https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্বাধ্যায় [৩] - দেবপূজা বিচার [ ৯।২৬ , ৩।১১-১৩]

Monday, October 31, 2022


পূর্বাভাসঃ দেব সম্পর্কিত আলোচনার পূর্ব দেবসংজ্ঞা প্রকরণের নিম্নোক্ত নিবন্ধসমূহ অধ্যয়ন অবশ্য কর্তব্য - বৈদিক দেবতা বিষয়


প্রশ্নঃ এ ফুল - পত্র - পাতা দ্বারা পূজার কথা রয়েছে । অতঃ এখানে মূর্তিপূজা বিদ্যমান । 


উত্তরঃ প্রশ্নকর্তা সম্ভবতঃ বৈদিক যজ্ঞ সম্পর্কে অবগত নন । নিম্নোক্ত যজ্ঞ উপকরণের উদাহরণ দেখুন - 


 

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী স্বীয় ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকা গ্রন্থে [বেদবিষয়বিচার] এর উপযোগিতা সম্পর্কে বলেছেন - 





এখানে কেশর স্পষ্টভাবে ফুল , নানা ফল ও সোমাদি ঔষধী পত্রের সূচক । তাই আলোচ্য শ্লোকে মূর্তির কোন উল্লেখ নেই ও বৈদিক যজ্ঞে উল্লেখিত দ্রব্যের প্রয়োগ বিচারে দেবযজ্ঞই সিদ্ধ হয় ।

মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি এই শ্লোকের অর্থ করেছেন নিম্নরূপ -

যে পুরুষ পত্র পুষ্প ফল জল আমার জন্য ভক্তিপূর্বক প্রদান করে সমাহিত চিত্ত ভক্তিযুক্ত সেই বস্তুকে (অহম, অশ্নামি) আমি গ্রহণ করি।


পণ্ডিতজীর ভাষ্য নিম্নরূপ -

এই শ্লোকে এই ভাব বর্ণনা করা হয়েছে যে, পরমাত্মার পূজনের জন্য বড় উপাচারের কোন আবশ্যকতা নেই। পত্র, পুষ্পাদি তুচ্ছ থেকেও তুচ্ছ বস্তু যদি ভক্তিপূর্বক সমাহিত চিত্তবান পুরুষ পরমাত্মাকে সমর্পণ করে তবে ইহাই সর্বোপরি উপাচার বুঝতে হবে ।

প্রশ্নঃ তোমাদের মতে তো পরমাত্মা নিরাকার তবে এই পত্র পুষ্পাদি উপাচার কিভাবে গ্রহণ করবে ?

উত্তরঃ পত্র পুষ্পাদি সর্বপরি উপাচার এখানে উপলক্ষ মাত্র। যেমন লোক রত্নাদি বহুমূল্য পদার্থ দেবার পর এটা বলে জানে যে, ইহাই পত্র-পুষ্পাদি। এই প্রকারে পত্র পুষ্পাদি উপাচার এখানে উপলক্ষ্য মাত্র। আর কেউ যদি বলে যে, এই শ্লোকে (অশ্নামি) লেখা আছে, যার অর্থ ভক্ষণ করে। তো উত্তর এরূপ সাকারবাদীর ঈশ্বর কি পত্র পুষ্প ভক্ষণ করে ? আবার তাদের মনে (অশ্নামি) ভক্ষণের অর্থ অযুক্ত। তাহলে আমাদের মতে ইহার সমাধান-

যস্য ব্রহ্ম ক্ষত্রং চ উভে ভবতং ওদনং।

মৃত্যুর্যস্যোপসেনং ক ইতথ্যা বেদ যত্র সঃ।।

[ কঠোপনিষদ ২।২৫ ] 

অর্থঃ যেই পরমাত্মার ব্রহ্ম-ক্ষাত্রশক্তি উভয়ই "ওদনং"= প্রলয়কালে উদরস্থ অন্নের ন্যায় লীন হয়ে যায়  । ৷ কোনটা যথার্থ  ? তবে কি এই বাক্যে ব্রহ্ম-ক্ষাত্রশক্তি পরমাত্মার খাদ্য ? 


 

" অত্তাচরাচরগ্রহণাত" ব্রহ্মসূত্র ১।২।৬ 

= চরাচরকে গ্রহণকারী পরমাত্মাকে কি এখানে ভক্ষণকারী বর্ণনা করা হয়েছে ? এখানে বাস্তবে পরমাত্মা ভক্ষক কখনই নয়। এবং এখানে উপাচার (অশ্নামী) শব্দে কি ভক্ষণকারী বর্ণনা করা হবে? বাস্তবে ইহার অর্থ গ্রহণ করা । এবং গীতার বৃহৎ দুই টিকাকার ইহা অর্থ এটাই করেছে । ভক্ষণ করেননি।

সামবেদের ৫৯৪ নং মন্ত্রে সবথেকে স্পষ্টভাবে এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে -

অহমস্মি প্রথমজা ঋতস্য পূর্বং দেবেভ্যো অমৃতস্য নাম।

য়ো মা দদাতি স ইদেবমাবদহমন্নমন্নমদন্তমদ্মি ॥

সামবেদ ৫৯৪

সরলার্থঃ
পরমেশ্বর স্বয়ং নিজের পরিচয় প্রদান করছেন—আমি পরমেশ্বর এই জগৎ মধ্যে সর্বত্র দৃশ্যমান সত্য নিয়মের প্রথম উৎপাদক। আমি সকল জ্যোতিষ্মান সূর্য, বিদ্যুৎ, অগ্নি, তারামণ্ডল প্রভৃতির উৎপত্তির পূর্বেও বিদ্যমান ছিলাম। আমিই মোক্ষাবস্থায় প্রাপ্ত অমৃতানন্দের কেন্দ্র বা স্রোত। যে মানব আমার নিকট নিজের আত্মাকে সমর্পণ করে, নিশ্চিতরূপে সে-ই আমাকে প্রাপ্ত হয়। আমিই অন্ন অর্থাৎ আমার ভক্তদের ভোজন হই, আবার আমিই অন্ন ভোজনকারী প্রত্যেক প্রাণীকে ভক্ষণ করি, অর্থাৎ প্রলয়কালে গ্রাস করি ॥

এই মন্ত্রে ‘আমি অন্ন, আমিই অন্ন ভোজনকারীকে ভোজন করি’ এখানে বিরোধ মনে হওয়াতে প্রকৃতপক্ষে বিরোধালঙ্কার ব্যক্ত হয় ॥

 ভাবার্থঃ যেমন প্রাণীসকল ভোজন ছাড়া বাঁচে না, ঠিক সেভাবেই ভক্তবৃন্দ পরমেশ্বরকে ছাড়া বাঁচতে পারেন না। যেভাবে প্রাণী অন্ন ভক্ষণ‌ [গ্রাস] করে, ঠিক সেভাবেই পরমেশ্বর এই বিশ্বচরাচরকে প্রলয়কালে গ্রাস করেন ॥

পরমেশ্বরের অন্ন এবং অত্তা (প্রলয়কালী গ্রাসকারী) বৈশিষ্ট্যকে উপনিষদ এবং ব্রহ্মসূত্রে এই প্রকারে বলা হয়েছে—"আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্নাদ, আমি অন্নাদ, আমি অন্নাদ" (তৈত্তি০ উপ০ ৩।১০।৬)। "পরমেশ্বর অত্তা নামে এজন্যই খ্যাত, কারণ তিনি প্রলয়কালে সমগ্র বিশ্বচরাচরকে গ্রাস করেন’ (ব্র০ সূ০ ১।২।৯)  ।  

নিরুক্তে যে পরোক্ষকৃত, প্রত্যক্ষকৃত তথা আধ্যাত্মিক তিন প্রকারের ঋকের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এই ঋক হচ্ছে আধ্যাত্মিক। আধ্যাত্মিক ঋক সেগুলোই, যেগুলোতে উত্তম পুরুষের ক্রিয়া তথা ‘অহম্’ সর্বনাম এর প্রয়োগ হয় অর্থাৎ যেটিতে মন্ত্রের আলোচ্য দেবতা, নিজের পরিচয় প্রদান করেন–"আধ্যাত্মিক্য উত্তমপুরুষয়োগা অহমিতি চৈতেন সর্বনাম্না" (নিরু০ ৭।২)

প্রশ্নঃ যদি ভক্ষণের অর্থ গ্রহণ করা হয় তবে পত্র পুষ্পাদি যাহা অর্পন করা হয় তাহলেও তো পরমাত্মাকে সাকার পাওয়া যায়?


উত্তর-এই প্রশ্নের উত্তর পরের শ্লোকে দেওয়া হয়েছে -

যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহসি দদাসি যৎ।

যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পনম।।

গীতা ৯।২৭ 

পদার্থঃ (কৌন্তেয়) হে অর্জুন (যৎ করোষি) তুমি যাহা করো (যৎ অশ্নাসি) যাহা খাও (যৎ জুহুষি)যাহা যজ্ঞ করো (দদামি যৎ) যাহা দান করো এবং (যৎ তপস্যসি) যাহা তপস্যা করো (তৎ মদর্পণং কুরুষ্ব) সে সব আমাকে অর্পণ করবে।

ভাষ্যঃ এই শ্লোকে এই ভাব বর্ণনা করা হয়েছে, মানব যা করে তাহা পরমাত্মাকে অর্পণ করবে অর্থাৎ কামনাবিহীন হয়ে করবে। আমার অর্থে কদাপি না রাখবে। এই বর্ণনা থেকে এই ভাব স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, পত্র পুষ্পাদি কোন সাকার মূর্তির সামনে রাখার কোন অভিপ্রায় নেই। কিন্তু নিষ্কাম কর্মে অবশ্যই অভিপ্রায় বিদ্যমান ।

প্রশ্নঃ এই শ্লোকে তো নিষ্কাম ও সকাম কর্মের কোন প্রকরণ নেই। তবে এ উত্তর কেন ?

উত্তর- এর উত্তর পরের শ্লোকেই দেওয়া হয়েছে -

শুভাশুভ ফলৈরেবং মোক্ষসে কর্ম্মবন্ধনৈঃ।

সন্ন্যাস যোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।। 

পদার্থঃ (শুভাশুভফলৈ) শুভ ও অশুভ ফল (কর্মবন্ধনৈ) বন্ধনরূপ কর্ম থেকে (এবং মোক্ষসে) মুক্ত হয়ে (সন্ন্যাস যোগযুক্তাত্মা) সন্ন্যাসরূপ যে যোগ তাহাতে যুক্ত হয়ে (বিমুক্তঃ) মুক্ত হয়ে (মাম, উপৈষ্যসি) আমাকে প্রাপ্ত হবে ।

ভাষ্যঃ এই শ্লোকে "সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা" এই বাক্য থেকে এই স্পষ্ট হয়েছে যে, নিষ্কামকর্মী প্রতিপাদন করতে এখানে কৃষ্ণজীর উদ্দেশ্য । ইহার জন্য বলেছেন যে পরমাত্মাকে অর্পণ করে কর্ম করো অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম করো । কারণ নিষ্কাম কর্ম করার নামই সন্ন্যাস। "যস্ত কর্মফলত্যাগী স ত্যাগী ভিধীয়তে " গীতা ১৮।১১ এই শ্লোকে বলছেন যে, যিনি কর্মের ফল ত্যাগ করেন তিনিই ত্যাগী। এবং দেহধারী সর্বদা কর্ম কে কদাপি ছড়াতে পারে না। এই প্রকারে এখানে সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা শব্দ দ্বারা নিষ্কামকর্মী সিদ্ধ হয়। এবং এখানে ঈশ্বরকে অর্পণ একমাত্র নিষ্কামকর্মীর অভিপ্রায়। অদ্বৈতবাদীর সাথে এখানে একটা ভেদ আছে যে- "মাং উপৈষ্যসি" অর্থাৎ তুমি ব্রহ্ম হয়ে যাবে। কিন্তু কৃষ্ণজীর উদ্দেশ্য হচ্ছে তুমি ঈশ্বরের শরণ প্রাপ্ত হবে।

প্রকৃত পক্ষে ঐ শ্লোকে কি বুঝানো হয়েছে তা শতপথ ব্রাহ্মণের নিচের বর্ণনা থেকে বুঝা যায়। শতপথ ব্রাহ্মণের বর্ণনা অনুসারে-

তদ্ধৈতজ্জনকো বৈদেহঃ যাজ্ঞবল্ক্যং পপ্রচ্ছ। বেত্থাগ্নিহোত্রং যাজ্ঞবল্ক্যা৩ ইতি বেদ সম্রাডিতি কিমিতি পয় এবেতি - ১১.৩.১.[২]

যৎপয়ো ন স্যাৎ। কেন জুহুয়া ইতি ব্রীহিয়বাভ্যামিতি যদ্ব্রীহিয়বৌ ন স্যাতাং কেন

জুহুয়া ইতি যা অন্যা ওষধয় ইতি যদন্যা ওষধয়ো ন স্যুঃ কেন জুহুয়া ইতি যা আরণ্যা ওষধয় ইতি যদারণ্যা ওষধয়ো ন স্যুঃ কেন জুহুয়া ইতি বানস্পত্যেনেতি যদ্বানস্পত্যং ন স্যাৎকেন জুহুয়া ইত্যদ্ভিরিতি যদাপো ন স্যুঃ কেন জুহুয়া ইতি - ১১.৩.১.[৩]

স হোবাচ। ন বা ইহ তর্হি কিং চনাসীদথৈতদহূয়তৈব সত্যং শ্রদ্ধায়ামিতি বেত্থাগ্নিহোত্রং যাজ্ঞবল্ক্য ধেনুশতং দদামীতি হোবাচ - ১১.৩.১.[৪]

 শতপথ ব্রাহ্মণ ১১।৩।১।২-৪

অনুবাদঃ মহারাজা জনক ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন- "হে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য! তুমি কি যজ্ঞকে (অগ্নিহোত্র) জান?

উঃ হ্যাঁ জানি, রাজন্।

প্রঃ কী রকম?

উঃ কেবল দুধ।

প্রঃ যদি দুধ না থাকে তাহলে কি দিয়ে আহুতি দিবে?

উঃ ধান বা যব।

প্রঃ যদি ধান বা যব না থাকে তাহলে?

উঃ অন্য ওষধীযুক্ত দ্রব্য।

প্রঃ যদি ওষধীযুক্ত দ্রব্য না থাকে?

উঃ জঙ্গলের ওষধীদব্য।

প্রঃ যদি তা না থাকে?

উঃ জঙ্গলের গাছপালা।

প্রঃ যদি তাও না থাকে?

উঃ তাহলে জল দিয়ে।

প্রঃ যদি জল না থাকে?

উঃ হে রাজন্! যদি কিছুই না থাকে, তবুও যজ্ঞ করা

উচিত। কেবল শ্রদ্ধায় সত্যের অগ্নিহোত্র করুন । 

এই রকম আনন্দদায়ক সংলাপে যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় হব্য পদার্থের উল্লেখ ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য করেছেন। এর অর্থ হল যদি যজ্ঞ সামগ্রীর প্রত্যেক বস্তু নাও থাকে, এই অবস্থায় যা আছে, তা দিয়েই যজ্ঞ করা উচিত । ঠিক এই রকম বাণী ঋগ্বেদেও পাই আমরা । সেখানে বলা হয়েছে-

নহি মে অস্ত্যঘ্ন্যা ন স্বধিতির্বনন্বতি ।
অথৈতাদৃগ্ভরামি তে ॥১৯॥
যদগ্নে কানি কানি চিদা তে দারূণি দধ্মসি ।
তা জুষস্ব যবিষ্ঠ্য ॥২০॥
যদত্ত্যুপজিহ্বিকা যদ্বম্রো অতিসর্পতি ।
সর্বং তদস্তু তে ঘৃতম্ ॥২১॥
অগ্নিমিন্ধানো মনসা ধিয়ং সচেত মর্ত্যঃ ।
অগ্নিমীধে বিবস্বভিঃ ॥২২॥

ঋগ্বেদ ৮.১০২.১৯-২২

অনুবাদঃ I have neither total immunity nor any essential power of my own, neither milk nor ghrta, nor even the fire fuel to offer. Hence I adore and worship you the way I can, offer you myself for the service I am worth.

Agni, whatever little fuel we possess, whatever potential to destroy the evil and negativities of life, we offer in service. Whatever weaknesses we possess, we offer into your powers of fiery purification. O power most youthful, pray accept all that with pleasure.
Whatever your flames of fire consume, whatever the fumes spread over, let all that be food for your dynamics of existence in evolution.
When the mortal starts lighting the fire in the vedi, let him, with his whole mind in concentration, call up all his faculties of perception, thought and action and say: I light the fire with all my light, will and awareness and awaken the divine in the soul.

এরপরও যারা বলবেন যে এখানে পূর্জার কথাই বলা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে প্রকৃত অর্থে পূজা কি তা দেখুন একবার। প্রশ্ন হল পূজা করা উচিত নয় বুঝি? হ্যাঁ, পূজা করতে হবে! তবে সে পূজা কেমন জানেন? জড় মূর্তির পূজা জড়ে মত, আর চেতন মূর্তির পূজা চেতনের মত করা উচিত। পূজা শব্দের ধাতুগত ও ব্যবহারিক প্রভৃতি কয়েক প্রকারের অর্থ হয়। পূজা অর্থ আদর,যত্ন করা। যাকে সংস্কৃততে সৎকা বলে। কোন বস্তুর যথাযথ ব্যবহার, রক্ষা ও কাউকে যথাযথ দান দেওয়াকেও পূজা বলে। এবার একটু বিচার বিবেচনা করে জড়মূর্তি পূজার অর্থ চিন্তা করে দেখুন। জড়মূর্তির পূজা মান সেই বস্তুকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা। মূর্তিটিকে এমন স্থানে রাখা যেখানে সেই মূর্তিটির কোন প্রকার ক্ষতি না হয়। মানে ভেঙ্গে না যায় বা ময়লা না হয় বা তার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট না হয় বা অবহেলিত হয়ে না থাকে ।এখানে মূর্তি পূজার অর্থ জড়মুর্তির যথাযথ উপযোগ,উচিত রক্ষণাবেক্ষণ । পূজা মানে এই নয় যে, প্রত্যেক বস্তুর সামনে ঢিপ ঢিপ করে মাথা ঠুকে তাতে ফুল বেলপাতা , তুলসীপাতা,ফল মিষ্টি ও নৈবদ্য অর্পণ করা। যেমন নাকি একজন আরেক জনকে বললে- 'আরে ভাই! এই সাধুজীর পেট পূজা করে দাও।' এর মানে এই নয় যে সাধুর পেটের উপর কিছু ফুল তুলসী বেলপাতা ও মন্ডা মিষ্টি রেখে প্রণাম করা! বরং এর মানে হলো সাধুকে ভালো করে খাইয়ে সন্তুষ্ট করা। আবার এক জন আরেক জনকে বলল- এই গুন্ডা বা চোরটাকে একটু পিঠ পূজা করে দাও তাহলে সে শান্ত হবে! এখানে কি এর মানে হবে ঐ গুন্ডা বা চোরের পিঠের উপর কিছু ফুল তুলসী বেলপাতা ও মিঠাই মিষ্টি রেখে প্রণাম করা ? বরং এর মানে হল তার পিঠের উপর লাঠি দিয়ে কষে কিছু মার দেওয়া। দেখলেনতো এক জায়গায় পূজার অর্থ খাওয়ানো ও অন্য জায়গায় মার দেওয়া। ঠিক তেমনি জড়মূর্তির পূজার অর্থ- মূর্তিকে যথা স্থানে রাখা যেন তার চাকচিক্য নষ্ট না হয়, ময়লা না জমে। জড়মূর্তির সামনে ফুল তুলসী বেলপাতা ও মিঠাই মিষ্টি দিয়ে তাকে ঈশ্বর আছেন ভেবে মাথা ঠুকে প্রণাম করার অর্থ মূর্তি পূজা নয়। কেননা জড়মুর্তিতে সে যোগ্যতা নেই যে, সে তোমার ফুল ফল মিঠাই মিষ্টি খাবে। যত সজীব ও চেতন মূর্তি আছে এ জগতে,যথা- মাতা, বাবা, গুরু, অতিথি,সন্ন্যাসী, উপদেশক বা অন্য প্রাণী, এরা সবাই ফল মূল মিঠাই মিষ্টি পেয়ে লাভবান হয়। আর এই সব দ্বারা এদের পূজা করা উচিত। এখানে পূজা অর্থ আদর যত্ন করা। সংস্কৃততে যাকে সৎকার বলে। আর এর নাম হল সজীব মূর্তি পূজা। এখন অনেকে এর বিরূদ্ধেও গলা উঁচিয়ে কথা বলবে, তাই আমার কথাগুলো যে ঠিক তার জন্য পূজা সম্পর্কে তাদের জন্য কিছু উদাহরণ দেখাবো মনুস্মৃতি থেকে! দেখুন নারীদের পূজা করার কথা-


পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা ।

পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণং ঈপ্সুভিঃ । । ৩.৫৫ । ।

যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ ।

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ । । ৩.৫৬ । ।

শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যত্যাশু তৎকুলম্ ।

ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্ধতে তদ্ধি সর্বদা । । ৩.৫৭ । ।

জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ

তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ । । ৩.৫৮ । ।

তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ ।

ভূতিকামৈর্নরৈর্নিত্যং সৎকরেষূৎসবেষু চ । । ৩.৫৯ । ।

মনুস্মৃতি ৩।৫৫-৫৯

অনুবাদঃ  যে কুলে নারীদের পূজা অর্থাৎ সম্মান হয়, সেই কুলে দিব্য গুণ, দিব্য ভোগ ও উত্তম সন্তান হয় এবং যে কুলে নারীদের পূজা হয় না, সেইখানে তাহাদের সব ক্রিয়া নিষ্ফল হয় জানিবে । যে বংশে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্র অলঙ্কার ইত্যাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন থাকেন। আর যে বংশে স্ত্রীলোকদের পূজা বা সমাদর নেই, সেখানে সমস্ত কাজই নিষ্ফল হয়ে যায়। পিতা, ভ্রাতা পতি ও দেবরের পক্ষে যথাক্রমে স্বীয় কন্যা, ভগ্নী, স্ত্রী ও ভ্রাতৃবধূ আদি স্ত্রী কে সর্বদা পূজা করা উচিত অর্থাৎ যথাযোগ্য মধূর ভাষণ, ভোজন, বস্ত্র ও অলঙ্কারাদিদ্বারা প্রসন্ন রাখিবে। যাহারা কল্যাণ কামনা করে, তাহার স্ত্রীদিগকে কখনও ক্লেশ দিবে না । যে কুলে নারীরা স্ব স্ব পতির বেশ্যাগমনে বা ব্যাভিচারাদি দোষে শোকাতুর থাকে, সেই কুল শীঘ্র বিনাশ প্রাপ্ত হয় এবং যে কুলে নারীরা পতির সদ্ব্যবহারে প্রসন্না থাকে সেই কুল সর্বদা উন্নতি লাভ করে। যে কুলে ও গৃহে নারীরা অপূজিত হইয়া অর্থাৎ সম্মানিত না হইয়া যে গৃহস্থকে শাপ প্রদান করে, সেই কুল ও গৃহস্থ, বিষপ্রয়োগে অনেকে যেরূপ এক সঙ্গে বিনষ্ট হয়, সেইরূপ চারিদিক হইতে নষ্ট হইয়া যায়। এই জন্য ঐশ্বর্য্যকামী পুরুষদের পক্ষে উচিৎ যে, স্ত্রীদিগকে উৎসব ও শুভানুষ্ঠান উপলক্ষে অলঙ্কার, বস্ত্র ও পানাহারাদিদ্বারা সদা পূজা করিবে অর্থাৎ সম্মান পূর্বক প্রসন্ন রাখিবে।


দেখলেন তো এক এক জায়গায় পূজার অর্থ এক এক রকম? তাছাড়া গীতার ঐ শ্লোকে পূজা শব্দই নেই। তারপরেও পাঠকের বোধগম্যতার জন্য এই উদাহরণ দেওয়া হলো । 

আশা করি পাঠকের নিকট তাৎপর্য স্পষ্ট যে উক্ত শ্লোকে মূলতঃ নিষ্কাম ভাব ও যজ্ঞই প্রতিপাদিত হয়েছে । 


প্রশ্নঃ গীতা ৩।১১-১৩ এ ভগবান বলেছেন দেবতাদের পূজা করে যারা না খায় তারা চোর । 

উত্তরঃ কথাটি সম্পূর্ণ সত্য । দেবতা অর্থ কী তা আমরা প্রথমেই আলোচনা করেছি । 


দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।

পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ ॥ ৩/১১

অর্থ:-এই যজ্ঞ দ্বারা তোমরা দেবদেরকে সংবর্ধনা করো । সেই দেবতারা তোমাদের প্রীতি সাধন করবেন; এভাবে পরস্পর প্রীতি সম্পাদন করলে পরম মঙ্গল লাভ করবে।

এখানে দেব = মাতা-পিতা - আচার্য । তাদের যথাক্রমে অতিথিযজ্ঞ ও পিতৃযজ্ঞের মাধ্যমে সেবা করা হয় । অগ্নিহোত্রের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জড় দেব থেকে আমরা যে উপকার পাই তার বিনিময়ে আমরা তাদের শুদ্ধ রাখি । ভূতযজ্ঞের মাধ্যমে সমস্ত প্রাণীদের যথোচিত সেবা করি যেন আমরা উক্ত উৎসসমূহ থেকে যথাযথ ভোগ্য অবারিত প্রাপ্ত হতে থাকি । অর্থাৎ আমরা যদি সব দেবকে যথাযথ সৎকার - উপযোগিতা প্রদান করি তবে আমরাও সংবর্ধিত হবো । 


ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ।

তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্ক্তে স্তেন এব সঃ ॥ ৩/১২

অর্থ:- যজ্ঞ দ্বারা সংবর্দ্ধিত দেবগণ তোমাদের অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। তাঁদের প্রদত্ত ভোগ্যবস্তু তাঁদের উৎসর্গ না করেই যে ভোগ করে সেই ব্যক্তি নিশ্চই চোর।


সংবর্ধনা = সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে এমন । এই পরমাত্মাই সমস্তকিছুতে বিদ্যমান ও জগতের নিয়ন্তা । তাই দেবতাদের প্রদত্ত ভোগ্যবস্তু পরমাত্মাই দান করেন। সেজন্য দেবতাদের উৎসর্গ করেই সবকিছু ভোগ করা উচিৎ । তৈত্তিরীয় উপনিষদ (৩/১০/৬) বলছে- ‘আমি অন্ন, আমি অন্নভোক্তা; যিনি অন্নরূপী আমাকে দান না করে স্বয়ং ভোজন করে, আমি তাঁকে ভক্ষণ (বিনাশ) করি । মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী যজ্ঞের তাৎপর্য বিশ্লেষণে ঋগ্বেদাদিভাষ্যভূমিকায় লিখেছেন - 


এই শ্লোকে যে দেব ঋণ শোধ না করে তাহাকে পাপী বলা হয়েছে অর্থাৎ যে কেবল নিজেরজন্য দ্রব্যোপার্জন করে এবং দেব বা বিদ্বানকেসেবা না করে সে পাপ ভোজন করে। ইহা দ্বারা স্পষ্ট যে উক্ত শ্লোকে দেবঋণ শোধ করার কথা বলা হয়েছে। যদি পৌরাণিক ইন্দ্রাদি দেবের কথন হয় তবে যজ্ঞের শেষ ভোজন করার কি অর্থ ? বিদ্বান কে ভোজন করার পরই যজ্ঞের শেষ হয় । যারা নিজেকে অতিমাত্রায় পণ্ডিত ও ভক্ত ভাবেন তারা বলে আর্যদের আর্যমুনি ব্যাখ্যা করেছে বলেই উপরের ব্যাখ্যাটা ঠিক হবে এমনটা কেন তাদেরকে বলতে চাই যে- আর্যমুনি জী না বললেও বৈদিক শাস্ত্র অনুসারেও প্রকৃত ব্যাখ্যা ঐটাই হয়। তার প্রমাণ দেখুন বৈদিক শাস্ত্র সমূহ থেকে-


পঞ্চ সূনা গৃহস্থস্য চুল্লী পেষণ্যুপস্করঃ ।

কণ্ডনী চোদকুম্ভশ্চ বধ্যতে যাস্তু বাহয়ন্ । ।

তাসাং ক্রমেণ সর্বাসাং নিষ্কৃত্যর্থং মহর্ষিভিঃ ।

পঞ্চ ক্ল্প্তা মহাযজ্ঞাঃ প্রত্যহং গৃহমেধিনাম্ । ।

অধ্যাপনং ব্রহ্ময়ম্যজ্ঞঃ পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পণম্ ।

হোমো দৈবো বলির্ভৌতো নৃযজ্ঞোঽতিথিপূজনম্ । ।

মনুস্মৃতি ৩।৬৮-৭০ 

অনুবাদঃ চুল্লী, জাঁতা বা শিল নোড়া, উপস্কার বা হাড়িকড়া, কন্ডনী বা ঢেকি ও কলসী এই পাঁচটির নাম সূনা বা পশুবধস্থান। এগুলো নিয়ে কাজ করতে গেলে অজ্ঞাতসারে যে প্রাণিহিংসা ঘটে, তার জন্য গৃহস্থকে পাপে লিপ্ত হতে হয় ।  

উপরোক্ত পাঁচটি থেকে উৎপন্ন পাপের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহর্ষিগণ গৃহস্থদের পক্ষে যথাক্রমে পাঁচটি মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানের বিধান দিয়েছেন। 

বেদাদি অধ্যায়ন ও অধ্যাপনার নাম ব্রহ্মযজ্ঞ, অন্ন উদকাদির দ্বারা জীবিত পিতৃপুরুষদের শ্রদ্ধা সহকারে তপর্ণের নাম পিতৃযজ্ঞ, অগ্নিতে প্রক্ষেপরূপ হোমের নাম দেবযজ্ঞ, পশুপাখি,কৃমি, কুকুর, বেড়াল, অধম, পাপীকে খাওয়ানোর নাম ভূতযজ্ঞ এবং অতিথি সেবার নাম নৃযজ্ঞ বা মনুষ্যযজ্ঞ । 


 মহর্ষি যাস্কাচার্য লিখিত বৈদিক শব্দকোষ নিরুক্তে [৭।১] বলা হয়েছে- 

“য়ৎকাম ঋষির্য়েস্যাং দেবতায়ামার্থপত্যমিচ্ছন্স্তুতিং প্রযুংক্তে তদ্দৈবতঃ স মন্ত্রো ভবতি॥” 

অর্থাৎ যখন ঈশ্বর কোন একটি বিষয়ের সম্বন্ধে আমাদের মন্ত্রের মাধ্যমে শিক্ষা দেন তখন মন্ত্রের সেই বিষয়টিকে দেবতা বলা হয়।


উদাহরণস্বরূপ ঋগ্বেদ ১০।১৫১ এর দেবতা হলো ‘শ্রদ্ধা’ এবং এই সূক্তের আলোচ্য বিষয় হলো ঈশ্বর ও গুরুজনে শ্রদ্ধা বা সম্মান। ঋগ্বেদ ১০।১১৭ এর দেবতা হলো ‘ধনদানপ্রশাংসা’ এবাং এই সুক্তের মন্ত্রসমূহের আলোচ্য বিষয় হলো গরীবদুঃখীদের দানে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। ঋগ্বেদ ১০।১৪৬ এর দেবতা হলো ‘দ্যুতনিন্দা’ এবং তাই এর আলোচ্য বিষয়বস্তু হলো জুয়াখেলার অপকারিতা ও নিষিদ্ধতা। ঋগ্বেদ এর প্রথম মণ্ডলের প্রথম সূক্তের দেবতা হলো ‘অগ্নি’। আজ ম্যাক্সমুলার সহ বিদেশী মিশনারীদের অপপ্রচারের কারণে একে সবাই নির্দিষ্ট আকৃতিযুক্ত আলাদা একটি দেবতা মনে করে, যদিও তা সম্পূর্ণ ভুল।

•  উপযোগের দেব -
এই তেত্রিশ প্রকার দেব এর মধ্যে কেবল জীবাত্মা চেতন। ইহা অন্যের উপযোগ করে অথবা স্বয়ং অন্য জীবাত্মার উপযোগে আসে। যেমন গাভী দুধ দিয়ে, ভেড়া ঊণ [লোম] দিয়ে, ষাঁড় হাল চাষের উপযোগে আসে। তেমনি সৈনিক, বৈদ্য আদিও উপযোগে আসে। জীবাত্মার অতিরিক্ত শেষ বত্রিশ দেব জড় এবং উপযোগের দেব বলা হয়।


•  ব্যবহারের দেব -
মাতা, পিতা,আচার্য, অতিথি এবং পতি-পত্নী দ্বারা সংসারের ব্যবহার সিদ্ধ হয়। এ জন্য এই পাঁচ কে ব্যবহারের দেব বলা হয়।

এই পাঁচজন বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষ দেব-দেবী। তৈত্তিরীয় উপনিষদেও আমরা এইরূপ দেবতাদেরই দেখতে পাই এবং তাদের পূজনের কথা পাই। “মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব, আচার্য়দেবো ভব, অতিথিদেবো ভব।” তৈত্তিরীয় উপনিষদ ১।১১।২। তবে দেব হবেন তিনিই, যাঁর মধ্যে উত্তম গুণাবলী তথা বিভিন্ন দৈবী সম্পদ [গীতা ১৬।১-৩] রয়েছে। পিতামাতা, আচার্য, পতি-পত্নী প্রত্যেকে আদর্শ আচরণ না করলে তারা দেব হিসেবে আখ্যার যোগ্য হবেন না।

গীতার ঐ শ্লোকগুলোতেও বলা আছে যে যজ্ঞ সম্পন্ন হলে দেব বা বিদ্বান ইষ্টকে অর্থাৎ যজ্ঞ সম্পন্নকারীকে ফল দান করবেন। অর্থাৎ গীতা ও মনুস্মৃতিতে যে দেবযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে তা নিরুক্ত অনুসারে মূলত বিদ্বান মানবদের ও পরিবেশের শুদ্ধিকারী দেবযজ্ঞের কথা । 

আর এই ধরণের যজ্ঞ কেন করবেন ও করলে কি হয় তাও একবার দেখুন-


অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জন্যো যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ ॥ ৩/১৪
অর্থ:
সকল প্রাণী অন্ন থেকে উৎপন্ন হয়, অন্নের উৎপত্তি হয় বৃষ্টি থেকে , বৃষ্টি হয় যজ্ঞ দ্বারা এবং যজ্ঞ কর্ম দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে।

কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥ ৩/১৫
অর্থ: 
কর্ম বেদ থেকে উৎপন্ন বলে জানবে। বেদ অবিনাশী অক্ষর  থেকে উৎপন্ন। সেজন্য সর্বব্যাপী ব্রহ্ম  নিত্য (সবসময়) যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।

অক্ষর শব্দে ক্ষয় রহিত পরমাত্মাকে বুঝানো হয়েছে (মুণ্ডক উপনিষদ : ১/১/৭)। রাচীন টীকাকারেরা বলেছেন - ব্রহ্ম শব্দে এখানে বেদ বুঝতে হবে এবং অক্ষর শব্দে পরমাত্মা। তবে কেউ কেউ প্রথম চরণে ব্রহ্ম শব্দে বেদ বুঝেছেন, দ্বিতীয় চরণে ব্রহ্ম শব্দে পরমব্রহ্ম বুঝেছেন। তা না হলে অর্থের অসঙ্গতি হয়। কিন্তু শঙ্করাচার্য দ্বিতীয় চরণেও ব্রহ্ম শব্দে বেদ বুঝেছেন। অর্থাৎ ‘বেদ সর্বার্থ প্রকাশক হেতু নিত্য যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত।’ তবে এজন্য মূল তাৎপর্যের কোনো সমস্যা হয় না। পাঠক যেকোনো একটি অনুবাদ গ্রহণ করতে পারে। আমরা এই স্থানে  শ্রীধর স্বামী, কেদারনাথদত্ত, বিশ্বনাথ ইত্যাদি বহু প্রচলিত টীকাকারের অর্থ গ্রহণ করেছি ।

এবং প্রবর্তিতং চক্রং নানুবর্তয়তীহ যঃ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি ॥ ৩/১৬
অর্থ:
হে পার্থ (অর্জুন)! যে এই পৃথিবীতে এই প্রকার প্রবর্তিত চক্র অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ ভোগী পাপময় ব্যর্থ জীবন ধারণ করে।

‘প্রবর্তিত’ শব্দে উপরে উল্লেখিত কর্মকে বুঝানো হয়েছে। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন যে, গীতা ও বৈদিক গ্রন্থসমূহে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবতা পূজা বলতে কি বুঝানো হয়েছে ।

যজ্ঞাশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ।

ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ ॥ ৩/১৩

অর্থ:- যজ্ঞে অবশিষ্ট অন্নের ভোগকারী শ্রেষ্ঠ মানুষেরা সকল পাপ থেকে মুক্ত হন। আর যে পাপী (শুধুমাত্র) নিজের শরীর পালনের জন্য পচন [ রান্না ] করে তারা তো পাপকেই ভোজন করে।

এখানে ‘যজ্ঞ’ শব্দে পঞ্চমহাযজ্ঞ বুঝানো হয়েছে। 

  • ১। ব্রহ্মযজ্ঞ (শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং সন্ধ্যোপাসনা), 
  • ২। দেবযজ্ঞ (হবন অর্থাৎ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে যে যজ্ঞ করা হয়), 
  • ৩। পিতৃযজ্ঞ (পিতা-মাতা সহ গুরুজনদের শ্রদ্ধার সাথে সেবা করা), 
  • ৪। অতিথিযজ্ঞ (ধর্মাত্মা অতিথিদের সেবা করা), 
  • ৫। ভূতযজ্ঞ (প্রাণীদের সেবা করা) ⎯এই পাঁচ প্রকার যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর অবশিষ্ট অন্ন ভোগকারী পাপমুক্ত হয় । 

 

ঋগ্বেদ ১০.১১৭.৬ এবলা হয়েছে - 

 

মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ সত্যং ব্রবীমি বথ ইতস তস্য৷ 
নার্যমণং পুষ্যতি নো সখায়ং কেবলাঘো ভবতি কেবলাদী।।
- উদার চিত্তরহিত, অদূরদর্শী, ক্ষুদ্রজ্ঞানী ব্যক্তির ধন উপার্জন ও অন্নাদি ভোজন সবই ব্যর্থ হয়। আমি সত্য বলছি যে,  ঐসব ধন বৈভব তার জন্য মৃত্যুস্বরূপ। যে ব্যক্তি অন্নাদি দ্বারা বিদ্বান ব্যক্তি অথবা তার আত্মীয় স্বজনকে পালন পোষণ করে না, প্রকৃতপক্ষে সেই একলা ভোজনকারী ব্যক্তি শুধু পাপই ভোজন করে অর্থাৎ সে পাপী হয়৷।

উক্ত শ্লোকের ভাব মনুস্মৃতিতেও সরাসরি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে - 

পঞ্চৈতান্যো মহাঅয়জ্ঞান্ন হাপয়তি শক্তিতঃ ।

স গৃহেঽপি বসন্নিত্যং সূনাদোষৈর্ন লিপ্যতে ।

মনুস্মৃতি ৩।৭১ 

অনুবাদঃ যে গৃহস্থ প্রতিদিন পূর্বোক্ত পাঁচটি মহাযজ্ঞ যথাসম্ভব পরিত্যাগ না করেন, তিনি গৃহস্থাশ্রমে বাস করেও সূনা বা পশুবধস্থান জনিত দোষে লিপ্ত হন না ।