সম্প্রতি ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন শাখার কয়েকটি মন্ত্রকে কেন্দ্র করে বেদে নানা দেবদেবীকে সিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এগুলো আদৌ যৌক্তিক কী না তা জানতে চেয়ে কয়েকজন আমাদের প্রশ্ন করেছেন।
- প্রথমত আমাদের জানতে হবে শাখা কী! মীমাংসানুযায়ী শাখার উৎপত্তি প্রবচনের জন্য। শাখা মূলত স্থানভেদে প্রবচনের জন্য সৃষ্ট বেদের সংরক্ষণ পদ্ধতি। দেখা গেল, কোনো এক ঋষির নিকট হতে তাঁর শিষ্যগণ গুরুপরম্পরায় বেদ শিখে, নানা স্থানে প্রচার ও প্রবচন আরম্ভ করলেন। কালক্রমে তাঁদের ও শিষ্য হল ও এভাবে শাখার সৃষ্টি হল। চার বেদের এমন অনেক শাখা থাকলেও, মূল নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
- বিন্যাস, পাঠের নিয়ম, উচ্চারণে শাখাভেদে পার্থক্য থাকলেও সাধারণত সব শাখার সংহিতা একই হবার কথা। কারণ সেগুলো কমন সোর্স থেকে এসেছে। যদিও শাখাভেদে নিজস্ব ব্রাহ্মণ, উপনিষদ্ সম্ভব; তবে বেদ সব শাখাতেই সমান হবার কথা যদি তা যথাযথ সংরক্ষিত হয়। ঋগ্বেদের তিনটি শাখা পাওয়া যায়, শাকল, বাস্কল ও আশ্বলায়ন। তবে অনুক্রমণিকা মতে, শাকলের শিষ্যগণই বাস্কল বা আশ্বলায়ন শাখা রচনা করেছেন।
পাণিনি অষ্টাধ্যায়ী বা যাস্কের নিরুক্তেও শাকল শাখার উল্লেখ পাওয়া যায় যার দ্বারা শাকল শাখার প্রাচীনত্ব ও প্রধানতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। বর্তমানে আমরা ঋগ্বেদ বলে যা জানি, তা মূলত এই বিশুদ্ধ ও প্রাচীন শাকল শাখার সংহিতা।
- আরো পড়ুন - চরণ ও শাখা
বাস্কল ও আশ্বলায়ন শাখাতেও এই সূক্ত ও মন্ত্রগুলো উপস্থিত। তবে বাস্কল ও আশ্বলায়ন শাখাতে এমন অনেক পৃথক মন্ত্র আছে যেগুলো তিন শাখার ভেতরে কমন না। অর্থাৎ, যেগুলো মূল ঋগ্বেদের অংশ নয়, বরং পরবর্তীতে ঐ ঐ শাখার সংহিতায় প্রবেশ করানো। এদেরকেই খিল বলে। খিল বিচার করবার ২ রকম উপায় আছে।
- প্রথমত, কমন সোর্স বা সব শাখায় উপস্থিত না থাকা।
- দ্বিতীয়ত, খিলের ভাষা, দেবতা, ছন্দ তুলনামূলক নবীন হয়।
খিল নিয়ে আমাদের সকল মন্তব্য (খিল পরবর্তী যুগে রচিত, খিল কমন সোর্সে নেই, বরং কেবল একটা শাখায় রয়েছে, খিলের সাথে বেদের ভাষাতাত্ত্বিক, ছন্দগত পার্থক্য আছে এবং খিলের ভাষা নিঃসন্দেহে নবীন) প্রমাণে স্বয়ং আশ্বলায়ন শাখার সংকলকের রচিত ভূমিকার উদ্ধৃতিও দ্রষ্টব্য।
এবার সবচেয়ে বহুল আলোচিত সূক্ত ১০.১২৮ যেখানে নাকি দেবীর কথা আছে! সেই সূক্তের পাঠেই সংকলক * চিহ্ন দিয়ে মন্ত্রগুলোতে খিল চিহ্নিত করেছেন।
এছাড়া আমরা প্রথম ছবির তালিকাতেও ১০.১২৮ দেখতে পাই।
এই সূক্তটি আশ্বলায়ন শাখার অন্তর্গত খিল সূক্ত অর্থাৎ এটি নবীন সূক্ত বা পরবর্তীকালে এই শাখায় তা যুক্ত হয়েছে। এই সূক্তের সর্বশেষ দুটো মন্ত্রের শেষ অংশে এই স্তব সর্বদা পাঠ করার নির্দেশ এবং এই স্তব পাঠের ফল নির্দেশ করা হয়েছে।
যথা - ইমং দুর্গাস্তবং পুণ্যং রাত্রৌরাত্রৌ সদা পঠেৎ (১০.১২৮.২২) অর্থাৎ এই দুর্গাস্তব পুণ্য রাত্রিতে সদা পাঠ করবে,এবং - রাত্রীসূক্তং জপেন্নিত্যং তৎকালমুপ পদ্যতে (১০.১২৮.২৩) অর্থাৎ রাত্রি সূক্ত নিত্য পাঠ করবে, তৎকালেই মুক্তি লাভ করবে।
শুধু তাই না ১০.১২৮.২৩ এর শুরুর অংশে বলা হচ্ছে -
রাত্রিঃ কুশিকঃ সৌভরো রাত্রিস্তবং গায়ত্রী - অর্থাৎ এই সূক্তের দেবতা রাত্রি, ঋষি কুশিক সৌভর, এটি রাত্রিস্তব, ছন্দ গায়ত্রী।
উল্লেখ্য ঋগ্বেদের মূল শাখা শাকল শাখাতে ১০২৮ টি সূক্ত রয়েছে। কোনো সূক্তের শেষেই ওই সূক্তের দেবতা, ঋষি, ছন্দ ইত্যাদির বর্ণনা থাকে না। এসবের বর্ণনা থাকে অনুক্রমণি নামক গ্রন্থে।
আবার, কোনো সূক্তের শেষেই ওই সূক্ত পাঠের বিধি বা ফল বর্ণনা থাকে না। বরং এগুলো পৌরাণিক কালের স্তবস্তুতিপাঠের ফল নির্দেশের সাথেই মেলে।
এ থেকে এই সিদ্ধান্তে সহজেই উপনীত হওয়া যায় যে, আশ্বলায়ন শাখার ১০.১২৮ সূক্তটি কেবল খিলই না, বরং পৌরাণিক যুগে তা সংযোজিত হয়েছে।
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
0 মন্তব্য(গুলি)