্পর্শ যোগ্য মনে করেন নি। যা অত্যন্ত ধিক্কার জনক কার্য।
★তাদের আরেকটি দাবি হলো মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী তার নিজ গ্রন্থ "সংস্কার বিধিতে" রজঃস্বলা নারীদের অপবিত্র মনে করেছেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত আমাদের সাইটে বহু পূর্বেই লেখা রয়েছে। পড়ুন - https://back2thevedas.blogspot.com/2024/11/blog-post.html...
ইতিপূর্বে আমরা নামধারী পণ্ডিতদের যারা রজঃস্বলা অবস্থায় নারীদের অপবিত্র মনে করতো এবং তাঁদের যজ্ঞে অধিকার নাই, এরূপ মানতো; তাদের সমস্ত যুক্তি বৈদিক শাস্ত্রের ভিত্তিতে খণ্ডন করেছি। এখন আমরা জানবো আমাদের আর্য পরম্পরার সিদ্ধান্ত।
- ❝রজঃস্বলা বিষয়ের উপর আর্য পরম্পরার সিদ্ধান্ত❞
এই সময়ে আমাদের মা-বোনেদের শরীরের একপ্রকার দুর্বলতা অনুভব হয়। আর এই শারীরিক ব্যবস্থা ঈশ্বর প্রদত্ত প্রকৃতির নিয়ম। এই সময়ে তাঁদের অন্যান্য পরিশ্রমযুক্ত কাজও করা উচিত নয়, কারণ তাঁদের শরীর তখন কাজ সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত থাকে না, তখন তাঁদের উচিত বিশ্রাম করা। সেই সময় তাঁরা আত্ম চিন্তন, উত্তম পুস্তকের অধ্যয়ন, জ্ঞান আহরন করবে। এখন আসি যজ্ঞ তথা অগ্নিহোত্র এবং নিত্যকর্ম আদি বিষয়ে।
মনুস্মৃতিতে প্রতিদিন গায়ত্রী জপের বিধান রয়েছে, অর্থাৎ একদিনও গায়ত্রী পাঠ ব্যাতিত থাকা উচিত নয়। দেখুন -
अपां समीपे नियतो नैत्यकं विधिमास्थितः ।
सावित्रीमप्यधीयीत गत्वारण्यं समाहितः ॥
[মনুস্মৃতি ২/১০৪]
অর্থ- (নৈত্যকং বিধিম্ + আস্থিতঃ) সন্ধ্যোপাসনার অনুষ্ঠানকারী ব্যক্তি (অরণ্যং গত্বা) বন প্রবেশ অথবা একান্ত শান্ত প্রদেশে গিয়ে (অপাং সমীপে নিয়তঃ) জলস্থানের নিকট উপবেশন করে (সমাহিতঃ) ধ্যানমগ্ন হয়ে (সাবিত্রীম্ + অপি + অধীয়ীত) সাবিত্রী অর্থাৎ গায়ত্রী মন্ত্রের অর্থ সহিত জপ-চিন্তন করবে এবং তদানুসারে আচরণ করবে।
☞ এখানে গায়ত্রী মন্ত্র দ্বারা নিত্য সন্ধ্যা উপাসনার বিধি কথিত হয়েছে। একই সিদ্ধান্ত মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর অমর গ্রন্থ সত্যার্থ প্রকাশের তৃতীয় সমুল্লাসে দিয়েছেন। এই একই বিষয়ে [ঋগ্বেদ ৮/৬/২৮] মধ্যে বলা রয়েছে।
এখন বেদ ও অগ্নিহোত্র আদিতে অনধ্যায় অর্থাৎ এগুলো কখনো ত্যাগ করা উচিত নয় —
वेदोपकरणे चैव स्वाध्याये चैव नैत्यके ।
नानुरोधोऽस्त्यनध्याये होममन्त्रेषु चैव हि ॥
[মনুস্মৃতি ২/১০৫]
অর্থ- (বেদোপকরণে চৈব) বেদের পঠনপাঠনে (চ) এবং (নৈত্যকে স্বাধ্যায়ে) নিত্যকর্মে বিহিত গায়ত্রী জপ বা সন্ধ্যোপাসনায় (হোম-মন্ত্রেষু চৈব) অনধ্যায় অর্থাৎ না করার ভূল করবে না। ভাব এই যে, এই অনুষ্ঠান সমূহের প্রত্যেক স্থিতিতে করা আবশ্যক।
☞ এখানে আমরা স্পষ্টরূপে জানতে পারলাম যে, অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ প্রত্যেক স্থিতিতে করা আবশ্যক। কোনো নির্দিষ্ট সময় তথা রজঃস্বলা স্ত্রীদের জন্য এখানে ব্যতিরেক নিয়ম বর্ণিত হয় নি; বরং সর্বজনীন রূপে এগুলোর ত্যাগ যেকোনো পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধ করেছে।
এবার দেখুন যজ্ঞ আদির ত্যাগ কখনো সম্ভব হয় না –
नैत्यके नास्त्यनध्यायो ब्रह्मसत्रं हि तत्स्मृतम् ।
ब्रह्माहुतिहुतं पुण्यमनध्यायवषट्कृतम् ॥
[মনুস্মৃতি ২/১০৬]
অর্থ- (নৈত্যকে অনধ্যায়ঃ ন + অস্তি) সন্ধ্যা-যজ্ঞ আদি নিত্যচর্চার অনুষ্ঠানের ত্যাগ অথবা সেগুলো থেকে বিশ্রাম হয় না (হি) কেননা (তৎ ব্রহ্মসত্রং স্মৃতম্) সেগুলোকে পরমাত্মার উপাসনার অনুষ্ঠান মানা হয়। (অনধ্যায়বষট্কৃতম্) বিশ্রামকালেও সম্পাদিত যজ্ঞ-সদৃশ উত্তম কর্ম এবং (ব্রহ্ম-আহুতি-হুত্তম্) ব্রহ্মকে করা সমর্পণ অর্থাৎ সন্ধ্যোপাসনা (পুণ্যম্) সর্বদা পূণ্যদায়ক হয়।
☞ তাহলে সেই নামধারী পণ্ডিতগণ কোন যুক্তিতে বলতে পারে যে, রজঃস্বলা নারীগণ অপবিত্র তথা যজ্ঞ তথা অগ্নিহোত্রে তাঁদের অধিকার নেই। এটি হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই না।
অতএব আমরা বলতে পারি যে, স্বাধ্যায় কখনোই ত্যাগ করা উচিত নয়, সেটা যেকোনো পরিস্থিতিতে। এখন স্বাধ্যায় শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করছি- ‘স্বাধ্যায়’ শব্দ দ্বারা মনুর অভিপ্রায়, বেদের নিরন্তর সাঙ্গোপাঙ্গ অধ্যয়ন, সন্ধ্যোপাসনা এবং অগ্নিহোত্র। এগুলো তিনি স্বয়ং [মনুস্মৃতি ২/১০৪, ১০৫, ১০৬] মধ্যে বলেছেন। এর অতিরিক্ত নিম্ন শ্লোকেও স্পষ্টত বলেছেন যে বেদাধ্যয়ন, অগ্নিহোত্র আদিকে স্বাধ্যায় বলে। [মনুস্মৃতি ২/১৬৫-১৬৮; ৩/৭৫; ৪/১৭-২০; ৪/১৪৭-১৪৯; ১১/২৪৫]।
অপবাদকারীদের নিকট রজঃস্বলা স্ত্রীগণ অপবিত্র হওয়ায় স্বাধ্যায় আদিও করা নিষেধ। কিন্তু যেখানে স্বয়ং বেদ বলছে যে- “বেদের পাঠে আত্মসন্তুষ্টি হয়, পবিত্রতা আসে” তো আমরা কোনটি মান্য করবো? বেদের বচন নাকি হঠকারী সেইসব ব্যক্তিদের বচন?
পাবমানীর্য়ো অধ্যেত্যৃষিভিঃ সম্ভৃতং রসম্।
তস্মৈ সরস্বতী দুহে ক্ষীরং সর্পিঃ মধূদকম্॥
[ঋগ্বেদ ৯/৬৭/৩২]
অর্থ- বেদবিদ্যা অধ্যয়নকারীকে পবিত্র করে, তাঁর মধ্যে সত্য বিদ্যার সার পরিপূর্ণ থাকে, সেই বেদবিদ্যা অধ্যয়নকারীর জন্য দুধ, ঘী, মধু এবং জল বর্ষণকারী অর্থাৎ আত্মসন্তুষ্টি, বল, মধুরতা এবং শান্তি প্রদান করে।
☞ এখন বলুন, যেখানে বেদ পাঠের মাধ্যমেই মনুষ্য [স্ত্রী/পুরুষ] পবিত্র হয়, তো সেই বেদ পাঠে নিষেধ করা হয় কোন যুক্তিতে? যদি মেনেও নেওয়া যায় যে তাঁরা মানসিক ভাবে অশুদ্ধ, তো বেদ স্বয়ং বলছে যে, বেদের পাঠের মাধ্যমে শুদ্ধতা আসে। অতএব অশুদ্ধ হোক বা অপবিত্র হোক, বেদের পাঠ তথা নিত্যকর্ম যজ্ঞ অবশ্য করা উচিত।
এবার একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে, নারীরা তো সেই সময় শারীরিক, মানসিক ভাবে অশুদ্ধ থাকে। তো শুনুন, আমরা এটা কখনোই মান্যতা প্রদান করি না যে নারীরা অশুদ্ধ হয়। কেননা পবিত্র বেদেই নারীকে বলা হয়েছে “শুভ্রময়ী”। তবুও যদি এই অশুদ্ধতার বিষয়ে কারোর খটকা লেগে থাকে তবে তাদের জন্য —
अद्भिर्गात्राणि शुद्ध्यन्ति मनः सत्येन शुद्धयति ।
विद्यातपोभ्यां भूतात्मा बुद्धिर्ज्ञानेन शुद्धयति ॥
[মনুস্মৃতি ৫/১০৯]
অর্থ- (গাত্রাণি অদি্ভঃ শুদ্ধয়ন্তি) শরীর এবং শরীরের অঙ্গ জল দ্বারা শুদ্ধ-নির্মল হয়, (মনঃ সত্যেন শুদ্ধ্যতি) মন সত্য সংঙ্কল্প, সত্যভাষণ এবং সত্যাচারণ দ্বারা শুদ্ধ হয়, (ভূতাত্মা বিদ্যা-তপোভ্যাং) জীবাত্মা বিদ্যাপ্রাপ্তি এবং ধর্মপালন রূপ তপ দ্বারা তথা (বুদ্ধিঃ + জ্ঞানেন শুদ্ধ্যতি) বুদ্ধি অধিকাধিক সত্যজ্ঞানের অর্জন দ্বারা শুদ্ধ হয়।
এখন এখানে যে বিষয়গুলো আসলো তা হলো, প্রথমত অশুদ্ধির বিষয় যা জল দ্বারাই শুদ্ধ হয়। আর দ্বিতীয়ত বিষয় যা স্বাধ্যায় আদি নিত্যকর্ম, এগিয়ে আবশ্যিক রূপে নিত্যদিন করতেই হবে। কারণ যজ্ঞের দ্বারাই মনুষ্য শুদ্ধ হয়, তো অশুদ্ধতা দূর করার জন্যই যজ্ঞ করা হয়। “यज्ञ वै शुद्धतम कर्मः” অর্থাৎ যজ্ঞ হলো শুদ্ধতম কর্ম। তাহলে শুদ্ধতা প্রাপ্তির জন্য এই যজ্ঞই করা উচিত, আর সেখানে এক শ্রেণীর লোকেরা নারীদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য [রজঃস্বলা কালীন] যজ্ঞ থেকে বহিষ্কৃত করতে উদ্যত। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
এত এত শাস্ত্র প্রমাণের পরেও যারা বলবে রজঃস্বলা অবস্থায় নারীরা অপবিত্র তথা যজ্ঞে অধিকার নেই, তারা নারীদের পূজা [সন্মান] করতেই জানে না। আর মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে,
यत्र नार्यस्तु पूज्यन्ते रमन्ते तत्र देवताः ।
यत्रैतास्तु न पूज्यन्ते सर्वास्तत्राऽफलाः क्रियाः ॥
=[মনুস্মৃতি ৩/৫৬]=
অর্থ- যে সমাজে নারীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয় সেই সমাজ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করে। আর যারা নারীদের যোগ্য সম্মান করে না, তারা যতই মহৎ কর্ম করুক না কেন, তার সবই নিষ্ফল হয়ে যায়।
সর্বোপরি নারীরা সর্বাবস্থায় শুদ্ধ ও যজ্ঞ কর্মে অধিকারিণী। তাই নারীদের সর্বদা শুভ কর্মের প্রেরিত করতে উৎসাহিত করুন, তথা নারীদের শ্রদ্ধা করুন। ঈশ্বরের নির্মিত এই সৃষ্টিতে নারীদেরও ততটুকুই অধিকার রয়েছে, যতটুকু অধিকার রয়েছে একজন পুরুষের। কেননা আমরা সকলেই সেই পরমপিতা পরমাত্মার সন্তান “অমৃতস্য পুত্রাঃ”।

বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্য(গুলি)