পারিভাষিক চরণ শব্দের প্রয়োগ নিরুক্ত ১/১৭ পাণিনীয়াষ্টক ২/৪/৩, মহাভাষ্য ৪/২/১০৪, ১৩৮ এবং প্রতিজ্ঞা পরিশিষ্টাদি গ্রন্থে রয়েছে ।
এভাবে শাখা শব্দের প্রয়োগ উত্তর মীমাংসা ২/৪/৮ পরিশিষ্টে এবং মহাভাষ্য আদি শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে ।
এই দুটি শব্দ অতি প্রাচীন । শাখা সমূহ মহর্ষি চরণের অবান্তর বিভাগ । যেমন: শাকল, বাষ্কল, বাজসনেয়, চরক আদি চরণ, এগুলোর পূর্বে পাঁচ, চার, পনেরো এবং বারো যথাক্রমে এগুলোর শাখা হিসেবে বিবেচ্য ।
" সর্বচরণানাং পার্ষদানি "অর্থাৎ - সব চরণ এর পার্ষদ ।
সৌত্র শাখা
অনেক শাখায় কেবল সৌত্র শাখা রয়েছে । যথা - ভারদ্বাজ, সত্যাষাঢ় আদি শাখা ।
এগুলোকে কিছু বিদ্বান চরণ শাখার মধ্যে গণনা করেন না । না এগুলোর কোনো স্বতন্ত্র সংহিতা আছে এবং না কোনো ব্রাহ্মণ গ্রন্থ ।
অতএব, চরণ শব্দ অপেক্ষা শাখা শব্দের সংকুচিত কিছু অর্থ প্রযুক্ত হয়েছে ।
মহাভারত কুম্ভঘোণ সংস্করণ শান্তিপর্ব অধ্যায় ১৭০ -এ উল্লেখ রয়েছে --
" পূষ্টশ্ব গোত্রচরণং স্বাধ্যায়ং ব্রহ্মচারিকম্ ।। ২অর্থাৎ - রাক্ষস গুলো সেই ব্রাহ্মণদের তাদের গোত্র, চরণ, শাখা এবং ব্রহ্মচর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে । এখানে স্বাধ্যায়ের অর্থ শাখা হিসেবে প্রতীত হয় ।
শাখা মূলত কি
এখন প্রশ্ন উঠে চরণ এবং শাখা কি ?
এই বিষয়ে দুটি মত উপস্থিত করা হয় ।
- প্রথম মত হলো শাখা বেদের অংশ । সব চরণ মিলিত হয়ে বেদ গঠিত হয় ।
- দ্বিতীয় মত, শাখা হলো বেদ এর ব্যাখান ।
এখন এই দুই মতের সমীক্ষা করা হচ্ছে ।
প্রথম মত -- শাখা বেদের অংশ
এই মত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মত । যদি এই মতের মান্যতা দেওয়া হয় তাহলে নিম্নের দোষ গুলো দেখা দেয় ।
১. উপরে উল্লেখ হয়েছে, অনেক শাখা এবং সৌত্র শাখা উপলব্ধ । যদি শাখা বেদের অংশ হিসেবে মানা হয়, তো অনেক গ্রন্থ বেদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে । এটি সম্পূর্ণ বৈদিক বিচারের বিপরীত ।
২. এই মত প্রথম থেকেই অনেক বিদ্বানের অভিমত বা সিদ্ধান্ত নয় ।
" নৃসিংহপূর্বতাপিনী " উপনিষদ প্রাচীন উপনিষদ নয় ; কিন্তু শঙ্কর আদি আচার্যের পূর্ব থেকেই মান্যতা দেওয়া হচ্ছে । এই উপনিষদে উল্লেখ রয়েছে --
" ঋগ্যজুঃসামাথর্বাণশ্বত্বারো বেদাঃ সাঙ্গাঃ সশাখাশ্বত্বারঃ পাদা ভবন্তি " ।১। ২।।অর্থাৎ - ঋগ্, যজুঃ, সাম এবং অথর্ব চার বেদ । যা অঙ্গো এবং শাখার সাথে চার পাদ ।
এখানে শাখাকে বেদ থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে ।
৩. বৃহৎজাবালোপনিষদ এর ৮ম ব্রাহ্মণের পঞ্চম কাণ্ড উল্লেখ রয়েছে --
" য এতদ্বৃহজাবালং নিত্যমধীতে স ঋচোধীতে স যজুংষ্যধীতে স সামান্যধীতে সোথর্বণমধীতে সোঙ্গিরসসমধীতে স শাখা অধীতে স কল্পানধীতে "।
এখানেও শাখা এবং কল্প আদিকে বেদ থেকে পৃথক মানা হয়েছে ।
৪. এই প্রকারে যদি সব শাখাগুলো বেদের অংশ হতো তাহলে বিশ্বরূপ বালক্রীড়া ১/৭ -এ এই বর্ণনার উল্লেখ থাকতো না --
" ন হি মৈত্রায়ণীশাখা কাঠকস্যাত্যন্তবিলক্ষণা "অর্থাৎ - মৈত্রায়ণী কাঠক থেকে বেশি ভিন্ন নয় ।
দ্বিতীয় মত -- শাখাগুলো বেদ এর ব্যাখ্যান
এই মতের পক্ষে অনেক প্রমাণ আছে যা নিচে দেওয়া হল ।
১. বায়ু আদি পুরাণে--
সর্বাস্তা হি চতুষ্পাদাঃ সর্বাশ্বৈকার্থবাচিকাঃ ।পাঠান্তরে পৃথগ্মুতা বেদশাখা যথা তথা । ৫৯।।-- বায়ু পুরাণ: ৬১তম অধ্যায়অর্থাৎ - সেই চতুষ্পদযুক্ত একটি পুরাণের অনেক সংহিতা তৈরি হয় । এগুলোর মধ্যে পাঠান্তর ভেদ ব্যতীত অন্য কোনো ভেদ ছিলো না । এই পাঠান্তর ঠিক তেমনি ছিল যার কারণে বেদশাখাসমূহ তৈরি হয়েছে।
২. এর প্রামাণিকতা সিদ্ধ করতে আরও প্রমাণ --
প্রাজাপত্যা শ্রুতির্নিত্যা তদ্ধিকল্পাস্ত্বিমে স্মৃতাঃ । -- বায়ু পুরাণ: ৬১/৭৫ ।অর্থাৎ -- প্রজাপতির কুলপরম্পরার শ্রুতি তো নিত্য, কিন্তু শাখাসমূহ সেটির বিকল্পমাত্র।
৩. পাণিনীয় সূত্র " তেন প্রোক্তম্ " ৪/৩/১০১ ।এর উপর টীকা করতে যেয়ে কাশিকা-বিবরণ-পঞ্জিকার কর্তা জিনেন্দ্রবুদ্ধি মন্তব্য করেছেন --
তেন ব্যাখ্যাতং তদধ্যাপিতং বা প্রোক্তমিত্যুচ্যতে ।অর্থাৎ -- ব্যাখ্যা করা অথবা অধ্যাপন করাকে প্রবচন বলে । এটি শাখা প্রোক্ত । অতএব ব্যখ্যান অথবা অধ্যাপনার কারণে এভাবে সম্বোধন করা হয় ।
এই সূত্রের উপর মহাভাষ্যকার পতঞ্জলিরও একই মত -
ন হি চ্ছন্দাংসি ক্রিয়ন্তে । নিত্যানি চ্ছন্দাংসীতি । যদ্যব্যর্থো নিত্যো য়া ত্বসৌ বর্ণানুপূর্বী সানিত্যা । তদ্ভৈদাঞ্চৈতদ্ভবতি কাঠকং কালাপকং মৌদকং পৈপ্পলাদকমিতি ।অর্থাৎ -- ছন্দ কৃত নয় । ছন্দ নিত্য । যদিও অর্থ নিত্য, কিন্তু বর্ণানুপূর্বী অনিত্য । সেই অনিত্যকে ভেদের মাধ্যমেই কাঠক, কালাপক আদির ভেদ হয়েছে ।
এর দ্বারা স্পষ্ট প্রতীত হওয়া যায় যে, বর্ণানুপূর্বী অনিত্য মহর্ষি পতঞ্জলির এটা বলার অভিপ্রায় শাখা গুলোর পাঠান্তরের বিষয়কেই নির্দেশ করছে। কেননা তিনি অর্থকে নিত্য মানতেন, অতএব পাঠান্তর একই মূল অর্থ নির্দেশ করে ব্যাখ্যানকে ।
৪. মহাভাষ্য ৪/১/৩৯ -এ উল্লেখিত " ছন্দসি ক্রমেকে " বচনের অর্থ কিছু আচার্য শাখা গুলোতে " অসিক্ন্যস্যোষধে " শব্দ এবং দ্বিতীয় " অসিতাস্যোষধে হিসেবে পাঠ করেন । প্রাতিশাখ্যেও এই নিয়মানুসারে পাঠ করা হয় । এরও অভিপ্রায় এটা যে, শাখা গুলোর অনেক পাঠ অনিত্য । বেদের মূল পাঠই হলো নিত্য ।
মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যের নির্ণয়
৫. ভগবান যাজ্ঞবল্ক্য এই বিষয়ে একটি নির্ণয়াত্মক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন । মাধ্যন্দিন শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৪/৩/৩৫ -এ বলেছেন -
তদু হৈকে ন্বাহুঃ । হোতা য়ো বিশ্ববেদস ইতি নেদরমিত্যাত্মানং ব্রবাণীতি তদু তথা ন ব্রুয়ান্মানুষ হি তবে যজ্ঞে কুর্বন্তি ব্যৃদ্ধং বৈ তদ্যজ্ঞস্য যন্মানুষং নৈব্দ্দৃদ্ধং যজ্ঞে করবাণীতি তস্মাদ যথৈবর্চানুক্তমেবানুব্রুয়াদ... ।অর্থাৎ -- অমুক যজ্ঞে শাখার পাঠ যেনো অধ্যয়ন না করে । অনেকে এরকম করে । এমন পাঠ মানুষ এবং যজ্ঞের সিদ্ধি বাধক হয়ে থাকে । অতএব যেমন ঋচা পাঠ মূল ঋগ্বেদে রয়েছে সেভাবেই যেনো পঠন হয় ।
মূল ঋক্ পাঠ রক্ষার জন্য মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য অধিক সতর্ক ছিলেন ।
৬. এই মতকে স্পষ্ট করে বুঝানোর জন্য আরও প্রমাণ রয়েছে । ভরত নাট্যশাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার আচার্য অভিনবগুপ্ত লিখেছেন -
তত্র নাট্যশাস্ত্রশব্দেন চৈদিহ গ্রন্থস্তদু গ্রন্থস্যেদানীং করণং ন তু প্রবচনম্ । তদ্ধি ব্যাখ্যানরূপং করুনাদ্ভিন্নম্ । কঠেন প্রোক্তমিতি যথা ।অর্থাৎ - যদি নাট্যশাস্ত্র শব্দে যেখানে গ্রন্থের গ্রহণ রয়েছে, তো সেটা তার কর্তৃত্বের অভিপ্রেত বোঝায়, প্রবচন নয় । প্রবচন ব্যাখ্যানকে বোঝায় এবং করণ থেকে পৃথক হয়ে থাকে , যেমনভাবে কঠের প্রবচন কঠের ব্যাখ্যান ।
অভিনবগুপ্তের এখানে স্পষ্ট অভিপ্রায় হলো শাখা প্রবচন এবং ব্যাখ্যান সমার্থক শব্দ ।
শাখাসমূহে পাঠান্তরের মাধ্যমে কেমন প্রকারে ব্যাখ্যান দেওয়া হয়েছে তার কিছু উদাহরণ নিম্নে দেওয়া হল -
১. ঋগ্বেদে একটি পাঠ রয়েছে --
" সচিবিন্দং সখায়ং " ১০/৭১/৬
এই পাঠের ব্যাখ্যান তৈ.আরণ্যক --
" সখিবিন্দং সখায়ং ১/৩/১ ,২/১৫/১ -এ রয়েছে ।
২. যজুর্বেদে একটি পাঠ রয়েছে --
"ভ্রাতৃব্যস্য বধায় " ১/১৮ ।।
এই পাঠের ব্যাখ্যান কাণ্ব সংহিতা --
" দ্বিষতো বধায় " ১/৩ ।। -এ রয়েছে ।
৩. পরবর্তী মন্ত্রভাগ যজুর্বেদ ৯/৪০ ।। ১০/১৮ ।। কাণ্ব সংহিতা ১১/৩/৩ ।। তৈত্তরীয় সংহিতা ১/৮/১০/১২ ।। কাঠক সংহিতা ১৫/৭ ।। এবং মৈত্রায়ণীয় সংহিতা ১১/৬/৯ ।। -এ ক্রমশঃ উপলব্ধ --
এষ বো মী রাজা যজুঃ
এষ বঃ কুরবো রাজৈষ
পঞ্চালা রাজা কাণ্ব
এষ বো ভরতা রাজা তৈ.
এষ তে জনতে রাজা কাঠক
এষ তে জনতে রাজা মৈত্রা.
যজুর্বেদ এর পাঠ মূল পাঠ । সেই স্থানে প্রত্যেক শাখাকার নিজের জনপদকে স্মরণ করেছেন । কাঠক এবং মৈত্রায়ণী শাখা গণরাজ্য গুলোতে প্রবচন দেওয়া হয়েছে । অতএব এই শাখা সমূহের পাঠ " জনতে " যেখানে জনতাই সর্বপ্রধান ছিলো । এটাই ছিলো পাঠান্তর, যা এক প্রকার ব্যাখ্যান । এই পাঠান্তরের কারণে অনেক শাখার সৃষ্টি হয়েছে । এসবের অতিরিক্ত কিছু শাখায় এবং বিশেষত ঋগ্বেদীয় শাখা সমূহে, দুই-চার সূক্তে কম বেশী দেখা যায় । যেমন শাকল শাখায় কোনো বালখিল্য সূক্ত নাই, পরন্তু বাষ্কল শাখায় রয়েছে । মূল ঋগ্বেদে সব সূ্ক্তই রয়েছে ।
শাখা বিষয় অত্যন্ত জটিল । যতক্ষণ পর্যন্ত বেদের অধিকাংশ শাখা উপলব্ধ না হয়, এখন পর্যন্ত এর অধিক কিছু বলা সম্ভব নয় ।
নমস্কার
0 মন্তব্য(গুলি)