বেদের প্রার্থনা এবং পুরুষার্থ দর্শনঃ—
সংসারে আস্তিকলোক ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রার্থনা করে চলে আসছে । প্রার্থনার দ্বারা সব লোক ঈশ্বরের কাছ থেকে কিছু না কিছু চায় । লোকেরা প্রার্থনার অর্থ-প্রভুর কাছ থেকে কিছু মেগে নেওয়া বা চাওয়া এই অর্থ ভেবে রেখেছে ।
বেদানুসার প্রার্থনা হোল প্রতিজ্ঞার সমানার্থবাচক শব্দ । অর্থাৎ প্রার্থনার পূর্বে পুরুষার্থ করা আবশ্যক । হাজার হাজার বছর পরে ঋষি দয়ানন্দ এমন একজন বিচারক এবং ধর্মাচার্য এলেন যিনি ‘পূজা’ শব্দকে ‘পুরুষার্থের’ সাথে মিলন করালেন । অন্যথা অন্ধবিশ্বাসী লোকেরা ঈশ্বরের কাছ থেকে কিছু চাওয়াকেই প্রার্থনার নাম দিয়ে রেখেছিল । পরমাত্মার কাছ থেকে কি চাওয়া উচিৎ, কি না চাওয়া উচিৎ-তা ভক্তকে জানা উচিৎ ।
বেদানুসার প্রার্থনা হোল প্রতিজ্ঞার সমানার্থবাচক শব্দ । অর্থাৎ প্রার্থনার পূর্বে পুরুষার্থ করা আবশ্যক । হাজার হাজার বছর পরে ঋষি দয়ানন্দ এমন একজন বিচারক এবং ধর্মাচার্য এলেন যিনি ‘পূজা’ শব্দকে ‘পুরুষার্থের’ সাথে মিলন করালেন । অন্যথা অন্ধবিশ্বাসী লোকেরা ঈশ্বরের কাছ থেকে কিছু চাওয়াকেই প্রার্থনার নাম দিয়ে রেখেছিল । পরমাত্মার কাছ থেকে কি চাওয়া উচিৎ, কি না চাওয়া উচিৎ-তা ভক্তকে জানা উচিৎ ।
অথর্ববেদের একটি প্রসিদ্ধ মন্ত্র ‘‘স্তুতা ময়া বরদা বেদমাতা’’-তে অতি সুন্দর
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এঁর আলোকপাত করা হয়েছে ।
ঈশ্বরের কাছ থেকে ১) পুরুষার্থ, গতি, ঊর্জা, ২) আয়ু, ৩) প্রাণ, ৪) প্রজা (সন্তান), ৫) পশু, ৬) কীর্তি,
৭) ধনসম্পদ, ৮) ব্রহ্মবাস
(Spiritual Vigour)
এবং মোক্ষ এই কামনা এই মন্ত্রে করা হয়েছে।
আপনারা বিচার করে দেখুন । এর পরেও মানুষকে আর কি চাই ?
পাওয়ার জন্য আর কিছুই বাকী নাই ।
যজুর্বেদের প্রথম মন্ত্রে-ও ঈশ্বরের কাছ থেকে ঊর্জা-র প্রার্থনা করা
হয়েছে। কর্মন্যতার উপর বল দেওয়া হচ্ছে বেদের মৌলিকতা এবং বিশেষতা । সংসারের লোক রামভরসা
অর্থাৎ কিছু না করাকে আস্তিকতা এবং ভক্তি বলে ব্যাখ্যা করে-লোক একনাগাড়ে বলতে থাকে
—
“অজগর করেন চাকরি, পঞ্ছী করে না কাম” ।
এটি সত্য নয় যে পাখী কাজ করে না । আপনারা চেতন সংসারের কথা তো ছেড়েই দিন । সম্পূর্ণ জড় জগৎ-ও
গতি করে । তাই যজুর্বেদের ৪০ অধ্যায়ের প্রথম মন্ত্রে সংসারকে ‘জগৎ’ বলা হয়েছে । সব গ্রহ উপগ্রহ গতি
করে চলছে । ঈশ্বরের অস্তিত্বের সব থেকে বড় প্রমাণ হোল যে তিনি গতি প্রদান করেন । প্রফেসার বিষ্ণু
দয়ালজী ঠিকই লিখেছেন যে যদি ‘জগৎ’ শব্দ বাইবেলে আসতো তাহলে গ্যালিলিও-কে অসহ্য যন্ত্রণা ভুগতে হোত না । অকর্মন্যতার শিক্ষা দেওয়া ব্যক্তিকেও “হিম্মদে মর্দা মদদে খুদা” (God helps those who help
themselves) প্রভু তার সহায়তা করে যে নিজের সহায়তা
নিজে স্বয়ং করে;- একে জানতে হয়, মানতে হয় ।
বেদে কৃষি, ব্যাপার এবং উদ্যোগ-শিল্পঃ—
বেদে কৃষিকে প্রমুখ এবং পবিত্র ব্যাপার বলে বলা হয়েছে । কৃষক ঈশ্বরের সব থেকে বড় নিয়ম “কর্মফল” সিদ্ধান্তের উপর অটুট বিশ্বাস রাখে । যেমন বীজ বুনবে তেমনটি কাটবে । অতঃ যেমন করবে তেমন ভরবে এই অটল নিয়ম হোল ঈশ্বরীয় বিধানের জীবন । কৃষকের সম্পূর্ণ কার্য্য-ব্যবহার এই অটল নিয়মেরই তো ব্যাখ্যা ।
এই নিয়মের উলঙ্ঘন থেকেই ভ্রষ্টাচার, ঘুষ, জমাখোরী (Hording) এবং কালোবাজারী এই রকম পাপকর্ম থাকে ।
বেদে ‘মধুবাতা ঋতায়তে’ আদি মন্ত্রগুলিতে জল, বায়ু, নদীগুলিকে কল্যাণকারী হওয়ার কামনা করা
হয়েছে । অন্তরিক্ষের অনুসন্ধান কর্তাদেরকে, বৈজ্ঞানিকদেরকে কোথাও আকাশে তো স্বর্গ (Heaven) দেখা দেয়নি । ধরতীর উপরেই স্বর্গ নামানোর প্রোগ্রাম
এবং প্ল্যান (যজনা) বৈদিক শান্তিপাঠে রয়েছে । মানব মনে, পৃথিবীতে, আকাশে, অন্তরিক্ষে, দ্যুলোকে, ঔষধিতে, বনস্পতিতে, সাগর-তরঙ্গে, পর্বত -জল -স্থল সবদিকে শান্তির নিবাস হোক । একাঙ্গী শান্তি দিয়ে শান্তি সম্ভব নয় । এইরকম পূর্ণ প্রার্থনা আর কোন গ্রন্থে আছে ? এই একটি মন্ত্রের সাথেই তুলনা করে কেউ বলুন তো
!
বেদে নিবৃত্তি এবং প্রবৃত্তি দুইটিরই মহত্ত্বকে দেখানো হয়েছে । দুই-য়েরই সমন্বয় বলা হয়েছে । শরীর-নির্মাণ, জীবন-নির্মাণ, শিষ্য, গুরু, রাজা, প্রজা, গৃহস্থ, ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, বিবেকশীল, শ্রমশীল, ডাক্তার, বৈদ্য সবার উন্নতি এবং কল্যাণের বিধান
পাওয়া যায় । কার কি কর্তব্য তা বেদে দেওয়া আছে ।
বেদের জয় জয়কারঃ—
সৃষ্টি-রচনা অভাব থেকে হয়নি ৷ অনাদি জীবসমূহের জন্য অনাদি প্রকৃতি
দিয়ে রচয়িতা এই জগৎ রচনা করেছেন । Matter can neither
be created nor it may be destroyed- প্রকৃতিতে না তো উৎপন্ন করা যেতে পারে, না এঁকে নষ্ট করা যেতে পারে । বিজ্ঞানের এই ঘোষণা বৈদিক ধর্মের জয়কার, জয়ঘোষ । উপাদান কারণ (Material
cause)-র ছাড়া সৃষ্টির রচনার কথা সৃষ্টি-নিয়ম সহ্য করতে পারে না । পণ্ডিত
গঙ্গা প্রসাদ উপাধ্যায়জীর এই কথাটি হোল যথার্থ ।
আমরা পুনরায় বলবো যে বেদে কোথাও. জাদু, টোনা, ভূত-প্রেত, বহুদেবতাবাদ,
সুরাপান, মাংসাহার এর বিধান নাই । এসব কথা, এসব গল্প বেদের উপর আঘাত করার জন্য
বেতনভোগী বেদভাষ্যকারেরা রচনা করেছে । ঐ সব ভাষ্যকার ভারতীয় অথবা অভারতীয় শাসকদের চাকর ছিল । শাসকবর্গকে প্রসন্ন করার জন্য, পাপী পেটের জন্য এঁরা বেদের অর্থকে অনর্থ করেছে । ঋষি দয়ানন্দ আজীবন কারও চাকরি করেন নি । ঊনবিংশ শতাব্দীর বেশ কিছু ধার্মিক নেতা যেমন,- স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ, রাজা রামমোহন রায় সরকারের চাকরি করতেন । সেই ঋষি ঈশ্বরের প্রেমপাত্র ছিলেন । তিনি শ্রদ্ধার সাথে, পূর্ণ হৃদয়ের সাথে তাঁর নিজের প্রীতম প্রভুর অমর বেদবাণীর ঠিক ঠিক
অর্থ করে মানবমাত্রের অতীব উপকার করেছেন । তাঁর বেদভাষ্যের এইটিই বিলক্ষণতা এবং বিশেষতা এই যে, তিনি ঈশ্বরের দিশা নির্দেশে বেদ ভাষ্য করেছেন।
এই কার্যে তার (Guide) মার্গদর্শক ছিলেন সর্বজ্ঞ প্রভু । তাঁর আর অন্য কোন (Boss) মালিক অথবা
অন্নদাতা ছিল না ।
বেদে কি নাই ? :—
এই প্রবন্ধের সমাপ্তি করতে গিয়ে আমরা ‘বেদে কি নাই’ -এই সম্বন্ধে খ্যাতনামা মুসলমান মৌলানা ডাক্তার গুলাম জৈলানির পুস্তক “এক ইসলাম-র” প্রমাণ দেওয়া আবশ্যক এবং উপযোগী বলে
মনে করছি ।
“বেদে মূর্তিপূজার কোথাও কোন উল্লেখ নাই । আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত কেবল
মাত্র এক পরমাত্মার আদেশ দেওয়া আছে । কেননা পণ্ডিত (পৌরাণিক, ব্রাহ্মণ) দের মানসিকতা ভীষণভাবে বিকৃত হয়ে
গিয়েছিল । এজন্য আদর এবং উপাসনার মধ্যে কোন
পার্থক্যই থেকে ছিল না । অতঃ সে পরমেশ্বর এবং মহাত্মা গান্ধি
দুইয়ের সামনে নতমস্তক হয়ে ঝুকে যায় । সে কৃষ্ণের মূর্তি এবং সম্রাট আকবরের চরণে চুমা খায়। তাকে হিমালয়ের উপরে প্রভুর সিংহাসন দেখা দেয়”।
(মুসলমানদেরকে আল্লাহর সিংহাসন সপ্তম
আকাশে দেখা যায়) সে বিদ্যুতের আওয়াজ এবং ঝড়ের আওয়াজে দেবতাদের ভয়াবহ আওয়াজকে শুনতে
পায় ।
সে সর্পের ফনাতে এবং ময়ূরের নৃত্য ঈশ্বরকে মগ্ন হতে দেখা দেয় । এবং এইজন্য সে পবিত্র বেদের এক একটি অক্ষরে এক একটি নূতন ভগবানকে
খুঁজে বেড়ায় । বুঝতে পারি না যে কেবল এক পরমাত্মাতে
ব্রাহ্মণের সন্তুষ্টি কেন হয় না ? যখন সে জানে যে, এই সৃষ্টি, সাগর, পর্বত, অনন্ত কোটি সূর্য, চন্দ্র একই পরমাত্মার রচনা। সেই প্রভুর শক্তির অনুমান লাগানো কঠিন । তাঁর কাছে সমস্ত প্রকারের দানের অসংখ্য ভান্ডার রয়েছে । বায়ুকে সেই চালায় । বর্ষা সেই বর্ষণ করে । ভূমি থেকে অন্ন, ধন সেই সৃষ্টি করে ।
এতে কোনই সংশয় নেই যে,— “বেদে ঈশ্বরের গুণবাচক নাম যথা ব্রহ্মা (মহান), মহাদেব (বড়দেব), বিষ্ণু (রক্ষক) ইত্যাদি এবং দেবতাদের (দেবদূত) বর্ণনা রয়েছে । পরন্তু অনেক ভগবানের কোথাও নিশান পর্যন্তও
পাওয়া যায় না” — (দ্রষ্টব্যঃ এক ইসলাম : উর্দূ পুস্তক, লেখক ডাঃ গুলাম জৈলানী পৃষ্ঠা ১৭৪ -১৭৫) ।
এ হচ্ছে ঋষি দয়ানন্দের কৃপার ফল যে ইসলামের এক প্রখ্যাত প্রবক্তা এবং
বিদ্বান্ লেখক এই প্রকারে বেদের মধ্যে একেশ্বরবাদ এবং এক ঈশ্বরোপাসনার সিদ্ধান্তকে
খোলা হৃদয়ে স্বীকার করেছেন ।
ইনিই ডাঃ গুলাম জেলানী তাঁর নিজের পুস্তকে আগে তিনটি মহত্ত্বপূর্ণ
প্রমাণ দিয়েছেন । মার্শম্যান বলেছেন— “বেদের মুখ্য সিদ্ধান্ত হোল এক ঈশ্বরের উপাসনা ।
এঁতে ঈশ্বরেতর অন্য কোন সত্তার পূজার
উল্লেখ নাই । এঁতে সন্দেহ নাই যে, যত্র তত্র দেবসমূহের বর্ণনা প্রাপ্ত হয় পরন্তু এঁতে সংসারের গুপ্ত
শক্তি সমূহই হোল অভিপ্রেত । দুঃখের কথা হোল যে, হিন্দু জাতি বেদের শিক্ষা থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছে” । (মার্শিয়ান হিস্ট্রী, পেজ -১)।
অন্য একজন লেখক কালব্রুর লিখেছেনঃ “বেদে অনেক ভগবানের পূজার কোথাও বর্ণনা নাই” । (এশিয়ার ঐতিহাসিক খোজ, পেজ- ৩৮৫) ।
প্রফেসার উইলসন মহোদয় বলেছেন— “বেদে প্রতিমা পূজন এবং প্রতিমা তৈরি করা সিদ্ধ হয় না” । (অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত উইলসনের ভাষণ, পেজ - ১৪)।
কিছু পশ্চিমদেশীয় খ্রীস্টান লেখক ঋগ্বেদকে যীশুর দুই হাজার বছর আগে
বলে আসছে, কেউ বেদের রচনাকাল তিন হাজার বছর
পূর্বে এবং বেশকিছু যীশু থেকে সাড়ে তিন হাজার
বছর পূর্বে হয়েছে বলে রাগ গেয়ে যাচ্ছে । শ্রী পন্ডিত ভগবৎ দত্তজী বলতেন— আমাদেরকে উক্ত বক্তব্যে খারাপ ভাবা উচিৎ নয় । এঁরা তো সৃষ্টির আয়ুকেই ছয় হাজার বর্ষ বলে স্বীকার করে । এ তো এঁদের বাহাদুরী যে বেদকে এঁরা যীশুর সারে তিন হাজার বৎসর
পূর্বের পুরাতন গ্রন্থ মেনে নিয়েছে । এঁরা সৃষ্টি রচনা হয়েছে পাঁচ হাজার বছর বলে মানে এবং আমরা পাঁচ হাজার
বর্ষ থেকে বিকৃত বলে মানি । এঁদের চিন্তার (কি
বেদ সারে পাঁচ হাজার বছর বর্ষ পুরনো) অভিপ্রায় তো ঠিকই যে বেদের আবির্ভাব সৃষ্টির আরম্ভেই হয়েছে । আনন্দের বিষয় যে এখন এসব লোক বেদে জাদু-টোনা, ভূত-প্রেতের পরিবর্তে যীশু, মোহাম্মদ আদি নিজেদের মহাপুরুষদিগকে, দেবদূতগণকে দেখতে লেগেছে ।
বিধান বিনা ন্যায়-ব্যবস্থা কি ভাবে ? :—
এটি তো সবার কাছে স্পষ্ট করা হয়েছে যে,
সৃষ্টির নিয়ম হোল অটল।
পরমাত্মার নিয়ম ঘসে না,
মিটে না, বদলায় না, কম হয় না,
বেশী হয় না । আর একটি কথা বিচারণীয় যে খ্রীস্টান এবং মুসলমান সবাই ঈশ্বরকে
ন্যায়কারী মানে । সেই প্রভু সদা-ই পাপ এবং পূন্যের
দুঃখ এবং সুখরূপে ফল দেন । সেই পরমাত্মা পূর্বেও ন্যায় প্রদান
করতেন এবং আজও । কোন নিয়মকে ভাঙলে এবং পরমাত্মার
আজ্ঞার অবহেলা করলেই তো দন্ড দেওয়া হয় । নিয়ম, ব্যবস্থা এবং আদেশ না বলে তো কাউকে
পাপী বলে দন্ডিত করা যেতে পারে না । বাইবেল তথা কোরানের পূর্বেও প্রভু ন্যায় দিতেন,
দন্ড দিতেন । নিজের জ্ঞান, বিধান এবং
ব্যবস্থা না বলেই কি তিনি মানুষকে দন্ড দিয়ে চলেছেন ?
বিধি বিশেষজ্ঞ কেউ-ই, কোন ব্যক্তিই এঁকে মানবে না । এথেকে এইটি সিদ্ধ হয় যে, পরমাত্মার বিধান বেদ সৃষ্টির আদিতেই আবির্ভূত হয়েছে । সৃষ্টির আদিতেই এই ব্যবস্থা লাগু করা হয়েছে । বিধান লাগু করার পরেই কাউকে দোষী নিরূপিত করা যেতে পারে-অন্যথা নয়
।
বাংলাদেশ
অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে
নির্ভিক সৈনিক
----০----
0 মন্তব্য(গুলি)