শঙ্কা. ১১ - কর্ম করার সময় ফলের আশা কী কারণে করা যাবে না ? এতে কীরূপ হানি হবে?
সমাধানঃ
কর্ম করার সময়ে মনে ফলের আশা করা উচিত নয়, কারণ ফল কখনও আমাদের ইচ্ছার
অনুকূলও হয়ে থাকে তথা কখনও প্রতিকূল । ইহা আবশ্যক নয় যে, ফলের বিষয়ে
আমরা মনে যেমন ইচ্ছা পোষণ করে থাকি ফল প্রাপ্তি তদ্রূপই হোক । অনুকূল
ফল প্রাপ্তির মাধ্যমে মনুষ্যের সুখ প্রাপ্ত হয় এবং প্রতিকূল ফলের মাধ্যমে
দুঃখ প্রাপ্তি করে থাকে । ফল প্রাপ্তিতে মনুষ্যের কোনোরূপ প্রভাব নেই । ফল
ইচ্ছার অনুরূপ প্রাপ্তি হওয়া অথবা ইচ্ছার প্রতিকূল প্রাপ্তি হওয়া
বিবিধ কারণের আধারে নির্ভর করে ।
মনুষ্য
এসব বিবিধ কারণের বিশেষ জ্ঞান সম্বন্ধে অজ্ঞাত । আমাদের শুধুমাত্র কর্ম
করার সক্ষমতা রয়েছে; কর্মের তদনুরূপ ফল প্রাপ্ত হওয়ার কিঞ্চিৎ অংশও
আমাদের হাতে নেই । এ কারণে দার্শনিক দৃষ্টিতে আমরা কর্ম করতে থাকি এবং “ইদন্ন মম”
অনুধ্যানে ফল প্রাপ্তির ইচ্ছা পরমাত্মার প্রতি সমর্পণ করি । পরম পিতা
পরমেশ্বর যখন, যেমন, যতটুকু চান তখন, তেমন, ততটুকুই ফল প্রদান করবেন ।
গীতায়ও [২।৪৭] ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন --
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ।
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি॥”
অর্থাৎ,
স্বধর্ম বিহিত কর্মে তোমার অধিকার রয়েছে, কিন্তু কোনো কর্মফলে তোমার
অধিকার নেই। কখনও নিজেকে কর্মফলের হেতু মনে করো না, এবং কখনও স্বধর্ম আচরণ
না করার প্রতিও আসক্ত হয়ো না।
অনেকবার
আমরা নির্ধারণ করে থাকি যে, যদি আমি অমুক কর্ম করি তো অমুক দণ্ড ভোগ
করবো এবং যদি সেই কর্ম করার পর সেই দণ্ড ভোগ করি তো আমাদের দৃষ্টিতে
নির্ধারিত ফল দ্বারা ন্যূনাধিক পূর্তি ঈশ্বর করে থাকেন । কিন্তু বাস্তবিক
সত্য এই যে, কর্মফলের উপর আমাদের কিঞ্চিৎও অধিকার নেই ।
শঙ্কা. ১২ - ঈশ্বর কী জীবাত্মাকে সৎ-অসৎ কর্ম করার প্রেরণা প্রদান করে থাকেন ?
সমাধানঃ
ঈশ্বর জীব কর্তৃক কৃত কর্মের প্রেরক নন । যদি ঈশ্বর মনুষ্যের কর্মের
প্রেরক হতেন, তাহলে ভালো-মন্দ কর্মের ফলও ঈশ্বরই প্রাপ্ত হতেন; জীব কেন
প্রাপ্ত হবে ?
যদি কর্ম করার প্রেরণা ঈশ্বর প্রদান করেন এবং ফল জীব ভোগ করে, তাহলে ঈশ্বর “অকৃতাভ্যাগম”
এর দোষে তুষ্ট হবেন । বৈদিক সিদ্ধান্ত এই যে, স্বীয়কৃত কর্মফল নিজেকেই
ভোগ করতে হবে ; অন্যকে নয় এবং অপর মনুষ্য কৃত কর্মফল অপরকেই ভোগ করতে
হবে; নিজেকে নয় ।
জীবাত্মা
ইচ্ছা, রাগ-দ্বেষ, সুখ-দুঃখ প্রযত্ন আদি গুণসমূহ দ্বারা যুক্ত চেতন তত্ত্ব
। জীব পরমেশ্বরের হাতের পুতুল নয় যে, ঈশ্বর যেমন ইচ্ছা করবেন জীব তেমন
ক্রিয়া করবে । জীব স্বতন্ত্র সত্তা এবং স্বীয় কর্মে পূর্ণরূপে স্বাধীন ।
যদি জীব স্বয়ং কর্তা না হতো, তাহলে ভোক্তাও হতো না ।
হ্যাঁ,
ইহা বোধ করা আবশ্যক যে, যখন জীবাত্মা তার স্বীয় অন্তরিন্দ্রিয়ে কোনো
সৎ অথবা উত্তম কার্য সম্পন্ন করার ইচ্ছা পোষণ করে বা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন
পরমাত্মা সেই উত্তম কার্য সম্পন্ন করার জন্য উৎসাহ, প্রসন্নতা, নির্ভয়তা
আদি ভাবনা প্রদান করে থাকেন । এর বিপরীত যখন জীবাত্মা অসৎ কার্য করার জন্য
মনস্থির করে, তখন ঈশ্বর তার অন্তরিন্দ্রিয়ে ভয়, শঙ্কা, লজ্জা আদি ভাবনা
প্রদান করে থাকেন । এই ভাবনা জীবাত্মার অন্তরিন্দ্রিয়ে কোনো সৎ-অসৎ কর্ম
করা বা না করার ইচ্ছা পোষণের পর হয়ে থাকে, পূর্বে নয় । যদি পরমেশ্বর
কার্য করার পূর্বেই জীবকে প্রেরণা প্রদান করেন, তাহলে শাস্ত্রে বর্ণিত
বিবিধ বিধান এবং নিষেধ ব্যর্থ হয়ে যায় । অর্থাৎ এসব বিধানের কোনো প্রকার
আবশ্যকতা থাকতো না ।
“কৃতপ্রয়ত্নাপেক্ষস্তু বিহিতপ্রতিষিদ্ধাবৈয়র্থ্যাদিভ্যঃ” [বেদান্ত দর্শনঃ ২।৩।৪২]
শঙ্কা. ১৩ - ঈশ্বর কী জীবাত্মাকে তাঁর স্বীয় ইচ্ছা অনুসারে যেমন চান তেমনই ফল প্রদান করেন ? অর্থাৎ কাউকে সৎ, তো কাউকে অসৎ, কাউকে ধনবান, তো কাউকে ধনহীন, কাউকে রূপবান, তো কাউকে রূপহীন , কাউকে বুদ্ধিমান,তো কাউকে মূর্খে পরিণত করেন ?
সমাধানঃ
ঈশ্বর তাঁর স্বীয় ইচ্ছায় কোনো মনুষ্যকে বিনা কর্মে সুখ অথবা দুঃখরূপে
ফল প্রদান করেন না । যদি পরমাত্মা স্বীয় ইচ্ছায় মনুষ্যকে সুখ-দুঃখ প্রদান
করতেন, তাহলে কর্মের কোনো মহত্ত্বই থাকতো না । বেদাদি শাস্ত্রে সৎ কর্ম
করার তথা অসৎ কর্ম না করার সর্বথা আদেশ দেওয়া হয়েছে।
“ইন্দ্র ক্রতুং ন আ ভর পিতা পুত্রেভ্যো যথা। জ শিক্ষা ণো অস্মিন্ পুরুহূত যামনি জীবা জ্যোতিরশীমহি ॥” [ ঋগ্বেদ.৭।৩২।২৬ ]
“অক্ষৈর্মা দীব্যঃ কৃষিমিৎকৃষস্ব বিত্তে রমস্ব বহু মন্যমানঃ” । [ ঋগ্বেদ. ১০।৩৪।১৩ ]
অর্থাৎ তুমি কখনও জুয়া খেলো না ; কৃষিকাজ করো । পরিশ্রম দ্বারা প্রাপ্ত ধনকে পর্যাপ্ত মেনে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো ।
“মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্” । [ যজু. ৪০।১ ]
কারও ধনের প্রতি লোভ করো না ।
সৎ
কর্ম করার তথা অসৎ কর্ম না করার বিধানে ইহা স্পষ্ট যে, জীবাত্মা কর্মে
স্বতন্ত্র । তার স্বীয় স্বতন্ত্রতা দ্বারা কৃত কর্মের ফলই সে ঈশ্বরের
ব্যবস্থা দ্বারা প্রাপ্ত হয়ে থাকে ।
ঈশ্বর
তাঁর স্বীয় ইচ্ছা ব্যতিরেকেই জীব কর্ম সম্পাদনে সক্ষম। বিনা কর্মে কাউকে
সুখ অথবা দুঃখ প্রদানে তিনি অন্যায়ী সিদ্ধ হবেন। ঈশ্বর এমনটা করবেন না,
তিনি ন্যায়কারী । ন্যায়কারী তিনিই, যিনি জীবের কর্মানুসারে ফল প্রদান করে
থাকেন । ঈশ্বর ন্যায়কারী হওয়ায়, জীবের জন্য সৎ-অসৎ কর্ম করার, না করার
বিধান থাকায় অর্থাৎ জীবাত্মা কর্মে স্বতন্ত্র সিদ্ধ হওয়ায়, ঈশ্বর তাঁর
ইচ্ছায় বিনা কর্ম অপেক্ষা কাউকে সুখ-দুঃখরূপী ফল প্রদান করেন না কদাপি।
শঙ্কা. ১৪ - ফল না দিয়েও কি কর্মের নাশ করা যায় ?
সমাধানঃ না, ফল না দিলেও কর্মের কখনো বিনাশ হয় না।
“অবশ্যমেব ভোক্তব্যং কৃতং কর্ম শুভাশুভম্।” [মহাভারত]
“নাভুক্তং ক্ষীয়তে কর্ম কল্পকোটিশতৈরপি॥” [অত্রি স্মৃতি]
অর্থাৎ,
সহস্র ধেনুর মধ্যে গোশাবক যেমন নিজের মাতাকে চিহ্নিত করতে পারে;
তদ্রূপভাবে কৃত কর্ম কৃতকারীর পিছু নেয়। যতই কেউ হাত জোর করুক,
গড়াগড়ি করুক, গ্লানি, দুঃখ পশ্চাত্তাপের অনুভূতি অনুভব করুক,
দান-দক্ষিণা প্রদান করুক, তীর্থ যাত্রা করুক, জপ করুক, যজ্ঞ-তপ করুক,
সেবা, পরোপকার, সামাজিক কল্যাণ আদি কার্য করুক না কেন, কৃত কর্মের ফল
ভোগ বিনা মুক্তি কদাপি অসম্ভব।
“য়থা ধেনুসহস্রেষু বৎসো গচ্ছতি মাতরম্ । তথা য়চ্চ কৃতং কর্ম কর্ত্তারমনুগচ্ছতি ॥”
[চাণক্যনীতি. ১৩।১৪]
অর্থাৎ
কর্ম শুভ হোক বা অশুভ, কর্ম সম্পন্ন জ্ঞানপূর্বক অবস্থায় করা হোক বা
অজ্ঞানপূর্বক অবস্থায়, কৃত কর্মের ফল অবশ্যই ভুগতে হবে । কোটি-কোটি জন্ম,
কল্প,সৃষ্টিও অতিক্রান্ত হোক না কেন, বিনা ফল ভোগে কৃত কর্মের ক্ষয়
অসম্ভব । “দৃষ্টাদৃষ্টপ্রয়োজনানাং দৃষ্টাভাবে প্রয়োজনমভ্যুদয়ায় ।” [বৈশেষিক.৬।২।১]
অর্থাৎ
দৃষ্ট-অদৃষ্ট ফল উপভোগের নিমিত্তে কৃত কর্মের ফল যদি তৎকাল সেই সময়েই
প্রাপ্ত না হয়, তাহলে সেই কর্মের ফল নিমিত্ত কর্ম (প্রয়োজন) অভ্যুদয়ায়
(তৎকাল থেকে অতিরিক্ত) বর্তমান তথা ভাবী উৎকর্ষের ভোগের জন্য অবশিষ্ট থাকে
। বর্তমান জন্ম বা পরবর্তী জন্মে ভোগ করা হয়ে থাকে ।
যোগ দর্শন. ২।১৩ নং সূত্রের ব্যাস ভাষ্য উদ্ধৃতি করে অনেকেই দাবি করে থাকে যে, ফল ভোগের নিয়ম এরূপ হলে কৃত কর্ম নষ্ট প্রাপ্ত হয় ।
“যত্ত্বদৃষ্টজন্মবেদনীয়ং
কর্মানিয়তবিপাকং তন্ত্রশ্যেদাবাপং বা গচ্ছেদভিভূতং বা চিরমপ্যুপাসীত
যাবৎসমানং কর্মাভিব্যঞ্জকং নিমিত্তমস্য ন বিপাকাভিমুখং করোতীতি ।”
অর্থাৎ ওইরূপ কর্ম যেটির ফল এই জন্মে লাভ হয়নি এবং পরের জন্মও হয়নি; জীব
যখন মুক্তি লাভ করে,ওইরূপ স্থিতিতে যে কর্ম অবশিষ্ট থাকে সেই কর্ম মুক্তি
থেকে ফিরে এসে যখন মানুষের জন্ম লাভ হয় তখন ভোগ করে, ততক্ষণ সেটি ঈশ্বরের
জ্ঞানে থাকে। এই কর্ম দীর্ঘকাল পর্যন্ত না ভোগার কারণে নষ্ট প্রাপ্ত
হয়েছে, এমনটা দাবি করা হয় । বাস্তবে কর্ম কদাপি বিনষ্ট হয় না ।
শঙ্কা. ১৫ - বেদাদি শাস্ত্রে কী এরূপ বর্ণন হয়েছে, কর্ম না করলে দণ্ড প্রাপ্ত হয় ?
সমাধানঃ
এই বিষয়ে এরূপ জানা আবশ্যক যে, যে কর্ম সামান্যরূপে সব মনুষ্য দ্বারা
অবশ্য করণীয়, যা না করলে মনুষ্যের জীবন সুখী, শান্ত, সন্তুষ্ট প্রাপ্ত
হয় না । বেদ-ভগবান বলেছেন -- “কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছত সমাঃ” [যজুর্বেদ. ৪০।২] কর্ম করে শত বর্ষ পর্যন্ত জীবিত থাকার কামনা করো ।
“অকর্মা দস্যুরভি নো অমন্তুরন্যব্রতো অমানুষঃ । ত্বং তস্যামিত্রহন্বধর্দাসস্য দম্ভয়॥” [ঋগ্বেদ. ১০।২২।৮]
অর্থাৎ
যে কর্ম করে না সে দস্যু; তার কোনও সুখ প্রাপ্তি হয় না; যে ব্রতহীন
সে মনুষ্য নয়। হে ন্যায়কারী ঈশ্বর ! তুমি শত্রুদের ন্যায় তাকে বধ করো
অথবা দাসের ন্যায় তাকে অনুশাসন করো।
বেদাদি
শাস্ত্রে শত-সহস্র প্রকারের কর্ম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।
নির্ধারিত তথা নির্দেশিত কর্ম তৎ-তৎ বর্ণাশ্রমস্থ মনুষ্যদিগের সামান্যরূপে
করার যোগ্য, উচিত, আবশ্যক, লাভকারী কর্তব্য । এই কর্মসমূহ যে মনুষ্য করে
না, সে দোষী হয়ে থাকে । যেমনঃ বেদ এর পঠন-পাঠন সমগ্র মানবজাতির পরম
কর্তব্য । বেদের অধ্যয়ন না করলে সে বাস্তবিক তত্ত্বজ্ঞান থেকে যেমন
বঞ্চিত হবে । ফলস্বরূপ যজ্ঞ-উপাসনা আদি কর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞাত থাকবে ।
তদ্রূপভাবে ঈশ্বর কর্তৃক আরও দণ্ড ভোগ করবে। কেননা বেদের অধ্যয়ন সকলের
আবশ্যক কর্ম ।
শঙ্কা. ১৬ - কর্মফল, কর্মের পরিণাম তথা কর্মের প্রভাব বলতে কী বুঝায় ? এই তিনের মধ্যে কী ভেদ প্রতিপাদন করে ?
সমাধানঃ অনেকেই
সুখ-দুঃখ প্রাপ্তির কারণ হিসেবে কর্মফলকে মেনে থাকে । এটাই ভাবে যে,
মনুষ্যের কর্মের ফল সুখ-দুঃখ আদিরূপে প্রাপ্ত হয়ে থাকে । পরন্তু কর্মের
পরিণাম বা প্রভাবরূপে সুখ-দুঃখ আদি প্রাপ্তি হয়ে থাকে । স্বীয় কর্মের
পরিণাম বা প্রভাব দ্বারাও সুখ-দুঃখের প্রাপ্তি হয়ে থাকে তথা অপর কৃত
কর্মের পরিণাম বা প্রভাব দ্বারাও সুখ-দুঃখ প্রাপ্তি হয়ে থাকে।
এই তিনটির পরিভাষা –
ক.
কর্মফল — কোনো কর্ম সম্পন্ন হওয়ার পর, কর্মের অনুরূপ, সৎ অথবা অসৎ
কর্মের কর্তা, ন্যায়পূর্বকভাবে না স্বল্প না অধিক; ঈশ্বর, রাজা, গুরু,
মাতা-পিতা, স্বামী আদি দ্বারা সুখ-দুঃখ; অথবা সুখ-দুঃখকে প্রাপ্ত করার সাধন
প্রদান করাকে কর্মফল বলে ।
উদাহরণ
– একজন ঘৃত বিক্রেতা ঘৃতে পশুর চর্বি মিশ্রিত করে বিক্রি করে । রাজা
কর্তৃক বন্দি হওয়ার পর রাজা দ্বারা ১৬ বর্ষ কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়েছে
। ইহাই কর্মফল।
খ.
কর্মের পরিণাম — ক্রিয়া করার তৎকাল পশ্চাৎ যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাকে
কর্মের পরিণাম বলে । যে ব্যক্তি বা বস্তু দ্বারা সম্বন্ধিত ক্রিয়া হয়ে
থাকে, কর্মের পরিণাম তৎ ব্যক্তি বা বস্তুর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে ।
উদাহরণ
– চর্বি মিশ্রিত ঘৃত খাওয়ার ফলে শত-শত ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়লো,
স্বাস্থ্যের অবনতি হলো । ইহা উক্ত ঘৃত বিক্রেতার অসদুপায়ের পরিণাম । যে
বা যাহারা এই ঘৃত খেয়েছে তাদের শরীরে এর প্রভাব পড়েছে ; যারা না
খেয়েছে তাদের শরীর সুস্থ আছে ।
গ.
কর্মের প্রভাব — কোনো ক্রিয়া, তার পরিণাম বা ফল নিজের উপর বা অপরের
উপর যে মানসিক সুখ-দুঃখ, ভয়, চিন্তা, শোক আদি প্রভাব পড়ে তাকে কর্মের
প্রভাব বলে । যতক্ষণ পর্যন্ত সম্বন্ধিত ব্যক্তিকে ক্রিয়াদির জ্ঞান প্রাপ্ত
হয় না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপর কোনও প্রভাব পড়ে না ।
উদাহরণ
– বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও শিশু ছুরি হাতে নিয়ে খেলা করছে এবং
খেলতে-খেলতে এক পর্যায়ে ছুরি দিয়ে বাচ্চা নিজের আঙুল কেটে ফেললো । কেটে
যাওয়ায় আঙুল থেকে রক্ত বের হলো । ঐ রক্ত দেখে পাশে বসা আরেকটি শিশু
ক্রন্দন করতে থাকলো । ক্রন্দন শুনে কিঞ্চিৎ দূরে অবস্থিত তার মাতা আসে
এবং যে শিশু ছুরি দিয়ে খেলছিলো, তার আঙুল কাটা এবং রক্ত পড়তে
দেখে । ইহা দেখে মাতা সেই শিশুকে প্রহার করেন । এখানে শিশুর আঙুল কাটা
কর্মের পরিণাম, কেননা এই ক্রিয়া তৎকাল বাদ প্রতিক্রিয়া হয়েছে । পাশে বসে
থাকা অপর শিশুর ক্রন্দন কর্মের প্রভাব, কেননা ঐ শিশুর আঙুল কাটার
পরিণাম-দর্শী সে, রক্ত বের হওয়ার পরিণাম দেখায়, ক্রিয়ার প্রভাব
হয়েছে । মাতা দ্বারা বালক শিশুকে প্রহার করা কর্মফল । কেননা ক্রিয়ার
অনুরূপ আজ্ঞা ভঙ্গের কর্তা শিশুকে প্রহাররূপে দণ্ড দেওয়া হয়েছে ।
কর্মের পরিণাম প্রায়ঃ তৎক্ষণাৎ লক্ষণীয়, পরন্তু প্রভাব বা ফল প্রাপ্তে সময়
লাগে ।
শঙ্কা. ১৭ – ফলের পরিভাষা কী ?
সমাধানঃ
কর্ম ফল সুখ-দুঃখরূপী ভোগের নিমিত্ত । ফল ভোগ সর্বদা কর্তাই প্রাপ্ত
হয়ে থাকে । সুখ-দুঃখরূপী ফল জীবাত্মা শরীর, মন, ইন্দ্রিয় তথা বিষয়ের সহিত
সমন্বয়যুক্ত হয়ে প্রাপ্তি হয়ে থাকে । বিনা শরীর আদি এই সুখ-দুঃখ
প্রাপ্ত হয় না । কর্মও জীব এই সাধন দ্বারা করে থাকে । সংসারে স্ত্রী,
পুত্র, স্বর্ণ, ভূমি, ভবন, সম্মান,পদ, প্রতিষ্ঠা আদি কর্মের ফলরূপে মানা
হয় । এই সব বস্তু বাস্তবে সুখ-দুঃখ প্রাপ্ত করিয়ে থাকে এবং সাধন মাত্র ।
সাধন হওয়ার পর এসবকে ফলের ন্যায় স্বীকৃতি দেওয়া হয় । একারণে ঋষিগণ
সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সকাম কর্মের ফল জাতি (যোনিবিশেষ), আয়ু ভোগ তথা
নিষ্কাম কর্মের ফল মোক্ষ প্রাপ্তি ।
ক. “প্রবৃতিদোষজনিতোঽর্থঃ ফলম্ ।”
[ ন্যায়. ১।১।২০]
রাগ-দ্বেষ যুক্ত কর্ম দ্বারা উৎপন্ন অর্থের নাম ফল ।
খ. “তৎসম্বন্ধাৎ ফলনিষ্পত্তেস্তেষু ফলবদুপচারঃ । ” [ন্যায়. ৪।১।৫৪]
অর্থাৎ
স্ত্রী, পুত্র, স্বর্ণ, ভূমি, ভবন, মান, পদ, প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে
সুখ-দুঃখরূপী ফল প্রাপ্তি হয়। অতঃ স্ত্রী আদিকে ফল স্বরূপ বলা যায় ।
গ. “আত্মেন্দ্রিয়মনোঽর্থসন্নিকর্ষাৎ সুখদুঃখে।” [ বৈশেষিক. ৫।২।১৫]
অর্থাৎ জীবাত্মার মন, ইন্দ্রিয় তথা বিষয়ের সাথে সম্বন্ধ হওয়ার সুখ-দুঃখরূপ ফল প্রাপ্ত হয়ে থাকে ।
অনেকবার
কর্তার ক্রিয়ার পরিণাম, ফল বা প্রভাব কল্পনাও হয় না, পরন্তু যখন ফল
প্রাপ্ত হয়, তখন প্রাপ্ত ফল অনুসারে সে স্বয়ং সুখ-দুঃখ অনুভব হয়ে থাকে ।
শঙ্কা. ১৮ – প্রায়শ্চিত্ত কাকে বলে ? অসৎ কর্মের ফলকে নষ্ট অথবা হ্রাস করা সম্ভব ?
সমাধানঃ মনুস্মৃতিতে "প্রায়শ্চিত্ত" এর পরিভাষা নিম্নরূপ –
“প্রায়ো নাম তপঃ প্রোক্তং চিত্তং নিশ্চয় উচ্যতে । তপো নিশ্চয়সংয়ুক্তং প্রায়শ্চিত্তমিতি স্মৃতম্ ।” [মনুস্মৃতি ]
ভাবার্থ
এই যে, প্রায়ঃ তপ-কে বলা হয় এবং চিত্ত নিশ্চয়-কে বলা হয় । তপ এবং
নিশ্চয়ের সংযুক্ত হওয়াই প্রায়শ্চিত্ত । অর্থাৎ অসৎ কর্ম করার ফলে মনে
গ্লানি, বিষণ্নভাব, দুঃখের অনুভূতি অনুভব করা তথা এমন কর্ম ভবিষ্যতে না
করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করাকে প্রায়শ্চিত্ত বলে । কোনো অসৎ কর্মের প্রায়শ্চিত্ত
করায় সেই কর্মের ফল ভোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব । তবে
প্রায়শ্চিত্ত করার লাভ কী? এর উত্তর এই যে, যদিও প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা কর্ম
ফল নষ্ট হয় না তবুও এর দ্বারা অনেক লাভ হয়। আমরা মন্দ কর্ম করলে তার এক
চিত্র আমাদের মনে তৈরি হয়, যাকে শাস্ত্রে সংস্কার বা বাসনা নামে বলা হয়েছে।
একে আমরা নেগেটিভ (Nagative) বলতে পারি। যেমন একটি নেগেটিভ থেকে পরে অনেক
Photographs (চিত্র) বের হয়, ওইপ্রকার এই সংস্কারকে যখন-যখন জীবাত্মা অনুভব
করে তখন পুনরায় ওইরূপ মন্দ কর্ম করার জন্য মনে ইচ্ছা উৎপন্ন হতে থাকে।
প্রায়শ্চিত্ত
করার ফলে মনে অসৎ কর্মের সংস্কারের প্রভাব পড়ে না এবং অন্য সকল অসৎ
কর্মের যে চিন্তা মনে উদিত হয়, তা নষ্ট হয়ে যায় ।
বস্তুতঃ
অসৎ কর্ম বারংবার করার দরুন এই প্রায়শ্চিত্ত সংস্কারই প্রমুখ ভূমিকা
রাখে। অনেকেই এমন অসৎ কর্ম করে থাকে, তা অন্য মনুষ্যগণের নিকট অত্যন্ত
নিন্দনীয়, কিন্তু সেই অসৎ কর্মের সংস্কার এতোটাই প্রবল যে, সেই অসৎ কর্ম
করার প্রভাব অনেকেরই উপরই পড়ে এবং সেই কর্ম করে থাকে ।
“কৃত্বা পাপং হি সন্তপ্য তস্মাৎপাপাৎপ্রমুচ্যতে । নৈবং কুর্যাৎ পুনরিতি নিবৃত্ত্যাপূয়তে তু সঃ ।।”
[মনুস্মৃতি. ১১।২৩১]
পাপ
করে যদি সন্তাপ উপস্থিত হয় [ অর্থাৎ “আমি প্রমাদবশত এইরকম করে ফেলেছি”
ইত্যাদি প্রকার চিন্তা এবং তার ফলে মনঃপীড়া হয় ], তাহ'লে পাপমুক্তি হ'য়ে
থাকে। পরন্তু “ আমি আর এরকম করবো না ” এই প্রকার মানসিক সঙ্কল্প করলে পাপ
থেকে নিবৃত্তি অর্থাৎ বিরতি ঘটে, এবং পাপকারী পুত হয়।
“সাবিত্রীং চ জপেন্নিত্যং পবিত্রাণি চ শক্তিতঃ । সর্বেষ্বেবব্রতেষ্বেবং প্রায়শ্চিত্তার্থমাদৃতঃ ॥” [মনুস্মৃতি ১১।২২৬]
নিত্য
সাবিত্রীজপ এবং যথাশক্তি অঘমর্ষণাদি পবিত্র সুক্ত জপ করবে।
প্রায়শ্চিত্তের জন্য চান্দ্রায়ণ ছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত ব্রত করা হয়
তাতেও এইভাবে যত্নের সাথে মন্ত্রজপ কর্তব্য।
শঙ্কা. ১৯ – কর্মের ফল কোন সময়ে প্রাপ্ত হয়ে থাকে ? কর্ম করার পর কত সময় পর ফল প্রাপ্ত হয়ে থাকে ?
সমাধানঃ
কর্মফল যেমনভাবে শীঘ্র প্রাপ্ত হয় আবার দেরিতেও প্রাপ্ত হয়ে থাকে ।
ইহা আবশ্যক নয় যে, কর্মফল তৎক্ষণাৎ প্রাপ্ত হবে । কর্মফল প্রাপ্তিকালের
নির্ধারণ কর্মের প্রকার অনুসারে হয়ে থাকে । কোনো কর্মফল তৎক্ষণাৎ প্রাপ্ত
হয়ে থাকে, অপর দিকে কোনো কর্মের ফল প্রাপ্তি কয়েক মাস পশ্চাৎ তথা কয়েক
বর্ষ পশ্চাৎ হয়ে থাকে । যে কর্মফল এই জন্মে ভোগ করা হয় না, তার ফল
পরবর্তী জন্মে প্রাপ্ত হয়ে থাকে ।
উদাহরণ-
শাক-সবজির ফলন ১-২ মাসেই হয়ে থাকে, আমি, কাঁঠাল জাতীয় ফল ১-২ বর্ষে
হয়ে থাকে । সুপারি, নারকেল ৮-৬ বর্ষে হয়ে থাকে । তদ্রূপভাবে কর্ম ফল
ভোগ হয়ে থাকে ।
যেসব
কর্মের ফল মাতা-পিতা, গুরু, আচার্য, সম্বন্ধী, স্বামী, সমাজ, রাজা আদি
দ্বারা প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তার ফল ভোগ এই জন্মেই সমাপ্তি হয়ে যায় ।
কিন্তু যেসব কর্মের ফল উপর্যুক্ত মাতা-পিতা, স্বামী, রাজা আদি ব্যক্তি
দ্বারা স্বল্প প্রাপ্ত হতে হয় বা প্রাপ্ত হওয়া যায় না, তার ফল পরজন্মে
ঈশ্বর কর্তৃক প্রদান করা হয়ে থাকে ।
অনেকেই
এমনটা বলেন এবং মানেন যে, বর্তমান জন্মে কৃত কর্মের ফল ভোগ এই জন্মেই
সম্ভব নয় । বরং পরজন্মে ভোগ করা হয়ে থাকে এবং বর্তমান জন্মে আমরা যে ফল
ভোগ করছি তা সব পূর্ব জন্মের কৃত কর্মের ফল ।
বর্তমান
জন্মে কর্মের কিঞ্চিৎ মাত্রও ফল ভোগ নেই, এই ধারণা সর্বথা অনুচিত ।
বর্তমান জন্মে আমরা যে সুখ-দুঃখ ভোগ করছি তা সব এই জন্মে কৃত কর্মের ফল
নয়, ফল ভোগে পূর্বের অনেক জন্মের কর্মফলও বিদ্যমান এবং যে কর্ম আমরা
বর্তমান জন্মে করছি, তার সমস্ত ফল এই জীবনে ভোগ করবো না । কিছু কর্মফল
ভোগ প্রাপ্তি হবে বর্তমান জন্মেই, অবশিষ্ট কর্মফল পরবর্তী জন্মে প্রাপ্ত
হবে ।
শঙ্কা.২০ – বর্তমান জন্মে কৃত কর্মের ফল এই জন্মেই প্রাপ্তি হবে, এ বিষয়ে শাস্ত্রীয় প্রমাণ কী?
সমাধানঃ
ক. “ক্লেশমূলঃ কর্মাশয়ো দৃষ্টাদৃষ্টজন্মবেদনীয়ঃ ।”
[ যোগ. ২।১২ ]
অর্থাৎ অবিদ্যাদি ক্লেশ দ্বারা যুক্ত কর্মফল বর্তমান তথা পরবর্তী জন্মে ভোগ করা হয়ে থাকে।
খ. “অভিবাদন শীলস্য নিত্যং বৃধ্দোপসেবিনঃ ।
চত্বারি তস্য বর্ধন্ত আয়ুর্বিদ্যায়শোবলম্ ।।” [মনু. ২।৭৮]
যে
ব্যক্তি বিদ্বানকে, বৃদ্ধকে বিনম্রতা দ্বারা, শ্রদ্ধা দ্বারা সেবা আদি
করেন তাঁর আয়ু, বিদ্যা, কীর্তি এবং বল এই চারটি সদা বৃদ্ধি হতে থাকে ।
“দেবানা সখ্যমুপসেদিমা বয়ং দেবা ন আয়ুঃ প্রতিরন্তু জীবসে ।” [যজু. ২৫।১৫]
আমরা যেনো দেবগণের সৎসঙ্গ করি, যার মাধ্যমে আমাদের আমাদের আয়ু বৃদ্ধি হোক ।
শুভ কর্মের ফল এই জন্মেই প্রাপ্তি হয়, ইহা যোগদর্শনের ২।১২ নং সূত্রের ব্যাসভাষ্য দ্বারাও প্রমাণিত হয় ।
“তত্র তীব্র সম্বেগেন মন্ত্র তপঃ সমাধিভির্নির্বর্তিত ঈশ্বরদেবতামহর্ষি- মহানুভাবানামারাধনাদ্বা যঃ পরিনিষ্পন্নঃ স সদ্যঃ পরিপচ্যতে ।”
ভাবার্থ
- তীব্র বেগে মন্ত্র, তপ, সমাধি দ্বারা সম্পাদিত অথবা ঈশ্বর, দেবতা,
মহর্ষি মহানুভাবের আরাধনা দ্বারা সম্পাদিত যে পুণ্য কর্মাশয় হয়, তার ফল
শীঘ্র প্রাপ্তি হয় ।
অশুভ, অসৎ কর্মফলও এই জন্মে ভোগ করা হয়ে থাকে ।
“যথা
তীব্র ক্লেশেন ভীতব্যাধিত কৃপণেষু বিশ্বাসোপগতেষু বা মহানুভাবেষু বা
তপস্বিষু কৃতঃ পুনঃ পুনরপকারঃ স চাপি পাপকর্মাশয়ঃ সদ্য এব পরিপচ্যতে ।”
[ব্যাসভাষ্য. ২।১২]
ভাবার্থ
- এরূপ ভাবে তীব্র ক্লেশ দ্বারা ভীত, রুগ্ণ, কৃপাপাত্র বা বিশ্বস্ত
মহানুভাব অথবা তপস্বীগণের প্রতি বরংবার কৃত অনিষ্ট, এই পাপকর্মাশয়ের ফলও
শীঘ্র প্রাপ্তি হয় ।
শঙ্কা. ২১ - সৎ কর্মকারী (ধার্মিক) ব্যক্তি বিবিধ কষ্ট ভোগ করে থাকেন, ইহা কী ঐ ব্যক্তির সৎ কর্মের ফল ?
সমাধানঃ
সৎ কর্মকারী ব্যক্তি পরমাত্মার আর্শীবাদে সদা সুখ, শান্তি, প্রেম, সহযোগ,
উৎসাহ, প্রেরণা আদিই প্রাপ্তি করে থাকে । পরন্তু পরিবার, সমাজের প্রভাবে
কখনও-কখনও সুখ, সহযোগ, প্রেম, সান্ত্বনার বিপরীত ভয়, তিরস্কার, ঘৃণা,
উপেক্ষা, বিরোধ, নিন্দা, অন্যায় আদিও প্রাপ্ত হয়ে থাকে ।
তদ্রূপভাবে
অসৎ কর্মকারী ব্যক্তি ঈশ্বর কর্তৃক সদা দুঃখাদি ভোগ করে থাকে; কিন্তু
পরিবার, সমাজের প্রভাবে কখনও-কখনও সেই ব্যক্তি সুখ, সহযোগ, প্রেম আদি
প্রাপ্তি করে থাকে ।
সৎ
কর্মের ফল সুখদায়ক । কিন্তু সমাজে অনেক বার এর বিপরীত চিত্র দৃশ্যমান
হয়, সৎ কর্মকারী দুঃখ এবং অসৎ কর্মকারী সুখ প্রাপ্ত হয়ে থাকে । এসব
বিপরীত স্থিতি অজ্ঞানী, অন্যায়কারী, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ, সমাজ
দ্বারাই সৃষ্ট হয়ে থাকে । সৎ কর্মকারী ব্যক্তির জীবনে কষ্ট, বাধা-বিপত্তি
এসে থাকে তা বিবিধ কারণে হয়ে থাকে –
(ক)
সৎ কর্মকারী আদর্শ ব্যক্তি হওয়ার দরুন সমাজে স্থিত অসৎ কর্মকারী অনাদর্শ
ব্যক্তিবর্গের অনিষ্ট কার্যে বাধা সৃষ্ট হয় । পরিণামস্বরূপ সেই অসৎ
ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সৎ ব্যক্তি তথা তার সৎ কার্যের অনেক প্রকারে বিরোধ
করে, ক্ষতি করতে চেষ্টা করে ।
(খ)
বর্তমানের পরিস্থিতিতে সমাজে সৎ ব্যক্তির সংখ্যা অতি নগন্য এবং যারা
রয়েছে তারা একত্রে অবস্থান করেন না এবং না যোজনাবদ্ধরূপে কোনো অসৎ
ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে, তাদের অসৎ কার্যের বিরোধ করে ।
(গ) এর বিপরীত অসৎ ব্যক্তির সংখ্যা অধিক এবং তাদের স্বীয় স্বার্থের পূর্তির জন্য একত্রিত হয়ে অসৎ কর্ম করে ।
(ঘ)
সৎ ব্যক্তি অনেকবার কোনো বিষয়ে স্বীয় অজ্ঞানতার কারণে, ভুলের মাধ্যমে,
শীঘ্রতার মাধ্যমে, পরিণাম, প্রভাবের সঠিক প্রকার বিনা বিচারে কর্ম করে
থাকে । ফলস্বরূপ সেই কর্মের খারাপ ফল ভোগ করতে হয় ।
(ঙ)
অনেক বার উত্তম মানসিকতার ব্যক্তি তাঁর সামর্থ্য, অনুভব, অভ্যাস, সাধনা
অপেক্ষা অধিক মাত্রায় বৃহৎ কার্যের প্রারম্ভ করে থাকে । ফল স্বরূপ তিনি
উক্ত কর্মে সফলতা প্রাপ্ত হন না এবং দুঃখ প্রাপ্ত হন ।
(চ)
বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদা সৎ কার্য করা, সত্য এবং আদর্শ
মার্গ অনুসরণ করা অনেক সময় বিবিধ প্রভাবে পরিশ্রমসাধ্য, কষ্টকর হয়ে
থাকে । এর বিপরীত অসৎ কর্ম করা, অসত্য, অনাদর্শ মার্গ অনুসরণ করা বিশেষ
কোনও পুরুষার্থ আদি অপেক্ষা করে না ।
(ছ)
সৎ ব্যক্তির অর্জিত সম্মান, প্রতিষ্ঠা, সুখ, অসৎ ব্যক্তি সহন না করতে
পেরে ঈর্ষা, দ্বেষ, প্রতিস্পর্ধার কারণে সৎ ব্যক্তির বিরুদ্ধ মিথ্যা আরোপ
লাগিয়ে তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় তথা বিভিন্ন চক্রান্ত করে সৎ ব্যক্তিকে
সমাজের অন্য সাধারণ মনুষ্যের নিকট বিরোধী বানিয়ে দেওয়া হয়।
(জ)
সৎ কর্মকারী আদর্শ ব্যক্তির যে কষ্ট বাধা আদির সম্মুখীন হতে হয় তা সৎ
কর্মের ফল নয় । পরন্তু এই কষ্ট, বাধা-বিপত্তিকে সৎ কর্মের পরিণাম, প্রভাব
বলা যায় ।
সৎ
কর্মের মন্দ প্রভাব সত্য আদর্শ, ন্যায় সম্বন্ধে সর্বথা অজ্ঞাত অজ্ঞানী,
স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ দ্বারাই সৃষ্ট হয়ে থাকে । বুদ্ধিমান ধার্মিক
ব্যক্তির উপর সৎ কর্মের প্রভাব, ফল সর্বদা উত্তমই হয়ে থাকে ।
শঙ্কা. ২২ – জগতে শুভ কর্মকারী ব্যক্তিকে দুঃখ প্রাপ্ত এবং অশুভ কর্মকারীকে সুখ প্রাপ্ত হতে দেখা যায়, এরূপ কেনো দৃষ্ট হয়ে থাকে ?
সমাধানঃ
ইহা সর্বথা মিথ্যা ধারণা যে, সৎ কর্মকারী দুঃখ প্রাপ্ত হয় এবং অশুভ, অসৎ
কর্মকারী সুখ প্রাপ্ত হয় । বাহির থেকে দুঃখী হিসেবে দৃশ্যমান হলেও সুখী,
প্রসন্ন এবং বাহির থেকে সুখী হিসেবে দৃশ্যমান হলেও ভেতর থেকে কতটুকু দুঃখী,
অশান্ত, চিন্তিত, ভয়ভীত— এটি কেবল সে-ই জানে, বাহিরের অন্য ব্যক্তি জানতে
পারবে না। এটি সুকর্মী এবং কুকর্মীকে দর্শনকারী ব্যক্তির ভ্রান্তি। তাদের
পরীক্ষণ করার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি হয়। তারা গভীরভাবে পরীক্ষণ করতে জানে না।
অজ্ঞানী, শাস্ত্র জ্ঞানহীন, অকুশল ব্যক্তি বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ দেখে
ধারণা করে যে, অসৎ ব্যক্তি সুখী এবং সৎ ব্যক্তি কর্মী দুঃখী । বাইরে
থেকে যেরূপ দৃষ্ট হয়ে থাকে, তদ্রূপ পরিস্থিতি অভ্যন্তরে থাকে না ।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনেক ফল বাইরে থেকে পরিপক্ক দেখায়, পরন্তু
কাটার পর ভিতরে কাঁচা দেখা যায় । এর বিপরীত ফলের বহিরাবরণে অনেক সময়
কাটা দাগ বা ভিন্ন রংয়ের দেখা যায়, কিন্তু কাটার পর ভিতরে পরিপক্ক
থাকে এবং স্বাদ বজায় থাকে । এরূপ স্থিতি সৎ কর্মী এবং অসৎ কর্মী
ব্যক্তিবর্গের জীবনে বিদ্যমান । উত্তম কর্মকারী অনেক সময় নানাবিধ কারণে
দুঃখী হন, তদ্রূপভাবে অসৎ কর্মকারীও সুখী হয়ে থাকে ।
শঙ্কা. ২৩ - সমাজে অসৎ ব্যক্তি নানাবিধ ক্ষতি-অনিষ্ট করে আনন্দ প্রাপ্তি করে থাকে। ঈশ্বর কেনো এসব পর্যবেক্ষণ করে কোনোরূপ দণ্ড প্রদান করেন না ? সমাজের অন্য সকল মনুষ্য যখন এহেন দৃশ্য লক্ষ্য করবে তখন ধর্ম, সদাচার, নৈতিকতার উপর তাদের বিশ্বাস, ভক্তি উঠে যাবে এবং তারা সেই অসৎ ব্যক্তিবর্গের অনুসরণ করবে । যে দৃশ্য আজ সর্বত্র পরিলক্ষিত ।
সমাধানঃ পূর্বেই বলা হয়েছে মনুষ্য কর্মে স্বতন্ত্র । “কর্তুমকর্তুমন্যথা কর্তুং যঃ স্বতন্ত্রঃ সঃ কর্তা
। " মনুষ্য সৎ-অসৎ যেমন খুশি তেমন কর্ম করতে সক্ষম । কোনো ব্যক্তি
অসৎ কর্ম দ্বারা অর্থ, ধন-সম্পদ ব্যতীত আর কিবা প্রাপ্ত করবে ? এবং এই
অন্যায় পথে অর্জিত অর্থ দিয়ে সে বিভিন্ন মনোরঞ্জন সামগ্রী কিনে ক্ষণিক
সময়ের জন্য সুখ ভোগ করবে । কিন্তু একসময়ে অসৎ পথে থাকার ফলস্বরূপ
প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করা শুরু করবে ।
“অধর্মেণৈধতে তাবত্ততো ভদ্রাণি পশ্যতি ।
ততঃ সপত্নাঞ্জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি ॥ [ মনুস্মৃতি. ৪।১৭৪ ]
অর্থাৎ
অধর্মের দ্বারা (অর্থাৎ প্রভুর অনিষ্টাদি করে) লোকে প্রথমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত
হয়, তারপর নানারকমে অভীষ্ট (অর্থাৎ ভৃত্য-গরু-গ্রাম-ধনাদি) লাভ করে, তারপর
শত্রুসমূহকেও জয় করে (অর্থাৎ যারা শঠতাবিহীন হ'য়ে ধর্মপথে অবস্থান করে
তাদের তিরস্কৃত বা অপদস্থ করে)। কিন্তু কিছুকাল এইরকম ভাবে চলার পর
অধর্মাচরণকারী সমূলে (অর্থাৎ পুত্র-জ্ঞাতি- ধন-বান্ধবাদিসমেত)
উচ্ছেদপ্রাপ্ত হ'য়ে থাকে৷
যেমনভাবে
গো পশুর সঠিক পালন করলে দুগ্ধ শীঘ্র প্রাপ্ত হয়ে থাকে তদ্রূপভাবে
অধর্মের ফল শীঘ্র প্রাপ্ত হয় না । কিন্তু কৃত পাপ কর্ম ধীরে-ধীরে কর্তার
সুখ-শান্তি বিনষ্ট করে দেয় । সুতরাং কর্তার কৃত কর্ম কখনও নিষ্ফল হয় না
।
শঙ্কা. ২৪ – এমন কী কোনো কর্ম রয়েছে, যার পিছনে মনুষ্যের কোনো কামনা (সাংসারিক বা মোক্ষ ) থাকে না ?
সমাধানঃ
এক মূহুর্তের জন্যও মনুষ্য কর্মরহিত হয় না । মানসিক, বাচনিক অথবা
শারীরিকভাবে কোনো না কোনো কর্ম সর্বদা করতেই থাকে । মনুষ্য সমস্ত কর্মের
কারণই প্রবল ইচ্ছা বা প্রযন্ত । তার ইচ্ছা মুখ্যরূপে দুই প্রকার । দুঃখ
থেকে মুক্তি এবং সুখ সাধনের প্রাপ্তি । মনুষ্যের প্রত্যেক কর্ম এই দুই
উদ্দেশ্য দ্বারা যুক্ত থাকে । এই দুইয়ের কামনা বিনা কোনও কিছু হয় না ।
একারণে কোনও কর্ম নেই, যার পিছনে লৌকিক বা মোক্ষ এই দুইয়ের একটি কামনা
না থাকে ।
“অকামস্য ক্রিয়া কাচিদ্ দৃশ্যতে নেহ কর্হিচিৎ।
যদ্ যদ্ হি কুরুতে কিঞ্চিত্তত্তৎকামস্য চেষ্টিতম্ ।। ” [ মনুস্মৃতি. ২।৪ ]
অর্থাৎ
অকামী ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে এমন কোনও কর্মই এজগতে পরিদৃষ্ট
হয় না। ( এই পৃথিবীতে) কি লৌকিক ভোজন-গমনাদি, কি বৈদিক জ্যোতিষ্টোমযাগাদি
যা কিছুই প্রাণী করে, তার সবই কামনার অভিব্যক্তিরূপেই সাধিত হয়। [আগের
শ্লোকে বলা হয়েছে, শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধে যে প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তি, তা
সঙ্কল্পের অধীন।
“ন হি কশ্চিৎক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ ।
কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ॥” [গীতা. ৩।৫]
অর্থাৎ,
নিঃসন্দেহে কোনও মানব কোনো অবস্থায় ক্ষণকালও কর্ম ছাড়া থাকতে পারে না;
কেননা প্রকৃতি জনিত গুণের পরাধীন হওয়ায় প্রাণীমাত্র কর্ম করতে হয় ।
শঙ্কা. ২৫ – মনুষ্য যেমন কর্ম করে তেমন ফলই কী প্রাপ্তি করে থাকে ?
সমাধানঃ
প্রত্যেক পুণ্য-পাপ কর্মের ফল কেমন মাত্রায় সুখ-দুঃখ রূপে মিলবে, এটা
ঈশ্বর অনাদিকাল থেকেই নিশ্চিত করে রেখেছেন। প্রত্যেক জীবাত্মাকে ঈশ্বর সেই
মাত্রা অনুসারে কর্মের ফল প্রদান করেন। তবে প্রতিটি পুণ্য এবং পাপ কর্মের
ফল আলাদাভাবে না দিয়ে সব কর্মের সামগ্রিক ফল একসাথে প্রদান করে থাকে ।
উদাহরনস্বরূপ-
মানুষ তার জীবনে যতটুকু হিংসা করেছে , মিথ্যা কথা বলেছে, যতটুকু দুরাচার ও
লোভ করেছে ইত্যাদি কর্মের ফল একত্র হয়ে একটি সামগ্রিকরূপ তৈরি হয়ে যায়। তো
এসব পাপকর্মের সামগ্রিক ফলস্বরূপ কীভাবে দুঃখ প্রদান করা হবে এটা ঈশ্বরের
দ্বারা নির্ধারিত হয়।
চড়
মারার ফল চড় দিয়ে , হাত কাটার ফল হাত কেটে, ১০০০০ টাকা চুরি করার ফল ১০০০০
টাকা চুরির রূপেই প্রাপ্ত হবে, এমনটা নয় । বরং সকল কাম-ক্রোধ, লোভ-মোহ,
ঈর্ষা-দ্বেষ, অহংকার, ছল–কপট ইত্যাদি পাপকর্ম সংগ্রহ করে তা কোনো শরীর ,
আয়ু, বা ভোগ রূপে পাওয়া যায় ।
সাংখ্য দর্শনে বলা হয়েছে যে, “কর্ম বৈচিত্র্যাত্ সৃষ্টিবৈচিত্র্যম্” । [৬।৪১]
উদাহরণ-
কোনো ব্যবসায়ী অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বছরব্যাপী ৫০ প্রকার ভিন্ন
ভিন্ন বস্তু ১০-২০ বারে ক্রয় করেছে । সবমিলিয়ে ৭০০ প্রকার বস্তু কিনেছে ।
বছরের শেষে ক্রেতা সব বস্তুর দাম আলাদাভাবে না দিয়ে সর্বমোট টাকা একসাথে
পরিশোধ করে। এহেন স্থিতি কর্ম ফল প্রদানের বিষয়েও হয়ে থাকে।
শঙ্কা. ২৬ – মনুষ্য যে সুখ-দুঃখ প্রাপ্ত হয়, সেটা কী স্বীয় কৃত কর্মের ফল ? নাকি অন্যের কর্মফলও ভোগ করে থাকে ?
সমাধানঃ
মনুষ্য স্বীয় কৃত কর্মের ফল স্বীয়ই ভোগ করে থাকে । অন্যের কর্মফল নয়,
পরন্তু অন্য কৃত কর্মের পরিণাম বা প্রভাবের মাধ্যমে সুখ-দুঃখ প্রাপ্তি
করে থাকে । সমাজে এই ধারণা প্রচলিত যে, একজন ব্যক্তির সকল সুখ-দুঃখ
প্রাপ্তির পিছনে তার স্বীয় কর্মের ফল দায়ী । যখনই তার সাথে কোনো
কষ্টদায়ক ঘটনা ঘটে তার সাথে, তখন অন্যরা তাকে এটা বলে সান্ত্বনা দেয়
যে, "সে কোনো অসৎ কর্ম করেছে যার ফলস্বরূপ এমন কষ্টদায়ক ঘটনা তার সাথে
ঘটেছে" । কিন্তু ইহা সর্বাংশ সত্য নয় ।
মনুষ্য স্বীয় কর্ম অতিরিক্ত অন্যের কর্মেরও পরিণাম প্রভাবরূপে প্রাপ্ত সুখ-দুঃখ ভোগ করে থাকে ।
উদাহরণ.
i. চোর কারো গৃহে প্রবেশ করে ৫০০০ টাকার দ্রব্য-সামগ্রী চুরি করেছে। সেই
গৃহের লোকজন স্বাভাবিকভাবেই চুরির ঘটনায় দুঃখী হবে । সম্পত্তি চুরি হওয়ার
কারণে তাদের এই দুঃখ সৃষ্ট হবে। এখানে, চোর চুরি করেছে । সুতরাং চোরকে
নিজের পাপকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। কারণ সিদ্ধান্ত এটাই যে, যিনি কর্তা হয়ে
কর্ম করবেন তিনিই ভোক্তা হয়ে সেই কর্মের ফল ভোগ করবেন। তবে ঘরে চুরি হওয়ার
ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে দুঃখ উৎপন্ন হবে তাকে চোরের কর্মফল না বলে
পরিবারের সদস্যের দ্বারা পূর্বজন্মে করা চুরির মতো কোনো দুষ্টকৃত্যের
পরিণাম বলা যায় । এখানে চোর যে চুরি করেছে তার চুরির ফলও চোরটি পরবর্তী
কোনো জন্মে ভোগ করবে।
এজন্য
এই সিদ্ধান্ত আসে যে, পাপকর্মের শাস্তি কর্তাকেই পেতে হবে । কিন্তু তার
কর্মফল ভোগের প্রভাব দুঃখরূপে অন্য কোনো ব্যক্তির উপরও পড়তে পারে।
উদাহরণ.
ii. কোনো ব্যক্তি শীতকালের ঠাণ্ডা রাতে কোনো ক্ষুধার্ত, শীতার্ত,
ভিখারিকে খাদ্য এবং শীতবস্ত্র দান করলেন । এতে ভিখারীর দুঃখ দূর হলো এবং সে
সুখী হলো। এই শীতবস্ত্র এবং খাদ্যের দ্বারা ভিখারীর সুখী হওয়া তার নিজের
কর্মের ফল নয় বরং কর্ম তো দাতা ব্যক্তিটি করেছেন। সুতরাং দাতা ব্যক্তি
এখানে পুণ্যলাভ করলেন। পুণ্যফলও তিনিই ভোগ করবেন। তবে এখানে ভিখারী যে
সুখলাভ করলো তাকে দাতা ব্যক্তির পুণ্যকর্মের পরিণাম বা প্রভাব বলা উচিত।
অতএব
সিদ্ধান্ত এই যে, ঈশ্বর কর্তাব্যক্তিকে পুণ্য কিংবা পাপের ফল যথাবৎ প্রদান
করবেন। কিন্তু কর্তার পুণ্য বা পাপকর্মের পরিণাম অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে
সুখ বা দুঃখরূপে প্রভাব ফেলে।
এই
সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, কর্তা তার সৎ কর্মের ফল যথা সময়ে
ঈশ্বর কর্তৃক প্রাপ্ত হয়ে থাকে, কিন্তু তার সৎ কর্মের পরিণাম বা প্রভাব
অন্য ব্যক্তি উপর সুখরূপে পড়তে পারে ।
“ অকর্তুরপি ফলাপোপভোগোঽন্নাদ্যবৎ”
[সাংখ্য. ১।১০৫]
অর্থাৎ বিনা কর্ম করেই ফল স্বরূপ অন্য ব্যক্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে । যেমন সেবক দ্বারা প্রস্তুত ভোজন প্রভু আহার করে থাকে ।
“শং নঃ সুকৃতানি সন্তু” [ঋগ্বেদ. ৭।৩৫।৪]
ভাবার্থ – সৎ পুরুষের উত্তম কর্ম আমাদের জন্য সুখদায়ক এবং লাভকারী ।
অতএব
পরম সত্য বৈদিক সিদ্ধান্ত এই যে, একজনের কর্ম দ্বারা অন্যজন লাভ বা হানি
এবং সুখ-দুঃখ উভয়ই প্রাপ্ত হয়ে থাকে । কর্মফল কর্তাই ভোগ করে থাকে,
পরন্তু কর্মের পরিণাম বা প্রভাব দ্বারা এরূপ স্থিতি হয়ে থাকে ।
শঙ্কা. ২৭ – শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে 'জ্ঞানাৎ মুক্তিঃ ' জ্ঞান দ্বারা মুক্তি হয়ে থাকে । তাহলে কর্ম করার আবশ্যকতা কী ?
সমাধানঃ
ইহা সত্য যে, শাস্ত্রে এরূপ বর্ণনা বিদ্যমান । কিন্তু এই বচনের
সারমর্ম এই নয় যে, মুক্তি প্রাপ্তির জন্য কর্ম বা উপাসনার বিরতি দেওয়া
। কর্ম বিনা জ্ঞান প্রাপ্তিও অসম্ভব এবং জ্ঞান প্রাপ্ত করে তা
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করলে, উপাসনাদি কর্ম না করলে সেই জ্ঞানের
কোনও লাভ নেই ।
যদি 'জ্ঞানাৎ মুক্তি' বচনের এই অর্থ করা হয় যে, শুধু জ্ঞানার্জন করে কর্মকে ত্যাগ করা,তাহলে তা বেদ বিরোধী অর্থ হবে ।
বেদ-ভগবান বলেছেন, “অকর্মা দস্যুঃ .... ।” [ঋগ্বেদ. ১০।১২।৮]
যে কর্ম করে না সে দস্যু ।
“ কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ॥” [যজু. ৪০।২]
হে মনুষ্য ! তুমি কর্ম করে শত বর্ষ জীবিত থাকার ইচ্ছা করো ।
“তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ॥” [গীতা. ৩।১৯]
“ শরীর যাত্রাপি চ তে ন প্রসিদ্ধয়েদকর্মণঃ” [গীতা. ৩।৮]
অর্থাৎ কর্ম বিনা শরীরকে জীবিত রাখতে খাবার খাওয়া, বস্ত্র পরিধান আদিও অসম্ভব ।
বৈদিক
সিদ্ধান্ত অনুসারে যথার্থ জ্ঞান, শুদ্ধ কর্ম তথা সমর্পিতভাব যুক্ত শুদ্ধ
উপাসনা করার পরই মনুষ্য মোক্ষ প্রাপ্তি করে থাকে, কেবল জ্ঞান দ্বারা
মুক্তি লাভ অসম্ভব।
শঙ্কা. ২৮ – শুভ ও অশুভ কাজ সমানভাবে করলে সেটি কী ফল ছাড়াই বিনষ্ট হতে পারে?
সমাধানঃ
মনুষ্য প্রত্যেক বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞানী না হওয়ার দরুন সৎ এবং অসৎ উভয়
কর্মই করে । উভয় কর্মেরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান । উভয় কর্মেরই
পৃথক-পৃথক সুখ-দুঃখরূপে ফল ভোগ হয়ে থাকে। সৎ কর্মের ফল সুখ তথা অসৎ
কর্মের ফল দুঃখ প্রাপ্তি হয়ে থাকে ।
যেমন:
এরূপ কখনই হয় না যে, কেউ ১০০ টি সৎ কর্ম তথা ২০টি অসৎ কর্ম করেছে ।
তাহলে ১০০টি সৎ কর্মের মধ্যে ২০টি অসৎ কর্ম কর্তিত হয়ে পরবর্তী জন্মে ফল
ভোগের জন্য কেবল ৮০টি শুভ কর্ম অবশিষ্ট থাকে।
আবার
কেউ ১০০টি অসৎ কর্ম করেছে এবং ২০টি সৎ কর্ম করেছে । তাহলে ২০টি অসৎ
কর্মের ফল পরজন্মে ফল ভোগের জন্য অবশিষ্ট থাকবে এমনটাও অসম্ভব । যদি এমন
হতো তাহলে প্রত্যেক প্রাণী কেবল সুখী অথবা কেবল দুঃখী হতো। পরন্তু সংসারে
এমনটা কখনই দেখা যায় না। জগতে প্রত্যেক মনুষ্য, প্রাণীকে সুখী বা দুঃখী
উভয়ের সম্মিলিত পরিস্থিতি দেখা যায়।
এ দ্বারা স্পষ্ট যে, পূর্ব জন্মে কৃত সৎ এবং অসৎ উভয় প্রকারেরই কর্মফল মনুষ্য ইহ জন্মে ভোগ করে থাকে ।
সুতরাং
পরম সত্য বৈদিক দার্শনিক সিদ্ধান্ত এই যে , দান, যজ্ঞ, তপ, সেবা, পরোপকার,
প্রশংসা আদি সৎ কর্ম যতোই করা হোক,কোনো প্রকার অসৎ, নিকৃষ্ট কর্মের
প্রায়শ্চিত্ত ভোগ থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব। অসৎ কর্মের ফল অবশ্যই ভোগ
করতে হবে ।
শঙ্কা. ২৯ – নিষ্কাম কর্মেরও কী ফল রয়েছে ?
সমাধানঃ।
হ্যাঁ, নিষ্কাম কর্মেরও ফল রয়েছে । নিষ্কামতার অর্থ কর্তার কোনও কামনা
হয় না, এমনটা কখনই নয় । প্রতিটি কর্মের লক্ষ্য কোনো কামনা-বাসনা
অবশ্যই থাকে ।
নিষ্কাম
কর্মের মূল সদর্থ হলো, যে কর্মের লক্ষ্য লৌকিক বা সাংসারিক বা ঐন্দ্রয়িক
সুখের কামনা নয় ; ধন, সম্পত্তি, পুত্র, পতি-পত্নী আদির কামনা না করে মোক্ষ
প্রাপ্তি অথবা ব্রহ্মানন্দ প্রাপ্তির কামনা
করা
হয়ে থাকে । এরূপ ভাবে যখন নিষ্কাম কর্ম পরমাত্মা প্রাপ্তি বা ব্রহ্মানন্দ
প্রাপ্তি নিমিত্তে করা হয়ে থাকে তখন তারও ফল অবশ্যই প্রাপ্তি হবে ।
তাহলে এই শঙ্কা সৃষ্ট হতে পারে যে , নিষ্কাম কর্মের ফল কীরূপ হয়ে থাকে?
সমাধান এই যে, নিষ্কাম কর্মকারী মনুষ্যে জীব এবং প্রকৃতির প্রকৃষ্ট বিবেক
সৃষ্ট হয় । পরিণামস্বরূপ তার অন্তঃকরণ পবিত্র হয়ে থাকে এবং সেই ব্যক্তি
ঈশ্বরকে প্রাপ্তি করার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে ।
শঙ্কা. ৩০- উপাসনা এক প্রকারের মানসিক কর্ম । তাহলে উপাসনাকে কর্ম থেকে ভিন্ন কেনো মানা হয় ? উপাসনা তো এক প্রকার কর্মই ।
সমাধানঃ
উপাসনার বাস্তবিক অর্থ ''ব্রহ্মানন্দে মগ্ন হওয়া", হৃদয়ে স্থিত
পরমাত্মাকে অনুভূতি করা । এই অনুভূতি শরীর মন-ইন্দ্রিয় দ্বারা হয় না, দেহে
স্থিত আত্মা নিজেই স্বীয় সামর্থ্য দ্বারা পরমাত্মায় সমাধি হয়ে
ব্রহ্মানন্দ অনুভব করে । অতএব যথার্থতঃ উপাসনাকে মানসিক কর্ম বলা
অবাঞ্ছনীয় । কেননা উপাসনা কর্মের পরিভাষার অন্তর্গত নয় । তাহলে এই
শঙ্কা উত্থাপিত হয় যে, যোগাভ্যাসী সাধক দ্বারা সন্ধিক্ষণে জপ, ধ্যান,
চিন্তন, স্তুতি, প্রার্থনা আদি যে মানসিক কর্ম করা হয়, তাতো তো একপ্রকার
কর্মেরই অন্তর্গত, তাহলে ইহাকে “উপাসনা” কেনো বলা হয় ? এর সমাধান, '
ব্রহ্মানন্দ মগ্ন হওয়ার পূর্বে যেসব কর্ম করা হয়, তা সবই মানসিক
কর্মের অন্তর্গত। পুনরপি এই সমস্ত মানসিক কর্ম; যা উপাসনার অন্তর্গত সাধন,
অষ্টাঙ্গ যোগ যম-নিয়মাদির সহিত যুক্ত হওয়ার দরুন গৌণরূপে উপাসনা বলা হয়
। বাস্তবে এইসব ক্রিয়া উপাসনা নয় ।
— বিদুষাং বশংবদঃ
১ম পর্ব পড়ুন - https://back2thevedas.blogspot.com/2022/07/blog-post.html
0 মন্তব্য(গুলি)