প্রশ্নঃ তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২।৯।১ ' যদ্ব্রাহ্মণানীতিহাসান্পুরাণানি কল্পান্গাথা নারাশꣳসীর্মেদাহুতয়ো দেবানামভবন্তাভিঃ ক্ষুধং পাপ্মা- নমপাঘ্নন্নপহতপাপ্মানো দেবাঃ স্বর্গং লোকমায়ন্ব্রহ্মণঃ সায়ুজ্যমৃষয়োঽগচ্ছন্ ' ও আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে ব্রাহ্মণ ও পুরাণ আলাদা উল্লেখিত আছে । তাই ব্রাহ্মণ ও পুরাণ আলাদা গ্রন্থ যা সায়ণ ভাষ্য অনুযায়ী স্বীকৃত ।
উত্তরঃ তৈত্তিরীয় আরণ্যক সায়ণ ভাষ্য ৮।২।১ অনুযায়ীই ব্রাহ্মণের ৮টি ভাগ রয়েছে যার একটি হলো পুরাণ ।
যদি পুরাণ এখানে আলাদা গ্রন্থ হয় তাহলে গাথা , নারাশংসী, আখ্যান, ব্যাখ্যান, কল্প এসব গ্রন্থও আলাদা থাকার কথা ৷ আমরা বৈদিক শাস্ত্রে কল্প ব্যতীত এমন কোন পৃথক গ্রন্থ পাই কি ? এর অর্থ হলো এগুলো মূলতঃ ব্রাহ্মণেরই অংশ এবং সায়ণাদি যারা অর্থ করেছেন তা কপোলকল্পিত ।
উল্লেখ্য 'ব্রহ্মাণ্ডাদীনি ' পদ সায়ণ ভাষ্যের আনন্দাশ্রম সংস্করণে পাওয়া গেলেও এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্করণে পাওয়া যায় না ।
আবার সায়ণ ইতিহাস অর্থ করেন মহাভারত । যদি তাই হয় তবে ব্রাহ্মণ যাকে কিনা বেদও মানেন অনেকে তাতে বহু পরের মহাভারতের উল্লেখ আসে কিভাবে ? এই অর্থ যে যথাযথ নয় এখানেই তা প্রমাণিত । ভট্ট ভাস্কর সায়ণের মত করেও এখানে ব্রাহ্মণাদির অংশও উল্লেখ করেছেন । বিপক্ষ বলেন সায়ণ এখানে পুরাণ বুঝিয়েও ব্রাহ্মণের উদ্ধৃতি দিয়েছেন পূর্ব আচার্যকে অনুসরণ করে । আশ্চর্যজনক বিষয় যেখানে পূর্ব আচার্য ভুল বলে এরা পরস্পরকে খণ্ডন অব্দি করতে পারে তারাই কিনা এখানে কেবল রেখে দিয়েছে যথাবৎ ? প্রকৃতপক্ষে তারা পৌরাণিক ব্যাখ্যা করেও সন্তুষ্ট ছিলেন না কেননা নিশ্চয়ই সায়ণের মত ভাষ্য করতে গিয়ে ভট্ট ভাস্করের মনেও এই প্রশ্নটি উঠেছিলো নতুবা তিনি আলাদা ব্রাহ্মণ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন না ।
প্রশ্নঃ বিষ্ণু পুরাণের ৩য় অংশের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে বলা হয়েছে বেদব্যাস গাথা, উপাখ্যান, আখ্যান ও কল্পশুদ্ধি একত্রে কম্পাইল করে পুরাণ রচনা করেন । অর্থাৎ এই পুরাণেই সেসব বিদ্যমান ।
উত্তরঃ আপনার অজ্ঞতা এটি । বিষ্ণু পুরাণের কোথাও কল্প বলতে কল্পসূত্র বোঝায়নি । বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী পুরাণে দেওয়া হয়েছে -
আখ্যানেশ্চাপ্যুপাখ্যানৈর্গাথাভিঃ কল্পসিদ্ধিভিঃ ।
পুরাণসংহিতাং চক্র পুরাণার্থবিশারদঃ ॥
১. আখ্যান
২. উপাখ্যান
৩. গাথা
৪. কল্পশুদ্ধি
শ্রীধর স্বামীর টীকা যা কিনা এখানে সর্বপ্রামাণ্য সব পৌরাণিকের মতে তিনি এগুলোর অর্থ করেছেন -
স্বয়ংদৃষ্ট বিষয়ের বিবরণের নাম আখ্যান , শ্রুত বিষয়ের বিবরণ উপাখ্যান , পিতৃপুরুষের গীত হল গাথা , বারাহ কল্পাদির [ যুগবিভাগাদি ] বিবরণ কল্পশুদ্ধি ।
অর্থাৎ সায়ণ উক্ত ভাষ্যে কল্প=কল্পসূত্র বুঝিয়েছেন যা কিনা পুরাণে বিদ্যমান নেই । যদি কল্পসূত্র সব পুরাণেই প্রবেশিত হতো তাহলে এখনো এতো কল্পসূত্র কিভাবে রইলো ? আবার গাথা অর্থ পিতৃপুরুষের গীত। কিন্তু সায়ণ অনুযায়ী অর্থ গীত মন্ত্র বিশেষ । এখানেও সুস্পষ্ট ভেদ বিদ্যমান । আমরা যদি একটি ছক তৈরী করি -
অর্থাৎ এখানে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত বিষ্ণুপুরাণে উক্ত কোন বিষয়েরই সংগ্রহ নেই । অতঃ পূর্বে পুরাণে সেসব গ্রন্থ একীভূত করা হয়েছে দাবিটি সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রসূত । ইতিহাস তো মহাভারত মেনে নিলেও নারাশংসী কোথায় গেলো ?
এগুলোকে যারা অপৌরুষেয় বলে তাদের জন্য কিছু বিশেষ প্রমাণ -
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ অনুযায়ী বেদের মল গাথা নারাশংসী হয়েছিলো ।
যদ্ব্রহ্মণঃ শমলমাসীৎ । সা গাথা নারাশꣳস্যভবৎ
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১।৩।২।৬
যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির ১।৪৫ বিশ্বরূপ টীকায়
ও মনুস্মৃতির ৯।৪২ এর মেধাতিথির ভাষ্যে গাথাকে শ্লোক ও পৌরষেয় বলা হয়েছে ।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, কাঠক সংহিতা, শতপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী গাথা, নারাশংসী অনৃত ও মানুষও অনৃত । অনৃত জিনিস কিভাবে বেদতূল্য পুরাণে ঢুকতে পারে?
এবং তথেতি গাথায়া ওমিতি বৈ দৈব তথেতি মানুষং দৈবেন চৈবৈনং তন্মানুষেণ চ পাপাদেনসঃ প্রমুঞ্চতি
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৭।১৮
যো গাথানারাশংসীভ্যাং সনোতি তস্য ন প্রতিগৃহ্যমনৃতেন হি স সনোত্যনৃতং হি গাথানৃতং নারাশংসী মত্তস্য ন প্রতিগৃহ্যমনৃতং হি মত্তো যদা হি সোঽমত্তো ভবত্যথ তং তত্তুপতি ॥
কাঠক সংহিতা ১৪।৫
অনৃতম্মনুষ্যা
শতপথ ব্রাহ্মণ ১।১।১।৪
শতপথ ব্রাহ্মণে গাথা গান করা হয় বলে সেখানেই কুন্তলা আদির ইতিহাস বলা হয়েছে ।
এতদ্বিষ্ণোঃ ক্রান্তম্ তেন হৈতেন ভরতো দৌঃষন্তিরীজে তেনেষ্ট্বেমাং ব্যষ্টিম্ব্যানশে যেয়ং ভরতানাং তদেতদ্গাথয়াভিগীতমষ্টাসপ্ততিং ভরতো দৌঃষ্যন্তির্যমুনামনু গঙ্গায়াং বৃত্রঘ্নেঽবধ্নাৎপঞ্চপঞ্চাশতং হয়ানিতি৷
শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩।৫।৪।১১
প্রশ্নঃ ব্রাহ্মণকে পুরাণ বলা হবে কেন ?
উত্তরঃ অষ্টাধ্যায়ী ৪।৩।১০৫ ' পুরাণপ্রোক্তেষু ব্রাহ্মণকল্পেষু' এ প্রাচীন ও অর্বাচীন ব্রাহ্মণের ভেদ আছে ।
কাশিকাকার বলেন -
ব্রাহ্মণেষু তাবৎ ভাল্লবিনঃ। শাট্যায়নিনঃ। ঐতরেয়িণঃ। কল্পেষু পৈঙ্গী কল্পঃ। আরুণপরাজী। পুরাণপ্রোক্তেষু ইতি কিম্? যাজ্ঞবল্কানি ব্রাহ্মণানি।
এখানে ভাল্লব, শাট্যায়ন ও ঐতরেয়কে প্রাচীন ও শতপথকে অর্বাচীন ধরেছেন ।
অষ্টাধ্যায়ী ৪।২।৬৬ এর কাশিকায়ও প্রাচীনে তাণ্ড ও অর্বাচীনে সৌলভের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে ।
ব্রাহ্মণানি খল্বপি তাণ্ডিনঃ। ভাল্ল্লবিনঃ। শাট্যায়নিনঃ। ঐতরেয়িণঃ। ব্রাহ্মণগ্রহণং কিং, যাবতা ছন্দ এব তদ্? ব্রাহ্মণবিশেষপ্রতিপত্ত্যর্থম্। ইহ তদ্বিষয়তা মা ভূৎ, যাজ্ঞবল্ক্যেন প্রোক্তানি ব্রাহ্মন্ণানি যাজ্ঞবল্ক্যানি। সৌলভানি।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন এদের পুরাণ বলেই ডাকা হতো বা বিশেষায়িত করা হয়েছে তার প্রমাণ কি ?
লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র ৩।১০।১৭ - তে ' তথা পুরাণং তাণ্ডম্' বলে পুরাণ তাণ্ডের উল্লেখ রয়েছে ।
প্রশ্নঃ ছান্দোগ্য উপনিষদে [ ২.৭.২ ], [ মহাভারত আদিপর্ব ৫৮.১২৮ মহাভারত পঞ্চমবেদ ] আবার পুরাণকে পঞ্চমবেদ বলা হয়েছে । এছাড়াও বৃহদারণ্যকে [ ৪.৫.১১ ;২.৪.১০ ] একে মহাভূতের নিঃশ্বাস বলা হয়েছে৷ অথর্ববেদ ১৫.৬.১১-১২, অথর্ববেদ ১১.৫.২৫ পুরাণের উল্লেখ আছে । যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি , মনুস্মৃতি [ ৩.৩২ ] পুরাণ উল্লেখিত ।
উত্তরঃ যেখানে পুরাণ গ্রন্থই পরবর্তীকালের সেখানে বহুকাল আগে রচিত উপনিষদ আদিতে এসবের কথা যে বোঝানো হয়নি তা বলাই বাহুল্য । মহাভারতের রেফারেন্স যেটা দিলেন সেখানে মহাভারতকেও পঞ্চমবেদ বলা৷ দুটো আলাদা বিষয় একত্রে পঞ্চমবেদ কিভাবে ? প্রকৃতপক্ষে এখানে পঞ্চমস্থানীয় বলাটা শুধুমাত্র গুরুত্বসূচক ও গৌণ উপাধি । শ্রীজীব গোস্বামী বা যেই এই যুক্তি দিন না কেন তিনি যে পুরাণ ও মহাভারত রচনাকালের ব্যাপারটি মাথায় রাখেননি তা সহজেই অনুমেয় । আর পঞ্চমবেদ এটি ঔপচারিক । মনুস্মৃতি যেখানে ১৮ পুরাণেরও আগে সেখানে পুরাণ যে অষ্টাদশ নব্য তথাকথিত পুরাণ নয় এটা সুস্পষ্ট৷ এসব নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন এখানে -
প্রশ্নঃ শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে পুরাণই বেদ ।
উত্তরঃ তার আগে ও পরে অথর্ববেদই বেদ, আঙ্গিরসই বেদ, মায়াই বেদ, সর্পবেদও আছে । তাই বলে কি সব বেদ পদবাচ্য ? না । এগুলোর অর্থ হলো এইসব বিদ্যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যা কিনা পূর্ব লিংকে আপনারা দেখেছেন । এমনকি অথর্ববেদের অপর নাম অথর্বাঙ্গিরস, এর পরের কণ্ডিকাতেও আঙ্গিরস বেদ বলতে অঙ্গিরা দৃষ্ট মন্ত্র পাঠের কথা উল্লেখিত । এতে আলাদা বেদ সূচিত হয় না । হরিস্বামীও তার ভাষ্যে এটিই বলেছেন ।
একইভাবে পুরাণ বা অন্যাদি ' বেদ' ও ভাগ বা গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা নির্দেশ করে । বেদ সংজ্ঞা না ৷
প্রশ্নঃ গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ২।১০ এ পুরাণের উল্লেখ আছে । সেখানে তা বেদের সাথেই পরবর্তীতে একীভূত হয়ে যজ্ঞ নাম ধারণ করে বলে কথিত । অতঃ পুরাণ বেদের ন্যায়ই প্রামাণ্য ।
উত্তরঃ সেখানে যজ্ঞে বেদের পাশাপাশি এসব বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় উল্লেখিত হয়েছে । মূলে ' সব্রাহ্মণা, সরহস্যা, সপুরাণা ' উল্লেখ রয়েছে ।
সর্বে বেদা নির্মিতাঃ সকল্পাঃ সরহস্যাঃ সব্রাহ্মণাঃ সোপনিষৎকাঃ সেতিহাসাঃ সান্বাখ্যানাঃ সপুরাণাঃ সস্বরাঃ সসংস্কারাঃ সনিরুক্তাঃ সানুশাসনাঃ সানুমার্জনাঃ সবাকোবাক্যাস্ তেষাং যজ্ঞম্ অভিপদ্যমানানাং ছিদ্যতে নামধেয়ং যজ্ঞ ইত্য এবাচক্ষতে ।
গোপথ ব্রাহ্মণ পূর্বভাগ ২।১০
এখানে বিবেচ্য বিষয় দুটি -
১। ব্রাহ্মণকে আলাদা করে উল্লেখিত অর্থাৎ বেদ ও ব্রাহ্মণ আলাদা ।
২। অনেকেই ১ নং পয়েন্টের জন্য বলবেন তাহলে পুরাণ আলাদা গ্রন্থ স্বীকৃত যা আর্যরা মানে না । যদি পুরাণ ব্রাহ্মণের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে ব্রাহ্মণও বেদ হবে না ।
তাদের জন্য সামান্য পাণিনীয় ব্যাকরণ শিক্ষা নিয়ে এসেছি । মূলে সব্রাহ্মণা এখানে এই স এর অত্যন্ত মাহাত্ম্য আছে ।অষ্টাধ্যায়ী ২।৩।১৯ ' সহযুক্তেঽপ্রধানে' যুক্ত কোন পদ অপ্রাধান অর্থ প্রকাশ করে ।
কাশিকাকারও বলেন -
সহার্থেন যুক্তে অপ্রধানে তৃতীয়া বিভক্তির্ভবতি। পুত্রেণ সহাগতঃ পিতা। পুত্রেণ সহ গোমান্। পিতুরত্র ক্রিয়াদিসম্বন্ধঃ শব্দেন উচ্যতে, পুত্রস্য তু প্রতীয়মান ইতি তস্যাপ্রাধান্যম্। সহার্থেন চ যোগে তৃতীয়াবিধানাৎ পর্যায়প্রয়োগেঽপি ভবতি, পুত্রেণ সার্ধম্ ইতি। বিনাঽপি সহশব্দেন ভবতি, বৃদ্ধো যূনা ১.২.৬৫ ইতি নিদর্শনাৎ। অপ্রধানে ইতি কিম্? শিষ্যেণ সহোপাদ্যায়স্য গৌঃ।
যেভাবে উপনিষদ ব্রাহ্মণ আরণ্যকের অংশ হয়েও এখানে আলাদা উল্লেখিত অপ্রধান হিসেবে তেমনই পুরাণও ব্রাহ্মণের অংশ হয়েও আলাদা উল্লেখিত হয়েছে । এতে এর বেদসম প্রামাণিকতা সিদ্ধ হয় না ।
প্রশ্নঃ কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে [ ৫.১৩-১৪ ] পুরাণপাঠীদের গুরুত্ব উল্লেখিত আছে ।
উত্তরঃ কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র ধর্মশাস্ত্র নয় । তাতে এও উল্লেখ আছে কিভাবে মন্দির তৈরী করতে হবে লোকজনকে অলৌকিকতার ছলে বোকা বানিয়ে , কেউ যদি তাতে সন্দেহ করে তবে কৌশলে হত্যা করারও কথা রয়েছে । এগুলো কি বেদানুকূল বা শাস্ত্রসম্মত ?
কোন প্রসিদ্ধ পুণ্যস্থানে ভূমি ভেদ করে দেবতা উঠেছেন বলে প্রচার করিতে হবে। অথবা রাত্রিতে বা নির্জনে একটি দেবতা স্থাপন করে ও এই উপলক্ষে উৎসবাদি ও মেলা বসাইতে হবে। শ্রদ্ধালু লােকের প্রদত্ত ধন দেবতাধ্যক্ষ গােপনে রাজসমীপে অৰ্পণ করিবেন।
যাহারা অশ্রদ্ধালু, বেশি জিজ্ঞাসু, তাহাদিগকে ভােজন ও স্নানাদি-দ্রব্যে স্বল্পমাত্রায় বিষ প্রয়ােগ করিয়া মারিয়া ফেলিবে। তারপর ইহা দেবতার অভিশাপ' বলিয়া প্রচার করিবে।
(কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র, ৫ম অধিকরণ, ২য় অধ্যায়, ৯০তম প্রকরণ)
প্রশ্নঃ আপনারা পুরাণকে অপ্রামাণ্য মানেন। কিন্তু স্বয়ং মীমাংসা দর্শনে বেদাদির ন্যায় পুরাণকেও প্রামাণ্য মানা হয়েছে৷ তাহলে আপনারা পুরাণকে প্রামাণ্য মানেন কোন যুক্তিতে?
উত্তরঃ মীমাংসা দর্শনের কোন সূত্রে পুরাণকে প্রামাণ্য মানা হয়েছে, সেটি উল্লেখ করুন।
প্রশ্নঃ "ধর্মস্য শব্দমূলত্বাদশব্দমনপেক্ষং স্যাৎ ॥" (মীমাংসা ১.৩.১) সূত্রে পূর্বপক্ষ হিসেবে বলা হয়েছে, ধর্ম বেদমূলক। বেদ ভিন্ন অন্য শাস্ত্র অপ্রামাণিক৷ এই পূর্বপক্ষ খণ্ডন করে সিদ্ধান্ত দিয়ে বলা হচ্ছে, "অপি বা কর্তৃসামান্যাৎ প্রমাণমনুমানং স্যাৎ॥" (মীমাংসা ১.৩.২) অর্থাৎ কর্তা সমান হওয়ায় স্মৃতিশাস্ত্রও প্রামাণিক৷ অথবা কর্তা সমান বলতে বুঝায়, ব্যাসাদি যেসব ঋষি বেদাদি অধ্যয়ন করেছেন, তাঁরাই ইতিহাস পুরাণের রচয়িতা৷ তাই পুরাণও প্রামাণ্য৷
উত্তরঃ প্রথমত, মীমাংসার উক্ত সূত্রে কোথাও পুরাণকে প্রামাণ্য বলা হয়নি৷ অর্থাৎ আপনি মীমাংসা সূত্র থেকে পুরাণকে প্রামাণ্য দেখাতে গিয়ে কপোলকল্পিত অর্থ দেখালেন। ফলে আপনি প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দোষে দুষ্ট৷ আপনার দেওয়া সূত্রার্থ যথার্থ নয়৷ কারণ "অপি বা কর্তৃসামান্যাৎ প্রমাণমনুমানং স্যাৎ॥" (মীমাংসা ১.৩.২) সূত্রের কোনো মীমাংসকই এরূপ অর্থ করেন নাই যে, কর্তা একই হওয়ায় পুরাণও প্রামাণ্য৷ কারণ মীমাংসা দর্শন মতে, বেদ অপৌরুষেয়৷ তাই বেদের কর্তা কোনো মনুষ্য হতে পারে না। তাই বেদের কর্তা ও পুরাণের কর্তা এক হওয়ায় পুরাণ প্রামাণ্য, এরকম হাস্যকর কথা কোনো মীমাংসকই স্বীকার করবেন না৷ আর আপনার প্রদত্ত দ্বিতীয় অর্থটি আরও আকাশকুসুম কল্পনা প্রসূত৷
এই সূত্রে স্মৃতি প্রামাণ্য দেখানোর জন্য কর্তা এক হওয়া বলতে বেদোক্ত কর্মের কর্তা ও স্মৃতির কর্তা একই হওয়ায় স্মৃতিকে প্রামাণ্য বলা হয়েছে৷ যা মীমাংসা দর্শনের ভাষ্যকার শাবরস্বামীও বলেছেন৷ ফলে এই সূত্রের যথার্থ অর্থ হলো,
"বেদোক্ত কর্মের কর্তা ও স্মৃতি কর্তা একই হওয়ায় মন্বাদি স্মৃতি প্রামাণ্য।"
প্রশ্নঃ শুধু যে মন্বাদি স্মৃতি এই স্থলে প্রমাণ নয়, পুরাণাদিও প্রমাণ সেটি এই সূত্রের উপর তন্ত্রবার্তিক টীকায় কুমারিলভট্ট উল্লেখ করে বলেছেন, "এষৈবেতিহাসপুরাণয়োরপ্যুপদেশবাক্যানাং গতিঃ।" (তন্ত্রবার্তিক ১.৩.২) অর্থাৎ এই স্মৃতি প্রামাণ্য নিয়ম ইতিহাস পুরাণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ ফলে এই সূত্র দ্বারাই পুরাণের প্রামাণ্য স্বীকৃত হয়।
উত্তরঃ আপনি এবার মীমাংসা দর্শন থেকে পুরাণের প্রামাণ্যতা দেখাতে গিয়ে মীমাংসা দর্শনের তন্ত্রবার্তিক টীকা থেকে পুরাণের প্রামাণ্যের বিষয়ে বাক্য প্রদর্শন করলেন। কিন্তু তন্ত্রবার্তিক টীকা গ্রন্থ৷ এটা স্বয়ং মীমাংসা দর্শন নয়। ফলে টীকা থেকে প্রমাণ দিয়ে, সেটাকে মীমাংসা দর্শনের প্রমাণ বলা প্রতারণা বই অন্য কিছু নয়। আর মজার ব্যাপার হলো কুমারিলভট্ট শাবরভাষ্যকে আদর্শ ধরে নিজের টীকা লিখেছেন। কিন্তু উক্ত সূত্রের কোথাও শাবরস্বামী পুরাণের প্রামাণ্যতার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করেন নাই। শুধু মন্বাদি স্মৃতির উল্লেখ করেছেন। ফলে উক্ত স্থলে কুমারিলভট্টের উক্ত ব্যাখ্যা কতটুকু মান্য তা বিবেচ্য বিষয়। এখানে অধিকরণে পুরাণের কোন প্রসঙ্গই নেই ।
আবার আপনাদের মান্য ব্যাসস্মৃতি ১।৪ স্পষ্ট করেই পুরাণ ও স্মৃতির বিরোধে স্মৃতি মান্য বলা হয়েছে ।
প্রশ্নঃ কুমারিলভট্টের উক্ত উক্তি প্রামাণ্য৷ কুমারিলভট্ট রচিত তন্ত্রবার্তিক প্রামাণ্য। আপনারা সবকিছু আংশিক মানেন। তাই আপনাদের কাছে এরকম প্রাচীন আচার্য মান্য নাও হতে পারে, কিন্তু আমাদের নিকট মান্য।
উত্তরঃ তাই নাকি! কুমারিলভট্ট এখন হয়ে গেলো আপনাদের মান্য প্রাচীন আচার্য। অথচ তাঁরই সমকালীন শঙ্করাচার্যের অষ্টবিধ ব্রাহ্মণের প্রমাণ আপনাদের নিকট অমান্য! কি আশ্চার্য বিষয়!
প্রশ্নঃ আপনারা আর্যসমাজী। আপনারা কিছু মানেন না.....ইত্যাদি ইত্যাদি
উত্তরঃ আপনারা তো পুরাণের সব কথাকেই হিসেবে মানেন। আর এখন কুমারিলভট্টের কথাকেও সত্য হিসেবে মানলেন। তাই তো? তাহলে পুরাণে যে ইন্দ্রের অহল্যা গমন আছে সেটাকে সত্য হিসেবে মানেন তো?
প্রশ্নঃ হ্যাঁ, অবশ্যই মানি৷ এগুলো দেবতাদের লীলা। এগুলো সত্য ঘটনা। আপনাদের মতো ভক্তিশূন্য মানব এসব বুঝবে না।
উত্তরঃ কিন্তু আপনার প্রামাণ্য কুমারিলভট্টও তো ইন্দ্রের অহল্যা গমনকে সত্য ঘটনা হিসেবে মানেন নাই। বরং তিনি এটাকে প্রাকৃতিক রূপক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এটি কিন্তু তিনি তন্ত্রবার্তিকেই লিখেছেন। কুমারিলভট্ট বলেছেন,
"এবং সমস্ততেজাঃ পরমৈশ্বর্যনিমিত্তেন্দ্রশব্দাচ্যঃ সবির্তবাऽহনি লীয়মানতয়া রাত্রেরহল্যাশব্দবাচ্যায়াঃ ক্ষয়াত্মকজরণহেতুত্বাজ্জীর্যত্যস্মাদনেনৈবোদিতেনেত্যাদিত্য এবাহল্যাজারইত্যুচ্যতে। ন তু পরস্ত্রীব্যভিচারাৎ।।" (তন্ত্রবার্তিক ১.৩.৭)
অর্থাৎ সমস্ত তেজস্বী পদার্থে ঐশ্বর্য রয়েছে৷ এজন্য তেজপুঞ্জকে ইন্দ্র বলা হয়েছে। দিনের মধ্যে লীন হওয়ার কারণে 'অহল্যা' এর শাব্দিক অর্থ হলো রাত্রি। রাত্রি যাতে জীর্ণ হয় অথবা যার উদয়ে রাত্রি (অহল্যা) জীর্ণ হয়, তাকে অহল্যা-জার বলে। 'অহল্যা-জার' শব্দের অর্থ সূত্র৷ এজন্য এখানে পরস্ত্রী ব্যভিচারের কোনো প্রসঙ্গ নেই৷
দেখুন, আপনি যাঁর উক্তিকে প্রামাণ্য ধরে পুরাণের প্রামাণ্য স্থাপনে বের হয়েছেন, তিনি নিজেই পুরাণের কাহিনিকে বাস্তব ও প্রামাণ্য মানেন না।
প্রশ্নঃ আপনারা দশজন মিলে সব মিথ্যা যুক্তি সাজাচ্ছেন। এসব মানি না৷ সবাই আর্যসমাজী। কাউকে মানি না.....ব্লা ব্লা
উত্তরঃ মিথ্যা যুক্তি তো আপনিই সাজাচ্ছেনব।আপনি পুরাণকে বেদের ন্যায় প্রামাণ্য বলে প্রচার করছেন। তার প্রমাণে মীমাংসার ১.৩.২ সূত্রের টীকাও দিচ্ছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আপনি এর পরের সূত্রটা স্কিপ করে যাচ্ছেন ।
দুর্জনতোষণ ন্যায় অনুসারে যদি কুমারিলভট্টের টীকা অনুসারে পুরাণকে এই স্থলে স্মৃতির ন্যায় প্রামাণ্য হিসেবে মেনে নেওয়াও হয়, তবুও তা বেদের ন্যায় প্রামাণ্য হতে পারে না। কারণ পরের সূত্রে বলা হয়েছে,
"বিরোধে ত্বনপেক্ষ্যং স্যাদসতি হ্যনুমানম্॥" (মীমাংসা ১.৩.৩)
অর্থাৎ শ্রুতির সাথে স্মৃতির বিরোধে শ্রুতি প্রমাণ্য৷ আর অবিরোধে অনুমান প্রমাণ অনুসারে স্মৃতি প্রামাণ্য।
তাই মীমাংসা দর্শন অনুসারে, বেদই একমাত্র চরম প্রামাণ্য। সব স্মৃতি বেদের অনুকূলে প্রমাণ্য৷ বিরোধে অপ্রামাণ্য।
0 মন্তব্য(গুলি)